পর্ব ১ পর্ব ২ পর্ব ৩ পর্ব ৪
দীপ্ত এসে পৌছাল যখন ভার্সিটি হলে, তখন বেলা সাড়ে তিনটা। এতদিন পর বাড়িতে গিয়েছে, আবার কেন ফিরে আসছে সে প্রশ্নের উত্তরে বাড়িতে বলেছে, ভার্সিটিতে কাজ আছে। আসতে ইচ্ছা করছিল ব্যাপারটা তেমন না। তবে না আসলেও সমস্যা, এই গোয়েন্দারকম মানুষগুলো কিছু হলেই সন্দেহ করে, দেখা গেল কোনো কারণে আসতে পারল না দীপ্ত। যে কারণে ডেকেছিল সে ব্যাপারে দীপ্তকেই ফাঁসিয়ে দিলো। অদিত, রাদিব, কায়েস আবার ভার্সিটি হলে আসলো চারটা নাগাদ। এসে সেই একই গেস্ট রুমে বসল। দীপ্তর সাথে আরিফ আর মিশুও এসেছে। অদিত আরিফ আর মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনারা কিছু মনে না করলে, একটু বাহিরে গেলে ভালো হয়।"
আরিফ আর মিশু উঠে বেরিয়ে গেল। দীপ্ত ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বসে আছে, ভয় বা বিস্ময় কিছুই কাজ করছে না চোখ দেখেই বলে দেয়া যায়। অদিত কথা বলা শুরু করে, "হঠাৎ বাড়িতে চলে গেলেন, এমন হুট করে?"
"ভার্সিটি তো বন্ধ। আপাতত কোন কাজ নেই, তাই ভাবলাম বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি।"
সামনে রাখা কোকের একটা বোতল অদিত তুলে নিয়ে, দীপ্তকেও বলল, "নিন কোক খান।"
দীপ্ত কোক তুলে নিলো।
"নাহিন সাহেবের সাথে তো আপনার দেখা হয়নি, তাই না?"
"কবে?"
"এই নাহিন সাহেব মারা যাওয়ার পর আর কী।"
"মৃত মানুষের সাথে দেখা হবার তো প্রশ্নই উঠে না।"
"কিন্তু আপনার বন্ধুদের তো দেখা দিয়েছে নাহিন সাহেব।"
"এটা ওদের মনের ভুল। ভয় পাচ্ছিল তাই সামনে দেখেছে।"
"আপনি ভয় পান না? যদি আপনার সামনেও লাশটা দেখা দেয়।"
"না ভয় পাই না। এটা ভয় পাবার মত কোনো ব্যাপার না।"
"বেশ, এই যে নাহিন সাহেবের লাশ হারিয়ে গেল, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?"
"এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এ ঘটনা ঘটেছে নাহিনের বড় ভাইয়ের সামনে, আপনি তার কাছ থেকেই ভালো জানতে পারবেন।", বেশ কাটছাট জবাব দীপ্তর।
"আপনার কি মনে হয় নাহিন বেঁচে আছে?"
"অবশ্যই না। আমার সামনে দুইবার করে ডাক্তার ওকে চেক করেছে। আমরা নিজেরা চেক করেছি। নাহিন মারা গিয়েছে।"
অদিতের প্রশ্নের মতই, দীপ্তও বেশ সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো সব। কথার মাঝে কোনো জড়তা নেই, আমতা আমতা ভাব নেই। রাদিব বেশ অবাক হচ্ছে ছেলেটাকে দেখে। এ পর্যন্ত যাদের জবাবদিহি করা হয়েছে, সবাই হয় ভড়কে গিয়েছে কিংবা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। একমাত্র দীপ্ত ব্যতিক্রম। দীপ্তর মাঝে জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে কোন ভাবান্তর নেই। কোকের বোতলে চুমুক দিচ্ছে আর পটাপট জবাব দিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে দুটি। এক, দীপ্ত সব একদম শতভাগ সত্যি বলছে, আর দুই, দীপ্ত আগে থেকেই কথা গুলো ঠিক করে রেখেছে এসব বলবে। কিন্তু মানুষ মিথ্যা বলার সময় চোখের মধ্যে একটা অস্থির ভাব দেখা যায়, দীপ্তর চোখগুলোও বেশ শান্ত। খুব শান্ত।
অদিত এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে গেল, দীপ্তর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, "আপনি গত ছয় তারিখ, মানে মঙ্গলবার কোথায় ছিলেন সন্ধ্যার পর?"
