ছেলেটাকে গত সপ্তাহ থেকে আশেপাশে দেখছে বর্ষা। ক্লাসে ঢুকবার সময় গেটের কাছে, ক্লাস থেকে বের হয়েও একই জায়গায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময়ও আশেপাশে। ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার সময়ও একটু দূরের টেবিলে। বাসে উঠার সময় বাস স্ট্যান্ডে। তবে বাসে উঠে বাসা পর্যন্ত আসে না। কোনদিন কাছে এসে কথাও বলে না। প্রতিদিন একটা লাল টি শার্ট আর একটা নীল জিন্স পরে আশেপাশে ঘুরে। বর্ষা কোনভাবে ছেলেটার দিকে তাকালেই, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে, গুতাগুতি করে। এমন একটা ভাব ধরে যেন এতক্ষণও তাই করছিল। এই এক সপ্তাহ দেখতে দেখতে কেন যেন, বর্ষা নিজেও আশেপাশে ছেলেটাকে খুঁজে। না চাইলেও একটু পর পর তাকায়। ভার্সিটিতে আসার আগে অনেক সময় নিয়ে সাজগোজ করে। অকারণ কিছু কাজ করছে জানে। একটা ছেলে ওর পিছু পিছু ঘুরছে। ফলো করছে। ভাল লোক না হয়েও, খারাপ লোকও হতে পারে। কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য হতে পারে। বাবার শত্রু পক্ষের লোক হতে পারে। তবুও ছেলেটাকে ভেবে সাজগোজ করছে। আজ সকালে কপালে একটা ছোট কালো টিপ দিল। গায়ে জড়িয়ে রাখা, কালো রঙের শাড়ির সাথে মিলিয়ে। কালো শাড়িতে বর্ষাকে সুন্দর লাগে। বর্ষা জানে। বেশ জানে। কালো হল শোকের রঙ। তবুও কালো রঙের শাড়িতে বর্ষাকে মানায়। অনেক ভালই মানায়। বর্ষা কালো শাড়ি পরে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে কারও দিকে তাকালে, কেউ মনের মাঝে কখনও শোকের কথা আনতেও পারবে না। আয়নায় নিজের দিকেই অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। চোখ ফেরাতে সময় লাগছিল। অন্য কারও আরও বেশী সময়ই লাগার কথা। শাড়ি পরে বের হবার সময় মা জিজ্ঞেস করলেন, তোদের ভার্সিটিতে আজ কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি?
- না তো মা।
- তাহলে শাড়ি পরেছিস কেন?
- অনুষ্ঠান ছাড়া কি শাড়ি পরা যায় না?
- যায়। কখনও পরিস না তাই জানতে চাইলাম।
- কখনও পরি নি, আজ পরলাম। আম্মু আমাকে সুন্দর লাগছে না?
- তোকে সবসময়ই সুন্দর লাগে।
- উহ, সবসময়ের কথা জানতে চাচ্ছি না। এখন লাগছে কিনা বল?
- হ্যাঁ লাগছে।
- যে কেউ দেখলে পছন্দ করবে না বল?
- কাকে পছন্দ করাতে যাচ্ছিস তুই?
- কাউকেই না।
বলে বর্ষা বের হয়ে আসে। আজ বর্ষা ক্লাস করবে না। ক্যাম্পাসে বসে থাকবে। ছেলেটা কি করবে দেখবে। ছেলেটা কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে দেখবে। শাড়ি পরে ক্যাম্পাসে বসে আছে বর্ষা। আজ এখনও আসে নি ছেলেটা। মিরা এসে তাড়া লাগাল, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। চল।
- যা তুই। আমি আজ করব না ক্লাস?
- কেন?
