গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম কৃত্রিম বা ল্যাবে বানানো কিছু ভাইরাস নিয়ে, এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আজ আরো কিছু ভাইরাস নিয়ে আলোচনা করবো।
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।
কৃত্রিমভাবে বানানো কিছু ভাইরাস…………করোনার ভাই বেরাদার।
৬) SARS 2.0
Severe acute respiratory syndrome (SARS) হচ্ছে আরো একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস। ২০০২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ২৯ টি দেশে ৮,০০০ মানুষ সংক্রামিত হয়ে মহামারীতে ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এটিকে আরও মারাত্মক করে তুলেছেন।
নতুন মিউট্যান্ট SARS ভাইরাসটি উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ রাল্ফ বারিকের নেতৃত্বে একদল গবেষক তৈরি করেছিলেন। তারা এটিকে SARS 2.0 বলে নাম দিয়েছিলেন। গবেষকরা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট SARS এ কিছু প্রোটিন যুক্ত করে ভাইরাসটি বিকাশ করেছিলেন। SARS ২.০ ভাইরাসটি তারা তৈরি করেছিল যাতে এটি প্রচলিত ভ্যাকসিন থেকে উন্নত হয় আর প্রাকৃতিক SARS এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।
দলটি বলেছিল যে গবেষণাটি প্রয়োজনীয় ছিল কারণ প্রাকৃতিক SARS ভাইরাসটি পরিবর্তিত হতে পারে এবং আমাদের ভ্যাকসিনগুলির জন্য প্রতিরোধক হতে পারে। SARS ২.০ ভাইরাসটি তৈরি করে আমরা আরও শক্তিশালী ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি যা আমাদের আরও মারাত্মক SARS মহামারী থেকে বাঁচাতে পারে।
তবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন, কারণ সারস ২.০ যা আমাদেরকে মারাত্মক SARS মহামারী থেকে বাঁচাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে যদি সে কোনো ভাবে ল্যাব থেকে বের হয়ে যায় তবে সে নিজেই মহামারী শুরু করে দিবে, যা থামানো খুব কঠিন হয়ে যাবে।
৭) Mousepox
কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিএসআইআরও) গবেষকরা ভুল করে মাউসপক্সের একটি মারাত্মক রূপান্তরিত স্ট্রেন তৈরি করেছিলেন। মাউসপক্স হ'ল আর একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস যা হর্সপক্স এবং স্মলপক্সের মতো একই পরিবারভুক্ত।
গবেষকরা ইঁদুরের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা করছিলেন এবং তখন ভুল করে এই ভাইরাসটি তৈরি হয়ে যায়। তারা মাউসপক্সে ইন্টারলেউকিন 4 (আইএল -4) তৈরি ত্বরান্বিত করতে একটি জিন প্রবেশ করান এবং তা তারা কিছু ইঁদুরের মধ্যে ইনজেকশন হিসেবে দেন। ইঁদুরগুলিকে টিকা দেওয়া হয়েছিল এবং মাউসপক্স দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা ছিল না।
গবেষকদের প্রত্যাশা মতো ইঁদুরকে বন্ধ্যাত্ব বানানোর পরিবর্তে, দুর্বল ভাইরাসটি মারাত্মক হয়ে ওঠে এবং ইঁদুরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং নয় দিনের মধ্যে তাদের হত্যা করে। নতুন মাউসপক্সটি এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে এটি যে টিকা দেওয়া ছিল তার প্রতিরোধক ছিল। পরিবর্তিত মাউসপক্সের সংস্পর্শে থাকা অন্যান্য টিকা দেওয়া ইঁদুরগুলির অর্ধেকও মারা গিয়েছিল।
গবেষকরা তাদের আবিষ্কার দ্বারা এতটা ভয় পেয়েছিলেন যে তারা তাদের অনুসন্ধানগুলি প্রকাশ করতে চাননি। এমনকি এটি প্রকাশ করা নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে তারা অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে, মানুষের স্মলপক্স যদি আইএল -4 ইঞ্জেক্ট করা হয় তাহলে এটিও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। যাইহোক, তারা অনিশ্চিত কারণ কেউ এখনও কেউ এই চেষ্টা করে নি। আমরা জানি কিছু বিজ্ঞানী এটি করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
