শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা নিয়ে বলতে গেলে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা হীনতার কথা। ১৯৭৮-১৯৭৯ সালে দেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টস শিল্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনা শুরু হয়। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ এই পাঁচ বছরে গার্মেন্টস শিল্পে অর্ধশতাধিক অগ্নিকান্ড ঘটে। ১৯৯০ সালের ২৭ ডিসেম্বর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সারাজ গার্মেন্টসে বড় অগ্নিকান্ড ঘটলে ৩২ শ্রমিক প্রাণ হারায়। ১৯৯১ সালে পল্লবীর একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকান্ডে মারা যায় ৩ শ্রমিক। ১৯৯৩ সালে পুরানা পল্টনে একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১২ জন শ্রমিক। ১৯৯৪ সালে এ্যাপারেল গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে মারা যায় ৫ জন। ১৯৯৫ সালে অগ্নিকান্ডে মারা যায় ৯ জন এবং ১৯৯৬ সালে পল্লবীতে একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১০ শ্রমিক। ১৯৯৭ সালে মিরপুরে দুটি গার্মেন্টস কারখানা আগুনে ৭ শ্রমিক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আহত হয় প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক। দুটি অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ কোটি টাকা। ১৯৯৮-৯৯ সালে গার্মেন্টস-এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা অনেক কমে আসে। তবে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকান্ডের ফলে ৩ শ্রমিক নিহত এবং ৭০০’র বেশী শ্রমিক আহত হয়। রেফারেন্স
গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড ও দুর্ঘটনা রোধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী মিলিয়ে ৭১ দফার সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছিল ১৯৯৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কিন্তু প্রণয়ইন কেবল রয়ে গেছে কার্যকর আর হয়নি। ৩১ মে ২০০১ মানবাধিকার সংগঠন আইন সালিশ কেন্দ্র আনীত এক রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এ শিল্পে কর্মরত ১৭ লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে ফ্যাক্টরিগুলোকে প্রচলিত আইন মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছিল। [রেফারেন্স]
কিসের কি আইন? কোন গার্মেন্টস মালিকপক্ষ কি এসব আইন মেনে চলে? মেনে চলেনা বলেইতো এখনো অগ্নিকান্ড ঘটেই চলছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টেরিগুলোতে। ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ গাজীপুরের মেট্রেক্স গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে [রেফারেন্স]; ২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ আশুলিয়ার সিএবিসি ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে [রেফারেন্স]। ২৬ জানুয়ারী ২০১৩ যখন মোহাম্মদপুর বেড়িবাধ সংলগ্ন স্মার্ট ফ্যাশনসে আগুন লাগে তখন কারখানাটির ফটক তালাবদ্ধ ছিলো এবং ভেতরে শ্রমিকরা আটকে পড়েছিলো। ওই ঘটনায় মারা যান মোট সাতজন কর্মী যারা সবাই নারী। এছাড়া আহত হন অনেকে। [রেফারেন্স]
২০১৩ সালে গার্মেন্টস শিল্পে এক কাল অধ্যায়ের জন্ম দেয় রানা প্লাজা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবনটি ধসে দু সপ্তাহের উদ্ধার অভিযানে শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ১১৩৪জনে। মৃতের সংখ্যা এতো বেশি হলেও গত তিন বছরে দুটি মামলায় রানা প্লাজা ভবনের মালিক সোহেল রানা এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ মোট ৪২ জনকে অভিযুক্ত করে দায়ের করা মামলার কোন রায় হয়নি এখনো।অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র ৬জন রয়েছেন কারাগারে, বাকিরা জামিনে রয়েছেন অথবা পলাতক। [রেফারেন্স]
