২০০ বছরেরও বেশী পুরনো ও কোন ভারতীয়র ইংরেজি ভাষায় লিখিত প্রথম বইয়ের আংশিক অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে। সবার অগোচরে থেকে যাওয়া এক ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ দুর্লভ বই। এখানে ২০০ বছর আগের আগ্রা-দিল্লি-ঢাকা-কলকাতার চেহারা দেখতে পাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বিভাগে চাকুরিরত এক ভারতীয় মুসলমানের লেখনীতে। দীন মোহাম্মদের সফরনামার প্রারম্ভিক পর্ব এখানে পাবেন। এই পর্বে আমরা তার বইয়ের ১ম চিঠিটি দেখব।
(জনাব গোলাম মুর্শিদ তাঁর এক গবেষণার বইয়ে আমাদের দীন মোহাম্মদের কথা বলেছিলেন। এই ব্লগে শিক্ষক ডট কমের প্রবক্তা জনাব রাগিব হাসান শ্যাম্পুর জনক এই দীন মোহাম্মদ সম্বন্ধে লিখেছিলেন।)
[আমার অনুবাদের ভাষা উন্নতির জন্য মন্তব্য পেলে উপকৃত হবো – যদিও অনেক সময় তা হজম করতে আসলেই বেশ কষ্ট হয় ]
=============================================
দীন মোহাম্মদের সফরনামা
- দীন মোহাম্মদ
=============================================
পত্র ০১
=============================================
প্রিয় মহোদয়,
এদেশে পদার্পনের পর থেকেই আমি বুঝেছি যে আপনি আমার জীবনের প্রথম ভাগের সঙ্গে ও আমার সফরনামার ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করে অপেক্ষারত আছেন। আপনার আকাঙ্খা পূরণ করতে পারলে আমি সুখী বোধ করব। এসঙ্গে আমাকে অকপটে স্বীকার করতেই হবে যে, আমি যখন প্রথম আয়ারল্যান্ডে এসে পৌঁছলাম তখন আমার চারপাশের সবকিছু ভারতের মনোহর দৃশ্যাবলীর চেয়ে একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। ভারতের সেসব আকর্ষণীয় দৃশ্যাবলীকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবো বলে আমি একবারেই ভরসা পাচ্ছি না। তারপরও কিছুটা চেষ্টা করতে গুটিগুটি পায়ে এই কাজে রত হওয়ার ইচ্ছা মনে জাগছে। একথা ভেবে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে যে ভারতবাসীর মাঝে আমার পূর্বপুরুষদের নিষ্পাপ আচরণের এখনো বহুকিছু অবশিষ্ট আছে এবং ইউরোপের আত্মশ্লাঘাধারী কিছু দার্শনিকের অন্তরের শুদ্ধতার চেয়েও অনেক বেশী শুদ্ধতা তাদের অন্তরে বিরাজ করছে।
যদিও আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে এসব মানুষের জীবনযাপনের সঠিক বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না, তবুও আপনার আকাঙ্খা পূরনের জন্যই আমি এ কাজে হাত দিচ্ছি। এটিই আমার মূল প্রেরনা। আসলে ভারতের সুখী মানুষের আচার আচরণের বর্ণনায় আমরা সভ্য জাতির যোগ্যতার আভাস পাবো। আমার কিছু বন্ধু বান্ধবের আন্তরিক অনুরোধ আর অন্যান্য অনেকের অকুন্ঠ উৎসাহও আমাকে আমার সফরনামা লেখার কাজটি করতে প্ররোচিত করছে। আমি এদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এটি আমার দ্বিতীয় প্রেরণা।
