somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিটেকটিভ, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার: মধ্য বৃত্ত

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রফেসর সাজিদ এলাহী, বয়স সাতান্ন। ইংরেজি বিষয়ের প্রফেসর। লম্বা চওড়া শরীর, গায়ের রং হালকা তামাটে। প্রতিদিন সকালে উঠে এক ঘণ্টা করে হাঁটাহাঁটির কারণে এখনও শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট নয়। শুধু চুল আর নাকের নিচের মোটা গোঁফের বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে সাদা হয়ে যাওয়া দেখে অনুমান করা যায়, বয়স কম হয়নি প্রফেসর সাজিদ এলাহীর। প্রতিদিন সকালে হেঁটে এসে তিনি, চায়ের কাপ হাতে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসেন। বারান্দা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে এদিক ওদিক দেখেন। সকাল বেলার দারুণ স্নিগ্ধ হাওয়া লাগে শরীরে। প্রতিদিনকার মতন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা মাত্র, কলিং বেল বেজে উঠল। একবার দুইবার না পর পর তিনবার। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালেন প্রফেসর সাজিদ এলাহী। কপাল কুঁচকে নিচে তাকিয়ে খেয়াল করলেন, যে দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দুজনই তার পরিচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র দীপ্ত ও আরিফ। প্রফেসর সাজিদ এলাহী হাতিরপুলের যে বাড়িটায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন, সে বাড়িটায় কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। নিচে সারি করে সাজানো কলিং বেলের সুইচ। তিনি থাকেন এ বাড়ির পঞ্চম তলায়। নিচ থেকে কলিং বেল চাপলে, উপর থেকে চাবি ফেলতে হয়, সে চাবি দিয়ে মেইন গেটের তালা খুলে তবেই উপরে আসা সম্ভব। এই দুই ছেলে এমন ভোরবেলা কী কাজে এসেছে তার কাছে সে বিষয়ে কোনো ধারণা তিনি করতে পারছেন না কিংবা করতে চাচ্ছেন না। এমনিতেই তিনি কিছুটা মানসিক বিভ্রান্তিতে ভুগছেন গতকাল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হার্ট এটাক করে মারা গিয়েছে। কয়েকজন বলাবলি করছে, প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বিষয়ে ফেল করার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, প্রচন্ড মানসিক কষ্টে ছেলেটা হার্ট এটাক করেছে। কেমন একটা অস্বস্তিকর অবস্থা! একটা ছেলে কেন এতটা দুর্বল চিত্তের হবে? একটা বিষয়ে ফেল করার কারণে হার্ট এটাক করে মরে যাবে? ব্যাপারটা এমন না যে, ঐ ছেলে জানত না যে, সে ফেল করবে। ছেলেটা পরীক্ষার খাতায় কিছুই লেখেনি, একদমই কিছু না। ফেল করাটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। মানসিকভাবেও প্রস্তুত থাকা দরকার ছিল তাই। চাবি ফেলবেন কিনা বার কয়েক ভেবে, তিনি উপর থেকে চিৎকার করে বললেন, "কে?"
নিচ থেকে ছেলে দুটো উপরে তাকিয়ে উত্তর দিলো, "স্যার, আমরা।"
"কী দরকার?"
"স্যার, একটু কথা বলতাম।"
প্রফেসর সাজিদ এলাহী একটা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে উপর থেকে দড়িতে বাঁধা কৌটার মধ্য করে চাবিটাও ফেললেন।

দীপ্ত ও আরিফ চাবি দিয়ে মেইন গেট খুলে, উপরে এসে সোফায় বসল। প্রফেসর সাজিদ এলাহী দরজা খুলেই রেখেছিলেন। তিনি এসে চশমা চোখে দুজনের দিকে তাকালেন। কিছুটা বিরক্ত তিনি হচ্ছেন। ছেলে দুটো ভালো মাত্রায় বেয়াদব। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বেয়াদবিগুলোকেই আবার বিপ্লব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যে যত বেয়াদব, সে তত বিপ্লবী। তিনি এসে সামনে বসলেন, ছেলে দুটো সালাম তো দূরের কথা, উঠে পর্যন্ত দাঁড়াল না। আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন প্রফেসর সাজিদ এলাহী, "হ্যাঁ বলো, কী দরকার আমার কাছে?"