- এমনি।
বর্ষা বসে থাকে অনেকটা সময়। বার বার শূন্য চোখে তাকায় পথের দিকে। ভাবে আসবে বোধহয় ছেলেটা। আসে না। পাগলামি করছে বর্ষা জানে। তবুও করছে। মাঝে মাঝে কিছু পাগলামি মানুষ, মনের অজান্তে করলেও, সেসবে মনের টান থাকে। যেমন বর্ষা জানে, এসব খুব অপ্রয়োজনীয় একটা কাজ। ছেলেটাকে জানে না, চিনে না। তার জন্য সেজে গুজে বসে আছে। তবুও এসবে মনের টান আছে, তাও জানে। মনের টান না থাকলে কখনই এসব করত না।
ক্লাস শেষে সবাই বের হয়ে আসে। আড্ডা চলে। তবে আড্ডায় মন দিতে পারে না বর্ষা। বারবার চোখ পথের দিকে। ছেলেটা আসে না। বন্ধুরা বলে খুব সুন্দর লাগছে বর্ষাকে। সেসব বর্ষাকে ছুঁয়ে যায় না। বিকেল হয়ে যায়। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েও বার বার চোখ বুলায় আশেপাশে। হয়ত শেষ মুহূর্তে ছেলেটা এসে দাঁড়াবে। আসে না। বাসের সিটে জানালার পাশে বসে, বাহিরে তাকিয়ে অকারণেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। কালো শাড়ির কোণা দিয়ে সেই জল মুছে ফেলে বর্ষা। খুব অভিমান হয় অজানা, অচেনা একজনের উপর। কপাল থেকে টিপটা খুলে বাসের জানালায় লাগিয়ে রাখে। পাশে বসেছে কম বয়স্ক এক ছেলে, সেই ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে কান্না দেখে। রাগ লাগে বর্ষার। ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বলে, এটা মহিলা সিট না? আপনি এখানে বসছেন কেন? উঠেন।
ছেলেটা ভয়ে উঠে যায়। এরপর বর্ষা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আবার কাঁদে। এতো দিনের জীবনে এই প্রথম কোন ছেলেকে ভেবে কাঁদছে বর্ষা। তাও অজানা অচেনা কেউ। কখনও কোন ছেলের প্রতি দুর্বল হয় নি, হতেও চায় নি। মনে মনে ভেবে নিয়েছিল, বাবা মা যাকে ঠিক করে দিবে তার সাথেই জীবন গুছিয়ে নিবে। তাকেই ভাল লাগাবে, ভালবাসবে। ঐ পিছু নেয়া ছেলেটার প্রতি, ভাললাগা ভালবাসা হয়ত নেই। তবুও কিছু একটা কাজ করছে, অকারণেই। মনে ব্যাপার গুলো এতো সহজে বুঝে নেয় যায় না। এমনকি নিজের মন হলেও না। কাঁদছে যেমন অকারণে এখন বর্ষা। মনের দোষে। তবে বুঝতে পারছে না, কারণ কি। বাস থেকে নেমে সোজা বেসিনে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিল। চোখের জল ধুয়ে নিল। এর পরের সময়টা, দরজা আটকিয়ে শুয়ে থাকা অনেকটা সময়। হঠাৎ মা এসে দরজায় টোকা দেন।
- মা একটু দরজাটা খুলবি?
দরজা খুলে বর্ষা। মা ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বলেন, কি রে, এই সন্ধ্যা বেলা ঘরের লাইট বন্ধ করে রাখছিস কেন? মন খারাপ, নাকি শরীর খারাপ?
- এমনি মা। একটু ঘুমিয়ে গেছিলাম। কোনটাই খারাপ না।
- একটু ফ্রেশ হয়ে ভাল কাপড় পরে নে তো।
- কেন?
- তোকে বলেছিলাম না একটা ছেলের কথা? সাজিদ নাম। তোর বাবার বন্ধুর ছেলে। ডাক্তার। ওরা আজ আসবে।
- কেন?
- কেন আবার? তোকে দেখতে। দেখ ছেলে পছন্দ হয় কিনা?
- তোমাদের পছন্দ হয়েছে তো?
