পর্ব ১ পর্ব ২ পর্ব ৩
আগের তিন পর্বে যা ঘটেছিল: ইংরেজির প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বিষয়ে ফেল করার কষ্ট মানতে না পেরে, হার্ট এটাকে মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র নাহিন। নাহিনের মৃত্যুর পর, ওর লাশ গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর নেয়ার সময় হারিয়ে যায় কিংবা পালিয়ে যায়। লাশ নিয়ে যাওয়া নাহিনের বড় ভাই দিদার বলে, নাহিনের লাশ পালিয়ে যাবার আগে কথা বলেছে। নাহিনের বন্ধু দীপ্ত ও আরিফ এ খবর দেয়ার জন্য ও নাহিনের মৃত্যুর জন্য যে সাজিদ এলাহীই দায়ী তা বলার জন্য, দেখা করে সাজিদ এলাহীর সাথে। সামগ্রিক মানসিক বিভ্রান্তিতে থাকা সাজিদ এলাহী সব খুলে বলে, তার বন্ধু অমিতের ছেলে অদিতকে। অদিত পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত। এই মানসিক কষ্ট থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তার জন্য তিনি আলাপ করেন, ডাক্তার রাদিবের সাথে।
এর মাঝে নাহিনকে একবার দেখে নাহিনের বন্ধু মিশু ও একবার এসে হাজির হয় প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বাসার সামনে। মৃত মানুষকে দেখতে পাওয়া ভালো কোনো বিষয় নয়। ডিটেকটিভ অদিত ও তার সহযোগী কায়েস নাহিনের বিষয় নিয়ে তদন্তের মাঝেই নিজ বাসায় খুন হন প্রফেসর সাজিদ এলাহী। ছুরিকাঘাতে খুন হওয়া সাজিদ এলাহীর লাশের পাশে পাওয়া যায় খুন হওয়া ছুরি, একটা সিগারেটের ফিল্টার, একটা বই যার উপর সাজিদ এলাহী কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলেন।
ডিটেকটিভ অদিত, সহযোগী কায়েস প্রফেসর সাজিদ এলাহীর হত্যা তদন্ত শুরু করে ও অদিতকে কোনোভাবে মানিয়ে প্রফেসর সাজিদ এলাহীর ডাক্তার রাদিব এ তদন্তে যুক্ত হয়। ইন্টারোগেশনের প্রথম পর্যায়ে জেরা করা হয়, সাজিদ এলাহীর নিচ তলার বাসিন্দা টাইলস ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনকে। যার সাথে প্রফেসর সাজিদ এলাহীর অর্থ সম্পর্কিত ঝামেলা রয়েছে। তাছাড়া খুনের দিন নাসির উদ্দিন যে যার দোকানে গিয়েছিল এবং রাত করে বাসায় ফিরে আসে, সে ব্যাপারটাও মিথ্যে প্রমাণিত হয়।
পর্ব ৪
৭
দিদারকে হাসপাতালে নেয়া হয়নি। মায়ের পরিচর্চায় সুস্থ হয়ে উঠেছে। শরীরে জ্বর নেই, তবে এখনও বিছানায়, শরীর খুব দুর্বল। ছেলেকে এ অবস্থায় কোনোভাবেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিবেন না মা। দিদারই মাকে রাজি করাল, এরা তদন্তে আছে, জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। এদের বাধা দেয়াটা ঠিক হবে না। দিদার বসে আছে বিছানায়, অদিত বসেছে একদম সোজা একটা ছোটো টুলে, রাদিব আর কায়েস পিছনের চেয়ারে। দিদার ক্লান্ত স্বরে বলল, "বলুন, কী জানতে চান?"
