১০
রাত সাড়ে এগারোটা, রাদিব হেঁটে বেরাচ্ছে তেজগাঁওয়ের অলিগলি ধরে। নাবিস্কো থেকে, নাখালপাড়া রেলগেট, পশ্চিম নাখালপাড়া, লুকাস মোড়, ছাপড়া মসজিদ হয়ে বিজয় সরণি ওভার ব্রিজের নিচের ফকিন্নি বাজার এসে দাঁড়াল। বাজারের নাম ফকিন্নি বাজার। এত রাতে এখানে বাজার নেই আর। ফকিন্নি বাজার নাম হবার কারণ, এখানে কাওরান বাজার থেকে পচা, ভেঙে যাওয়া, থেতলে যাওয়া সবজি এনে, পচা, থেতলে যাওয়া অংশ কেটে তা বিক্রি করা হয় কম দামে। সবজির এই হালের জন্যই বাজারের নাম ফকিন্নি বাজার। এখান থেকে শুধু গরীব লোকেরাই সবজি কেনে ব্যাপার কিন্তু তেমন না। টাকা বাঁচাবার জন্য, একটু সঞ্চয়ের জন্য অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত লোকেরাও বাজার করে। হয়ত নতুন সংসার, একটু টাকা বাঁচাতে পারলেই ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়। বউটা হয়ত বিরক্ত এ সবজি দেখে, তবুও স্বামীর এ ব্যাপারগুলো মাঝে মাঝেই বুঝে ফেলে। এ বোঝাপড়াটার নামই ভালোবাসা। এ সংসারে ভালোবাসা আছে বলেই মানুষ গুলো বেঁচে আছে। ভালোবাসাহীনতায় মানুষগুলো মরে যায়, বেঁচে থেকেও মৃত হয়। রাদিব ফকিন্নি বাজার ছেড়ে তেজকুনিপাড়ার দিকে পা বাড়াল। রাদিব চাইছে ওর একটু দৃষ্টিভ্রম হোক, নাহিন এসে দেখা দিক রাদিবকে। সেদিন যেমন মোটর সাইকেলের পিছনে এক ঝলক দেখা দিয়েছিল। রাদিবের দৃষ্টিভ্রম হয় না। কত দূর যেতেই একটা সরু গলি, কী ভেবে সে গলিতে চলে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিতে। সাথে মোবাইলটাও নেই যে আলো জ্বেলে সামনে আগাবে। আর একটু সামনে আগাতেই একটু একটু আলোর দেখা পেল। খুব ক্ষীণ একটা আলো। আর একটু সামনে যেতেই বুঝতে পারল, ও আলো সিগারেটের। একটা দম বন্ধ করা গন্ধ আসছে। রাদিব অনেক সিগারেট পুরায়, এমন গন্ধ আসে না কখনও। এরা সিগারেটের সাথে মিশিয়ে অন্য কিছু টানছে। সিগারেটের আলোর দিকে অকারণেই এগিয়ে যায় রাদিব। নিজের হাতটাও অন্ধকারে দেখা যায় না, এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতেই হুট করে সিগারেটের আলোটাও নিভে গেল। এতক্ষণ একটা ফিসফিসানি শব্দ পাওয়া গেলেও, এখন সুনসান নীরবতা। রাদিব তবু এগিয়ে যায়। কান খোলা রাখছে, সামনে কোথাও মানুষ আছে। এদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবার কথা। রাদিব কোনো শব্দ পেল না। আর একটু এগিয়ে যেতেই কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। কিছু বুঝে উঠবার আগেই, বেশ শক্তিশালী একটা হাত রাদিবের মুখ চেপে ধরল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, "এই, কী আছে বের কর। এত রাতে তুই এখানে কী করিস?"
রাদিবের কাছে কিছুই নেই, এ কথাটা বলবার মতও সুযোগ পাচ্ছে না। মুখ সজোরে হাত দিয়ে আটকে ধরা। অন্য একজন পকেটে হাত দিয়ে খুঁজে দেখল, কিছু নেই। যে খুঁজল, সেই হবে, রাদিবের গাল বরাবর একটা ঘুষি দিয়ে বলল, "এই শোরের বাচ্চা, ফকিন্নি সাইজা রাতের বেলা ঘুরে বেরাচ্ছিস কেন?"