রেসমি অক্ষত বেঁচে গিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে গেছে কিন্তু যারা রানা প্লাজা ধশে আহত হয়েছিল, তারা জীবণ যাপন করছে চরম অবহেলায়। বিবিসি নিউজের এক সাক্ষাতকারে এক আহত শ্রমিক বলেছিল “সিআরপি বলছিলো পা কাটার জন্যে। কিন্তু আমার স্বামী বললো ও যদি মরেও যায় দু:খ নাই, তাও পা কাটতে দিবোনা। ক্র্যাচ দিয়ে হাটি। চলাফেরায় কষ্ট হয়। ঘুমাতে পারিনা। কাজ কর্ম করতে পারিনা। কেটে পা লাগিয়ে দিলে কাজ করতে পারতাম।” [রেফারেন্স] আমরা হরহামেশাই টকশোতে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলি, অথচ এসব নারীর কথা যেন ভুলে যেতে চাই।
তবে তাৎক্ষনিকভাবে বড় একটি ধাক্কার মুখে পড়লেও, তিন বছর পর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোষাক রপ্তানি ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বেড়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.৮ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যেই বর্তমান রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ করে ৫ হাজার কোটি ডলার তৈরি পোষাক রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। [রেফারেন্স] যেই শ্রমিকগুলো এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখবে তাদের ৫০% ঈদ বোনাশ ঠিকমত পান না।৩০ ভাগ গার্মেন্টস দু’ঈদে ১ মাসের বেতন সমপরিমাণ বোনাস দেন। ১০ ভাগ গার্মেন্ট-এ যথাসময়ে বেতন দেয়া হয়। শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ গার্মেন্টসে ঠিমত বেতন-ভাতা না দিয়ে শ্রমিক ছাটাই ও হয়রানি করা হয়। দু’ ঈদের আগে বেতন-ভাতা, বোনাস ও ছুটি দেয়া নিয়ে শ্রমিকদের ওপর মালিক কর্তৃপক্ষের যে নির্যাতন চলে তা কল্পনাতীত।[রেফারেন্স]
দেশের ট্যানারি শিল্পে কর্মরত প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক অমানবিক জীবনযাপন করছে। এদের মধ্যে মাত্র ছয় হাজার শ্রমিকের নিয়োগপত্র আছে। নিয়োগপত্র আছে এমন শ্রমিকের মাসিক বেতন মাত্র ৭২১৬ টাকা। অথচ শ্রম আইনে ট্যানারি কারখানা শ্রমিকের নির্ধারিত বেতন ৯৩০০ টাকা। চামড়া শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা প্রতিদিন আট থেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করেন। যে সমস্ত শ্রমিকের নিয়োগপত্র নেই তারা দিনপ্রতি পান ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। কিন্তু নারী ও শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই হার অর্ধেক। [রেফারেন্স] হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে। আর তা দূষিত করে বুড়িগঙ্গার পানি, এলাকায় মাটি ও বায়ু। এর প্রভাব পড়ে ট্যানারির শ্রমিক ছাড়াও ঐ এলাকার বাসিন্দাদের ওপর। তাছাড়া কারখানার শ্রমিকরা কোনো ধরণের নিরাপত্তা ছাড়াই খালি হাতে, খালি পায়ে এই প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন, ফলে তাঁরা ক্যানসার ও চর্মরোগসহ নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হন। একটা গবেষনায় দেখা গেছে ট্যানারী শ্রমিকদের গড় আয়ু ৫০ বছরেরও কম! ট্যারারী শ্রমিকরা প্রচন্ড স্বস্থঝুকির মধ্যে কাজ করছে অথচ এই সমস্থ শ্রমিকের জন্য কোন স্বাস্থ্য ইনসুরেন্স সেবা নেই।
এবার আসি নির্মান শ্রমিকদের কথায়; ৭ জুলায় ২০১৫ নওগায় সেফটি ট্যাক পরিষ্কার করার সময় গ্যাসে মারা যায় ৪ শ্রমিক, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি ফিলিং স্টেশনের দু’টি পিলার ধ্বসে ১০ নির্মাণ শ্রমিক আহত হন; ২ মার্চ ২০১৬ বগুড়ায় সেফটি ট্যাক পরিষ্কার করার সময় গ্যাসে মারা যায় ২ শ্রমিক; ১৩ মার্চ ২০১৬ শরিয়তপোরে ১ জন, ১৬ মার্চ রাজধানীর মগবাজারে উড়ালসেতু থেকে লোহার টুকরা পড়ে রাব্বী আহমেদ নামের এক নির্মান শ্রমিকের মৃত্যু এবং ১৯ এপ্রিল ২০১৬ চট্রগ্রামে ১ নির্মাণ কর্মি মাথায় ইট পড়ে মারা যায়। শুধুমাত্র বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই চিত্র তুলে ধরা হলেও প্রকৃত চিত্র কিন্তু আরো ভয়াবহ। প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নির্মাণ শ্রমিক মারা যায়।
এতো কিছুর পরও আমরা একদিনের জন্য হলেও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছি, এই বা কম কি?