অদিত একটু কাশি দিয়ে বলল, "আপনার কাছে দুইটা বিষয়ে তথ্য নিব। প্রথমটায় আসি আমি, মানে আপনার ছোটো ভাই নাহিনের ব্যাপারে। সেদিন রাতে কী কী হয়েছিল আমাকে একটু বিস্তারিত বলুন সব।"
দিদার খুব দুর্বলভাবে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। শরীরে, কন্ঠে এখনও ক্লান্তি ও ধকলের ছাপ স্পষ্ট। তাছাড়া কথা বলতে গিয়ে গলাও ধরে আসছে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমাকে দীপ্ত ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলল, আমি বুঝলাম খারাপ কিছু হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, নাহিন আর নেই। সরকারি হাসপাতাল, সবাই অনেক ব্যস্ত। ডাক্তার আগেই নাহিনকে মৃত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমি তাও আর একজন নার্সকে ধরে নিয়ে আসলাম, সত্যি নাহিন মারা দিয়েছে কিনা। নার্সও ভিন্ন কিছু বলল না।"
"আচ্ছা, এরপর ফরিদপুর নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা?", কথার রেশ কাটার আগেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অদিত।
"আমি একটা পিকআপে নাহিনের লাশ তুলে ফদিদপুরের দিকে রওয়ানা দিলাম।"
"আপনি লাশবাহী গাড়ি বাদ দিয়ে পিক আপে কেন নিলেন?", দিদারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অদিত।
দিদার এবার মুখ তুলে তাকাল। অদিতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, "আমার মাথায় তখন অতকিছু ছিল না। আমার পরিচিত একজন পিকআপ ড্রাইভার আছে, তাকে ফোন দিয়ে আসতে বললাম। সে রাজিও হলো নিয়ে যেতে লাশ ফরিদপুর।"
"আপনি একাই লাশ নিয়ে যাচ্ছিলেন?"
"জি।"
"আর কাউকে নিলেন না যে সাথে?"
"ওর বন্ধুরা যেতে চেয়েছিল। আমিই মানা করেছিলাম। ওরা গিয়ে শুধু শুধু কী করবে? এমনিতেই ওদের অনেক ধকল গেল", বলে একটু থামল দিদার।
অদিত সাথে সাথেই বলল, "ওকে কন্টিনিউ।"
"আমরা তখন বেশিদূর যাইনি। সাভার ছাড়িয়ে ধামরাইয়ের কাছাকাছি। দু পাশের রাস্তা সুনসান, নীরব। একটা দুইটা হাইওয়ে বাস চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। ড্রাইভার আমাকে বলল, 'দিদার ভাই, ভয় লাগাতাছে।' আমি বললাম, 'ভয়ের কী আছে? গাড়ি চালাও।' সে বলল, 'আগে কখনও লাশের গাড়ি নিয়া যাই নাই। এই প্রথম। আমি শুনছি মাঝ রাতে লাশের গাড়িতে নানা রকম অদ্ভুত কাজ কারবার হয়। তাই গাড়ি চালানির সময় ড্রাইভররা, মাল পানি খাইয়া নেয়। আমি তো ওগুলা ছুঁই না।' ড্রাইভারের সাথে সাথে আমার যে ভয় লাগছিল না তেমন না। আমিও ভয় পাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই হুট করে মনে হলো, আমাদের পিছনের কাঁচে কেউ সজোরে আঘাত করছে আর চিৎকার করে বলছে, 'ঐ শোরের বাচ্চা, ঐ শোরের বাচ্চা গাড়ি থামা, কই নিয়া যাস?' আমরা দুজনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ফেলল। ভয়ে ভয়ে আমরা পিছনে গ্লাস দিয়ে তাকালাম। অন্ধকারে যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তবুও বুঝতে বাকি রইল না, নাহিন উঠে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে আমার পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারাচ্ছি। আমার পাশের ড্রাইভার, ভূত ভূত করে চিৎকার করছিল। এর মাঝেই নাহিনের লাশ পিকআপ থেকে নেমে রাস্তার পাশের জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। আমার ভয়ে পেটে মোচড় দেয়াটা ক্রমশ বাড়ছিল। পাশের ড্রাইভার কী বলছিল আমি কিছুই বুঝছিলাম না। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার ঢাকার দিকে ছুটল। আমি কিছুই টের পাচ্ছিলাম না যেন, কী হচ্ছে না হচ্ছে। ড্রাইভার আমাকে ফার্মগেট নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পুরো ঘটনা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘটল। এরপর আমার জ্বর আসলো, আমি বিছানায়।"
অদিত চুলগুলো দুই হাতের আঙুল দিয়ে টেনে পিছনে নিতে নিতে বলল, "আপনার ভাইয়ের লাশের ব্যাপারে পরে আর খোঁজ খবর করেছেন বা পুলিশকে জানিয়েছেন?"