রাদিব কিছুই বলতে পারছে না, কিছুই না। রাদিবের পেটে আর একটা ঘুষি দিয়ে মুখটা ছেড়ে দিল যে ধরেছিল।
"দিমু নাকি শালারে উপরে পাঠাইয়া?"
রাদিব ব্যথায় কাঁকালেও বুঝতে পারল কথাটা বলেছে, যে মুখ চেপে ছিল সে। পিছন থেকে অন্যজন বলল, "ছেড়ে দে তো। শোরের বাচ্চা এখানেই পড়ে থাকুক।"
রাদিব ব্যথায় ধুলার মধ্যেই পড়ে থাকল। রাদিবকে পেরিয়ে যখন মুখ চেপে ধরা ছেলেটা যাচ্ছিল, রাদিব পা ধরে টান দিলো ছেলেটার। ছেলেটা পড়ে গেল। অপর জন শব্দ শুনে বলল, "কী হলো রে, রাফি?"
রাফি নামের ছেলেটা উঠে দুইটা লাথি মারল রাদিবের গায়ে। লাথি মেরে বলল, "শালায় পা ধরে ফেলে দিছে।"
এরপর রাদিবকে ফেলে রেখে অন্ধকার ধরে এগিয়ে গেল দুজন, কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। রাদিব ওভাবেই পড়ে রইল সেখানে। উঠে দাঁড়াবার কোনো শক্তি নেই। ব্যথায় মাথার মস্তিষ্কে গণ্ডগোল হচ্ছে। মনে হচ্ছে চারপাশটা ভনভন করে ঘুরছে। আর কানে একটা শব্দ আসছে, কণ্ঠটা প্রফেসর সাজিদ এলাহীর। তিনি বলছেন, "এভাবে হবে না। এভাবে হবে না। তুমি আমাকে দ্বিতীয় কারণটা বললেই না।"
রাদিবের মনে হলো রাদিব জ্ঞান হারাচ্ছে। পেটের ঘুষিটা বেশ জোরে লেগেছে। রাদিব শেষমেশ জ্ঞান হারায়নি। ক’ঘণ্টা কেটে গেছে জানে না। পেটের ব্যথাটা একটু কমলে হাঁটা শুরু করল একা একা। বাসার পথে যাবার সময়, পুলিশ আটকাল। চেক করে নানা রকম কথা জিজ্ঞেস করল, রাদিব বলল, ছিনতাইকারী ধরেছিল। তারা তা বিশ্বাস করে না। পকেটে এক পোঁটলা গাঁজা ঢুকিয়ে দিয়ে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে গেল। রাদিবের মনে হচ্ছিল রাতের বেলাতেই অদিতকে ফোন দিক। রাদিব তা করল না। রাতটা থানাতেই কাটিয়ে দিয়ে, সকাল বেলা পুলিশের কাছে অদিতের পরিচয় দিলো, বলল রাদিব তার সহযোগী, একটা ফোন করতে চায় অদিতকে রাদিব। যদিও ফোন করা ছাড়াই পুলিশ ছেড়ে দিলো রাদিবকে। আর যেন রাত বিরাতে ওভাবে ঘুরে না বেরায় সে ব্যাপারেও সাবধান করে দিলো। আর একবার গাঁজা সহ ধরা পড়লে, ব্যাপারটা খারাপ হবে, সে কথাও জানিয়ে দেয়া হলো।
আজ প্রফেসর সাজিদ এলাহীর ফ্ল্যাটের নিচের দুই তলার মানুষদের জবানবন্দি নেবার কথা। রাদিবকে চলে যেতে বলা হয়েছে বেলা এগারোটার দিকে। অদিতের কাছে নাকি ফরেনসিক রিপোর্টটাও চলে এসেছে। সে রিপোর্টেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। এখন সকাল আটটা। হাতে আরও তিন ঘণ্টা সময় আছে। একবার ঘুরে আসা যায়, দীপ্তদের হল থেকে। দীপ্ত ছেলেটাকে রাদিবের বেশ পছন্দ হয়েছে। বলিষ্ঠ শরীরের মত, বলিষ্ঠ আচরণ, কোনো ভয় ডর নেই। ভীষণ নার্ভ শক্ত ছেলেটার। সাড়ে আটটা নাগাদ পৌছাল রাদিব দীপ্তদের হলে। হলের ছেলেগুলো এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না, এদের সন্ধ্যা হয় রাত বারোটায়, সকাল হয় বেলা বারোটার পর, যদি না সকাল বেলা ভার্সিটিতে ক্লাস থাকে। ক্যান্টিন বয়ের সাহায্যে দীপ্তর রুমে গেল রাদিব। দীপ্ত তখনও ঘুমাচ্ছে। রুমে তিনটা বেডের দুইটা খালি, একটাতে দীপ্ত শুয়ে। দীপ্তকে ডাক দিতেই উঠে গেল ঘুম থেকে, কোনো রকম বিরক্তি ছাড়াই উঠে বসল। রাদিব ভেবেছিল ছেলেটা বেশ অবাক এবং বিরক্ত হবে, তেমন হয়নি। দীপ্ত বেশ স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইল, "এত সকালে এখানে? আপনি একাই এসেছেন? সাথের দুজন কোথায়?"
"আমি একাই এসেছি। কিছু কথা জিজ্ঞেস করব, যদি কিছু না মনে করেন।"
"আমি কিছু মনে করলেও তো আপনাদের কিছু যায় আসে না। করুন জিজ্ঞাসা।"
"আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?"
"না, আমি বিরক্ত হচ্ছি না। আপনি জিজ্ঞেস করুন।"
রাদিব দীপ্তর চোখে সত্যি বিরক্তির কোনো ছাপ পেল না। রাদিব বলে, "আপনাকে যে কথা গুলো জিজ্ঞেস করব, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলতে পারেন আমি পুরোপুরি একটা অনুমানের উপর এসেছি। অনুমান সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে।"
"আপনি জিজ্ঞেস করুন, আমার জানা থাকলে আমি অবশ্যই সত্যি উত্তর দিব।"
"আচ্ছা, আপনাদের কি রাফি নামে কোনো বন্ধু আছে?"
দীপ্ত দু পাশে ঘাড় নেড়ে একটু ঘাড়ের ব্যায়াম করে নিলো। এরপর উত্তর করল, "জি না।"
"রাফি নামে পরিচিতও কেউ নেই, যে আপনারা বা নাহিন সাহেবের পরিচিত?"
"রাফি নামে একজনকে চিনি, ও আমাদের সাথে পড়ত। তবে পরীক্ষায় নকল করার জন্য আমাদের থেকে দুই বছর নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নাহিনের সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। তবে আমার ওকে পছন্দ না।"
"কেন পছন্দ না?"
"এটার আসলে কোনো কারণ নেই। এমন হয় না, একটা মানুষকে অকারণেই ভালো লাগে, একজনকে অকারণেই খারাপ লাগে। যেমন আপনাদের তিনজনকেও আমার পছন্দ না।"
দীপ্ত আবার সেদিনের মত অনবরত উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, সম্পূর্ণ অপরিচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর এত সহজে দেয়াটাও বা কীভাবে সম্ভব তাই ভাবছে রাদিব। কোনো রকম চিন্তা করার সময় না নিয়েই দীপ্ত উত্তর দিচ্ছে প্রশ্ন গুলোর। রাদিব এরপর জানতে চাইল, "নাহিন সাহেব কি নেশা করতেন?"
দীপ্ত এ প্রশ্নেও চমকাল না, ইতস্তত না করেই উত্তর দিল, "করতে পারে, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছি না।"
রাদিবও জোর করল না। শেষ প্রশ্ন হিসাবে জানতে চাইল, "আচ্ছা দীপ্ত সাহেব, আপনি যে রাফির কথা বললেন, সেও কি আপনার মত জিম করে?"