দীপ্তই কথা বলা শুরু করল। ছোট-খাটো শরীর জিম করার কারণে দারুণ গঠন পেয়েছে। পরে আছে কালো রঙের ফুল হাতা টি-শার্ট আর জিন্স, টি-শার্টের বুকে চে গেভারার ছবি। প্রফেসর সাজিদ এলাহী ভাবেন, এই ছেলে নিশ্চিত ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিজম, সোস্যালিজম এসবের সাথে যুক্ত, না হয় বুকে চে গেভারা নিয়ে ঘুরে বেরানোর কথা না।
"স্যার, নাহিনের ব্যাপারটা তো শুনেছেন, তাই না?"
একটু শক্ত গলায় বলল দীপ্ত। পাশে বসা লিকলিকে শরীরের আরিফ চুপ করেই রইল। কথাটা প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কান পর্যন্ত পৌঁছালেও, দীপ্তর কথা বলার ভঙ্গি তার পছন্দ হয়নি এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বোঝাবার জন্য, দ্বিতীয় বার দীপ্তর কাছ থেকে কথাটা শুনবার জন্য বললেন, "বুঝলাম না, কী বললে?"
দীপ্ত কিছুটা বিরক্তি মুখে এনে বলল, "নাহিনের ব্যাপারটা শুনেছেন?"
প্রফেসর চশমা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবলেশহীন গলায়, "আচ্ছা নাহিন, ঐ ছেলেটা গতকাল হার্ট এটাকে মারা গেল?" কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন ব্যাপারটা তার জীবনে খুব গুরুত্ববহ কিছু নয় এবং জনা চারেক শিক্ষক দুপুরের খাবার খেতে খেতে এই ব্যাপারে আলাপ করেছেন, সেখান থেকে আবছাভাবে তার কানে তা এসেছে।
“জি স্যার,” বেশ শান্ত গলায় কথাটা বলল দীপ্ত।

নাহিন দীপ্তর বড় কাছের বন্ধু। দুটোকে ক্যাম্পাসে বেশির ভাগ সময় একই সাথে দেখা যেত। ক্লাসেও বসত একসাথে, ক্লাসে অনিয়মিত নাহিনের অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে দীপ্তই নাহিনের এটেনডেন্স প্রক্সি দিয়ে দিত। ক্লাস টেস্টে নাহিন দীপ্তর খাতা হুবহু নকল করে পরীক্ষা দিয়ে, ফাইনালে পাস করার কিছু নাম্বার যোগাড় করে রাখত। কিন্তু ফাইনালে তা সম্ভব হতো না। দুজনের সিট দু জায়গায়। ফলাফল নাহিন এই সেমিস্টারে এসে প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বিষয়ে ফেল করল। ফেল করে মরে গেল। একটা অস্বস্তিকর ঝামেলায় তাকে ফেলে রেখে চলে গেল।

প্রফেসর সাজিদ এলাহী খুব করে ব্যাপারটাকে গুরুত্বহীন প্রমাণের জন্য, স্বাভাবিক এবং স্বভাবত ছাত্রদের উপর কর্তৃত্বপ্রবণ গলায় কথা বলতে চেয়েও বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন। তিনি চশমাটা চোখে পরে, ধরে আসা গলায় বললেন, "হ্যাঁ, আবার কী হয়েছে?"
দীপ্ত গলার স্বরে একটু কাঠিন্য এনে বলল, "স্যার, নাহিনকে ফেল না করালেও পারতেন আপনি।"
প্রফেসর প্রতিউত্তর করলেন, গলায় অধৈর্যের ভাব নিয়ে,"দেখো, একটা টিচার কখনও কোনো ছাত্রকে ইচ্ছা করে ফেল করায় না, আমি তোমাদের খাতা যথেষ্ট কন্সিডার করে দেখেছি। এখন একটা ছেলে যদি খাতায় কিছুই না লেখে, ফাঁকা খাতা জমা দেয়, আমি পাস করাবো কোন হিসাবে? ফাঁকা খাতায় মার্কস দিয়ে আমি ভরে রেখে দিব?"