দীপ্ত একবার বাম পাশে তাকাল, একবার ডান পাশে এরপর অদিতের চোখের দিকে তাকিয়েই বলল, "আমি হলে ছিলাম।"
"আপনি নিশ্চিত, আপনি মিথ্যা বলছেন না?"
"জি, নিশ্চিত।"
"আপনি দিদার সাহেবের বাসা থেকে সরাসরি হলে এসেছেন তার মানে?"
"জি না।"
অদিত ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, "কোথাও গিয়েছিলেন?"
"জি।"
"কোথায়?"
দীপ্ত সোজা হয়ে বসে বলল, "আমার মোবাইলটা ডিস্টার্ব করছিল, তাই ভেবেছিলাম মোতালেব প্লাজা থেকে ঠিক করে নিয়ে আসব। আমি ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন মঙ্গলবার। গিয়ে দেখি মোতালেব প্লাজা বন্ধ। এরপর হলে ফিরে আসি।"
অদিত উঠে দাঁড়াল, দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল, "মোতালেব প্লাজা তো হাতিরপুলে, যদি আমি ভুল না করি?"
"হ্যাঁ হাতিরপুল, আপনি কোনো ভুল করছেন না।"
"আর প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বাসা যেন কোথায়?"
"সেটাও হাতিরপুল।"
"আচ্ছা, আচ্ছা, এখন আপনি হাতিরপুল গেলেন, সেটা মোবাইল ঠিক করতে না প্রফেসর সাহেবের সাথে দেখা করতে?"
ভেবেছিল অদিত এই প্রশ্নে ভড়কে যাবে দীপ্ত। অথচ দীপ্ত সাথে সাথেই জবাব দিলো, "মোবাইল ঠিক করতেই।"
"আপনি প্রফেসর সাহেবের বাসার দিকে যান নি কিংবা তার সাথে দেখা করেননি বলছেন?"
"জি না, আমি মোতালেব প্লাজা বন্ধ পেয়ে চলে এসেছি।"
অদিত আবার দীপ্তর সামনে এসে বসল, রাদিব খেয়াল করল, দীপ্ত যতটাই শান্ত, স্থির, অদিত ততটাই ধীরে ধীরে অশান্ত হচ্ছে। ধীরে ধীরে বলা কথাগুলোর গতি এবং তীব্রতা দুই ই বাড়ছে। অদিত কিছুটা কাঁপা গলায় বলল, "আপনার অ্যালিবাই আছে কোনো মানে সাক্ষী আর কি যে আপনি সেদিন মোতালেব প্লাজা থেকেই ফিরে এসেছেন, আপনি প্রফেসর সাহেবের বাসায় যাননি?"
"আমি তো কোনো অপরাধ করছি না যে, আমার অ্যালিবাই রেডি রেখে ঘুরতে হবে। আমি যেটা বলছি, সেটা সত্যি।"
"আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব এটা?"
"সেটা তো আমি জানি না। আমি মোতালেব প্লাজা গিয়েছিলাম, সেখান থেকে সোজা হলে আসি।"
অদিত ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হাতের তালু দিয়ে, কপালের ঘাম মুছে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, "আপনি হলে আসেন কয়টায়?"
"সাড়ে সাতটার দিকে।"
"এরপর?"
"এরপর হলের ক্যান্টিনে রাতের খাবার খেয়ে, ঘুমিয়ে যাই। আমি অনেক ক্লান্ত ছিলাম। আর সকালে উঠে মানিকগঞ্জ চলে যাই।"
"আচ্ছা, আপনি যে হলে সাড়ে সাতটা নাগাদ এসেছিলেন, এটার তো নিশ্চিত অ্যালিবাই আছে। আপনি হলে এসে কারও সাথে কথা বলেছেন, আরিফ বা মিশু সাহেবের সাথে দেখা করছেন, তাই তো?"
