১.
আমি নীলাকে ভালোবাসি। ঠিক ভালোবাসি বললে ভুল হবে; আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। আমাদের প্রথম পরিচয়টা বেশ মজার ছিল। আমি বেশ চুপচাপ টাইপের একজন ছেলে; কারও সঙ্গে ঠিকমত কথা বলি না। তাই সেদিন যখন ইমন আমাকে বলল, “শুদ্ধ আমার সাথে একটা জায়গা যাবি?” তখন আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি, আর যখন শুনলাম ওর খালার বাড়ি যেতে হবে তখন একদম দমে গিয়েছিলাম। তারপরও ইমন আমাকে ছাড়েনি, টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আমি আর ইমন ড্রইং রুমে বসে ছিলাম, ইমনের খালাতো ভাই মাসুম আমাদের চা দিতে বলে ভিতরে চলে গিয়েছিল কয়েকটা সফ্টওয়ার আনতে। ওগুলোর জন্যই সেখানে যাওয়া। এমন সময় একটি মেয়ে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিল। ঐ মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম, আমার দ্বারা কারও প্রেমে পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করে সব কিছু ওলট পালট করে দিয়েছিল। “শুদ্ধ এ হচ্ছে মাসুমের বোন নীলা।” ইমন পরিচয় করিয়ে দিতেই আমি যেটা কখনও করিনি ঠিক সেই কাজটিই করে বসছিলাম। হাত বাড়িয়ে বলেছিলাম, “আমি শুদ্ধ।” আমি নীলার চোখে বিব্রত বোধ দেখে যেই মুহূর্তে হাত সরিয়ে নিচ্ছি ঠিক সেই সময়ে নীলা ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে আমি ওর হাতটা ধরে ঝাকিয়ে দিয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু হাসিটা ধরে রাখতে পারিনি। হাসি যে কতটা সংক্রামক সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম। আমার মুখে হাসি দেখে প্রথমে নীলা তারপর ইমন হাসতে শুরু করেছিল। মাসুম ঘরে প্রবেশ করে যখন হাসতে হাসতে বলল,“কিরে তোরা হাসছিস কেন?” তখন আমাদের হাসিটায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
আজও আমার চোখে পানি। আমি দ্বিতীয় বারের মত উচ্চারণ করলাম,“আমি নীলাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি।” তারপর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। হাতের কাছে পড়ে থাকা পাথরটাকে ছুড়ে দিলাম পুকুরে। পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি হল। কিন্তু আমার মনের মঝে এই মুহূর্তে যে ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে, তা আমাকে ভেঙ্গে ফেলতে চাচ্ছে। আমি আবারও উচ্চারণ করলাম,“আমি কিছুতেই ভেঙ্গে পড়ব না। কখনও না। আমি নীলাকে ভালোবাসি। আমি নীলাকে চাই। হোকনা সে বোবা। তবু আমি তাকে ভালোবাসি।”
ইমন আমার বাল্য বন্ধু। ও কম্পিউটার সায়েন্স এ পড়ে। আমি পড়ি মেকানিক্যালে। মাসুম ও ইমন দু’জনেরই সাবজেক্ট এক, তাই যখন শুনতাম ওরা ল্যাবে আছে তখনই ছুটে যেতাম নীলাদের বাসায়। নীলার বাবা চাকরি করেন আর নীলার বয়স যখন দশ বছর তখন তার মা মারা যান, তারপর শোকে নীলা বোবা হয়ে যায়। তাই ফাঁকা বাসাতে দ্বিধাহীনভাবে আমরা গল্প করতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। আমরা বললে ভুল হবে। গল্প করতাম শুধু আমি, আর নীলা আমার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকত। কিন্তু আমি ঠিকই ওর চোখের ভাষা পড়তে পারতাম। আমি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিলাম। আমি কখনও কল্পনাও করতে পারতাম না আমি এত কথা বলতে পারি। আমি এমনই ভাবে ওর হাসিতে ডুবে গিয়েছিলাম ওর মুখের একটু হাসির জন্য আমি সব করতে পারি। আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,“আমি ওর মুখের হাসির জন্য এখনও অনেক কিছু করতে পারি। আমি কোন কিছুতেই পিছু হটব না। আমি সুধু জানি, আমি নীলাকে ভালোবাসি। আর কিছু জানতেও চাই না। ও কথা বলতে পারে না, কিন্তু আমি ওর মনের কথা চোখ থেকে পড়ে নেব। জীবনটা হয়ত একটু কঠিন হয়ে পড়বে, কিন্তু দুর্বিসহ কখনও হবে না। হতে দেব না। আমি নীলাকে বিয়ে করব।.....হ্যাঁ বিয়ে করব।”
২.
