মেসের ঘরগুলোতে কোন দেয়াল ঘড়ি থাকে না। এরা সময় দেখে মোবাইলে। এদের এলার্ম ঘড়ি থাকে না, এরা এলার্মও দেয় মোবাইলে। এলার্ম বন্ধ করে সকাল বেলা আবার ঘুম দেয়। কেউ কেউ ঘুম ঘুম চোখে উঠে দৌড় লাগায় নিজের কাজে। রিহানও নিজের মোবাইলে এলার্ম দিয়েছিল সকাল ৭ টায়। রুমের কেউ দিয়েছিল ৮ টায়, কেউ ৯ টায় কিংবা কেউ সকাল ৬ টায়। সবারই জরুরী কাজ আছে। রিহানের কোন কাজ নেই। তবুও দিয়েছে। রিহান শুয়ে শুয়ে অন্যের ব্যস্ততা দেখবে। দেখতে ভাল লাগে। এখন বাজে দুপুর ২ টা। রিহান এখনও বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু পর পর পিঠে , হাতে চুলকে নিচ্ছে। মশার কামড় খেয়ে ফুলে থাকা জায়গা গুলো। মেসের ঠিক পিছনে ড্রেন। ময়লা পানির ড্রেন। এই ড্রেনের পানি নড়াচড়া করে না। স্থির থাকে। কালো পানির উপর মাঝে মাঝে হলুদ কিছু ভাসতে দেখা যায়। পচা পানির গন্ধের সাথে সেই হলুদ জিনিসের গন্ধ যুক্ত হয়। আর সেই স্থির দুর্গন্ধ যুক্ত ড্রেনের পানিতে মশারা সুন্দর সংসার পেতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে রিহান ভাবে বেশ ভাল আছে, রিহান মশা না। তাহলে ঐ পচা ড্রেনে থাকা, হলুদ জিনিস গুলোর উপর মাখামাখি। কি বিচ্ছিরি অবস্থা। সকাল সাতটার আগেই ঘর থেকে চলে গেছে রাসেল। ও উঠে জিমে যায়। জিম থেকে ভার্সিটি। যখন ঘুম ভাঙে চিৎকার শুনতে পায় দিনারের। কেউ একজন দিনারের একমাত্র ডেটল সাবানটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। সকালে বাথরুম সেরে এসে হাত ধুবার জন্য আর সাবান পাচ্ছে না দিনার। সেই নিয়ে মারাত্মক চিৎকার চেঁচামেচি। দিনারের এমন চেঁচামেচি প্রায়ই শোনা যায়। সবাই নজর কেন যে দিনারের জিনিসের উপরেই পড়ে। একদিন টুথপেস্ট হারায়, একদিন ফেসওয়াশ, একদিন শ্যাম্পুর বোতল, একদিন মুখে দেবার জেন্টস ক্রিম। দিনার নিজের রূপচর্চার ব্যাপারে খুব সচেতন। দেখতে সুন্দর, কয়েকদিন পর পর একেকটা মেয়ের প্রেমের প্রস্তাব পায়। আর সবগুলোই ও আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। দিনারের কথা, আমি কখনও মেয়েদের না করতে পারি না।
আজ আবার একজনের সাথে দেখা করার কথা। তাই এতো তাড়াহুড়া। কিন্তু সাবান হারিয়ে যাওয়ায় খুব মর্মাহত দিনার। তবুও সাবানের শোক ভুলে গোসল করে বের হয়ে যায়। নতুন প্রেমের বাস্তবায়নে।
রুমের মানিক আর মুশফিক সবসময় একসাথে থাকে। চুপিচুপি কি সব আলাপ করে। কাউকে শুনতে দেয় না। মাঝে মাঝে দুজন একসাথে হাসে। খাবার এনে একসাথে খায়। যাই করে একসাথে। রুমের অন্য কারও সাথে এদের সম্পর্ক ভাল না। দুই দিন পর পরই ঝগড়া বাধে সবার সাথে। শুধু রিহানের সাথে বাধে না। ঝগড়া বাধলেই রিহান, কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুম দেয়। এসব মুহূর্ত ভাল লাগে না রিহানের। জীবনের ঝামেলা গুলো খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলে।
রুমের সবচেয়ে নিরীহ ছেলেটা অয়ন। রিহানের কেন যেন নিরীহ লাগে। দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগে। রুমে যতক্ষণ থাকে কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকে। দিনার যখন কিছু হারালে চিৎকার করে, সবচেয়ে বেশী ভয় কাজ করে অয়নের ভিতর। মুখের ভিতর একটা ভয় ভাব থাকে। রিহান দেখে বুঝতে পারে। আর দিনার চিৎকার করার সময় বার বার পরোক্ষভাবে অয়নের দিকেই ইঙ্গিত করে। চিৎকার করে বলে, ফকির পোলাপানে ঘর ভরে গেছে। নিজের কিছু কেনার সামর্থ্য নেই। মানুষের জিনিস দেখলেই চুরি করা।