"না, এটারও কোনো অ্যালিবাই নেই। আমার কারও সাথে দেখা হয়নি, ভার্সিটি বন্ধ, বেশির ভাগ ছেলে বাড়ি চলে গিয়েছে, হলে ছেলে অনেক কম। আর আরিফ, মিশু দুজনেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।"
অদিতের চোখে লালচে একটা ভাব চলে এসেছে। রাগে শরীর কাঁপছে, কেন এমন হচ্ছে রাদিব বুঝতে পারছে না। দীপ্ত উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা সরিয়ে, আবার জায়গা মত রাখল। চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, "আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?"
অদিত এক দৃষ্টিতে দীপ্তর দিকে তাকিয়ে রইল। দীপ্ত বলল, "আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার না থাকলে, আমি আসি এখন। আর ডিটেকটিভ স্যার, আপনার রেস্ট করা দরকার। আপনি অনেক উত্তেজিত হয়ে গিয়েছেন।"
দীপ্ত গেস্ট রুমের দরজাটা খুলে চলে গেল। রাদিব এসে অদিতের পাশে বসল। বিস্ময় ভরা চোখে অদিতকে দেখছে। অদিতের পাশ ঘেঁষে বসে বলল, "কী হলো?"
অদিত চুপ করে রইল অনেকটা সময়। রাদিব উত্তরের আশায় বসে রইল। অদিত অনেকটা সময় পরে বলল, "আপনার কি মনে হয়? দীপ্ত সাহেব সব সত্যি বলল?"
রাদিব একটু ভেবে বলল, "আমি ঠিক বুঝি নাই। তবে কথা শুনে মিথ্যা মনে হলো না।"
অদিত মাথাটা দুদিকে নেড়ে বলল, "না, আমার কিন্তু তেমন মনে হয়নি। মনে হলো, খুব গুছিয়ে অনেক গুলো মিথ্যা বলে গেল। এর মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা আছে।"
"হতে পারে, আপনার মত তো আমরা এত সহজে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারি না।"
অদিতকে এখন অনেক স্বাভাবিক লাগছে। গেস্ট রুম থেকে তিনজন বেরিয়ে আসলো। রাদিব বুঝতে পারছে, এখানে আবার আসতে হবে। আসাটা অবশ্যম্ভাবী। গাড়ি চালিয়ে গুলশানের দিকে যাবার সময় অদিতের একটা ফোন আসলো। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের ডাক্তার তারেক আজিজ। কিছু বলল, ওপাশ থেকে। যেতে হবে ওখানে। রাদিবকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে অদিত, কায়েসকে নিয়ে চলে গেল। রাদিবকে রাত আটটার দিকে রেডি থাকতে বলল, এসে নিয়ে যাবে নিজের বাসায় অদিত। রাদিব নিজের ঘরের মধ্যে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ভাবনার গভীরে, অনেকটা গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করল। এর মাঝেই মোবাইলটা বেজে উঠল, স্নিগ্ধার মেসেজ, "রাদিব ভাইয়া, আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। একটু সময় বের করে দেখা করেন না। আমার বোধ হয় বিয়ে হয়ে যাবে। আমার বিয়ে হলে কি আপনি অনেক খুশি হবেন?"
মেসেজটা দেখে রাদিব মোবাইল বন্ধ করে রেখে দিলো। কয়েকটা দিন কী নিদারুণ অভিনয় করে যাচ্ছে রাদিব। অবশ্য পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই অভিনেতা, অভিনয়ে জীবন চলে। কেউ অভিনয়ে পটু, কেউ অভিনয়ে আনাড়ি। সে যাই হোক, অভিনয় তো করে যাচ্ছে। এই যে স্নিগ্ধা মেসেজ দিলো, চাইলেই একটু অভিনয় করে মেয়েটার সাথে ভালো করে কথা বলা যেত। রাদিব বলল না। রাদিব ভাবছে, স্নিন্ধার বিয়ে হয়ে গেলে কি সত্যি রাদিব খুশি হবে? অভিনয় হবে কোনটা? রাদিবের হাসি মুখে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া, না-কি নিশ্চুপে 'ব্যস্ত আছি, আসতে পারব না' বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া?