ভারতের মানুষজন স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপার অধিকারী এজন্য যে, তারা মন প্রফুল্ল রাখার ও দৃষ্টিকে আনন্দ দান করার মত বহুকিছুর অধিকারী। স্বর্গের পরিবেশ যদিও কেবল কবির সৃষ্টিশীল মানসজগতে বিরাজ করে, ভারত ভ্রমণকারী যে কোন ব্যক্তি চোখ মেলে গ্রাম্য পরিবেশের দৃশ্যাবলী দেখে অকুন্ঠে চোখ জুড়াতে পারে। ভ্রমণরত ব্যক্তির চোখে পড়বে এমন পথের দিশা যা দেখে মনে হবে এ যেন মিলটনের লেখনীতে অতি সুন্দর করে আঁকা এক পথ। এখানে দেখবেন, মৃত্তিকা অকৃপণভাবে নিজেকে গাছগাছালিতে পরিপূর্ন করে রেখেছে। এখানকার বাগানগুলো রঙের বৈচিত্রে সাজানো। এখানে জমকালো আনন্দমুখর সব রঙের ফুলের সুবাস বাতাসের বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। এখানকার মাটির তলে পৃথিবীর উদর অপরিমেয় সোনা আর হীরার খনিতে পরিপূর্ন।
জীবনে যা কিছু ঈর্ষা উদ্রেককারী তার সবকিছুর অধিকারী হয়ে আমরা আরো বেশী সুখী কারণ আমাদের মন এখনো ঔদার্য ও অন্যের মঙ্গলকামনায় পূর্ণ। শঠতা কিংবা সস্তা চাতুর্যের ব্যবহারের চিহ্নমাত্র আমাদের মাঝে নেই। আমাদের প্রফুল্লতায়, সামাজিক আমোদপ্রমোদে প্রতিবেশীরা কখনো বাদ পড়ে না। যেমন ধরুন, কোন ব্যক্তি কোন আনন্দ অনুষ্ঠানের সময় তার পেশার ও আশেপাশের সকলকে আমন্ত্রন করে থাকে। দুনিয়ার অন্যান্য প্রান্তে যেসব জাঁকালো লাম্পট্যপূর্ণ আচরণের প্রসিদ্ধি আছে, এখানে সেসব আচরণকে সাধারণ জনগন ধিক্কারজনক দৃষ্টিতে দেখে। আমাদের নারীরা ইউরোপের নারীর মত অত সাংস্কৃতিক গুণসম্পন্ন না হলেও এরা বহু গুণে গুণান্বিত যা স্ত্রীজাতির জন্য গর্বের বিষয়।
এতক্ষণ যেহেতু আমার দেশের আচার ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত রূপরেখার বর্ণনা উপস্থাপন করলাম, এখন আমি আমার জীবনের কিছু কথা বলতে চাই। ১৭৫৯ সালে গঙ্গার উত্তর [প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ] পাড়ে পাটনা নামের এক বিখ্যাত শহরে আমার জন্ম। এই শহরটি বাংলার রাজধানী ও সেই অঞ্চলে ইংরেজ সরকারের পীঠস্থান কলকাতা থেকে ৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত। আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স খুবই কম ছিল। আর তাই আমি আমার পরিবারের ইতিহাস তেমন জানতে পারিনি। তাঁকে সম্মান জানানোর সময় আমি কেবল এটুকু জানতে পেরেছি যে, মুর্শিদাবাদ এর নবাব যে বংশের সেই একই বংশের সন্তান তিনি। তিনি ক্যাপ্টেন এডামস এর নেতৃত্বে পরিচালিত সিপাহীদের এক ব্যাটালিয়ন এর সুবেদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন এডামস এর কোম্পানিটি তখন পাটনা থেকে বেশী মাইল দূরে ছিল না। কোম্পানিটি তাজপুর শহরে অবস্থান করছিল। তাজপুর আসলে এক ক্ষুদ্রায়তন দুর্গ, উল্লেখ করার মত তেমন বড় না। দুর্গটি একটি ছোট নদীর পাশে অবস্থিত। আমার বাবা এখানে দুর্গ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৭৬৯ সালে তাজপুর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় এক দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বাস করত রাজা বুধমল ও তার ভাই কোরাক্সিন [প্রকৃতপক্ষে কোরা সিং]। তারা এই অবস্থাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে রাজা সত্যপ্রয় [প্রকৃতপক্ষে সিতাব রায়] এর সঙ্গে কৃত চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় রসদাদি সরবরাহ করতে অপারগ হওয়ার ভান করে। এদিকে রাজা সিতাব রায় আশানুরুপ সরবরাহ না পেয়ে