আমাদের বিয়েতে অনেকেই অমত প্রকাশ করল। যারা অমত প্রকাশ করল তাদের মধ্যে নীলাও একজন। তবে নীলার অমতের কারন সবচেয়ে ভিন্ন। আমি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, তাই নীলা মনে করে আমরা বিয়ে করলে আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তারমতে আমার মাথা থেকে বিয়ের ভুত ঝেড়ে ফেলে, পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমিতো লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পারছি না। আমার একটা খারাপ ব্যাধি আছে, যখন কোন কিছু করব বলে ঠিক করি তখন সেই কাজটি না করা পর্যন্ত কোন কিছুতে শান্তি খুজে পাই না। তাই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে ফেললাম। বিয়ের পর হল ছেড়ে আমি আর নীলা একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নিলাম। এই বিয়েতে আমার বাবার কোন মত ছিল না, তাই বাসা ভাড়া নেবার সময় কোন টাকাও দিলেন না। শুধু বললেন,“তুই আমার ছেলে, তোর লেখাপড়ার খরচ আমি চালাব, কিন্তু তোর বোবা বউ এর খরচ চালাতে পারব না। ওটা তুই কিভাবে ম্যানেজ করবি সেটা তোদের ব্যাপার।” বাবা আমাদের খরচ চালাতে পারবেন না এটা ঠিক না, তিনি আমাদের খরচ চালাবেন না সেটাই আসল কথা।
খুব চিন্তাই পড়ে গেলাম। কিন্তু এসব ব্যাপারে বন্ধুরা খুব হেল্পফুল হয় আমার জানা ছিল না। ওরা সবাই মিলে এই বাসাটা ভাড়া করে দিল। বেশ কিছু বাসন পত্রও কিনে দিল। সব কিছু যখন গোছগাছ শেষ হয়েছে তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বন্ধুরা চলে যাবার সময় বলল,“নতুন বিয়ে করেছিস, বউকে নিয়ে থাক আমরা যাই। আর এই নে ধর।” আমার হাতে একটা খাতা ধরিয়ে দিয়ে ওরা খুব হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে যাবার পর খাতাটা খুলে ‘থ’ বনে গেলাম। নীলা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওর চোখ দেখে বুঝলাম কী লেখা আছে জানতে চায়। আমি বললাম,“বাসা ভাড়া নেবার সময় কে কত খরচ করেছে তার হিসাব।” আমার কথা শুনে নীলা কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল, তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করল। ওর হাসি দেখে আমিও হাসতে লাগলাম।