"আপনি এটা তো মানেন স্যার, আপনার জন্য নাহিন মরে গেল?", প্রফেসর যতটা বিচলিত হচ্ছেন, নিজের মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন, দীপ্ত ততই নিস্পৃহ ও শান্ত গলায় জবাব দিচ্ছে।
প্রফেসর সাজিদ এলাহী এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না, দীপ্ত আর আরিফের দিকে ঝুঁকে, মোটামুটি চড়া গলায় বললেন, " নো, নাহিন ভালো করেই জানত, ও ফেল করবে এই বিষয়ে। এটাতে এত শকড হবার কোনো প্রশ্নই আসে না, যে মরে যাবে।"
দীপ্তর মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন না আসলেও, গলার স্বরে আরও কিছুটা কাঠিন্য ভর করল, "কিন্তু স্যার মরে তো গেল।"
প্রফেসর রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন, এই ভোরের হালকা শীতল হাওয়াও তার শরীরের চামড়ায় চৈত্রের দাবহাদের অনুভূতি দিচ্ছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমিয়ে দিচ্ছে, তিনি চিৎকার করে বললেন " তোমরা এসব বলতেই এই ভোরবেলা আমার এখানে এসে হাজির হয়েছ?"
দীপ্ত যেন ভেবেই নিয়েছিল এমন কিছু একটা ঘটবে, সোফায় হেলান দিয়ে আলতো হেসে বলল, "না, স্যার। আপনাকে একটা বিষয় জানাবার জন্য এসেছি।"
প্রফেসর পায়চারি করতে লাগলেন, নিজের রাগ কমাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। অন্যদিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “কী বিষয়, বলো?”
"গতকাল রাতে নাহিনের লাশ ওর গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর নেবার সময় হারিয়ে গেছে।"
প্রফেসর সাজিদ এলাহী থেমে গেলেন, কিছুটা দ্বিধার চোখে দুজনের দিকে তাকালেন। দীপ্তর কথার মানেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। আবার সোফার কাছে ফিরে এসে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, "মানে?"
"মানে, লাশ নিয়ে বাড়ি যাবার সময় লাশ হারিয়ে গেছে। ওর বড় ভাই বলছেন, নাহিনের লাশ না-কি কথা বলেছে। একা একাই পালিয়ে গেছে।"
বাম হাত দিয়ে নিজের পিঠের পিছন দিকটা চুলকাতে চুলকাতে দ্বিধার চোখে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, "কী আবল তাবল বলছ?"
"আবল তাবল না স্যার। এটাই সত্যি। নাহিনের লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না," এতক্ষণে নীরবতা ভাঙল আরিফ, একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, " নাহিনের বড় ভাই এবং যে পিকআপে করে লাশ যাচ্ছিল, সে পিকআপের ড্রাইভার, দুজনেই সাক্ষী।"
প্রফেসরের দ্বিধান্বিত ভাব কাটছে না। অস্থিরতা বাড়ছে ভিতরে ভিতরে।
"একটা ছেলে মারা গিয়েছে, তার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া কী করে সম্ভব?"
এবার দীপ্ত উঠে দাঁড়াল, উঠতে উঠতে বলল, "জানি না স্যার। তবে মনে হলো, আপনাকে বিষয়টা জানানো দরকার। যত যাই হোক, আপনার জন্যই তো মারা গিয়েছিল নাহিন।"
"তোমরা কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ?", দাঁড়িয়ে থাকা দীপ্তর দিকে তাকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
দীপ্ত একটা স্মিত হাসি হেসে বলল, "না স্যার। আসি আমরা এখন তাহলে, আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম।"
আরিফও উঠে দাঁড়াল। দুজন একসাথে দরজার কাছে যেতেই পিছন থেকে প্রফেসর দুজনকে ডাক দিলেন, "শোনো।"
দুজনে পিছন ফিরে তাকাল, "জি স্যার?"
"তোমরা কি ছাত্র ইউনিয়ন কর? মানে কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্ট টাইপের কিছু?"
দীপ্ত উপরের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে, খানিক পরে উত্তর দিলো, "না স্যার। আমরা কোনো ইউনিয়নই করি না। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই আমরা যুক্ত না।"
"আচ্ছা।"
দীপ্ত আর আরিফ এবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। প্রফেসরের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এত বড় বাড়িটায় তিনি একা থাকেন। বিয়ে করেননি তাই বাচ্চা কাচ্চা থাকারও প্রশ্ন আসে না। প্রতিদিন বিকাল বেলা, এক বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। দুপুরের খাবার তিনি হোটেল থেকে এনে সারেন কিংবা হোটেলে গিয়েই খেয়ে নেন। প্রায় সন্ধ্যায় প্রফেসর সাজিদ এলাহীর কাছে কেউ না কেউ আসে, কখনও কয়েক জন। গল্প করেন, আড্ডা দেন, একা জীবনে এই আড্ডাটাই তার ভালো থাকার ওষুধ। আবার রাতের বেলা একা ঘুমাতে চলে যান। প্রফেসর সাজিদ এলাহীর মনের মাঝে খচখচ করছে। যদি সত্যি নাহিনের লাশ পালিয়ে গিয়েই থাকে, দেখা করতে আসবে না তো প্রফেসর সাজিদ এলাহীর সাথে? তিনি বার কয়েক ঘুরে বেরালেন পুরো ঘর জুড়ে। মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। অস্থিরতা কমছে না। এডগার এলান পো এর 'টু হেলেন' কবিতাটা পড়লেন
On desperate seas long wont to roam,
Thy hyacinth hair, thy classic face,
Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece,
And the grandeur that was Rome.