রুমের সবচেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল ছেলে অয়ন। কথাগুলো অয়নের খুব লাগে। বুকের ভিতর লাগে। তবুও কিছু বলে না। রিহান জানে অয়ন কোনভাবেই দিনারের হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো নেয় নি। অয়ন অমন ছেলে না। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব মানুষের ভিতর কিছু অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। আবার সবার মাঝে কিছু গুণ দিয়েও পাঠান। আমাদের সময় লেগে যায় অনেক সেই গুণটুকু খুঁজে পেতে। সেই টুকু বের করতে। যথাযথ ব্যবহার করতে। টাকা পয়সার অপূর্ণতা অয়নের আছে। সাথে সাথে কিছু গুণ তো অবশ্যই আছে। সেই গুণ কি জানে না রিহান। শুধু জানে অয়ন অনেক ভাল ছেলে। এর চেয়ে একটা মানুষ বিচারের আর কোন মাপকাঠি থাকতে পারে না। যখন মন থেকে বলে, না এ আসলেই অনেক ভাল। তখন এতো হিসেব নিকেশ আসে না। রিহানের কাছে অয়ন ভাল। অনেক ভাল। অয়নের মা অসুস্থ। বাবা নেই। মায়ের চিকিৎসার খরচ, নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালাচ্ছে। সারাদিন টিউশনি, কোচিং এ ক্লাস নেয়া, নিজের ক্লাস করা, মায়ের খোঁজ নেয়া, হাসপাতালে বিল দেয়া শেষে। দিন শেষে যখন রুমে শুকনো মুখ নিয়ে ঢুকে অয়ন, রিহানের খুব মায়া লাগে। চোখে জ্বালা করে, চোখ দিয়ে পানি পড়তে চায়। দিন দিন ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছে। হয়ত ঠিক মত খায় না। দুপুরে সকালে। রাতের বেলা একটা পলিথিনে করে ২ টা শুকনো রুটি আর একটু ডাল নিয়ে বসে বসে খায়। তৃপ্তি নিয়ে খায়। সেই অল্প একটু খাবার থেকে মাঝে মাঝে রিহানের মুখে জোর করে অল্প একটু ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। বলে, খা না।
রিহানের সেই রুটি মুখে নিয়েও কান্না পায়। গলার কাছে আটকে যায়। ভাবে আসলেই কত বিচিত্র জীবন। কত সুখ দুঃখে ঘেরা। অয়নের জন্য কিছুই করতে পারে না, তাই মাঝে মাঝে খারাপ লাগে খুব। রিহানের খুব ইচ্ছা, এ মাসে মামার কাছ থেকে একটু বেশী টাকা চেয়ে নিয়ে আসবে। এনে অয়নকে দিবে। রিহানের মা নেই। বাবা নেই। খরচ সব মামা চালান। নিজের খরচের টাকা অয়নকে দিবে। দিয়ে বলবে, আন্টিকে ওষুধ কিনে দিস। আর নিজে একটু খাওয়া দাওয়া করিস। শুকিয়ে যাচ্ছিস।
রিহানের কখনও কষ্ট হয় না। কারও জন্য মায়া লাগে না। শুধু এই ছেলেটার জন্যই লাগে। মাঝে মাঝে যখন রিহানের পাশে বসে, অনেক রাতে এসে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বলে, রিহান বন্ধু আমার মা বোধহয় বাঁচবে না বেশীদিন।
হাত ধরে রিহানের নিঃশব্দে কাঁদে। কতটা কষ্ট নিয়ে এই কথাগুলো বলে অয়ন বুঝতে পারে রিহান। জীবনে টিকে থাকার জন্য, যুদ্ধ করে যাচ্ছে অয়ন। একদিন এই যুদ্ধ হয়ত ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবুও চলতে থাকে। থামে না।
এখন রুমে আছে শুধু রিহান আর পরশ। পরশের কানে মোবাইল। এটা খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য। এই ছেলের কানে সারাক্ষণই মোবাইল থাকে। রাতে ঘুমাবার আগে কানে মোবাইল দেখে। ঘুম থেকে উঠেও দেখে। এতো কি কথা বলে, ভেবে পায় না রিহান। এক মেয়ের সাথে প্রেম চলছে। কিছু প্রেমের সম্পর্ক থাকে, সারাক্ষণ কথানির্ভর। এরা সারাদিন সারারাত কথা বলা মোবাইলে। মোবাইলেই সারাক্ষণ খোঁজ খবর নেয়া। এটা কর ওটা কর। এটা করবে না, ওটা করবে না। খাও ঠিক মত।
শার্ট পরতে পরতেই পরশ বলছে, খাব তো বাবু। আর একটু পরেই। রাগ কর কেন?