বিয়ের পর আমাদের জীবন আরও পাল্টে গেল। আমার রাগ চেপে বসল রেজাল্ট ভালো করার। তাই উঠে পড়ে লাগলাম। সারাদিন সারা রাত শুধু ঘরে বসে লেখাপড়া করি। প্রতিদিন সকালে মাসুম এসে বাজার দিয়ে যায়, খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিল না। টি.এস.সি তে আমাদের আর আড্ডা বসে না। বন্ধুরা সবাই বিকেলে আমাদের বাসা চলে আসে। নীলা আমাদের সবার জন্য চা-বিস্কিট নিয়ে আসে, সন্ধ্য পর্যন্ত চলে আমাদের আড্ডা। একদিন ইমন বলল,“সত্যিই বলছি দোস্ত, নীলা যা চা তৈরি করে না, অন্ডারফুল।” আমি বললাম,“খাচ্ছিস খেয়ে যা। মাস শেষে যখন চা-নাস্তার বিল হাতে ধরিয়ে দেব, তখন সব অন্ডারফুল ভুলে যাবি।” সবাই এক সাথে হাসতে শুরু করল, নীলাও। নীলা হাসলে যা সুন্দর দেখায় না, কী বলব অসাধারণ! রাতে আমি যখন পড়তে বসি নীলা আমার পাশে বসে থাকে। আমি কিছুতেই ওকে ঘুমুতে পাঠাতে পারি না। ও আমার পাসে বসে থেকে গল্পের বই পড়ে। ভোর রাতে যখন ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন ঘুমাতে যায়, সঙ্গে আমাকেও টেনে নিয়ে যায়।
আমার রেজাল্ট অসম্ভব রকমের ভাল হল। বিভিন্ন দেশ থেকে বৃত্তির অফার আসতে লাগল। আমার সব থেকে বড় পাওয়া হল, রেজাল্টে বাবার রাগ ভেঙ্গেছে। রেজাল্টের পরদিন বাবা-মা মিষ্টি নিয়ে আমাদের দেখতে এলেন। বাবা নীলাকে প্রথমবার দেখছেন, তাই বললেন,“তুমিতো অনেক সুন্দরী তবে এই গাধাটাকে বিয়ে করলে কেন?” নীলা যে কি পরিমান লজ্জা পেল তা বলার নয়। আমি বৃত্তি পেয়েছি তাই ভিসা-পাসর্পোটের কোন সমস্যা হল না। কিন্তু নীলার ভিসা পেতে সমস্যা হয়ে দাড়ালো। বাবা তার এক বন্ধুকে বলে সে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।
বিদেশের মাটিতে আমাদের জীবন খুব একটা সুখকর হল না। লেখাপড়া, পার্টটাইম জব আর সংসার একসাথে চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তারপরও আজ আমাদের বাসাতে উৎসবের আমেজ। লেখাপড়া শেষ করে আজ আমি নাসা’র প্রজেক্ট এলিয়ান’এ একজন টেকনিসিয়ান হিসাবে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিলাম। বাসাতে উৎসব তো হবেই। নীলা প্রচন্ড খুশি হয়েছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন খুশিতে ফেটে পড়বে। আমি ওর কাছে এগিয়ে গেলাম, দুই হাতে ওর গাল স্পর্শ করে দিতেই সবাই হৈ-হৈ করে উঠল আর নীলা লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল। গেস্টরা সবাই চলে যাবার পর আমি নীলার দিকে তাকালাম, ওর ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির মৃদু হাসি। আমি বললাম,“প্রবাসী বাঙ্গালীদের নিয়ে আমাদের পার্টিটা বেশ জমল। কী বল?” নীলা মুখের হাসিটা ধরে রেখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপর আমার বুকের ওপরে ঝাপিয়ে পড়ল। আমিও মনে মনে এমনটিই চাচ্ছিলাম।
৩.