"করতে পারে, আমার সঠিক জানা নেই।"
রাদিব উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল, "আর ডিস্টার্ব না করলাম। আপনি ঘুমান। আসি আমি।"
দীপ্ত আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল, কাঁথাটা গায়ে টেনে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। রাদিব বেরিয়ে আসলো হল থেকে। বাসা থেকে মোবাইলটা সাথে করে নিয়ে এসেছে রাদিব। মোবাইলে সময় দেখল, নয়টা বাজতে তিন মিনিট বাকি। পেটের ব্যথাটা একটু একটু এখনও করছে। নাস্তা করে একটা ব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছে, তবুও। আবার গন্তব্য তেজগাঁও। দিদার সাহেবের বাসা। যাবার পথে একবার তেজকুনিপাড়ার সে জায়গাটায় উঁকি মেরে গেল, যেখানে গতকাল রাতে আহত হয়েছে রাদিব। কয়েকটা সিগারেটের ফিল্টার পড়ে আছে। একটা ফিল্টার তুলে নিল রাদিব। পকেটে পুড়ে রাখল।
দিদারের বাসায় পৌছাতে বাজল রাদিবের নয়টা সাইত্রিশ। দিদার এখন সুস্থ। সে জানাল, পুলিশের কাছে তার ভাইয়ের লাশ হারিয়ে যাবার ব্যাপারে অবগত করেছে। তারা আশ্বাস দিয়েছে, ব্যাপারটা তারা দেখবে। রাদিবকে রুমে আসতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো দিদার। দিদারও একই প্রশ্ন করল, "আপনি একাই এসেছেন? বাকি দুজন?"
রাদিব শুকনো হাসি মুখে ধরে রেখে উত্তর দিল, "হ্যাঁ, একাই এসেছি। আসলে আমি ওনাদের সাথের কেউ না। এমনিই সাথে সাথে থাকছি। প্রফেসর সাহেব আমার রুগি ছিলেন, তাই আগ্রহ থেকে খুনের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছি। আমি প্রফেসর স্যারের ডাক্তার ছিলাম।"
দিদার বুঝতে পারছে না কী বলবে, তাই চুপ করে রইল। রাদিব বলে যায়, "আপনাকে আসলে কিছু কথা জিজ্ঞেস করার জন্য আসা। আমাকে আপনি সাহায্য করবেন আশা করি।"
দিদার ম্লান করা একটা হাসি দিয়ে বলল, "অবশ্যই।"
"আপনার ভাইয়ের রাফি নামে কোনো বন্ধুকে আপনি চিনতেন?"
দিদার কিছু সময় চিন্তা করল, ভেবে চিন্তে বলল, "আমি তো আসলে ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ সময় ঢাকার বাইরে থাকতাম। নাহিনের অনেক বন্ধু বান্ধব বাসায় আসত। সবার নাম তো আমি জানি না।"
"এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করি। যদি জানেন, একদম সত্যি উত্তর দিবেন। এ উত্তরটা খুব জরুরী।"
"জি বলেন।"
"আপনার ভাই কি নেশা করত? আপনি জানেন এ ব্যাপারে জানেন কিছু?"