রাদিবের হুট করেই নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। খুনির চিন্তা বাদ দিয়ে স্নিগ্ধার চিন্তা করছে। মেয়েরা এক একটা পোকা, সে পোকা মাথায় ঢুকাতে রাদিব চায় না। তার চেয়ে বরং চোখ বুজে খুনি দর্শন করাটা ভালো। রাদিব চোখ বন্ধ করলেই খুনিকে প্রফেসর সাজিদ এলাহীকে খুন করতে দেখছে। একটা আবছা অবয়বের খুনি। সে আবছা অবয়ব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে, চকচকে কাঁচের মত স্বচ্ছ হচ্ছে।
৯
অদিত এসে রাদিবকে নিয়ে রওয়ানা দিলো। সাথে এখন কায়েস নেই। উঁচু উঁচু বিল্ডিং পেরিয়ে যাবার সময় এক ফাঁকে রাদিব বলল, "একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে?"
অদিত হেসে বলল, "অবশ্যই।"
"আমাকে প্রফেসর স্যার বলেছেন, আপনার বাবার অনেক বড় ব্যবসা। আপনার গাড়ি দেখেও বোঝা যায় আপনার অনেক টাকা পয়সা। তাহলে ব্যবসা ছেড়ে, এই পেশায় কেন?"
"হাহাহা, এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করে। হ্যাঁ, আমার বাবার অনেক বড় ব্যবসা আছে, টাকা পয়সাও প্রচুর। আমি যদি কিছু নাও করি, ঘরে বসে বসে খেলেও টাকা শেষ হবে না। তবুও আমি এই পেশায় কেন?"
"জি।"
"আসলে, আগ্রহ বলতে পারেন বা এটার মাঝে একটা থ্রিল খুঁজে পেয়েছি। ভালো লাগে এই জটিল সমস্যা গুলো সমাধান করতে।"
"আপনাকে আমি যত দেখছি অবাক হচ্ছি, আপনি যেভাবে ভাবতে পারেন, আমি সেভাবে পারি না।"
অদিত মৃদু হেসে বলল, "আপনিও যথেষ্ট বুদ্ধিমান।"
"আরে না, অমন কিছুই না। আচ্ছা আপনি আপনার গোয়েন্দাগিরিতে কাকে ফলো করেন? শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, ফিলিপ মারলো, স্যাম স্পেড নাকি ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটী রায়? "
"হাহাহা, আপনি কী যে বলেন? এরা গল্প, উপন্যাসের চরিত্র। এদের মধ্যে সবাইকে আমি চিনিও না। মানে গল্প, উপন্যাস যাই হোক, পড়িনি। বাস্তবতাটা তো আর গল্পের মত না, বাস্তব অনেক জটিল। গল্প পড়লেই বোঝা যায়, কে খুনি। যাকে সবচেয়ে নির্দোষ মনে হবে, সন্দেহ ভাজনের মধ্যে সেই খুনি। আসলে কি তেমন হয়?"
রাদিব হাসল একটু, কথার আর জবাব দিলো না। গাড়ি চলে এসেছে গুলশানে অদিতদের বাড়ির সামনে। বিশাল বাড়ি, গেট দিয়ে ঢুকতেই মসৃণ রাস্তা, রাস্তার দু পাশে ফুলের গাছ। শিউলি ফুলে ভরে আছে গাছ গুলো, কাঠ গোলাপের মিষ্টি সুবাসও নাকে আসছে। অদিত রাদিবকে নিয়ে ভিতরে গেল। সোফায় বসিয়ে 'মধুমিতা' বলে চিৎকার করে ডাকল। পাশের এক রুম থেকে, মধুমিতা বেরিয়ে আসলো। মধুমিতা অদিতের স্ত্রী। দেখতে দারুণ এক কথায়, চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। অদিত পরিচয় করিয়ে দেবার পর, রাদিব বলল, "ডিটেকটিভদের সচরাচর বউ থাকে না। এরা একাই হয়।"
অদিত সজোরে হেসে উঠল।
"ডাক্তার সাহেব, আপনি ভাবছেন শুধু, আমি গোয়েন্দাগিরিই পারি, আর কিছু না। তবে আসুন আমার সাথে।"
মধুমিতাকে খাবার সাজাতে বলে, অদিত রাদিবকে নিয়ে উপর তলায় চলে গেল। একটা রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। ঘরের মধ্যে শো কেসে সাজানো হাজার হাজার ক্রেস্ট। অদিত সেসবের সামনে দিয়ে রাদিবকে নিয়ে যাবার সময় দেখালো, কোনটা ফুটবল খেলে, কোনটা ক্রিকেটে, কোনটা ক্লাসে ফার্স্ট হবার জন্য, কোনটা বিতর্কের, আরও সারি সারি সাজানো ক্রেস্টে সায়েন্স ফেয়ার, ভার্সিটির সেরা ছাত্র, সেরা গল্পকার, স্কুলে কলেজের দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্প, রচনা প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান, চাকরি জীবনেরও অনেক গুলো অর্জনের ক্রেস্ট সাজানো। রাদিব অদিতের দিকে তাকাল, একটু বিস্ময়ে ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, "একটা মানুষের এত গুণ থাকে কী করে? কী করে সম্ভব?"