অনেকের মতে এই কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন তার কালজয়ী কবিতা 'বনলতা সেন', তবু মনের মাঝের অশান্ত ভাব প্রশমিত হচ্ছে না। একটা অবান্তর ভাবনায়, ভয়ে তিনি ম্লান হচ্ছেন, ব্যাপারটা হাস্যকর একই সাথে প্রচণ্ড চিন্তার। এই মুহূর্তে মাথায় আসছে শুধু একজনের কথাই, অমিতের ছেলেটার কথা। অমিতের ছেলেটা মাঝে মাঝেই আড্ডা দেয় এখানে এসে। অমিত প্রফেসর সাজিদ এলাহীর বেশ কাছের বন্ধু, সেই কলেজ জীবন থেকেই। টেলিফোনটা হাতে নিয়ে প্রফেসর সাজিদ এলাহী অমিতের ছেলের নাম্বারে কল করলেন, মনে হচ্ছে বড় বিপদে পড়েছেন তিনি, অমিতের ছেলেটা এ বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করতে পারবে। ওপাশ থেকে 'হ্যালো' শব্দটা ভেসে আসতেই মনে হলো চিন্তার ভার অর্ধেকটা কমে গিয়েছে।


নাহিনের লাশ হারিয়ে যাবার পর, দিদার আবার ঢাকায় ফিরে এসেছে। দিদার নাহিনের বড় ভাই। দিদারের স্বল্প পরিসরের গার্মেন্টস এক্সেসরিসের ব্যবসা। ব্যবসায় মোটামুটি ভালো লাভ হয়। দুই ভাইয়ের দারুণ চলে যায়, নাহিনের পড়ালেখার খরচও আসত সেখান থেকে। ফরিদপুরে মা থাকেন, বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। মাকে বহুবার বলা হয়েছে ঢাকা এসে দিদার আর নাহিনের সাথে থাকতে, মা রাজি নন। শহরে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
দিদারের পাশে দীপ্ত, আরিফ আর মিশু বসে আছে। গত রাতের ঘটনায় মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছে দিদার। সকাল বেলা জ্বর এসেছে, একটু পর পর কেঁপে উঠছে শরীর। দীপ্ত, আরিফ আর মিশু বসে আছে ঘটনাটা আরও পরিষ্কারভাবে জানার জন্য। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা, যার কোন ব্যাখ্যাই হতে পারে না। মৃত লাশের হেঁটে পালিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই বেশ অদ্ভুত ঘটনা। যে কাউকে বললে তা অবিশ্বাস করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ঠিক কী ঘটেছিল, তাই জানার আশায় বসে ওরা তিনজন। পিকআপ ড্রাইভার লাপাত্তা, পুলিশের কানে এখনও খবর যায়নি। খবর গেলে আবার আরেক ঝামেলা, নানা জিজ্ঞাসাবাদ, কীভাবে কী হলো! দিদার এখন কোনো জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দেবার পরিস্থিতিতে নেই। ফরিদপুর খবর গিয়েছে, নাহিনের মা রওয়ানা দিবেন সকাল বেলা। তার আগ পর্যন্ত দীপ্ত, আরিফ আর মিশু এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিদারকে দেখার মত কেউ নেই। আরিফ একবার বলেছে, ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার। নাহিনের লাশ পাওয়া যাচ্ছে না এটাও তো একটা চিন্তার বিষয়। পুলিশের সাহায্য ছাড়া লাশ খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। ভিন্ন কথা বলেছে অবশ্য দীপ্ত, ওর কথা হলো, এখনই জানাবার কোনো মানেই হয় না। দিদার ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। এই অবস্থায় পুলিশি ঝামেলায় আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। পুলিশ এসে সরাসরি সন্দেহ করবে দিদার ভাইকে। এদের তো কাজই একটা, যত সহজে কাউকে ফাঁসিয়ে দেয়া যায়। লাশ পালিয়ে যাবার ব্যাপার স্যাপার পুলিশ কখনই বিশ্বাস করবে না।

