বাঙলায় সংস্কৃতজাত 'ধর্ম' শব্দটি একটা ব্যাপৃত অর্থ বহন করে। তা লাতিনজাত ইংরেজি শব্দ 'রিলিজিয়ন' করে না। নানা ধর্ম আছে দুনিয়ায়, ছোট ধর্ম বড় ধর্ম, জনপ্রিয় ধর্ম বিলুপ্ত ধর্ম ইত্যাকার। তা যাই হোক, বাংলায় 'ধর্ম' শব্দটিকে দর্শনের মর্যাদা দেয়া যায়, যদিও অনেকের মতে বা আমারও মতে ইংরেজি 'ফিলোসফি' শব্দটির অনুবাদ 'দর্শন' হয় না। আমার মাঝেমধ্যে সাহস করে এর অনুবাদ 'ধর্ম' করতে মন চায়। তবে নানাবিধ প্রথাগত ঝামেলার কারণে তা করা যায় না, ঝামেলাগুলো আমার নয়, তথাকথিত ধর্মপন্থীদের, যাদের প্রগতিশীলরা ডাকেন ' মৌলবাদী' ব'লে। যদিও এই শব্দটি তাদের জন্যে প্রযাজ্য বলে মনে করি না। অনেকে ডাকেন 'প্রতিক্রিয়াশীল', তাও না। এদের বলা উচিত 'বিশ্বাসী'। তারা 'যে কোনো কিছু' তা যাই হোক, তাদের অর্জন বা জন্মগত, স্বজ্ঞা বা পরবিশেগত, পশু বা মনুষ্যোচিত, তা তারা বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। সাধারণত প্রথাগত যে জনপ্রিয় ধর্মগুলো আছে মর্ত্যে তার সঙ্গে কোনো না কোনো অতিপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃতের প্রাকৃত, কোনো এক রকম সম্পর্ক আছে। তবে যারা তা বিশ্বাস করেন, বা বিশ্বাসের গৌরব অর্জন করতে পারেন, তাদের বস্তু মিলে যায়, তারা তর্কে বহুদূর যেতে চান না। যানও না, গেলে কখনো কখনো হিংস্র জল্লাদ বা পশুর অধম হয়ে ওঠেন, তবে কাকে বলে 'মানুষ' তা এখনো মীমাংসিত না, যদি না বিশ্বাস করা যায় কোনো কিছুতে। প্রচলিত ধর্ম সাধারণত ভাববাদী, তবে ভাববাদ যুক্তির যে ধারণা রাখে ধর্ম তা রাখে না, বা তার পরিমাণ কম। যদিও যুক্তির বেসিস নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। এই উত্তরআধুনিক যুগে তা অনেকেই তোলেন। রেনেসাঁ যখন প্রথম হলো তার পরেও তা নিয়ে তোলা হয়েছে আপত্তি, তা রোমান্টিক যুগে। তবে ভাববাদ যুক্তি ভাঙালেও শেষতক যুক্তিকে ধর্ষণ করে দেখে প্রথম যার অভ্যুত্থান হলো তার নাম 'যান্ত্রিক বস্তুবাদ'। শেষে দেখা গেলো এই যান্ত্রিক বস্তুবাদও এক ধরনের ভাববাদ। তা বিশ্বাস করে বা ধারণা করে বা আস্থা রাখে পরমাণুর অবিভাজ্য অবিনাশিতায়। তখন বহুকাল পুরোনো যা ভাবাবাদের সময়েও ছিল সেই 'দ্বন্দ্ব'-কে এর সঙ্গে জুড়ে তৈরি করা হলো 'দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ'। কিন্তু যারা ব্যক্তিসত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয় তারা একেও মনে করলেন যান্ত্রিক, তাই তারা প্রস্তাব দিলেন অস্তিত্ব নিয়ে নতুন দর্শন, তার নাম দেয়া হলো 'অস্তিত্ববাদ'। আরো হাজার '-বাদ' রয়েছে, এইসব '-বাদ'এর মধ্যে রয়েছে বিবাদ,বাদানুবাদ। বিষয়টাকে বাণিজ্য-সমাজ-সংস্কৃতি-যুদ্ধ, তার বহুত্ব-বৈচিত্র্য-বৈষম্য আরো হাজার দিকে ব্যাপৃত করা যায়, যা জটিল-কঠিন এবং শেষতক কুটিল হয়ে ধরা দেয়। আদর্শ-ভাবাদর্শ-বস্তুআদর্শ-অবস্তুআদর্শ-প্রতিবস্তুআদর্শ-অধ্যাত্ম-অতীন্দ্রিয়তা-মধ্যপন্থা কত ভাবেই না ব্যাখ্যা। এই সকল বিবাদ-বাদানুবাদ'র শেষ পরিণতি হলো ধর্ম (চলমান/বিকাশমান) হয়ে ওঠে অধর্ম, অধর্ম (বিকাশমান/চলমান) হয়ে ওঠে ধর্ম।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:৪১