দিদার মাথা নিচু করেই বলল, "জি না।"
"ভাইয়ের লাশ হারিয়ে গেল, এ নিয়ে আপনার কোনো মাথা ব্যথা নেই?"
দিদার কাতর হয়ে বলল, "আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি খোঁজ খবর নেয়ার মত অবস্থায় ছিলাম না।"
বলতে বলতে চোখ ভিজে আসল দিদারের।
অদিত দিদারের দিকে ঝুঁকল, ঝুঁকে বলল, "এমন কি কোনো সম্ভাবনা আছে যে, পুরো ব্যাপারটাই আপনার সাজানো?"
দিদার কথাটা শুনে বিস্ময় আর বিষাদে হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, "কী বলছেন আপনি এসব? আমার সাজানো মানে?"
"মানে বললাম আর কি। আপনি জানেন যে আপনার ছোট ভাইকে ইতোমধ্যে কয়েকজন দেখেছে?"
বিস্ময় ভরা চোখে দিদার জিজ্ঞেস করল,"মানে?"
"মানে আপনার মৃত ভাইকে মিশু সাহেব দেখেছেন, আরিফ সাহেব দেখেছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা নিজ কক্ষে খুন হওয়া প্রফেসর সাজিদ এলাহীও দেখেছেন। আপনিও দেখেছেন কি? কিংবা কথা হয়েছে?"
দিদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল অদিতের দিকে। কিছু ভাষা খুঁজে বেরাচ্ছে কায়েস আর রাদিবের দিকে তাকিয়েও। কোনো কথা বের হলো না মুখ দিয়ে দিদারের। মনে হচ্ছে গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে আছে কথা গুলো। অদিত আবার জানতে চাইল, "আপনি কিন্তু উত্তর দিলেন না।"
নিজেকে একটু সামলে ভারী হয়ে আসা গলায় উত্তর দিলো দিদার, "আমি দেখিনি। আর এরা দেখেছে সে ব্যাপারেও আমি কিছু জানি না।"
"এখন কথা হচ্ছে, আপনার ভাই মারা গিয়েছে। একটা মরা লাশকে কেউ দেখছে, এটা তো বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা না।"
"কিন্তু নাহিন তো মারা গিয়েছে। আপনাদের বিশ্বাস না হলে, হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন।"
অদিত টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাদিব আর কায়েসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলল, "আপনাদের কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?"
দুজনেই একসাথে মাথা নাড়িয়ে না বলল। অদিত আবার দিদারের কাছে ফিরে আসলো।
"তাহলে আপনার কাছে আপাতত এ পর্যন্তই জানার ছিল। আমরা আবার আসতে পারি।"
অদিত দিদারের সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। কী ভেবে আবার ফিরে আসলো। বিধ্বস্ত দিদারের কাছে এসে বলল, "আর একটা কথা জানার ছিল। আপনি গত পরশু, মানে ছয় তারিখ সন্ধ্যার পর থেকে কোথায় ছিলেন?"
দিদার এলোমেলো চাহুনিতে ঘরের চারপাশটা দেখে বলল, "আমি বাসাতেই ছিলাম। হালকা জ্বর ছিল তখনও, তাই কোথাও বের হইনি। কেন?"
"আপনার কোনো অ্যালিবাই আছে?"
হাঁ করে তাকিয়ে রইল দিদার, যেন কথাটা ঠিক বুঝতে পারেনি।
“মানে আপনি যে সেদিন এখানেই ছিলেন, তার কোনো সাক্ষী আছে আপনার?” অদিত আবার জিজ্ঞেস করে।
"আমার মা, আমার পাশেই ছিল। আমার মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি সারারাতই জেগে ছিলেন। আপনি মাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।"
অদিত বিনয়ী হাসি হেসে বলল, "ধন্যবাদ। তার আর দরকার নেই।"
"আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?"
