গতকাল এতবার বলার পর রাজি হল, রিমি। তবে আশিকের সাথে ঘুরবে, আগের মত, সে জন্য না। আগের সম্পর্কে দুজন নেই এখন। আজ বৃহস্পতিবার। বাসায় যাবে রিমি। আর পাশের সিটে বসে থাকবে আশিক। বাসায় যাবার সময়, পাশের সিটে অপরিচিত অনেকেই বসে থাকে। আজ না হয় পরিচিত কেউ। হাতে ২ টা ৩৫ টাকার টিকেট নিয়ে, দাড়িয়ে আছে আশিক। রিমির খবর নেই আসার। বলল তো, একটু দাঁড়াও তুমি, আমি আসছি।
আশিক দাড়িয়ে আছে। রিমিকে কাল খুব করে বলল, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে।
- আমাকে কেন দেখবে?
- ইচ্ছা করতে পারে না?
- না পারে না।
- কেন?
- আমাকে দেখার এখন অন্য কেউ আছে।
- এতো মিথ্যা না বললেও পার।
- কি মিথ্যা বলেছি?
- বাদ দাও। শুধু তুমি তোমার হলের সামনে আসবে, আমি দূর থেকে দেখে চলে আসব।
- পারব না।
- একটু শুধু।
- আচ্ছা, আমি কাল বাসায় যাব। তুমি বিকেল ৩ টার দিকে বাস কাউন্টারে এসো। আমি তোমার সাথে যাব।
আশিক খুশি হয়েছিল, সত্যি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিল। সত্যি এতো বেশি দেখতে ইচ্ছা করছিল, বলে বুঝাবার মত না। আজ দেখবে আবার রিমিকে। হোক একটু বদলে যাওয়া রিমি। তবুও সেই রিমিই, যাকে ভালবাসত আশিক। যাকে ভালবাসে আশিক। দূর থেকে রিমিকে দেখা যাচ্ছে। চটপটির দোকান গুলোর সামনে দিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে। গোলাপি রঙের ড্রেস পরে। রোদের ভিতর রঙটা জ্বলজ্বল করছে। আবার বুকের ভিতর কেমন যেন করছে আশিকের। রিমিকে দেখলেই বুকের ভিতর কেমন যেন করে। প্রথম যেদিন দেখেছে, সেদিন এমন করেছে। যেদিন প্রথম হাত ধরেছে, সেদিন এমন করেছে। যেদিন একসাথে বৃষ্টির মধ্যে, হুড তোলা রিকশায় চলেছে, সেদিনও এমন করেছে। পরে যে কটা দিন দেখা হয়েছে, প্রতিটা দিন বুকের ভিতর এমন করেছে। যেদিন হারিয়ে গেল ভালবাসা, রিমি মুখের উপর বলে দিল, তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। তোমার জন্য আমার ভালবাসা, আগের মত কাজ করে না। সেদিনও বুকের ভিতর এমন করেছে। এই কেমন করার নাম জানে না আশিক। তবে অন্যরকম এক অনুভূতি। যা শুধু রিমির জন্য কাজ করছে। রিমি এসে সোজা বাসের দরজা দিয়ে সিটে গিয়ে বসল। পিছন পিছন আশিক। জানালার পাশে রিমি, আর পাশের সিটে আশিক। কেউ কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। আশিকই বলল, কেমন আছ?
- ভাল।
- দেখে তো লাগছে না।
- না লাগলে আমি কি করব?
- ওওও। মন খারাপ?
- না।
- আমি তোমাকে চিনি, রিমি। তোমার চোখ দেখে বলতে পারি, তোমার মন কখন কেমন।
- তবে জিজ্ঞেস করছ কেন?
- মন খারাপ কেন?
- এমনি।
- বল না।
- ইশ বিরক্ত কর না এতো, ভাল লাগে না। দেখা করছি তাই অনেক। চুপ চাপ বসে থাক।
আশিক সত্যি চুপ হয়ে গেল। কিছু বলল না। বাস ছেড়ে দিয়েছে। রিমির পাশের জানালাটা বন্ধ। রিমি তাই খুলবার চেষ্টা করছে। তবে পারছে না। আশিক হাত দিয়ে খুলে দিল, জানালাটা। খোলার সময় আলতো করে রিমির আঙুলে , আশিকের হাতের ছোঁয়া লাগল। রিমি ধীর চোখে আশিকের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পারতাম খুলতে।
- হ্যাঁ, আমি খুব পারতে।
- চুপ কর।
আশিক আবার চুপ হয়ে গেল। পাঞ্জাবির পকেটে রাখা, বেলি ফুলের মালাটা আস্তে করে বের করল। রিমি নিবে কিনা কে জানে? দেখা হলেই সবার আগে রিমি, বেলি ফুলের মালার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করত। আর আজ একবারও জানতে চাইল না। সাদা ফুলগুলো একদম স্নিগ্ধ। ঠিক রিমির মত স্নিগ্ধ। রিমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে। আশিক আস্তে করে রিমির হাতের উপর মালাটা রাখল। রিমি চমকে তাকাল, আশিকের দিকে।
- এটা দিচ্ছ কেন আমাকে?
- সবসময় দিতাম যে তাই।
- সবসময় আর এখন এক না। তোমাকে বুঝতে হবে তো।
- আমি বুঝতে চাই না।
রিমি সেই মুখ গোমড়া করেই, আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। মালাটা হাতের ভিতর নিয়েই। আশিক আবার বলে উঠল, মন খারাপ কেন বললে না?
- শোনাটা খুব জরুরী?