অদিত আলতো করে হাসি দিলো।
"এবার তো বুঝলেন, আমি শুধু ডিটেকটিভ না, আরও অনেক কিছু। তো এত কিছুর জন্য হলেও অমন সুন্দরী একটা বউ থাকাটা তো অনুচিত না।"
রাদিবও হাসির সাথে তাল মিলালো।
নিচের তলায় বসে আছে যে দুজন, তার মধ্যে একজন রাদিবের পরিচিত, অন্যজন না। একজন কায়েস। অন্যজন কে জানে না। রাদিবকে নিয়ে নিচে নেমে অদিত, রাদিবকে পরিচয় করিয়ে দিল রাদিবের অপরিচিত মানুষটার সাথে। অপরিচিত মানুষটা অদিতের ডিপার্টমেন্টের বড় অফিসার, আরেকটা পরিচয় হলো সে অদিতের বড় বোনের জামাই, মানে অদিতের দুলাভাই, নাম মঈন আহমেদ। খাবার খেতে বসল সবাই, টেবিলের এক পাশে অদিত, রাদিব, কায়েস, অন্য পাশে মঈন আহমেদ, মধুমিতা, মঈন আহমেদের স্ত্রী বা অদিতের বোন যাই হোক, আর মধুমিতার কোলে ওদের চার বছরের মেয়েটা। খাওয়া দাওয়া বেশ হলো, যদিও সব রকম খাবারের নাম জানে না রাদিব। এত বড়লোকের বাড়িতে খেয়ে দেয়ে অভ্যস্ত হয় বলেই হয়ত। মাছ, মাংস, ডিম চিনে, সেগুলো দিয়ে বানানো হরেক রকম খাবারের নাম জানা নেই রাদিবের। খাবার খেতে খেতেই রাদিব জানতে চাইল, অদিতের বাবা মার কথা। জানা গেল অদিতের মা মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। বাবা থাকেন আলাদা। অদিতের সাথে সারাক্ষণ ঝামেলা লেগেই থাকে তার, অদিতের পেশা তিনি কোনোভাবেই পছন্দ করেন না।
খাবার শেষে আড্ডা বসল। আড্ডার বেশির ভাগ সময় জুড়ে অদিতের গুণগানই শুনল রাদিব। এমন একজন মানুষের পাশে থাকাটাও তো ভাগ্যের ব্যাপার। উপস্থিত সবাই এক দুই লাইন করে গান গাইল। রাদিবের পালা এবার। রাদিব অল্প হেসে বলল, "আমি তো গান পারি না।"
কেউ তাকে ছাড়বে না। গান করতেই হবে। রাদিব শেষমেশ বলল, "গানের পরিবর্তে ছোট একটা জাদু দেখাই?"
অদিত অবাক হয়ে বলল, "আপনি আবার জাদুও পারেন না-কি?"