রাত হয়েছে ভালো, ঘড়িতে এগারটা বাজতে তিন মিনিট বাকি। ঘরে বাজার করা আছে, তবে দীপ্ত, আরিফ, মিশু তিন জনের কেউই রান্না করতে জানে না। ভার্সিটি হলে থাকে, হলের ডাইনিংয়েই খাবার খায়। এখন পেটের মধ্যে চো চো করছে। বাহিরে গেলে এক দুইটা হোটেল খোলা পাওয়া যেতে পারে। খাবার পার্সেল করে নিয়ে আসা যায়। দিদার ভাইয়েরও কিছু খাওয়া দরকার। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে। দীপ্ত আর মিশু দুজনে খাবার কেনার জন্য বেরিয়ে আসলো। দিদারের সাথে রইল আরিফ। দিদারের ভাড়া নেয়া বাসাটা তেজগাঁও-এ, অলিগলি ভরা এলাকা। একটু রাত হতেই কেমন যেন নিশ্চুপ বাহিরের দিকটা। গোটা কয়েক লোক যদিও হাঁটা চলা করছে, তবুও এই গলিগুলো খুব একটা নিরাপদ না। রাত হলেই ছিনতাইকারীরা দল বেঁধে গলি দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে। একা কাউকে পেলেই সুযোগ বুঝে সব হাতিয়ে নেয়। দীপ্ত, মিশু দুজন থাকাতে এখন যদিও ভয়টা কম। তবুও অন্ধকার গলি দিয়ে হাঁটবার সময় মিশুর শরীরটা কেমন যেন শিরশির করছে, নাহিনের কথা ভেবেই কিনা জানে না মিশু। মৃত মানুষের প্রতি বরাবরই একটা ভয় কাজ করে মিশুর। কখনও কোনো মৃত লাশ দেখেনি এই ভয়ে। নাহিন কাছের বন্ধু, মারা গেল, না আসলে দেখতে সবাই স্বার্থপর বলবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই কাল এসেছিল। একটা মানুষ এই দিব্বি বেঁচে আছে, হাসছে, কথা বলছে, ভালো কথা, নোংরা কথা, আবার এই হুট করে মরে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত একটা জিনিস। চরম অবিশ্বাসী মানুষটাও মৃত্যুকে বিশ্বাস করে, ভয় করে। মৃত মানুষ দেখে একবার হলেও ভাবে, আমিও অমন মরে যাব একদিন। একবার হলেও ভাবে, সব ছেড়ে ভালো হয়ে যাই। গলি ধরে হাঁটার মাঝেই দীপ্ত হঠাৎ বলল, "মিশু তুই একটু সামনে যা। আমি একটু করব।"
মিশু কিছুটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, "কী করবি?"
"আরে প্রস্রাব করব।"
"এই গলির মধ্যে?"
"গলির মধ্যে ধরলে এখন কী করব?"
"আমি একা একা সামনে যাব, এই অন্ধকারে?"
"তো কী করবি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুতা দেখবি? ব্যাটা, ছেলে মানুষ এতো ভীতু হলে হয়? সামনে যা, আমি করে আসতেছি।"
মিশু অনিচ্ছা নিয়েই সামনে এগিয়ে গেল। আবছা আলো, আবছা আঁধার গলিতে। আশেপাশের বাড়ি গুলো থেকে যা একটু আলো আসছে, সেটুকুই। আর কোনো আলো নেই। মিশুর অকারণেই ভয় লাগছে। হাত পা সব জমে আসছে। মনে হচ্ছে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ কথা বলছে। কথা গুলো বড় অস্পষ্ট। বাতাসের শব্দের চেয়ে গাঢ় তবে মানুষের কণ্ঠের চেয়ে গূঢ়। মিশুর হুট করেই মনে হলো, পাশের গলি থেকে উঁকি দিয়ে কেউ মিশুকে দেখছে। টকটকে লাল চোখ জোড়া মিশুর বড় পরিচিত। থেমে গেল মিশু, সামনে পা বাড়াবার সাহস হচ্ছে না। পাশের গলির চোখ জোড়া এবার পুরো মাথা বের করল, অন্ধকারে স্পষ্ট না দেখা গেলেও, একটা পরিচিত মুখ আঁধারেও চিনতে পারাটা অস্বাভাবিক কিছু না। মনের ভুল না সত্যি দেখছে মিশু বুঝতে পারছে না। মিশুর ইচ্ছে করছে দৌড়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু মনে হচ্ছে পা জোড়ার ওজন কয়েক মন বেড়ে গিয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও পা এক বিন্দু নাড়াতে পারল না। গলার কাছে এসে কিছু একটা দলা পাকিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে মিশুর। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করল চিৎকার করবার। শেষমেশ চিৎকার করে দীপ্তকে ডাক দিলো। মিশুর চিৎকারে দীপ্ত দৌড়ে ছুটে চলে আসলো। মাথা ঘুরিয়ে আবার গলির ওদিকটায় তাকাতেই দেখল, সেই পরিচিত লাল চোখ জোড়া, পরিচিত অবয়ব মিলিয়ে গেছে কোথায় যেন। কোনো চিহ্ন নেই। দীপ্ত এসে মিশুকে আবিষ্কার করল খুবই ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়। ভয়ে হাঁপাচ্ছে মিশু। দীপ্ত মিশুর গায়ে হাত দিয়ে একটু নাড়া দিয়ে বলল, "ঐ, কী হইছে?"