দিদারের চোখে মুখে অন্য রকম একটা ভাব ভর করল। যেন এ প্রশ্নের জন্য কোনোভাবেই সে প্রস্তুত ছিল না। মাথার পিছন দিকটায় কিছুক্ষণ চুলকিয়ে বলল, "কী বলেন আপনি এসব? ও নেশা করবে কেন? আমার ভাই যথেষ্ঠ ভালো একটা ছেলে ছিল।"
রাদিব দিদারের চোখের দিকে তাকিয়ে। রাদিব আবার জানতে চাইল, "আপনি সত্যিটা বলেন। আমি বলছি তো এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য।"
দিদার এবার একটু রেগে গেল।
"আপনাকে আমি মিথ্যা বলতে যাব কেন? কী আজব ব্যাপার? আপনি যান তো এখন, আমার কাজ আছে।"
রাদিব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দিদারের দিকে। আসন ছেড়ে উঠল না রাদিব। দিদার নাকের উপরটা আঙুল দিয়ে মুছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দ্বিধা আর সংকোচের সাথে রাদিবের দিকে তাকাল। রাদিব খুব ঠান্ডা গলায় বলল, "আপনি বলুন।"
দিদার জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে, বাম হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো আবার কিছুক্ষণ চুলকে নিলো। বুঝতে পারল এই লোক এত সহজে যাবে না। দিদার একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, "আমি ঢাকার বাহিরে থাকতাম মাঝে মাঝেই। নাহিনের সাথে কথা হতো না, দেখাও হতো কম। শুধু টাকা লাগলে আমার কাছে চাইত, আমি দিতাম। ব্যাস, এ পর্যন্তই। অনেক বন্ধু বান্ধব আসত ওর এ বাসায়। আমার একটা সময় মনে হলো, ওর আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কি নেশা করিস? ও অস্বীকার করল। কিন্তু আমার সন্দেহ হলো। একদিন আমার সিলেট যাবার কথা, আমি রেডি হচ্ছি আর নাহিন বাথরুমে গোসলে। নাহিনের নাম্বারে একটা কল আসলো, রাফি নামে একটা ছেলে কল করেছে। আমি কল ধরে হ্যালো বললাম। হয়ত ছেলেটা বুঝতে পারল না আমি নাহিন ছিলাম না। ছেলেটা বলে, 'বন্ধু তোর ভাই তো আজ সিলেট যাচ্ছে। সাথে হিরু আছে আমার, আজকে সেই পিনিক হবে।' আমি আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলাম। বুঝতে বাকি রইল না, হিরু মানে হিরোইন। আমি নাহিনকে কিছু বললাম না। সিলেট যাবার জন্য বেরিয়ে, ফিরে আসলাম দুই আড়াই ঘণ্টা পরেই। বাসায় এসে দেখি, ও আর ওর আরও দুইটা বন্ধু। তিন জনেই নেশা করে টলতেছে। আমি রাগে একটা থাপ্পড় মারলাম নাহিনের গালে। ও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। সেদিন রাতে আর ফিরল না। ওর প্রতি আমার একটা অভিমান জমল। আমি আর খোঁজও নিলাম না। পরদিন সকাল বেলা দেখি, দীপ্ত ওকে নিয়ে বাসায় হাজির। আমাকে বুঝাল, নাহিন আর এসব করবে না। ওকে মাফ করে দিতে। নাহিন তাও নেশা করে। আমি মানা করলে, আমার সাথেও খারাপ আচরণ করে। একটা সময় আমি ওর সাথে এই কারণে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ওর টাকা লাগলে ওর বন্ধুদের দিয়ে বলায়। এমনকি, ও মারা যাবার আগ পর্যন্ত আমি ওর সাথে আর কথা বলিনি।"
বলতে বলতে দিদারের চোখ ভিজে গেল। গলা ধরে আসলো। দিদারের মা একটু দূরে দাঁড়ানো। তিনিও শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। দিদার ভারী হয়ে আসা গলায় বলল, "মাও ব্যাপারটা জানত। তিনিও কয়েকবার বলেছে নাহিনকে, ওসব খাওয়ার চেয়ে একবারে মরে যা তুই। সত্যিই আমার ভাইটা মরে গেল।"