"আসলে ওভাবে না। টুকটাক আর কি।"
"আচ্ছা দেখান তবে।"
রাদিব তিন টুকরা কাগজ নিলো, তিনটাতে তিনটা সংখ্যা লিখল। দশ, তেরো, সতেরো। জাদু দেখাবার জন্য বেঁছে নিল কায়েসকে। কায়েসের হাতে দশ আর সতেরো সংখ্যা লেখা কাগজ দুটো দিলো। এরপর দু হাতে নিজের ইচ্ছা মত কায়েসকে সংখ্যা দুটো রাখতে বলল যেন রাদিব দেখতে না পায়। কায়েস এক হাতে দশ, অন্য হাতে সতেরো রাখল। রাদিবের কাছে রইল তেরো লেখা কাগজটা। রাদিব বলল, "এবার হাত দুটো আমার সামনে ধরেন।"
কায়েস সামনে ধরল। রাদিব বাম হাতের উপর হাত রেখে বলল, "আমি একটা লোকের ঘটনা বলল, আপনারা ঘটনাটা মন দিয়ে শুনবেন, এ ঘটনা থেকে আমি কায়েস সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করব। ঠিক আছে?"
রাদিব ঘটনা বলা শুরু করল, "একজন ডাক্তার, নাম হ্যারল্ড শিপম্যান। যখন তার বয়স সতেরো তখন ফুসফুস ক্যান্সার হয়ে, তার মা মারা যায় । ক্যান্সারের শেষ দিকে তার মা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, ডাক্তারের সহায়তার মরফিন ইঞ্জেকশন নেয়া শুরু করেন। শেষ দিকে মায়ের কষ্ট তার মনে বিশাল রেখাপাত ফেলে।"
সবাই মনোযোগ নিয়ে গল্প শুনছে। রাদিব নিজের হাতের তেরো লেখা কাগজটা কায়েসের বাম হাতের উপর রেখে বলল, "এখন আপনাকে প্রথম প্রশ্নটা করব, তার আগে একটা কাজ করতে হবে আপনার। আমার বাম হাতে সে সংখ্যা আছে, সেটার সাথে আমার হাতের এই তেরো সংখ্যাটা গুণ করবেন মনে মনে, শেষ হলে আমাকে বলবেন। এরপর প্রশ্ন করব।"
কায়েস মনে মনে গুণ করে বলল, "শেষ।"
রাদিব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, "আমরা যে ডাক্তারের নাম বললাম, তার নাম কী?"
কায়েস একটু ভেবে বলল, "শিপম্যান।"
রাদিব একটু হেসে বলল, "সঠিক। এখন আমি গল্পের পরের অংশে যাই। তো শিপম্যান এরপর ডাক্তার হলেন, এক সময়ে তার নাম খ্যাতিও বাড়ল। মানসিক ব্যতিগ্রস্থদের নিয়ে তার একটা স্পিচ, পৃথিবী ব্যাপী বিখ্যাত। কিন্তু সে নিজে যে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল সে খবর কেউ জানত না। এক সময় একজন অভিযোগ করল, শিপম্যানের কাছে আসা রুগিদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তখন কেউ সেটা আমলে নিলো না। এমনকি পুলিশও যথেষ্ট তথ্যের অভাবে তাকে ধরতে পারল না। ঝামেলা ঘটল আরও পরে, ক্যাথলিন গ্রান্ডি নামে তার এক রুগী মারা গেল। শিপম্যান লিখে দিলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছে গ্রান্ডি। কিন্তু তার মেয়ে এটা মেনে নিলো না, কারণ গ্রান্ডি মারা যাবার আগে সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছে শিপম্যানের নামে। এর কোনো কারণই ছিল না। এরপর তদন্ত, তদন্ত শেষে ময়না তদন্তে বেরিয়ে আসলো, গ্রান্ডির শরীরে ভালো মাত্রায় ডায়ামরফিন ছিল। এই ডায়ামরফিন প্রয়োগ করেছিলেন শিপম্যান। শিপম্যানকে গ্রেফতার করা হলো, তার বাসায় খোঁজ করে সম্পত্তি জালিয়াত করার একটা টাইপ রাইটারও পাওয়া যায়। তার মৃত ঘোষণা করা আরও চৌদ্দটি লাশ, পুনরায় তুলে ময়না তদন্ত করা হয় এবং সবার শরীরে ডায়ামরফিন পাওয়া যায়। তাকে পনেরটা খুন আর গ্রান্ডির সম্পত্তি জালিয়াতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো। যদিও বলা হয়ে থাকে তিনি আড়াইশর অধিক খুন করেছেন। শেষমেশ তিনি কারাগারেই আত্মহত্যা করে নিজেই মরে গিয়েছিলেন।"
সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে কাহিনীটা শুনছিল। রাদিব কাহিনীটা শেষ করে, কায়েসের ডান হাতের উপর তেরো লেখা কাগজটা ধরল। এরপর বলল, "মনে মনে এবার আপনার ডান হাতের সংখ্যার সাথে আমার হাতের কাগজের সংখ্যাটা গুণ করুন। শেষ হলে বলবেন, শেষ। এরপর আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটা করব।"
কায়েস মনে মনে গুণ করে বলল, "শেষ।"
রাদিব দ্বিতীয় প্রশ্নটা করল, "আপনি বলুন তো তাকে কয়টা খুনের দায়ে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল?"
