১
আমি মেয়েটার পিছনে ঘুরছি প্রায় ঘন্টা চারেক ধরে, খেয়াল রাখছি দিন তিনেক। মেয়েটা হয়ত বুঝে গিয়েছে ব্যাপারটা আমি ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছি এতোটা সময়। এই ব্যাপার গুলোতে ছেলেদের থেকে মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্রুত সাড়া দেয়। কে তাকাল, কোথায় তাকাল, কীভাবে তাকাল, ঠিক কতটা সময় ধরে আশেপাশে ঘুরঘুর করল, খুব সহজেই বুঝতে পারে মেয়েরা। ছেলেরা এসব ব্যাপারে এত খুঁতখুঁতে নয়। মেয়েটা বুঝতে পারলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি এই কাজ আজ নতুন করছি না, ভালো সময় অতিবাহিত হয়েছে এই কাজে আমার। কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় আমি জানি।
মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ, সুন্দরী; টিপিক্যাল বাঙালি মেয়েদের চেয়ে উচ্চতা বেশি, শরীর ভারী। হাতা কাটা জামার সাথে মেয়েটা একটা ক্রপ লেন্থ জিন্স পরেছে, দারুণ লাগছে এতে। আমি খুঁজে খুঁজে এমন মেয়েই বের করি, যাদের দিকে একবার তাকালে, দ্বিতীয় বার তাকাতে ইচ্ছা করে, তৃতীয়বার ইচ্ছা করে, বার বার ইচ্ছা করে। অনেক কিছুই নিজেকে আকর্ষণ করে।
সংসদ ভবন এলাকা থেকেই মেয়েটার পিছনে আমি, ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট আসলো, বাসে চড়ল, শাহবাগ নেমে টিএসসি গিয়ে আড্ডা দিলো ঘন্টা খানেক। পুরোটা সময় আশেপাশেই ছিলাম আমি। এত মেয়েটা মেয়েটা কেনো করছি আমি? মেয়েটার নাম আমি জানি, টিএসসিতে ওকে অনেকবার এই নামে ডাকা হয়েছে। মেয়েটার নাম সাইমুন। বেশ অপ্রচলিত একটা নাম। এই নামের মেয়ে আমি প্রথম পেলাম। মেয়েদের নাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আ-কার বা ই-কার দিয়ে শেষ হয়। সে হিসাবে নামটা বেশ আলাদা বলা যায়। অবশ্য আ-কার কিংবা ই-কার ছাড়া শেষ হওয়া অধিকাংশ মেয়ের নাম আমি 'ন' দিয়েই শেষ হতে দেখেছি- শারমিন, তাজরিন, মেহেরিন, তাজনিন, জেসমিন, জেরিন সব নামের শেষে 'ন'। সে হিসাবে মেয়েটার নাম ঠিকই আছে বলা যায়।
গত সপ্তাহে আমি যে মেয়েটার পিছু নিয়েছিলাম ওর নাম ছিল নিহা। খাটো করে, কিন্তু বেশ আকর্ষণীয় দেখতে। মেয়েটার বাসা মিরপুর। উত্তরা এসে ক্লাস করত ভার্সিটির। ওর ক্লাসের সময়টা আমি ভার্সিটির বাহিরে বসে ছিলাম পাকা চার ঘন্টা। একবার চেষ্টা করেছিলাম ওর ভার্সিটির ভিতরে যাবার, সে অনুমতি দারোয়ান ব্যাটা দেয় নি। আমি নিবৃত্ত হয়ে জায়গা বেছে নিয়েছিলাম ভার্সিটির সামনের ফুটপাথে। বিরক্তিকর চারটা ঘন্টা শেষে যখন নিহা বেরিয়ে আসলো, আমার ভিতর কী যে এক প্রাপ্তির আনন্দ খেলা করছিল, আমি তা বুঝাতে পারব না। কিন্তু হুট করেই নিহা আমার হাত ছাড়া হয়ে যায়। ভার্সিটি শেষে ও একটা সিএনজি ভাড়া করে মোহাম্মদপুরের দিকে চলে গেল। আমি আর খুঁজে পেলাম না, হারিয়ে ফেললাম। চার ঘন্টার অপেক্ষা একদম বৃথা গেল। আমি মিরপুরে ওর বাসার সামনের সরু গলিতে অনেক রাত অবধি দাঁড়িয়ে ছিলাম, ও আসেনি। কিংবা এসেছিল অনেক আগেই, আমার চোখে পড়েনি।
আমি এবার এমন ভুল করছি না। সাইমুন বাসের যে সিটটায় বসে আছে, আমি তার ঠিক পিছনের সিটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাইমুনকে। যে তৃপ্তি আমি পেয়েছিলাম রিমির পিছনে সারাটাদিন ব্যয় করে, সে তৃপ্তি আমি সাইমুনকে দিয়েও পাবো। আমি জানি। সাইমুন আমার আর হাতছাড়া হচ্ছে না। কোনোভাবেই না। রিমিকে আমি চাইলেও ভুলে যেতে পারি না, প্রায় পাঁচ ছয় জনের পর রিমিকে দিয়ে আমার সফলতা আসে। মেয়েটার চেহারা এখনও আমার চোখে লেগে আছে। কী মিষ্টি করে হাসত মেয়েটা! রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকত সবাই। রিমি বেশ লাজুক মেয়ে, সাইমুনের মত এতোটা বোল্ড না। কেউ তাকালেই চটজলদি নিজেকে সামলে নিত, ওড়না পেঁচিয়ে নিজেকে আড়াল করবার চেষ্টা করত। ঐ এক টুকরা কাপড়ে কি আর নিজেকে আড়াল করা যায়? যে তাকাবার, তাকাবেই। সুন্দর জিনিসের প্রতি সবার আজন্ম আগ্রহ। সে আগ্রহ রিমি দমিয়ে দিতে পারত না কোনোভাবেই। রিমির মগবাজারের বাসায় যাবার গলির মোড়েই ঘটনাটা ঘটল। আমার তৃপ্তি, পরিপূর্ণ তৃপ্তি। রাত তখন দেড়টা, কেউ টের পায়নি, একদম না।