"এমনিতেই। আপনার সাথে কি প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কখনও দেখা হয়েছিল?"
দিদারের সোজা উত্তর, "জি না। আমি তাকে কখনও দেখিনি। নাহিন মারা যাবার দিন, শুধু দীপ্তদের মুখে ওনার নাম শুনেছিলাম, ও পর্যন্তই।"
অদিত এবার আর কথা বাড়াল না। বেরিয়ে আসলো দিদারের ফ্ল্যাট থেকে। বেরিয়ে আসার সাথে সাথে রাদিব বলল, "অদিত সাহেব, আমার একটা জিনিসের ব্যাপারে খুব আগ্রহ হচ্ছে।"
"কী ব্যাপার?"
"নাহিন সাহেবকে নিয়ে এত কাহিনী। নাহিন সাহেবকেই তো আমরা দেখলাম না। একটা ছবি নিয়ে আসি ওনার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।"
অদিত বাধা দিলো না। রাদিব ভিতরে গিয়ে একটা ছবি নিয়ে আসলো। কায়েস মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, "আপনার কি গন্ডারের ব্রেন নাকি? সব কিছু এত পরে মনে পড়ে। ওখানে থাকতে মনে করতে পারলেন না?"
রাদিব শুকনো হাসি হেসে বলল, "গন্ডারের চামড়া মোটা, ব্রেনের বিষয়ে এমন কোনো অভিযোগ আমি কোনোদিন শুনিনি।"
অদিত চোখ বড় করে কায়েসের দিকে তাকাতেই, কায়েস চুপসে গেল। কথা বাড়ল না আর। ছবিটা মনোযোগ নিয়ে দেখল অদিত। দেখে আবার রাদিবের কাছে ফেরত দিলো। রাদিব বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, "ওটা আপনার কাছেই রাখুন। আপনি চিফ ডিটেকটিভ, আমরা তো সহযোগী।"
অদিত মনে মনে ভীষণ খুশি হলো, এই ডাক্তার সাহেব অকারণেই এত উপরে তুলছে অদিতকে। অথচ অদিত কিন্তু অমন কিছুই না।
রাত বাড়ছে। তেজগাঁওয়ের এই অলি গলির রাস্তা দিয়ে আবার যেতে হচ্ছে। অদিত গাড়ি চালাচ্ছে, আজ রাদিব বসেছে অদিতের পাশে, কায়েস পিছনের সিটে। রাদিবের না-কি কী জরুরি কথা আছে অদিতের সাথে। অন্ধকার গলি ধরে যাবার পথেই রাদিব বলল, "অদিত সাহেব, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।"
"বলেন, সমস্যা নেই।"
"মানে আপনি সব সাক্ষীর কাছেই জিজ্ঞেস করছেন সন্ধ্যার পর কোথায় ছিল। এটা কেনো? খুনটা তো সন্ধ্যার আগেও হতে পারে।"
অদিত হালকা শব্দ করে হাসল, গাড়ির গতি একটু কমিয়ে ধীরে ধীরে সামনে আগাতে আগাতে বলল,"এই ব্যাপার? এর কারণ হলো, আমি নিশ্চিত খুনটা সন্ধ্যার পরেই হয়েছে। আমাকে প্রফেসর সাজিদ এলাহী সন্ধ্যার দিকে ফোন দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে সব কিছুই বলেন। তার সাথে কথা বলার মাঝে তিনি বললেন, কাউকে তিনি এসে থাকতে বলবেন কিনা তার সাথে রাতে। আমি তাকে সোজা না বলে দিয়েছি। আমি বলেছি যদি ওনার একা থাকতে ভয় লাগে, আমি এসে থাকব।"
"তারপর?"