তার কিছু লোকজন পাঠায় যেন তারা বুধমল ও তার ভাইকে সেসব সরবরাহে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু বুধমল ও তার ভাই দুর্গে আশ্রয় নিয়ে সিতাব রায়ের লোকজনকে কঠোর প্রতিরোধ করার সংকল্প করে। এসব খবরের ভিত্তিতে আমার বাবাকে সেই বিবাদস্থলে পাঠানো হয়। স্থানটি ছিল বাবা যে দুর্গে ছিলেন সেখান থেকে প্রায় বার মাইল দূরে। বাবা তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে তাহারাহ [ প্রকৃতপক্ষে তেলারহা] পৌঁছে রাজা বুধমলকে বন্দী করে কঠোর পাহারায় পাটনায় পাঠিয়ে দেন যাতে করে বুধমল সেখানে তার কাজের ব্যাখ্যা দিতে পারে। আমার বাবা বিবাদস্থলে থেকে গেলেন যাতে করে তাদের শক্তির কিছুটা নমুনা শত্রুদেরকে বোঝানো সম্ভব হয়। শত্রুরা এতটা বাধাগ্রস্ত হলো যে তারা প্রাণপনে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে চাইল এবং দ্বিগুন শক্তি প্রয়োগ করল। এর ফলে আমাদের অনেকে হতাহত হলো। সেসময় আমার বাবাও হত হলো। তবে তিনি রাজার বাহিনীকে পুরোপুরি পরাস্ত না করে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন নি কারণ শেষমেষ শত্রুরা আত্মসমর্পণ করেছিলো। সৈন্যরা বাবার সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কোরা সিংকেও বন্দী করলো এবং তাদের দুর্গের দখল গ্রহণ করলো।
এভাবেই আমি আমার সাহসী বাবাকে হারালাম। বিভিন্ন সামরিক কার্যক্রমে বাবার দৃঢ়তা ও স্থিরসংকল্প সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। এমন বাবাকে আমি হারালাম । সেসময় আমার ভাই সেখানে উপস্থিত ছিলো। তার বয়স মাত্র ষোল। আমাকে ছাড়া সেই ছিলো আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। সে বাড়ী ফিরে ক্যাপ্টেন এডামস এর কাছে চাকুরির আবেদন করল। ক্যাপ্টেন আমাদের বাবার সামরিক সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি দেখিয়ে যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে ভুল করলেন না। তিনি আমার ভাইয়ের আবেদনটা গভর্ণরের কাছে উপস্থাপন করলে আমার ভাইকে দ্রুততার সঙ্গে বাবার পদে উন্নীত করা হলো। আমার মা এবং আমি যুদ্ধক্ষেত্রে বাবার এমন সম্মানজনক কিন্তু আকস্মিক পরিণতিতে অতিশয় যন্ত্রণা ভোগ করলাম। আমার ভাই তখন অপরিণতবয়স্ক এবং কিছুটা হঠকারী স্বভাবের হওয়ায় আমাদের পরিস্থিতি বোঝার জন্য সে তেমন কোন প্রচেষ্টাই নেয়নি। আমাদের পারিবারিক কষ্টের এটিও একটি কারণ।
মাত্র এগার বছর বয়সেই আমি বাবাকে হারিয়েছি। যদিও অমন অপরিণত বয়সে ছেলেপুলেরা বলতে গেলে তেমন স্পর্শকাতরতা বা অনুচিন্তনের অধিকারী হয়না, তারপরও আমি ঠিক বুঝেছি, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া আর কোন কিছুই আমার মনে অতটা দাগ ফেলেনি। এ পর্যন্ত আমার জীবন অভিজ্ঞতার কোন কিছুই তাঁর স্নেহপূর্ণ মনোযোগের স্মৃতিকে আমার মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তিনি যেহেতু মুসলমান ছিলেন, তাঁকে আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে অতি সমারোহে সমাহিত করা হয়। এর পর আমি কিছুদিন আমার মায়ের সঙ্গে থাকলাম এবং সেসময় পাটনার এক স্কুলে কিছুটা লেখাপড়াও করলাম।