মিশু হাঁপাতে হাঁপাতে বার দুয়েক ঢোক গিলে বলল, "নাহিন।"
ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দীপ্ত মিশুর দিকে জানতে চাইল, "কী নাহিন?"
মিশু আঙুল উঁচু করে, গলির সে দিকটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, "ঐ যে ওখানে আমি নাহিনকে দেখেছি। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।"
দীপ্ত ওপাশটায় তাকিয়ে কিছু না পেয়ে, মিশুর পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলল, "তুই শালা ভালো ভীতু আছিস। মনে মনে ওগুলা ভেবে এখন নাহিনকে দেখছিস।"
"আমি সত্যি দেখছি।"
"নাহিন আসবে কই থেকে রে ভাই? হুদাই একটা কথা বললি। চল খাবার নিয়ে আসি।"
মিশু আর কথা বাড়াল না, দীপ্তর পাশে চুপচাপ চলতে লাগল। নাহিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুই দীপ্ত। নাহিনের মৃত্যু সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে, বেদনা দিয়েছে দীপ্তকেই। তবু দীপ্ত বেশ স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে। কিছু কষ্ট, কিছু ব্যথা কাউকে দেখাবার জন্য না। একা একা নিভৃতে অনুভব করার জন্য। দীপ্তর মন খারাপ করে থাকলে চলবে না। ওতে কষ্টের পরিমাণটা বুঝানো যাবে না। হাউ মাউ করে কাঁদতে হবে, একা একা চিৎকার করে কাঁদতে হবে। কাছের মানুষ গুলোকে হারাবার বেদনা কেউ হুট করে বুঝে না। অভিনয় করে স্বাভাবিক থাকার পিছনে বুকের ভিতর জমা এক রাশ কষ্টের ভার কেউ অনুভবও করতে পারে না। এ অভিনয় গুলো বড় বিচ্ছিরী। সবার সামনে কাঁদতে না পারাটাও একটা ব্যর্থতা। কাঁদতে সবাই পারে, সবার সামনে কাঁদতে সবাই পারে না।
দীপ্ত মনে মনে চাচ্ছে, মিশু যেটা দেখেছে সেটা সত্যি হোক। খাবার নিয়ে ফেরবার সময়ও দীপ্ত একবার গলির ঐ জায়গাটায় চোখ বুলালো। কিছু একটা খুঁজে গেল। দীপ্ত চায় নাহিন ফিরে আসুক। হয় নাহিনের কায়া আসুক, না হয় ছায়া আসুক, কিংবা অশরীরী কিছু হয়ে আসুক, শুধু ফিরে আসুক নাহিন। দীপ্তর এই আকুলতাটুকু অন্তত বুঝুক নাহিন, ফিরে এসে বলুক, "বন্ধু, চলে এলাম। তোদের ছাড়া বড় কষ্টে ছিলাম।"
তবু দীপ্তর মনের একটা অংশ বলছে, মৃত্যু মানে অনন্ত কালের জন্য হারিয়ে যাওয়া। মৃত্যু মানে তুমি আসতে পারো, কখনও ফিরে যেতে পারো না।

(২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার তৃতীয় উপন্যাস মধ্য বৃত্ত)
২য় পর্ব

রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১১:৫০
১১টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×