"তারপর উনি বললেন, ওনার ভয় লাগবে না। সমস্যা নেই। এরপরের ঘটনা তো জানেনই।"
রাদিব অন্ধকারে অদিতের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময়। অদিতকে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে রাদিব। রাদিবকে বিজয় সরণি পার করে নামিয়ে দিলো অদিত। গাড়ি ছুটে চলল লাভ রোড ধরে গুলশানের দিকে। অদিত নেমে যাবার আগে আগামীকাল দাওয়াত গিয়ে দিয়েছে তার বাসায় খেতে যাবার জন্য রাতে। রাদিব আকাশের দিকে তাকাল, আজ ডিসেম্ববের আট তারিখ, চাঁদের বয়সও আট দিন, মোটামুটি গোল হতে শুরু করেছে। এলোমেলো মেঘ চাঁদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাদিব কিছু হিসাব মিলাচ্ছে, খুব জটিল তবে খুব সহজ সমাধানের হিসাব। খুব সহজ সমাধানগুলোই মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকেও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়, বিভ্রান্তিতে ক্লান্ত করে দেয়। ঝাপসা হয়ে আসা কুয়াশার মাঝেই চাঁদের মিটিমিটি আলোতে রাদিব একটা মুখচ্ছবি দেখল, একটা মোটর সাইকেলের পিছনে বসা সে মুখচ্ছবি। অল্প একটু দেখাতেই সে চেহারার আবছা আলো আবছা আঁধারে চিনতে পারল রাদিব। আসলেই কি সত্যি দেখেছে রাদিব? রাদিবের দৃষ্টি বিভ্রম হবার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে এর পিছনের কারণটা কী? রাদিব ভেবে যায়, মাথার উপর চাঁদ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই।
৮
ভার্সিটি হলে গিয়ে আরিফ এবং মিশুকে পাওয়া গেলেও, দীপ্তকে পাওয়া গেল না। গেস্ট রুমে বসেছে অদিত, কায়েস আর রাদিব। ক্যান্টিন বয় এসে তিনটা কোকের বোতল দিয়ে গেল। দিয়ে যাবার সময় বলল,"স্যার, আপনারা কি পুলিশের লোক?"
অদিত হাসি দিয়ে জানতে চাইল, "কেন বলতো?"
"স্যার, নেতারা খুব বাকি খায়, টাকা দেয় না। আপনারা হ্যাগোরে ধইরা নিয়া যান।"
অদিত আবার হেসে উঠল।
"না, আমরা পুলিশের লোক না।"
ছেলেটা এ উত্তরে খুব হতাশ হলো, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হয়ত এ অভিযোগ ও বহুজনের কাছে করেছে, কখনও কোনো সমাধান পায়নি। তবু জনে জনে অভিযোগ করে যায়, যদি কখনও কোনো সমাধান এসে ধরা দেয়। কোকের বোতল গুলো রেখে হতাশ মুখে বেরিয়ে গেল গেস্ট রুম থেকে ছেলেটা।
আরিফ এবং মিশু দুজন একসাথে গেস্ট রুমে এসে বসল। অদিত একটু নম্রতা দেখিয়ে বলল, "আবার আপনাদের একটু বিরক্ত করতে আসলাম। সময় হবে তো, তাই না?"
আরিফ শুকনো মুখে বলল, "অবশ্যই স্যার।"
"আপনাদের বন্ধু দীপ্ত সাহেব কোথায়?"
"ও তো বাড়িতে গিয়েছে, মানিকগঞ্জ।"
অদিত চোখ ছোট ছোট করে বলল, "কবে এই ঘটনা?"
"মানে?"
"মানে কবে গিয়েছে?"
"স্যার পরশু দিন।"
"পরশু দিন মানে, সাত তারিখ, তাই তো?"
"জি, সকাল বেলাতেই।"
"আচ্ছা।" চিন্তিত ভঙ্গিতে অদিত বলল, "আপনার বন্ধুর নাম্বারটা বলুন একটু। কায়েস, নাম্বারটা টুকে নাও।"
আরিফ মোবাইল বের নাম্বারটা বলল, কায়েস নাম্বারটা টুকে নিলো। অদিত বলে যায়, "আপনাদের বেশি সময় বিরক্ত করব না। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেই হবে।"
মিশু তখনও চুপ করে আছে। কোনো কথাই বলছে না। অদিত বলে যায়, "আরিফ সাহেব, আপনি বলুন তো, আপনি গত মঙ্গলবার মানে ছয় তারিখ সন্ধ্যার পর থেকে কোথায় কোথায় ছিলেন?"