- না জরুরী না। কিন্তু ইচ্ছা করছে।
- তোমার সাথে যাচ্ছি তাই। তুমি না আসলে, ঈশানকে আসতে বলতাম। ওর সাথেই বাসায় যেতাম। একসাথে পাশাপাশি বসে। ঈশান কে, তা অন্তত তোমাকে বলে দিতে হবে না?
- ও আচ্ছা।
আশিক মাথা নিচু করে বসে আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। রিমি মিথ্যা বলছে জানে আশিক, তবুও খারাপ হয়ে গেল। রিমি তাকিয়ে আছে আশিকের দিকে। ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে। রিমিও পাচ্ছে। তবুও হয়ত কিছু করার নেই। রিমি আস্তে করে আশিকের ডান হাতটা ধরল, নিজের বাম হাত দিয়ে। আশিক চমকে তাকাল রিমির দিকে। রিমি হাত ধরার জন্য , হাত ধরলেও। এখন বলল, হাতটা একটু সরাও। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করব।
আশিক হাত সরিয়ে নিল। রিমি ব্যাগ থেকে মোবাইল আর এয়ারফোন বের করে, এক কানে এয়ারফোন গুঁজে নেয়। এরপর আশিকের দিকে তাকিয়ে বলে, কানে এয়ারফোনটা লাগাও। তোমাকে একটা গান শুনাব।
আশিক পড়ে থাকা, অন্য এয়ারফোনটা কানে পরে নিল। কানের ভিতর বেজে যাচ্ছে গান। আশিক শুনে যাচ্ছে, আর রিমিকে দেখছে। বেজে যাচ্ছে-
" ভেবে ভেবে বলি,
বন্ধ দু চোখের, নিভু নিভু কালোয়,
যে আলোয় ভেসে আসো তুমি,
মনে হয় মিশে যাই, তোমার আরো কাছে,
যদি যাও চলে তুমি, জড়িয়ে বলবো যেওনা.........। ।"
গানটা কানের মধ্যে বাজছে, আর আশিক রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি তাকিয়ে আছে, জানালা দিয়ে বাহিরে। খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এলোমেলো হয়ে উড়ে রিমির চোখ মুখে এসে পড়ছে। রিমি সেগুলো সরাচ্ছে না। আশিক ভেবে নিচ্ছে, হয়ত গানের কথাগুলো রিমিই বলছে আশিককে। বা রিমি চাচ্ছে, আশিক বলুক রিমিকে। রিমি চাচ্ছে, আশিক জড়িয়ে ধরে বলুক, যেও না।
বুকের ভিতর কেমন যেন করছে আশিকের। এই কেমনের নামও আশিক জানে না। শুধু জানে, অস্থির লাগছে খুব। খুব অস্থির। কষ্ট হচ্ছে খুব। কি করবে বুঝছে না। রিমি মুখ নাড়িয়ে কিছু একটা বলল আশিককে অনেক আস্তে করে। আশিক না শুনলেও ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে বুঝে নিল, কথাটা, ভালবাসি। রিমি হয়ত ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত, অভিনয় করতে করতে। ভাল না বাসার অভিনয় করতে করতে। ভালবাসার মানুষের সাথে, ভাল না বাসার অভিনয় করা বড় কঠিন। বড় কষ্টের। রিমি তাই করছে। রিমি অভিনয় করতে পারে, কাছে টানতে পারেনা। ভালবেসে কষ্ট পেতে পারে, ভালবাসতে পারে না। না পারার কারণ আছে। অভিনয় করার কারণ আছে। সেই কারণ সবাইকে বলা যায় না। আশিককেও না। আশিকের বড় কান্না পাচ্ছে। গানের কথাগুলো শুনে কান্না পাচ্ছে। আগে এই গান অনেকবার শুনেছে। কখনও এমন লাগেনি। আজ লাগছে। রিমি বার বার বলছে, গানের মত করে, জড়িয়ে ধরে বল, যেও না। আমি ঠিক যাব না। তোমার হাত ধরে থাকব। ভালবাসব।
আশিক আলতো করে হাত ধরল রিমির। রিমি কিছু বলল না। ঠাণ্ডা হয়ে থাকা হাতটাকে আর একটু জোরে , চেপে ধরল আশিক। আশিক রিমিকে হারাতে চায় না। ভালবাসা হারাতে চায় না। রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে চায়, ভালবাসি। জড়িয়ে ধরে বলতে চায়, যেও না।
হয়ত রিমি মেনে নিবে, নয়ত আবার সেদিনের মত ফিরিয়ে দিবে।
কিছু মানুষ ভালবেসেও অভিনয় করে, না বাসার। কাছে থাকতে চেয়েও, অভিনয় করে দূরে তাড়িয়ে দেবার। এই অভিনয়ের পিছনে কারণ থাকে, অনেক বড় কোন কারণ। সেই কারণ কাউকে বলা যায় না। শুধু একা কষ্ট পাওয়া যায়। অভিনয় শেষে ক্লান্ত হয়ে, আবার সেই ভালবাসার মানুষটাকে কাছে চাওয়া যায়। হাতের ভিতর ছোঁয়া আশা করা যায়। দুই কানে এয়ারফোন খুঁজে, আঁকড়ে ধরার কথা বলা যায়। মানুষগুলো জানে, সবই জানে। শুধু মন থেকে বাসা ভালবাসা, দূরে বহুদূরে তাড়িয়ে দিতে জানে না। মনের ভিতর টানে টানে, ফিরে আসে। চেনা অচেনা গানে গানে, কাছে আসে।