৮) Polio
আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও তাদের সহযোগীদের মতো, নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ডিএনএ টুকরা জোড়া দিয়ে একটি মারাত্মক কৃত্রিম ভাইরাস তৈরি করেছেন। এটি অনেকটা পোলিও এবং এর প্রাকৃতিকটির মতোই শক্তিশালী। কৃত্রিম পোলিওর সংস্পর্শে আসা ইঁদুরগুলো ঠিক একইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ঠিক যেভাবে প্রাকৃতিক পোলিওর সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়।
গবেষকদের এই আবিষ্কার নিয়ে পোলিও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ছিল। যে গবেষকরা এটি তৈরি করেছিলেন তারা এর কোডটি ডাটাবেসগুলি থেকে সংগ্রহ করেছিল যা ছিল খুবই সহজলভ্য।
তাই অন্যান্য গবেষকরা আশঙ্কা করছিলেন যে হীন বা নিচু মানসিকতার লোকজন অথবা ব্যাবসায়িক উদ্দেশে লোকেরা তাদের নিজস্ব কৃত্রিম পোলিও ভাইরাস তৈরি করে ছড়িয়ে দিতে পারে যা স্কলপক্সের মতো বিপজ্জনক ভাইরাসের তুলনায় তৈরি করা আরও সহজ।
স্কলপক্সের জেনেটিক কোডটি ১৮৫০০০ অক্ষর দীর্ঘ এবং পোলিওর মাত্র ৭৭৪১ অক্ষর দীর্ঘ।
যদিও আমরা ইতিমধ্যে পোলিও নির্মূলের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি, তবে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে আমাদের এখনও এই রোগের বিরুদ্ধে টিকা নেওয়ার দরকার কারণ যে কোনও সময় এটি পুনরায় ছড়িয়ে যেতে পারে।
৯) Black Death
১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় একটি রহস্যজনক রোগে ভুগছিলেন যেটাতে ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরন করেছিল। আজ, আমরা জানি এই রোগটির নাম হচ্ছে ব্ল্যাক ডেথ, যা Yersinia pestis ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। যদিও ব্ল্যাক ডেথ রোগটি প্রায় এখনও রয়েছে, তবে এটি আগের মতো শক্তিশালী নয়।
কয়েক বছর আগে, জার্মানির টিউবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় সহ একাধিক বিদ্যালয়ের গবেষকরা প্লেগের সময় মারা যাওয়া একজন ভুক্তভোগীর দাঁত থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ নমুনা থেকে এই মারাত্মক ব্যাকটিরিয়াটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তারা দাঁত থেকে কেবল ৩০ মিলিগ্রাম ব্যাকটিরিয়া পেয়েছিলেন তবে এই পরিমানটিও ব্যাকটেরিয়া পুনরুদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
ফলস্বরূপ, গবেষকরা আজ প্রায় ব্ল্যাক ডেথের সাথে মূল ব্যাকটেরিয়ার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে সময়ের সাথে ব্যাকটেরিয়া গুলো পরিবর্তন হওয়ার কারনে আজ সেগুলো তেমন প্রাণঘাতী নয়।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যুদ্ধ চলছেই। কে বেশি শক্তিশালী ? প্রকৃতি নাকি মানুষ- এই প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করাই বৃথা। মানুষ যেমন প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে শুরু থেকে ঠিক তেমনি প্রকৃতিও মানুষকে নিয়ন্ত্রন করছে অলিখিত ভাবে। শুধু এক কোরোনা এসেই পুরো পৃথিবীকে থমকে দিলো ভালো ভাবে। পুরো পৃথিবী যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত।
করোনায় মৃত সকল আপনজনের জন্য সমবেদনা।
সবাই ভালো থাকবেন, নিজের যত্ন নিবেন। আল্লাহ যাতে আমাদের এই করোনা যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়ি শেষ করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৪:১৯