হয়ত ওপাশ থেকে রাগের অভিমান চলছে। রাগ ভাঙাতে চাচ্ছে পরশ। শার্ট পরে বের হয়ে যায় পরশ। রাগ ভাঙানো চলবে। অভিমানে চলবে ভালবাসা। খেয়াল রাখায় চলবে ভালবাসা।
রুমে এখন রিহান একা। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত জীবনের পথে ব্যস্ত। রিহান শুধু ব্যস্ততাহীন। কেউ রিহানের খোঁজ নিবে না। ঘুম থেকে উঠতে বলবে না। খাবার খোঁজ নিবে না। খেতেও বলবে না। শরীর খারাপ করবে না খেলে, রকম কথা বলে অভিমান করবে না। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে কেন জানতে চাইবে না। রিহানের মোবাইলে কখনও ব্যস্ততা থাকে না। রিহানের মোবাইল শুধু এলার্ম দেবার জন্য। সময় দেখার জন্য। মাসে একদিন শুধু মামাকে কল দিয়ে বলে, মামা টাকা শেষ।
এ পর্যন্তই। এর চেয়ে বেশী কিছু হয় না।
বিছানায় শুয়ে টেবিলের দিকে তাকাল। ছোট একটা টেবিল ক্যালেন্ডার। ধুলো পড়া ক্যালেন্ডার। রুমের একজন এনে রেখেছে রিহানের টেবিলে। ক্যালেন্ডারে দু একটা লাইন লেখা,
" যেদিন আমি হারিয়ে যাব,
বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায়
আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
- কাজী নজরুল ইসলাম "
অনেক প্রিয় কিছু লাইন রিহানের। আজ লাইন গুলোর লেখকের জন্মদিন। রিহান বিছানায় উপুড় হয়ে বলল, শুভ জন্মদিন কাজী নজরুল ইসলাম। কবি সাহেব। আমার কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই। মাসের শেষ দিকে এই অবস্থা হয়। নয়ত একটা ছোট কেক নিয়ে আসতাম। ৬-৭ টাকা দিয়ে। এরপর দুজন মিলে আপনার জন্মদিন উদযাপন করতাম। তার চেয়ে চলেন দুজন মিলে একসাথে ঘুমাই।
মুখ ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে, সোজা উপরের দিকে তাকাল রিহান। সাদা চুনকাম করা দেয়াল। আর দুদিন পর রিহানের জন্মদিন। মাঝে আর দু দিন। রিহানের কখনও জন্মদিন উদযাপন করে নি। রিহানের জন্মদিন কেউ মনে রাখে না। কেউ কেক নিয়ে এসে বলে না, তোমার জন্মদিন পালন করব। কেউ বলে না, আজ অনেক বিশেষ দিন দেখা করব। কিংবা কখনও রিহানের কাউকে জন্মদিনে দাওয়াত দিতে হয় না। রিহানকে কেউ জন্মদিনে উপহারও দেয় না। ফুল হাতে শুভ জন্মদিন বলে না। রিহান হুট করে একদিন হারিয়ে যাবে। কেউ মনে করবে না, হয়ত কেউ কাঁদবে না। কিংবা রিহানের লেখা কোন লাইন কেউ কোনদিন এতো দিন পরে পড়বে না। ক্যালেন্ডারের পাতায় ধুলো জমে লেখাগুলো কখনও কারও চোখে ভাসবে না। রিহান সাধারণ কেউ। অতি সাধারণ। কারও কাছে অসাধারণ না। সাধারণ থেকেই একদিন হারিয়ে যাবে। ব্যস্ততায় কেউ সময় পাবে না হয়ত, রিহানকে নিয়ে ভাবার। রিহান ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পাড় করে দিবে। রিহান মশার কামড় খেয়ে, মশার চেয়ে নিজেকে ভাল ভেবে সময় পাড় করে দিবে। সময়টুকু কাটিয়ে দিবে মানুষের ব্যস্ততা দেখে। কখনও বৃষ্টি হলে জানালার পাশে বসে, জমে থাকা ড্রেনের পানিগুলোর চলাচল দেখবে। জমে থাকা রিহানের মনের কখনও অমন বৃষ্টির জলে চলাচল আসবে কিনা জানে না। তবে জানে রিহান, নিজের ভিতর কখনও আফসোস আসবে না জীবন নিয়ে। কারও সুখ দেখে, কারও দুঃখ দেখে।
কারও জীবন সাধারণ থেকেই যায়, কখনও অসাধারণ কেউ হতে চায় না। হয় না। সবার অসাধারণ হবার চেষ্টায়, দিন গুলো যখন গোধূলির লগনে অপ্রাপ্তির হিসেবে আটকে যায়। তখন সাধারণ থাকা কেউ মুচকি হেসে বলে, বেশ আছি। ভাল আছি। দিন গুলো চলে যাচ্ছে। বেঁচে আছি, এই তো প্রাপ্তি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৪ দুপুর ২:৫৭