প্রজেক্ট এলিয়েনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য বাইরে থেকে পৃথিবীতে আগত তরঙ্গ পরিমাপ করা এবং সেখানে কোন তথ্য লুকানো আছে কি না সেটি বের করা। আর আমার কাজ রাডার সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করা। আমাদের জীবন গতানুগতিকভাবে বেশ কেটে যাচ্ছে; অফিস থেকে ফিরে দু’জন মিলে কফি খাই, তারপর আমি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে বসে পড়ি। আর ও হাসিমুখে আমার পাসে বসে থাকে, কখনও বিরক্ত হয় না।
প্রতিদিনের মত আজও কাজ করতে করতে নীলার মুখের দিকে তাকালাম। যা কখনও আমি ওর চেহারায় দেখতে পাইনি, তা আজ দেখতে পেলাম; বিরক্তি। আমি অবাক হয়ে বললাম,“আজ জিনিসটা কাজ করবে, তুমি দেখো আজ অবস্যই কাজ করবে।” আমি বুঝতে পারছি নীলার বিরক্ত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রতিকদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে ওর মাথায় থট্ রিডার-টা বসিয়ে দিয়ে আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে পড়ি। ও বিরক্ত হবে নাতো কী আমি বিরক্ত হব! কিন্তু কী করব? আমি যে নীলাকে ভীষণ ভালোবাসি! আমি যে ওর কথা শুনতে চাই। আমি ওর মস্তিস্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গটাকে শব্দ তরঙ্গে রূপ দিতে চাই। তাইতো এই খাটা-খাটুনি।
আমি শেষ তারটা জোড়া দিতে দিতে বললাম,“এইতো এই কাজটা শেষ হয়ে গেলে তুমি কথা বলতে পারবে।” তারটা জোড়া দিতেই নীলা বলে উঠল,“...কীভাবে যে বলি আমি মা হতে চলেছি। আর ও কি সব ছাই পাস আবিস্কার করছে ...” আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। নীলা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠে নীলাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে শুরু করলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমি কোন কারনে নাচছি; থট্ রিডার-টা কাজ করছে তাই, নাকি আমি বাবা হতে চলেছি তাই? ...হয়ত দু'টো কারনেই।
৪.
আমার তৈরি থট্ রিডার-টা কাজ করছে বটে তবে নীলা যা চিন্তা করছে, সেই চিন্তাটাকেও ভোকাল কর্ডের সাহায্যে শব্দে রূপান্তর করে দিচ্ছে। বিপত্তিটা এখানেই। আমি অনেক খাটা খাটুনির পর থট্ রিডার-টাকে ঠিক করলাম। ফলে থট্ রিডার-টাকে দুটি অংশে ভাগ করে একটি সুইচের মাধ্যমে অংশদুটিকে আলাদা করতে হল। নীলা যা বলতে চায়, শুধু মাত্র মস্তিস্কের সে সব বৈদ্যুতিক তরঙ্গকে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত করে প্রথম অংশটি। আর দ্বিতীয় অংশটি চালু করলে নীলার চিন্তা ভাবনাগুলোও শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়।
অফিস ছুটি বলে বিকালে আমি আর নীলা ড্রইং রুমে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় আমাদের বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠল। নীলা থট্ রিডার-টা টেবিলের ওপর খুলে রেখে ভেতরে চলে গেল আর আমি দরজা খুলে থ বনে গেলাম। কোন রকমে বললাম,“স্যা...স্যার আপনি?” প্রজেক্ট এলিয়েনের প্রধান বিজ্ঞানী হার্সেল ড্রেক মৃদু হেসে বলল,“ভেতরে আসতে পারি?” আমি দরজা থেকে সরে গিয়ে বললাম,“অবস্যই..