- হ্যাঁ। ছেলে তো অনেক ভাল। মাঝে দুই দিন আমাদের বাসায় এসেছিল । তুই ভার্সিটিতে ছিলি। তাই দেখা হয় নি। কথা বললাম। অনেক ভদ্র।
- আচ্ছা যাও তুমি। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
বর্ষা সোফার একপাশে মাথা নিচু করে আছে। তার ঠিক বিপরীত পাশে সাজিদ। বর্ষা তাকাচ্ছে না মুখ তুলে। শুধু কানে কথা আসছে। বাবা মা আর সাজিদের বাবা মা কথা বলছেন অনর্গল। আড্ডা জমিয়ে দিছেন। ছেলের গুণগানে একেবারে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন। ছেলেও চুপ করে বসে আছে। সাজিদের মা বললেন, বর্ষা মা তো এমনিই অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে। ওকে তো সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি।
বর্ষা ঠিক মনে করতে পারছে না, এই মহিলাকে আগে কখনও দেখেছে কিনা। কিন্তু তিনি বলে দিলেন, সেই ছোট বেলা থেকে দেখছেন।
মা বললেন, বর্ষা, সাজিদের সাথে কথা বল।
বর্ষা মুখ তুলে তাকাল। সাজিদ তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে। বর্ষা প্রথমে তাকিয়ে একটু চমকে উঠল। বুকের ভিতর ধক করে উঠল। কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সামলে নিল। টাই, কোট পরা ছেলেটার চেহারা অনেকটা সেই ছেলেটার মত। যে ছেলেটা পিছু নিয়েছিল। যেই ছেলেটার জন্য কালো শাড়ি পরে, কপালে কালো টিপ দিয়ে গিয়েছিল। সারাটা দিন অপেক্ষা করেছে। বাসের ভিতর কান্না করেছে। তবে সাজিদের গায়ের রঙ ফর্সা, ঐ ছেলেটার গায়ের রঙ একটু শ্যামলা। সাজিদকে দেখেই বোঝা যায়, সাজিদ অনেক লম্বা। তবে ঐ ছেলেটা এতো লম্বা না। সাজিদ একটু স্বাস্থ্যবান। আর ঐ ছেলেটার শরীর একটু শুকনা করে। তবে চেহারায় অনেক মিল আছে। অনেকটা মিল। প্রথমে সাজিদকে দেখে বর্ষা ঐ ছেলেটা ভেবেই চমকে উঠেছিল। তবে আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে, ঐ ছেলের সাথে সাজিদের অনেক অমিল। কাছাকাছি চেহারার পৃথিবীতে অনেকেই আছে। তাছাড়া বর্ষার চোখে ঐ চেহারাটা গেঁথে গেছে, তাই মিল পাচ্ছে। ওসব কিছু না। সাজিদের সাথে কথা বলল বর্ষা। আসলেই অনেক ভদ্র করে ছেলেটা। বর্ষা যখন চুপ করে থাকে, সাজিদও। কিছুই বলে না। বেশী কিছু কথা হয় নি। কেমন আছে, কি খবর, এসব আর কি। মাঝে শুধু কথা বলার মধ্যে এটুকু বলেছে, আমাকে অপছন্দ হলে সরাসরি বলে দিও। আসলে এই যুগে এসে, জোর করে বিয়ে করার পক্ষে আমি না।
সাজিদ কোনভাবেই অপছন্দ করার মত ছেলে না। কোন দিক দিয়েই না। তাছাড়া বড় কথা, সাজিদকে বর্ষার বাবা মা দুজনেই অনেক পছন্দ করেছে। এরপর আর কিছুই বলার থাকে না।
এরপর দুই দিন ভার্সিটি বন্ধ। যায় না বর্ষা। এরপর যেদিন ভার্সিটিতে আসে। চোখে পড়ে আবার সেই ছেলেটা। আসলে চোখ গুলোই খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু আজ খুব রাগ লাগে ছেলেটার উপর। ক্লাস শেষেও দেখে ছেলেটাকে। তবে ছেলেটাকে আজ খুব বিষণ্ণ লাগে। বারবার কেমন যেন করছে। মনে হচ্ছে খুব অস্থির। বর্ষার আশেপাশে একটু বেশীই ঘুরছে। আজ বর্ষা তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। বিষণ্ণ চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বর্ষা বুঝতে পারে ছেলেটা কিছু বলতে চায়। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। বর্ষাও কিছু বলতে চায়। ছেলেটা কি পেয়েছে? এভাবে একটা মেয়ের পিছনে ঘুরবে, বিরক্ত করবে, বখাটে পানা ছুটাবে আজ বর্ষা। নিজে থেকেই ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আর ছেলেটা লাল টিশার্ট পরে আসেনি। আজ এসেছে একটা নীল, সাদা পাঞ্জাবী পরে। ছেলেটাকে ভাল লাগছে দেখতে। তবে বর্ষার মনে রাগ। ভাল লাগার সময় না এখন। বর্ষা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, এই যে, আপনার সমস্যা কি? সেই কবে থেকে দেখছি, আমার পিছনে পিছনে ঘুরছেন। আমাকে ফলো করছেন। কি পেয়েছেন আপনি হ্যাঁ? যেখানে যাই, সেখানেই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসব না অনেক দেখেছি, বুঝছেন? এরপর থেকে খবরদার আমার আশেপাশে আপনাকে যেন না দেখি। খারাপ হবে তাহলে। বখাটেপানা একদম দেখিয়ে দেব।