দিদার শব্দ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট গলায় বলল, "মরে যাওয়ার আগে আমি ওর সাথে একটু কথাও বলতে পারলাম না।"
দিদারের মা এসে দিদারকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেই জড়াজড়ি করে কাঁদছে। এ দৃশ্য যে কারও চোখ ভিজিয়ে দিবে। রাদিবের চোখ ভিজে যাচ্ছে না। মনের কোণেও কোনো চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে, দিদার সাহেবের কান্নার সময় ওনার মা জড়িয়ে ধরছেন, রাদিব কাঁদলে জড়িয়ে ধরারও কেউ নেই। মাঝে মাঝে কান্নার সময় জড়িয়ে ধরার মতনও কাউকে দরকার। অমন কেউ না থাকলে আবেগহীন জীবন কাটানোই ভালো।
রাদিব চট করে উঠে দাঁড়াল।
"আমি আবার আসব সময় হলে, আজ আসি।"
বেরিয়ে আসল বাসাটা থেকে রাদিব। এখন হাতিরপুল যাওয়া দরকার। এগারোটা বাজতে এখনও চল্লিশ মিনিট বাকি। হাঁটতে লাগল রাদিব। মনে হচ্ছে দুইটা রহস্যের একটার সমাধান পেয়ে গিয়েছে রাদিব। নাকি দুইটাই? ভেবে দেখা দরকার। তার জন্য একটা সিগারেট প্রয়োজন। সে সিগারেট জ্বালিয়ে পুড়তে দেখা প্রয়োজন।
১১
তিন তলার বাসিন্দা মিসেস রেনুফা ইয়াসমিন, বয়স সাইত্রিশ। থাকেন তার একমাত্র মেয়ে মিলিকে সাথে নিয়ে। মিলির বয়স পনেরো। ক্লাস নাইনে পড়ে। মিলির বাবা মারা গিয়েছেন যখন মিলির বয়স ছয়, বাস এক্সিডেন্টে। রেনুফা ইয়াসমিন এসে বসেছেন, অদিত, কায়েস, রাদিবের সামনে। তার চেহারা কিংবা পোশাক আশাক দেখে বোঝার উপায় নেই তার বয়স সাইত্রিশ, দেখে মনে হবে যেন সদ্য কোনো যুবতী মেয়ে। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপিস্টিক লাগানো, চোখে কাজল, মুখে কড়া মেকআপ। পরনে গোলাপি রঙের বড় গলার সালোয়ার কামিজ, এক পাশে ওড়না। রেনুফা ইয়াসমিনকে নিয়ে অনেক কথাই শুনেছে অদিত, প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কাছ থেকে। সেসবের সত্যি মিথ্যা অদিত জানে না। রেনুফা ইয়াসমিন কথা বলার সময় টেনে টেনে কথা বলেন, একটু স্মার্ট ভাব আনার জন্য। অদিত প্রশ্ন করা শুরু করে,"প্রফেসর সাজিদ এলাহী সাহেব যে মারা গিয়েছেন এ ব্যাপারে তো আপনি অবগত, তাই তো?"
রেনুফা ইয়াসমিন মুখের উপর পড়ে থাকা এক গোছা চুল সরিয়ে নিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, শুনেছি।"
"আপনার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল?"
"উনি তো অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।"
ছলছল চোখে উত্তর দিলেন রেনুফা ইয়াসমিন। এক নিমিষে তিনি তার কথা বলার ধরণ পাল্টে গলার স্বরে একটা মায়া ভরা ভাব নিয়ে আসলেন।
অদিত বলে, "এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওনার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?"
রেনুফা ইয়াসমিন অদিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "ভালো।"
"তার সাথে আপনার কোনো ঝামেলা ছিল না?"
"না তো।"
রেনুফা ইয়াসমিন একটু ঝুঁকে বসল অদিতের দিকে। জামার ফাঁকা দিয়ে বুকের অনেকটা অংশ অদিতের চোখের সামনে ভেসে উঠল। অদিত পিছনে সরে গেল। সরে গিয়ে বলল, "আপনি একটু পিছিয়ে, সোজা হয়ে বসুন প্লিজ।"
রেনুফা ইয়াসমিন বোঝা গেল কিছুটা অপমানিত হলেন। তিনি সরে সোজা হয়ে বসে বললেন, "আমাকে এখানে ডেকে আনার মানেটা কী?"