অবস্যই।” হার্সেল ড্রেকের সঙ্গে আরও তিন জন এসেছে। তাদের মাঝে আমাদের টেকনিক্যাল বিভাগের হেড ডেভ মরিস এবং দ্বিতীয় জন হার্সেল এর ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা কর্মি। তৃতীয় জনকে চিনলাম না। আমি হার্সেল ড্রেকের মুখোমুখি বসলাম। নীলাকে নাস্তা দিতে বললে হার্সেল ড্রেক বলল, “নীলাকে কিছু করতে হবে না। সে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারে।” নীলা আমার পাসে এসে বসল। নীলা মোটামুটি ঠিকই আছে কিন্তু আমি লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে আছি বলে বিব্রত বোধ করছি। হঠাৎ করে হার্সেল ড্রেক বলল,“তোমার পোশাকটা অদ্ভুত!” আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,“ এটা আমাদের জাতীয় পোশাক।” “আই সি। তুমি জানইতো আমি বেশ ব্যস্ত, তাই কাজের কথায় আসি।” তিনি নিশ্চয় আমার কাছে অনুমতি চাচ্ছেন না। তাই আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হার্সেল ড্রেক বলল,“তুমি না কি একটা যন্ত্র তৈরি করেছ? যেটা মানুষের মনের কথা বলতে পারে।” আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম; এটা সে কিভাবে জানল। কিছুটা বিরতি দিয়ে হার্সেল বলল,“আমরা সেটাই দেখতে এসেছি।” আমি টেবিলের ওপর থাকা থট্ রিডার-টা দেখিয়ে দিলাম। হার্সেল অবাক হয়ে বলল,“এই হেলমেট-টা!?” আমি বললাম,“ আমি এর নাম দিয়েছি, থট্ রিডার।” হার্সেল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,“এটি সত্যিই কাজ করলে বলতে হবে নামটা যুতসই।” আমি কোন কথা না বলে সেটা নীলার মাথায় পরিয়ে দিলাম। নীলা বলল,“আপনারা আসাতে আমি অনেক খুশি হয়েছি। কখনও ভাবিনি এরকম একজন বড় বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলতে পারব।” হার্সেল হাসি মুখে বলল,“যে এরকম যন্ত্র বানাতে পারে তাকে কখনও ছোট বিজ্ঞানী ভেবনা যেন।” অপরিচিত লোকটিকে দেখিয়ে হার্সেল বলল,“এর নাম ক্লার্ক, এও বোবা, আমি একে দিয়েও পরীক্ষা করতে চাই।” আমি থট্ রিডারটা ক্লার্কের মাথায় পরিয়ে দিলাম, বললাম,“কথা বলার চেষ্টা করতে হবে, নাহলে ভোকাল কর্ড কাঁপবে না।” তারপরও ক্লার্ক চুপ করে বসে আছে দেখে আমি উঠে গিয়ে দ্বিতীয় অংশটা চালু করে দিলাম আর ক্লার্ক বলে উঠল,“...গাধাটা কী ফালতু একটা যন্ত্র বানিয়েছে। না জানি কীভাবে কাজ করে।” আমরা সবাই ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে আছি, সে চোখ বড় বড় করে বলল,“হায় হায় আমি এসব কি বলছি? কীভাবে বলছি?!!” এরপর একটানে থট্ রিডারটা টেনে খুলে ফেলল। তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। আমি বললাম,“সুইচ দিয়ে দ্বিতীয় অংশটা চালু করেছিলাম, তাই ও যা চিন্তা করছিল সব ভোকাল কর্ডের মাধ্যেমে শব্দে রূপান্তরিত হচ্ছিল।” হার্সেল আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল,“এই অর্ডারটা কার্যকর হবে, যদি তুমি এখানে সই করে দাও তবে।” আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা মেলে ধরলাম। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা যে হার্সেলের প্রধান সহকারী হিসাবে নিয়োগ পত্র। হার্সেল বলল,“নাও এবার দ্রুত কাগজটায় সই করে দাও। আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করলাম না।
৫.