ছেলেটা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে। কিছু বলছে না। বর্ষার রাগ আরও বাড়ছে।
- আপনি কিছু বলবেন? কিছু বলার থাকলে বলেন, নয়ত যান এখান থেকে।
ছেলেটা তাও চুপ। বর্ষা একটু খেয়াল করে দেখল, ছেলেটার কানে এয়ারফোনের মত কিছু একটা লাগান। বর্ষার কথা হয়ত কিছুই শুনেনি। গান শুনেছে এতক্ষণ। বর্ষা রাগ দেখিয়ে বলল, আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান এখান থেকে।
ছেলেটার চোখটা ভিজে এসেছে। বর্ষার ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হচ্ছে। তবে মায়া বাড়াতে চায় না, বর্ষা। ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজল। কিছুক্ষণ খুঁজে একটা কাগজ বের করল। বর্ষার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিল। বর্ষা সেটা হাতে নিতেই, কিছু না বলেই ছেলেটা হাঁটতে লাগল। চলে গেল। পিছন ফিরে তাকাল না। বর্ষাও পিছন থেকে ডাক দিল না। তবে বর্ষার বুকের ভিতর কেমন যেন করছিল। সেসবকে এবার পাত্তা দিল না। ভাবল ফেলে দিবে হাতের কাগজটা। কিন্তু কি মনে করে, কাগজটা ব্যাগে রেখে দিল।
বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল, ছেলেটা নেই। হয়ত থাকার কথাও না। বাসের জানালাটার পাশের সিটে বসে, অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব পার করে, ব্যাগের ভিতর থেকে কাগজটা বের করল বর্ষা। কাগজটা খুলল। চিঠি রকম একটা কাগজ। এই যুগেও কেউ চিঠি দেয়। মুখে বিরক্তি নিয়েও, বুকের ভিতর অন্য রকম একটা অনুভব নিয়ে, পড়তে লাগল কাগজের লেখাগুলো। হাতের লেখা বাচ্চা ছেলেদের মত। ছাড়া ছাড়া হাতের লেখায় লেখা।
বর্ষা,
তুমি করেই বললাম। বয়সে তুমি আমার ছোট। আমি কে, কেন এমন পিছন পিছন ঘুরছি হয়ত অনেকদিন ধরে ভাবছ এটা। নয়ত কখনও ভাবার সময় সময়ই পাও নি। আমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে সেই দিন থেকেই ভাবছি, প্রতিটা মুহূর্ত। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি। নামটা বলে নেই? শারার। তোমাকে প্রথম দেখি, জীবিত তোমাকে না। একটা ছবির ভিতর আটকে থাকা অবস্থায়। আমার বড় ভাইটার সাথে আমার খুব ভাব। আমার একমাত্র ভাল বন্ধু আমার বড় ভাইটা। ওর সব কিছুতেই আমার অধিকার আছে। কখনও কোন মানা নেই। সেদিন ওর ড্রয়ার খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে একটা খাম পেলাম। খামের ভিতর একটা কাগজে অনেক কিছু লেখা। তোমার নাম ঠিকানা, কোথায় পড় এসব। সাথে তোমার একটা ছবি। ছবিটা দেখেই আমি জানিনা আমার কি হল। আমার বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠল। আমার কোনদিন কারও ছবি দেখে, কিংবা সামনাসামনি দেখেও এমন হয় নি। এক মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, একে আমার চাই। একে আমার দরকার। এর জন্য আমি সব করতে পারি। মুহূর্তেই ভুলে গেলাম, হয়ত এই মেয়েকে বড় ভাইটার জন্য পছন্দ করেছে। ছবিটা লুকিয়ে নিয়ে রাখলাম নিজের কাছে। বুক পকেটে। রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে ছবিটা দেখি অনেকটা সময়। বার বার কানে বাজে, নয়নও সমুখে তুমি নাই, নয়নেরও মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই।