অদিত শান্ত গলায় বলে, "তেমন কিছুই না। প্রফেসর সাজিদ এলাহী খুন হলেন তার ফ্ল্যাটে, এখন আপনারা তার নিচের ফ্ল্যাটে থাকেন, সাধারণ ভাবেই আপনাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা, তাই খতিয়ে দেখা।"
রেনুফা ইয়াসমিন নিচের ঠোঁট কামড়ে অদিতের দিকে তাকিয়ে রইল। অদিত বলে যায়, "আপনার হাসবেন্ড মারা গিয়েছেন প্রায় দশ বছর। আপনি কোনো চাকরি বাকরি করেন বলেও আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। মাইন্ড করবেন না প্লিজ, এত বড় একটা ফ্ল্যাটে থাকা, এত টাকা দিয়ে মেয়েকে পড়ানো, মেয়ের জন্য বাসায় টিচার রাখা, কিংবা নিজের খরচ এসব আসে কোথা থেকে?"
রেনুফা ইয়াসমিন এ প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। মুখ কালো হয়ে বাঁকা করে অদিতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। অদিত আবার জিজ্ঞেস করল, "আমি উত্তরটা চাচ্ছি।"
রেনুফা ইয়াসমিন ওড়নাটা বুকে ঠিক করে জড়াতে জড়াতে বললেন, "আমার বড় ভাই আমাদের চালান।"
অদিত একটু গলার স্বর নামিয়ে বলল, "আমরা কিন্তু অন্য কিছু জানি।"
রেনুফা ইয়াসমিন গলার স্বর উঁচু করে বললেন, "কী জানেন আপনারা?"
"আপনি কী করেন সেটা। আচ্ছা সে যাই হোক। সেটা আপনার নিজস্ব ব্যাপার। প্রফেসর সাজিদ এলাহীর সাথে আপনি বলেছেন আপনার সম্পর্ক বেশ ভালো। আসলে কি তাই?"
ঘাড়টা একটু বাঁকা করে চোখের দৃষ্টিতে একটা জিজ্ঞাসার ভাব এনে রেনুফা ইয়াসমিন বললেন, "মানে? কী বলতে চাচ্ছেন?"
"বলতে চাচ্ছি, আপনার সাথে প্রফেসর সাজিদ এলাহীর সম্পর্ক খুবই খারাপ ছিল। আমি ব্যাপারটা বলি। আপনার যে পেশা, সে সম্পর্কে যেভাবে হোক প্রফেসর সাহেব জেনেছিলেন। তার কোনো কারণে মনে হলো, একটু পরীক্ষা করুক তিনি। তিনি আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে রাজিও করিয়ে ফেললেন। আপনি তার সাথে একদিন দুপুর বেলা সময় কাটালেন। কিন্তু তিনি আপনাকে আপনার যে ডিমান্ড ছিল, তা পূরণ করলেন না। আপনার টাকাটা আপনাকে দিলেন না। আপনি তাকে কিছু বলতেও পারলেন না। এ বাড়িতে আপনি মেয়ে নিয়ে থাকেন, আপনার মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে এখানে। প্রফেসর সাহেবের কাছে অনেক মানুষ আসে। আর তিনি একটু বেশি কথা বলেন। আমাকে যেমন তিনি ঘটনাটা বলেছেন, তিনি তেমন আরও অনেককেই বলেছেন। অনেকেই আপনার সাথে দেখা করতে যেতে চাইল, আপনার দরজায় এসে কলিং বেল চাপতে লাগল। আপনাকে মোট কথা মোটামুটি ভাল মাত্রায় অপমানিত করলেন। অনেক গুলো মানুষের কাছে আপনার নামে আজেবাজে কথা বললেন। আপনিও ব্যাপারটা নিয়ে প্রফেসর সাহেবকে শাসিয়ে আসলেন, আপনি কেস করবেন। প্রফেসর সাহেব হেসে বললেন, কেস করতে। এতে আপনারই আরও মান সম্মান নষ্ট হবে। আপনি প্রচণ্ড নিরুপায় হয়ে গেলেন। কিছুই করার নেই দেখে, চুপ হয়ে গেলেন। তবে ভিতরে ভিতরে রাগটা ঠিকই জমে ছিল।"
রেনুফা ইয়াসমিন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে খুঁজতে, টেবিলের উপর রাখা এশট্রেটা বাম হাত দিয়ে তুলে অদিতের দিকে ছুঁড়ে মারলেন, যদিও অত জোরে না। তবুও অদিত সেটা ধরতে পারল না। সোজা গিয়ে নাকের উপর পড়ল। অদিত নাক চেপে ধরে নিচে পড়ে গেল। কায়েস আর রাদিব ছুটে আসলো। অদিতকে ধরে তুলে বসাল। কায়েস রেনুফা ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, "আরে, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন না-কি? কী করছেন এসব?"