আরিফ স্পষ্ট ভাষায় বলল, "আমি হলে এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। দিদার ভাইয়ের ওখানে থেকে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম অনেক। টানা ধকলে শরীর আর নড়ছিল না, আমি সন্ধ্যার দিকে ওখান থেকে ফিরে এসে ঘুমিয়ে যাই। একদম পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি।"
অদিত মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, "আর আপনি?"
মিশু আবার আমতা আমতা করতে লাগল। অদিত বলল, "আপনি বলুন, ভয় পাবার কিছু নেই।"
মিশু বলে, "আমি তো আরিফের সাথেই এসেছি হলে। মানে আর কি এসে ঘুমিয়ে গেছি।"
"আপনিও সকালে উঠলেন একেবারে?"
"জি।"
অদিত রাদিব আর কায়েসের দিকে তাকাল। ওদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, "তার মানে আপনারা একজন অন্যজনের ব্যাপারে জানেন না, এর মাঝে কেউ ঘুম থেকে উঠেছিলেন কিনা?"
আরিফ আর মিশু দুজন দুজনের দিকে তাকাল। আরিফ বলে, "উঠবার কথা কেন আসছে? আমরা তো ঘুমাচ্ছিলাম।"
"আর আপনাদের বন্ধু দীপ্ত?"
আরিফ চিন্তা করল, একটু ভেবে বলল, "দীপ্ত আমাদের সাথে আসেনি। বলল কাজ আছে, এরপর কোথায় যেন চলে গেল। আচ্ছা আমাদের এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।"
"আপনাদের শিক্ষক প্রফেসর সাজিদ এলাহী যে মারা গিয়েছেন, এ ব্যাপারে তো আপনারা জানেন, তাই তো? না জানার কথা না, আপনাদের হলে শোক বার্তা লাগানো দেখলাম।"
"হ্যাঁ জানি,” বেশ রসকষহীনভাবে উত্তর করল আরিফ।
"উনি খুন হয়েছেন, নিজ রুমে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর।"
আরিফ আর মিশুর মুখে রক্তশূন্য সাদাটে একটা ভাব চলে আসলো। মিশু কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বলল, "আমরা স্যারকে মারব কেন? কী বলেন আপনি?"
অদিত ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল, "সে খবর তো আমি জানি না। আর আপনারা খুন করেছেন সেটাও আমি বলছি না, আপনাদের খুন করার যথাযোগ্য কারণ আছে, তাই আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা। আপনাদের বন্ধু, প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কারণে মারা গেল, তার প্রতি একটা ক্ষোভ, রাগ থাকাটা তো অস্বাভাবিক ব্যাপার না।"
আরিফ অদিতের দিকে তাকিয়ে মনের মাঝে রাগ চেপে, শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল, "স্যার বিশ্বাস করুন, আমরা দুজন একসাথে এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজে সকাল বেলা মিশুকে ঘুম থেকে তুলেছি।"
"আপনাকে তো মিশু সাহেব তুলেননি।"
চরম হতাশায় চোখ বন্ধ করে ফেলল আরিফ, এবার আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, মুখ থেকে উচ্চারণ করে ফেলল, "বাল, বলতেছি আমি এসবের কিছু জানি না।"
অদিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "খুন না করলে তো আমরা প্রমাণ করতে পারব না, আপনি খুন করেছেন। এভাবে উত্তেজিত হবার তো কিছু দেখছি না।"
আরিফ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, "আপনি তো আমাকে কারণ ছাড়া দোষারোপও করতে পারেন না, তাই না?"