আমার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম; নয়টা বাইশ। আমার ঘড়ি ছয় মিনিট আগানো, মানে সময় এখন নয়টা ষোলো। অত রাত হয়নি। তবু আমি আশাবাদী। রাস্তার জ্যাম আমাকে সে আশা দেখাচ্ছে। সাইমুন যখন বাস থেকে নামল, তখন সময় সাড়ে দশটা। গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সাইমুন, পিছন পিছন আমি। একবার পিছন ফিরে তাকাল। আমার সাথে চোখাচোখি হবার ঠিক আগেই আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সাইমুন ঠিক এবার ধরে ফেলল, আমি ওকে অনুসরণ করছি। হাঁটার গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সাইমুন। আমি অতটা বাড়ালাম না, বেশ ধীর স্থির গতি বজায় রেখে এগিয়ে চললাম। এসব কাজে কখনও তাড়াহুড়া করতে নেই, মাথা ঠান্ডা রেখে বুঝেশুনে সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়। সুযোগ আসেই, আজ বা কাল। সাইমুন যখন এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা, আমি তখনও হালকা গতিতে এগিয়ে চলছি। সাইমুন ওর বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে। আর মাত্র একটা গলি পেরুলেই ওর বাসা। আমি ব্যর্থ হচ্ছি, এবারও ব্যর্থ হচ্ছি। বাসার কাছাকাছি গিয়ে সাইমুন থেমে গেল। গলির মাথার জনা চারেক ছেলের সাথে কথা বলছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। নিশ্চিত খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে। আমি লুকিয়ে পড়েছি একটু অন্ধকার দেখে। মেয়েটা হয়ত বাসায় ফিরে যাবে, ফিরেই যাচ্ছে। আমার উপর কতটা অভিমান, কতটা রাগ নিয়ে আমি জানি না।
২
আমি বসে চা খাচ্ছি, সাইমুনদের বাসার সামনে, এখানে ভালো রকম জটলা পেকেছে। সাইমুন বাসা থেকে বের হয়েও সেই জটলার দিকে গেল। পুলিশ চলে এসেছে, সমাধান একটা এবার নিশ্চিত হবে। একটা লাশ পড়ে আছে সাইমুনদের বাসার সামনে। লাশটা দেখে সাইমুনের মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। কী অনুভূতি হচ্ছে আমি জানি না। হয়ত সাইমুন নিজেও জানে না। চায়ের বিল দিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সাইমুন আমার দিকে তাকাল একবার, আর একবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের দিকে। সাইমুনের বিস্ময়ের রেশ কাটেনি এখনও। আমি ধীর পায়ে সরে আসলাম ওখান থেকে। আমি টের পাচ্ছি, সাইমুন পিছন পিছন আসছে আমার। তাকালাম না আমি। একটা চলন্ত বাসে ধপ করে উঠে বসে গেলাম।
পুরো বাসে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সাত আটটা মেয়ে আছে, এর মাঝে কাউকে বেছে নেয়াটা আজ কি জরুরী? নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম নিজে। মন থেকে উত্তর আসল, না, আজ নয়।
আমার বাসা রামপুরাতে। বাসার দরজা খুলে আমি বিছানার উপর শুয়ে পড়লাম। আমার পাশের রুমটাই মিলির। আমার ছোট বোন মিলির। ঘরটায় তালা মারা। আজন্ম কালের জন্য তালা মেরে দেয়া হয়েছে।
সাইমুন যে জনা চারেক ছেলের সাথে কথা বলছিল, তাদের একজনের লাশ পড়ে আছে সাইমুনের বাসার সামনে। মাত্র একজনকে। বাকী তিনজন ঠিক বেঁচে আছে। ওরা বেঁচে থাকুক। এই তিনজনের আর সাইমুনকে বিরক্ত করার সাহস হবে না। কিংবা ভাবনাও আসবে না। নিয়মিত গলির মুখে সাইমুনের এটা ওটা বাজে কথা শুনতে হবে না। প্রতি রাতে একা গিয়ে কাঁদতে হবে না। রিমির যেমন এখন আর গলির মোড়ে কোন বাজে ইঙ্গিত, কথা শুনতে হয় না ঠিক তেমন। আমি কাল আবার নিহার বাসার সামনে যাব। সারাটাদিন নিহার পিছন পিছন ঘুরব, কে তাকায় বাজে করে তা দেখব, কে করে বাজে ইঙ্গিত তা শুনব। সুযোগ বুঝে একজনকে টুক করে নাই করে দিব।
এ শহর বিশুদ্ধ হবে, আমি তা আশা করি না। তবে মিলির মত বাজে কথা শুনে এসে সিলিং ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে না পড়ুক- একজন, দুইজন বা পাঁচ ছয় জন, আমি তা চাই। কিছু পাপ হোক, সে পাপে কিছু পাপ মুছে যাক। এ শহরের বাতাসে অল্প করে হলেও কিছু আতঙ্কে স্বস্তি নামুক। কেউ কেউ অন্তত মিলি না হোক।
০৮-১২-২০১৮
রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:২৪