আমার এরূপ পদোন্নতির কারণে আমি থট্ রিডারটা নিয়ে বিষদ গবেষণা করার সুযোগ পেলাম। ফলে আমার হেলমেট আকৃতির থট্ রিডারটাকে কয়েক মাসের মধ্যে এক বর্গ সে.মি এর দুটি আই.সি-তে পরিনত করলাম। একটি আই.সি ভেগাসের উপরে করটিতে লাগানো থাকে এবং অপরটি ভোকাল কর্ডের ওপর। যে আই.সি টি করোটিতে লাগানো হয় তার নাম কালেক্টর আই.সি সংক্ষেপে সি.আই.সি। সি.আই.সি এর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য সি.আই.সি এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা। ফলে যদি দু’টি মানুষের মাথায় সি.আই.সি লাগানো থাকে তবে তারা কথা না বলেই একে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে।
আমি ল্যাবে কাজ করছিলাম, এমন সময় একটা ফোন এল, আমি হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে একটা নারীকন্ঠ বলল,“কংগ্রাচুলেশন ড. শুদ্ধ। আমি নার্স জুলিয়া বলছি, আপনি জমজ সন্তানের বাবা হয়েছেন।” আমি খুশিতে বাগ বাগ হয়ে বললাম,“সত্যিই! আমি এক্ষুনি আসছি।” আমি আমাদের নতুন বাসাতে ছুটে গেলাম, হাতে অনেকগুলো খেলনা নিয়ে। নীলার দেখাশুনার জন্য একজন গাইনোলোজিস্ট সহ দুজন নার্স রেখেছিলাম, তারা জানালো আমার জমজ সন্তানের একজন ছেলে অপরজন মেয়ে। ওফ্ কী মজার কথা! আমি ছুটে নীলার ঘরে প্রবেশ করলাম। নীলা শুয়ে ছিল, আমি গিয়ে ওর কপালে একটা চুমো দিয়ে হাতটা ধরে বসে পড়লাম। নীলা বলল,“তোমার সন্তানদের দেখবে না?” আমি বললাম,“অবস্যই! অবস্যই!!”
রাতে বাচ্চাদুটো ভীষন কাঁদছিল। নীলা ওদের ঘুম পাড়াতে হিমশিম খাচ্ছিল। আমার কী মনে হল দুটি সি.আই.সি ওদের দু’জনের মাথায় লাগিয়ে দিলাম। একেবারে জাদুর মত কাজ হল। বাচ্চাদুটি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করল। আমি নীলাকে বললাম,“তোমার সি.আই.সি-তে কী কোন সংকেত ধরা পড়ছে?” নীলা অনিশ্চিত ভাবে বলল,“কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ করছে ঠিক বুঝছি না।” আমি ওদের কথা শুনার জন্য নিজের মাথায় একটা সি.আই.সি লাগিয়ে নিলাম। সত্যিই বাচ্চাদুটি নিজেদের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের সংকেত প্রেরন করছে। আমি ওদের সংকেত রেকডিং করতে গিয়ে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ওদের প্রেরিত তরঙ্গ রাডারে ধরা পড়ছে না।
পর দিনই ব্যাপারটা নিয়ে হার্সেল ড্রেকের সাথে আলোচনা করলাম। ও এতটাই খুশি হল যেন, ইউরেনিয়ামের খনি খুঁজে পেয়েছে। হার্সেল ব্যাপারটা নিয়ে পুরোপুরি মেতে উঠল। দুদিন পর হার্সেল হাসি মুখে বলল,“তুমি দারুণ একটা জিনিস আবিষ্কার করেছ। ওটি তোমার বাচ্চাদের নিজস্ব ভাষা বলেই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে বিষদ গবেষণা দরকার। কিছুদিন পর জানা গেল সব স্বদ্যজাত শিশু ঐ একটি ফ্রিকোয়েন্সিতে ভাব বিনিময় করে। হার্সেল অনেক গবেষণা করে ওদের ভাষাটি আবিষ্কার করল।
৬.
