- লেইলা আবুলেলা
সুদানের খার্তুমে জন্মগ্রহনকারী লেইলা আবুলেলা ২০০০ সালে আফ্রিকার সম্মানজনক ‘কেইন’ পুরষ্কার লাভ করেন। তাঁর উপন্যাস অনুবাদক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বাৎসরিক ১০০ উল্লেখযোগ্য বই এর তালিকায় স্থান পেয়েছে। তাঁর দুটো উপন্যাসই অনুবাদক ও মিনার আফ্রিকার ‘অরেঞ্জ পুরষ্কার’ এর প্রাথমিক তালিকায় স্থান পেয়েছে। তাঁর ছোটগল্পের সংকলন রঙিন আলোক ম্যাকমিলান সিলভার পেন অ্যাওয়ার্ড এর জন্য মনোনীত হয়। বর্তমান অনুবাদটি তাঁর ছোটগল্প “ডেইজ রোটেট” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই গল্প সম্বন্ধে লেখিকার নিজস্ব মন্তব্য হলো: “আমার অন্যান্য গল্পগুলোর চেয়ে একেবারে ভিন্ন একটি গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, যেটি সময় ও স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। এই গল্পটি সুফিবাদ প্রভাবিত। একে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবেও পড়া যাবে।” বর্তমান অনুবাদটি ইংরেজি অনুবাদেরও সংক্ষিপ্ত রূপ।
-----------------------------------------------------------------------------
আমি বললাম, ‘আমাকে বয়ে নিয়ে চলো।’ সে বলল, ‘না।’
তাই ওর যে হাতটা আমাকে আঁকড়ে ধরে পথ দেখাচ্ছিল, সে হাতে কামড় দিলাম। আমার কান্না না আসা পর্যন্ত আমি প্রাণপনে কামড়ে থাকলাম। ওর চোখ বাদামি থেকে নীল হয়ে পড়ল, তবু সে হাত ছাড়ল না।
আমরা উপরের দিকে চড়তে থাকলাম। আমি বললাম, ‘আমাকে বয়ে নিয়ে চলো।’ সে বলল, ‘না।’
আমি উপরে উঠা বন্ধ করলাম, নড়াচড়া থামিয়ে দিলাম। আমাদের হাত টানটান হয়ে পড়ল, আমাদের চোখের দৃষ্টিতে দূরত্ব সৃষ্টি হলো। আমি বললাম, ‘এই উচ্চতাই আমার জন্য ঠিক আছে। আমি আর চড়তে পারবো না।’
সে বলল, ‘নিজেকে শুন্য করো,’ আর তারপর সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি আমার স্বর্ণালংকার ফেলে দিলাম, ওগুলো নীচে পাথুরে শিলায় গিয়ে পড়ল। আমরা চড়তে থাকলাম।
একসময় এই খাড়া পার্বত্য পথে দুরন্ত গাড়ি চলত। মহাযুদ্ধের পূর্বে, রাতে এমন আলোক জ্বলত যা আগুন না, আবার চাঁদের মতও না। পৃথিবীতে তখন মানুষের ঠাসাঠাসি, সে এক হতাশার স্থান। কেউ না খেয়ে মারা গেল, আবার কেউ অর্থকড়ি খরচ করে ওজন কমাবার তালে থাকল। আমরা চড়তে থাকলাম। এই পার্বত্য পথের উপর দিয়ে একসময় বিমান উড়ত। তারা বিমান থেকে রাসায়নিক ছিটাতো। তবে এক মহাযুদ্ধ প্রযুক্তিকে হার মানালো। সেসঙ্গে বস্তুবাদ আর রাষ্ট্রও হার মানলো।
‘আমি তোমাকে একটা ধাঁধা ধরব,’ সে বলল। ‘আমেরিকানরা ভাল ছিল কেন?’ ‘ওরা ব্যাংকনোটের ওপর লিখতো: ঈশ্বরে আমরা আস্থা রাখি।’ ও হাসলো।
‘আমাকে বয়ে নিয়ে চলো,’ আমি বললাম। সে মাথা নাড়ল। আমরা চড়তে থাকলাম।
‘যুদ্ধের পূর্বে তোমার জীবন কেমন ছিল বলো,’ আমি জানতে চাইলাম। ‘আমি এক মোটা রাবারের মত চামড়া দিয়ে আচ্ছাদিত ছিলাম, যেন হাতির চামড়ায় ঘেরা। আমি সবসময় আরো বেশী চাইতাম। আমি যা চাইতাম তা পাওয়ার পর পরই আমার মোহমুক্তি ঘটতো। আবার নতুন কিছু...’
আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলাম। দুই দেবদূত গভীর আলাপে মগ্ন। ওদের আলোক আমার চোখের পলক ফেলতে বাধ্য করলো। আমরা চড়তে থাকলাম।
বৃষ্টি শুরু হলো। হালকা কোমল বৃষ্টি, বড় বড় সমতল ফোঁটা। পাথুরে শিলা এই বৃষ্টিকে ধন্যবাদ জানাতে থাকল। গাছেরা দুলে উঠল। আমাদের গতি কমে এলো।
আমি বললাম, ‘আমাকে বয়ে নিয়ে চলো।’ সে কিছুই বলল না। আমি বললাম, ‘আমি সারাদিন কিছুই খাইনি, আমি ক্ষুধার্ত।’
সে হাঁটা থামাল এবং তার চোখ ধুসর থেকে বাদামি হতে দেখলাম। মহাযুদ্ধের বীরদেরকে চোখের রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, যেন তারা ক্ষত সারাতে পারে। সে বলল, ‘দু:খিত, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তোমার তো এখনো প্রতিদিন খাবারের প্রয়োজন হয়।’
আমরা একটা গাছের নিচে বসলাম, তার ছায়ায়। সে আমাকে চারটি খেজুর দিল। আমি তিনটি খেলাম, চতুর্থটি খেতে পারলাম না, কারণ পেট ভরে গেছে। আমি ওটা ওকেই দিলাম। সে মাথা নাড়ল। তার তো কেবল দু’তিন দিন পরপর খাওয়ার প্রয়োজন হয়। আসলে আমার যৌবন আমাকে ক্ষুধার্ত করেছে।
‘সেইসব পুরনো দিনে তোমার মত যৌবনবতী নারী বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল।’ সে সজোরে হেসে উঠল।
গাছের ছায়া দীর্ঘ হতে থাকলো। প্রার্থনার ডাক কানে এলো। শামুকের খোলস থেকে, বোবা গাছ থেকে, স্পষ্ট ও পরিচিত কন্ঠে। হাত-মুখ ধোয়ার কোন পানি না থাকায় আমরা পর্বতের পাথুরে দেয়ালে আমাদের হাতের তালু ঘষে নিলাম। আমরা আমাদের মুখ আর হাত মুছে নিলাম। সে পকেট থেকে দাঁতন বের করে দাঁত পরিষ্কার করল।
আমি বললাম, ‘আমাকে বয়ে নিয়ে চলো।’ সে বললো, ‘না।’ আমি চিৎকার করলাম, ‘আমার ভেতর আর কিছুই নেই।’ ‘কথাটি সত্য না,’ সে জানাল। আমরা চড়তে থাকলাম।
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার বন্ধু!’ আমি আমার হাতটা ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। আমি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লাম। নিচে গড়িয়ে পড়া এত সহজ, নিজেকে ছেড়ে দেওয়া, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তখন আমার পক্ষে, আমাকে সাহায্য করছিল। আমার সঙ্গে সঙ্গে নুড়ি গড়িয়ে চলল। আমি স্বাধীন। ওর থেকে স্বাধীন, উপরে চড়তে থাকার চেষ্টা থেকে স্বাধীন।
‘উঠে দাঁড়াও,’ সে এখন আমার পাশে। ‘আমি উঠতে পারছি না।’ সে আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল, এতটা কাছে যে আমি তার দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, তার চোখের তারায় আলোকের ঝলকানি দেখছিলাম। আমি জানতাম না সে উড়াল স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল।
‘আমাকে শ্রেয় করো,’ আমি আকুতি জানালাম। আমার হাঁটুর ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। সে বলল, ‘কাঁদো।’ আমার কান্না শেষ হলে উঠে দাঁড়ালাম আর শরীর থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে ফেললাম। ‘আমরা কেন চড়ছি?’ সে জিজ্ঞেস করল, যেন আমি কখনো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনি, যেনবা আমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।
‘আমি জানি না, আমি জানি না। আমি কেবল তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।’ তখন তার দৃষ্টিতে প্রচুর দয়া দেখলাম, তার হাতের ছোঁয়ায়। আমরা হাঁটতে থাকলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগের পৃথিবীতে এত সমস্যা কেন ছিল?’ ‘মানুষ স্বর্গ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল, তারা ভেবেছিল সেভাবেই তাদের জীবন চলে যাবে।’
‘আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছে,’ আমি বললাম। আমাদের বাড়ির উঠোনটার জন্য বুকের ভেতরটা ব্যথায় মুচড়ে উঠল। আমার বোনেরা, আর তাদের সঙ্গে খেলার কথা মনে পড়ল। আমার কুড়িজন ভাইবোন ছিল। তাদের কেউ কেউ দেখতে আমার মত, কেউ একেবারেই আমার মত না। আমরা হাঁটতে থাকলাম।
‘এখন,’ সে কোমলস্বরে বলল, ‘নিজেকে শূন্য করে ফেলো।’ আমি আমার মাতৃভূমি ত্যাগ করলাম। নিচে পাথরের গায়ে তা আছড়ে পড়ল। আমরা চড়তে থাকলাম।
আমি একটি শব্দ শুনতে পেলাম, গান গাওয়ার শব্দ, আর এটি এমন কিছু যা আমি আগে কখনো শুনিনি। ‘কি এটা? কেমন অদ্ভূত।’ ‘মেঘেরা।’
‘আমরা কি প্রায় পৌঁছে গেছি?’ আমাদের সামনে পর্বতটা তখনো নিরেট অনড়।
সে উত্তর দিলো না। দ্রুত পা চালালো। আমার নিজেকে হালকা বোধ হলো। সে আরো দ্রুত চড়তে থাকলো এবং আমি তার সঙ্গেই পথ চলতে থাকলাম। আর কোন বেদনা নেই। আমার পায়ের নিচে মাটিতে আঘাত করলাম। আমি আমাদের গন্তব্য দেখতে পাচ্ছিলাম, শুনতে পাচ্ছিলাম, অনুভব করলাম - আমি যাকিছু ত্যাগ করেছি, মাতৃভূমি এবং স্বর্ণালংকার, সবকিছুর চেয়ে সুন্দর ও প্রগাঢ়। আমার পায়ের নিচের মাটিতে ধাক্কা দিলাম। মাটি আমার কাছ থেকে সরে পড়ল। কিন্তু এটি তো আসলে মায়া বিভ্রম - মাটি তো সরে যায়নি। আমরাই উড়ছিলাম।