কায়েস চটপট উত্তর দিল, "পনেরটা।"
রাদিব স্মিত একটা হাসি হেসে বলল, "এটাও সঠিক। যেহেতু আপনি দুইটাই সঠিক উত্তর দিলেন, তার মানে নিঃসন্দেহে আপনার বাম হাতে সতেরো আর ডান হাতে দশ।"
কায়েস চোখ বড় বড় করে রাদিবের দিকে তাকিয়ে রইল। হাত খুলে দেখাল, সত্যি ডান হাতে দশ আর বাম হাতে সতেরো। মধুমিতা অতি বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে, বলেই ফেলল, "আপনি এটা কীভাবে করলেন? আপনি যে কোনো সংখ্যা দিয়েই এমন পারবেন?"
"পারার কথা।"
মধুমিতা মুখটা হাঁ করে, একটা হাত দিয়ে চেপে[ ধরে বলল, "আপনি আর কোনো জাদু পারেন?"
রাদিব একটু ভেবে বলল, "অনেক গুলোই পারি। আর একদিন এসে, মৃত থেকে জীবিত হওয়া জাদুটা দেখাবো।"
মধুমিতা যেন উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না, একটু উচ্চস্বরে বলল, "আজকে দেখান না।"
অদিত তীব্র দৃষ্টি ছুঁড়ে মধুমিতার দিকে তাকিয়ে। মধুমিতা সে দৃষ্টি গ্রাহ্য না করার ভান করল। রাদিবের অবশ্য চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা। রাদিব একটু সরে এসে মধুমিতার সামনে থেকে বলল, "এর থেকেও দারুণ ম্যাজিক অদিত সাহেব পারেন। কেমন ম্যাজিক করার মতন খুনি ধরে ফেলেন।"
অদিত রাদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, "খুনি ধরাটা ম্যাজিক না, তবে আপনি দারুণ দেখালেন। কায়েস তো পুরা বোকা হয়ে গেল।"
অদিত জানতে চাইল, "আপনি এটা করলেন কী করে? আমাদের কী শিখানো যাবে? আর ঐ গল্প আর প্রশ্নের উত্তর থেকে বের করলেন কীভাবে কোন হাতে কোন কাগজ আছে?"
রাদিবের ইচ্ছে ছিল না, জাদুটা শিখিয়ে দেবার। তবুও অদিতের কথা ফেলতে পারল না। বলেই দিল জাদুটার পিছনের রহস্য। শুনে সবাই বেশ অবাক হলো, দেখে কত কঠিন মনে হলো, অথচ কত সহজ একটা কৌশল। রাদিব আবার মনে মনে ভাবছে, পৃথিবীর জটিল সমস্যা গুলোর সমাধান বড় সহজ। দেখেও আমরা দেখি না, না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই। অনেক জটিল করে সমাধান করার চেষ্টা করে যাই। রাদিব সব কিছুকে সহজ করে শুরু করে, মাঝে মাঝে জটিলতায় এলোমেলো হয়ে যায় সব রাদিবের। প্রফেসর সাজিদ এলাহীর খুনটাও কি এলোমেলো করে দিচ্ছে রাদিবকে? এত সহজে সমাধান ভেবে নেয়াটাও কি ঠিক হচ্ছে? এখান থেকে বেরিয়ে তেজগাঁও যেতে হবে, দিদার সাহেবের বাড়ির আশেপাশে রাতের আঁধারে ঘুরে বেরাতে হবে। জটিল সমস্যার সহজ সমাধান বের করতে হবে।
(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত।)
ষষ্ঠ পর্ব
রিয়াদুল রিয়াদ