যে ফ্রিকোয়েন্সিতে বাচ্চারা ভাব বিনিময় করে সে ফ্রিকোয়েন্সি ধরার জন্য আমি আর হার্সেল একটা রাডার তৈরি করলাম। শক্তিশালি রাডারটি যেদিন সেট করা হল, তার পর দিন পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে গেল। রাডারে একটি বহির্জাগতিক সংকেত ধরা পড়ল। সংকেতটা ডিকোড করার পর এরূপ দাড়ালো,“মহাকাশের কোথাও প্রণের বিকাশ ঘটে থাকলে এবং আমাদের সংকেত বুঝতে পারলে সাড়া দাও। আমরা তোমাদের বন্ধু হতে চাই।” এই একই সংকেত নির্দিষ্ট সময় পরপর ধরা পড়তে লাগল। হার্সেল সংকেতটা নিয়ে গবেষণা করে বলল,“কী আশ্চর্য আমাদের এত কাছে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে অথচ নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির কারণে তারা আমাদের অড়ালে ছিল।” আমি বললাম,“ওরা কত দূরে আছে?” হার্সেল বলল,“ওরা জয় তারার কোন এক গ্রহে আছে, মানে সংকেত আদান প্রদানে এই ধর দশ বছর সময় লাগবে।”
হার্সেল বলেছিল দশ বছর কিন্তু পাঁচ বছর পরেই জবাব এল,“আমরা তোমাদের উত্তর পেয়েছি মানুষ। আমরা তোমাদের সাথে দেখা করতে চাই। তোমরা কী আমাদের অনুমতি দিচ্ছ?” হার্সেল উত্তর পেয়ে ভীষন অবাক হল। কারন উত্তর আসছে বৃহঃস্পতি গ্রহের কাছ থেকে।
প্রজেক্ট এলিয়েনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মিটিংএ বিতর্কের ঝড় উঠল। ওরা এলে মানুষের অস্তিত্ব কতটা নিরাপদ এনিয়ে প্রচন্ড বিতর্কের পরও কোন সিদ্ধান্তে পৌছানো গেল না। হার্সেল ম্যাসেজ পাঠালো ,“আমরা এখনও প্রস্তুত না তোমাদের সাথে দেখা করতে। তা তোমরা আমাদের এত কাছে থেকে উত্তর দিচ্ছ কী ভাবে?” কয়েক মিনিট পরেই উত্তর এল,“আমরা তোমাদের ব্যাপারে প্রচন্ড কৌতুহলী তাই চলে এসেছি। দুঃখিত আমরা বুঝতে পারি নি তোমরা প্রস্তুত নও। তোমাদের যতটা সময় দরকার তোমরা নিতে পার। আমরা অপেক্ষা করব।” এবার উত্তর এল আরও কাছে থেকে। হার্সেল পরিমাপ করে বলল,“ওরা আছে মঙ্গলের কাছে।” ওদের আর আসতে বারণ করা উচিত হল না। কারণ যারা স্পেস-টাইম সংকুচিত করে এতটা পথ পাড়ি দিতে পারে, তারা পৃথিবীতেও আসতে পারে। সুতরাং বন্ধুত্বের হাতটা আমাদেরও বাড়িয়ে দেয়া দরকার।
আমরা ওদের অনুমতি দেয়ার দশ মিনিট পর ওদের মহাকাশ যান পৃথিবীতে ল্যান্ড করল। যান থেকে অদ্ভুত দর্শন একটি প্রাণী বের হয়ে এল। লিওন ও লিয়া আমাদের জমজ সন্তান ছুটে গেল প্রাণীটার দিকে। তারপর প্রাণীটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। সি.আই.সি এর মাধ্যমে লিওন লিয়া ভাব প্রকাশ করত বলে ওদের ভাষাটা ভুলে যায়নি। প্রজেক্ট এলিয়েনের একজন কর্মচারী আমার এবং হার্সেলের জন্য দুটি সি.আই.সি নিয়ে এল। আমি লিওন, লিয়া ও মহাজাগতিক প্রাণীটাকে তীক্ষè দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছি, আর কর্মচারীটি আমার মাথায় দ্রুত সি.আই.সি সেট করে দিচ্ছে।
(এই গল্পটি সাইফাই সংকলন ২০০৯ এ প্রকাশিত)