রেনুফা ইয়াসমিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, "আমাকে নিয়ে উনি আজেবাজে কথা বলে যাবেন, আর আমি বসে বসে শুনব?"
অদিত নাকটা ধরেই রাদিব আর কায়েসকে বলল, ও ঠিক আছে। আবার রেনুফা ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি মিথ্যা কিছুই বলিনি, সেটা আপনিও জানেন। আর এরপর এমন কিছু করলে কিন্তু সোজা জেলে চলে যাবেন। কেউ আটকাতে পারবে না। আমি যা জিজ্ঞেস করি তার সোজা সোজা উত্তর দিন। আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোক, তাই আপনাকে প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে, আর তার উত্তর দিতে আপনি বাধ্য।"
রেনুফা ইয়াসমিন রাগে ফোসফোস করতে করতে সোজা হয়ে বসলেন। অদিত নাকটা ধরে একটু নড়াচড়া করে, এরপর ছেড়ে দিলো। নাক নিয়ে রক্ত বের হয়নি, অত জোরে আসেনি বলেই রক্ষা। অদিত জিজ্ঞেস করে, "আপনি গত ছয় তারিখ মানে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে কোথায় ছিলেন?"
রেনুফা ইয়াসমিন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, এরপর মৃদু স্বরে বললেন, "আমি আমার রুমেই ছিলাম। সন্ধ্যার পর টিভি দেখেছি, এরপর রান্না বান্না করে, রাতের বেলা ঘুমিয়ে গেছি।"
"আপনি এর মাঝে কি প্রফেসর সাহেবের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?"
"আমি তার ফ্ল্যাটে যেতে যাব কেন?"
"প্রশ্নটা আমিই জিজ্ঞেস করছি। হ্যাঁ বা না উত্তর দিন।"
"না, যাইনি।"
"সেদিন আপনার সাথে তো আপনার মেয়ে ছিল, তাই না?"
"না। ও ছিল না।"
"ও কোথায় ছিল তাহলে?"
"ওর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। রবিবার ওর দাদা বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমার ওর দাদা বাড়ির সাথে আর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, আমার মেয়েকে ওনারা অনেক ভালোবাসে। তাই দাদা বাড়ি যেতে চাইলে আমি না করি না।"
"তার মানে বাসায় আপনি একাই ছিলেন? আপনি প্রফেসর সাজিদ এলাহীর ফ্ল্যাটে যাননি এ ব্যাপারে আপনার কোনো সাক্ষী নেই?"
"আমি যাইনি।"
"আপনার কিন্তু প্রফেসর সাহেবকে খুন করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনাকে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করল, আপনি সুযোগ পেলে তাকে ছাড়বেন কেন? আপনার মেয়ে বাসায় নেই, আপনিও সুযোগ পেলেন, চুপ করে গিয়ে প্রফেসর সাহেবকে খুন করে চলে আসলেন।"
"আমি প্রফেসরকে খুন করিনি।"
"আপনার তো কোনো সাক্ষী নেই।"
রেনুফা ইয়াসমিন পার্স থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, "আছে সাক্ষী।"
অদিত নিচু হয়ে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, "কে?"
"আমার সাথে সেদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত আলম ছিল।", বড় লজ্জা নিয়ে অপরাধী মুখে কথাটা বললেন রেনুফা ইয়াসমিন। তার পুরো মুখটায় লজ্জায় লালচে একটা ভাব চলে এসেছে।
"আলম কে?"
রেনুফা ইয়াসমিন ইতস্তত করে বললেন, "আমার মেয়ের টিচার। ও আমার বন্ধুও। একটা জব করে, আর অবসর সময়ে আমার মেয়েকে পড়ায়।"
(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত। )
পর্ব ৭
রিয়াদুল রিয়াদ