মিশু আরিফকে ধরে শান্ত হতে বলল। অদিত গেস্ট রুম জুড়ে পায়চারী করতে লাগল। আরিফের দিকে ঝুঁকে বলল, "দেখুন এভাবে উত্তেজিত হবার কিছু হয়নি। আমি এই খুনের তদন্তে আছি, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারি। আপনাদের অ্যালিবাই থাকলেই তো বিষয়টা সমাধান হয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে মুখ খারাপ করার মতন কোনো ঘটনা এখানে ঘটেনি।”
আরিফ নিজেকে একটু সামলে নিলো, শান্ত হবার চেষ্টা করল, পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, "সর্যি আমি। আমার অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায়।"
"ইটস ওকে। এবার আমরা একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। মিশু সাহেব নাহিন সাহেবকে দেখেছেন সে খবর আমরা জানি। আপনার ব্যাপারটা বলুন।"
"আমি নাহিনকে দেখেছি, এটা আপনাকে কে বলেছে?"
"সেটা তো জরুরী ব্যাপার না। ঘটনাটা বলুন।"
আরিফ মুখ কালো করে বলে যায়, "বুধবার রাতে আমি দিদার ভাইদের বাসায় যাই। ওনার মা আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন, সে খাবার নিয়ে আসতে। রাত তখন বেশি না, সাড়ে দশটার মতন। একটু শীত পড়াতে মানুষ কম ছিল বাহিরে, একেবারে নেই বললেই চলে। দু একটা রিকশা ছিল কিন্তু কোনো রিকশাই যেতে রাজী হয় না। শেষমেশ হাঁটতে শুরু করলাম। অল্প অল্প ভয় করছিল না, তা না। মিশুর কথা মনে পড়ে আরও ভয় লাগছিল যে, নাহিনকে দেখেছে। আমি তখন তেজকুনিপাড়া, ওখান থেকে বিজয় সরণি ফ্লাইওভারে উঠবার একটা সরু রাস্তা আছে। ওটার পাশ থেকে যাবার সময় মনে হল আমার পাশে খচর মচড় করে একটা আওয়াজ হচ্ছে। আমি পাশে তাকাতেই চমকে উঠি, দেখি একটু দূরেই নাহিন দাঁড়িয়ে। অল্প অন্ধকারে চেহারা না বুঝতে পারলেও ঠিক ভাবে, আমি নিশ্চিত ছিলাম ওটা নাহিন। কোন নড়াচড়া ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিনা আমি জানি না। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ছিল, পালাতে হবে। আমি খাবার গুলো ফেলে রেখেই দৌড়ে চলে আসি। কতদূর আসতেই একটা রিকশা পাওয়াতে সে রিকশা চেপে হলে আসি।"
অদিত মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনল। সোফার কোণায় আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে বলল, "আপনারা দুজনেই আপনাদের বন্ধুকে দেখেছেন। দুজনের কারও সাথেই নাহিন সাহেব কথা বলেননি। দুজনেই দেখেছেন কাছাকাছি জায়গায়। যাই হোক, ধন্যবাদ আপনাদের। অনেক সময় দিলেন। আপনাদের কাছে আর জানার কিছু নেই। আমি বিকেল বেলা আর একবার আসব, আপনাদের বন্ধু দীপ্তকে আসতে বলছি, বিকেলের মধ্যে। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতে অত সময় লাগবার কথা না। আপনারা নামাজ পড়ুন জুম্মার। এতগুলো মানুষ একসাথে নামাজ পড়ছে, দৃশ্যটা দেখতেও ভাল লাগে।"
অদিত উঠে দাঁড়াল, দুজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে আসলো। রাদিবও আরিফের সাথে হ্যান্ডশেক করার সাথে সাথে জড়িয়েও ধরল একবার, পিঠে আস্তে করে চাপড় দিয়ে বলল, "অতি রাগ, অতি বিপদজনক।" এরপর কানের কাছে আস্তে করে কিছু বলল, সে কথা অন্য কারও কান পর্যন্ত পৌছাল না।
দীপ্ত এসে পৌছাল ভার্সিটি হলে, তখন বেলা সাড়ে তিনটা।
৫ম পর্ব
(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত। )
রিয়াদুল রিয়াদ