রাতটা কাটতে চায় না। মনে হয় একে সামনা সামনি না দেখলে আমি পাগল হয়ে যাব। পরদিন সকালে চলে যাই তোমার ভার্সিটিতে। অনেক খুঁজি, পাই না। সারাদিন খুঁজি। এরপর দিনও না। তিন দিনের দিন, তোমাকে দেখলাম। দেখলাম তুমি ছবির চেয়েও অনেক বেশী সুন্দর। দূর থেকে দেখি তোমাকে। তোমাকে যত দেখি মুগ্ধ হই। মুগ্ধতা যত বাড়তে থাকে, তোমাকে পাবার আশা তত ক্ষীণ হয়। একটা সময় বুঝতে পারি, আমার সাথে তোমার হয় না, চলে না। তবুও তোমাকে না দেখে, থাকতে পারি না। আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে প্রায় নিশ্চিত। সেদিন আমার বাবা মা, আর সাজিদ ভাইয়া, তোমাদের বাসায় গিয়েছিলেন। আমাকে হয়ত তুমি এতদিনে বখাটে ভেবেছ। কিন্তু আমার ভাইটা বখাটে না। অনেক ভাল। বিয়েটা করে ফেল। তোমাকে তাহলে সবসময় দেখতে পাব। আর কাগজটা দেবার সময় হয়ত তুমি আমাকে হয়ত অনেক কিছু বলবে। বকবে, কিংবা চিৎকার করবে। কিন্তু আমি জানো শুধু তোমার দিকে তাকিয়েই থাকব। আমি কিছুই বলতে পারব না। আমি কথা বলতে পারি না। বোবা। তবে কানে একটা মেশিন লাগানো, তা দিয়ে সব শুনতে পারি। আমার উপর যতই রাগ থাকুক। অনুরোধটা রাখো না। আমার ভাইয়ের বউ হয়ে যাও। তোমাকে দেখতে আমার ভাল লাগে। সত্যি ভাল লাগে। আমি যদি ভাল থাকতাম, বিশ্বাস কর, যাই হোক আমার ভাইটাকে বলে কয়ে, তোমাকে বিয়ে করে নিতাম। "
বর্ষা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে। আর কিছু লেখা নেই। এই পর্যন্তই। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে বর্ষার। বুঝতে পারছে না এই অনুভূতিটার নাম কি। তবে চোখ জ্বলছে খুব। আজ আর সাজগোজ করে আসেনি বর্ষা। পরেনি শাড়ি, পরেনি কপালে টিপ। তবুও জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে, কিছু হারিয়ে ফেলেছে বর্ষা। যেই কিছু কখনও পাবার ছিল না। কখনও পাবার না। কখনও পাবেও না। কিছু শূন্যতা বুকের ভিতর হাহাকার করছে। বর্ষা কাউকে ভালবাসে নি, কাউকে ভাল লাগেনি। তবুও কারও জন্য দুই দিন কাঁদল। কারও জন্য অকারণেই মনের ভিতর টান পাচ্ছে, বুকের ভিতর ব্যথা হচ্ছে। আবার ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা কখনই সম্ভব হবে না।
বাসায় যাবার পর, রাতে খাবার টেবিলে বসে, বাবা মাকে জানিয়ে দিল, সাজিদকে বর্ষার পছন্দ হয় নি। বিয়ে করবে না সাজিদকে। সাজিদের নাম্বারটা ছিল কাছে। মা দিয়েছিল। সাজিদকেও বলে দিল একই কথা। হয়ত বিয়ে হলে, শারার দেখতে পাবে সবসময়। তাকিয়ে থাকবে ফ্যালফ্যাল করে। তবুও কিছু শূন্যতায় বুকের ভিতর জ্বলবে, এই মেয়ে আমার নয়। বর্ষাও যে এভাবে দেখতে চায় না আর ছেলেটাকে। আর কাঁদতে চায় না অমন করে। প্রথম ভালবাসার মানুষ না, ভাললাগার মানুষ না, প্রথম কাঁদিয়ে দেয়া মানুষটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাক। হারাক কোথাও।
আর চোখের সামনে এসে চোখ জ্বালিয়ে, কাঁদাক শারার চায় না বর্ষা। তবুও শূন্য চোখে, শূন্য বুকে তাকিয়ে থাকে পথটার দিকে। হয়ত কখনও আবার ছেলেটাকে। দূরে দাঁড়িয়ে বর্ষাকে দেখবে। যেখানে যেখানে যাবে, সেখানে সেখাবে যাবে। নিঃশব্দে চোখে চোখে অনেক কথা বলবে। মনটাকে মানাতে পারে না হয়ত বর্ষা। প্রথম কাঁদিয়ে দেয়া মানুষটার জন্য, আর একবার কাঁদতে চায়।
অনুভূতিগুলো শূন্য হয়ে যায়, মনটা মাঝে মাঝেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যায়। কারও কারও জন্য। কখনও কখনও হিসেব কষে মিল পাওয়া যায় না, কেন এর জন্যেই এমন করে মন। কেন এর জন্যই চোখ জ্বলে, অশ্রু ঝরে। সব কিছুর উত্তর পাওয়া যায় না। কিছু যে মনের জটিলতায়, অনুভবের কিছু।