করোনা ভাইরাস। সেই সুদূর উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর এখনও তার ভয়ানক ছোবল আঘাত করে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। করোনা মনুষ্য আবিষ্কৃত নাকি প্রাকৃতিক এই নিয়ে দন্ধ থাকলেও অন্যান্য অনেক ভাইরাস যে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারেও আবিস্কার করে থাকে তা নিয়ে দন্ধ নেই।
বিজ্ঞানিরা সাধারণত বিদ্যমান অথবা বিলুপ্তপ্রায় ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস গুলিকে পরিবর্তন করে নতুন স্ট্রেন তৈরি করতে চায় যা আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা, ভ্যাকসিন এবং ড্রাগগুলিকে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে। যাইহোক, এই স্ট্রেনগুলি মানুষের পক্ষে সর্বদা বিপজ্জনক নয় যদিও তারা অন্যান্য প্রাণী এমনকি অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার জন্যও মারাত্মক হতে পারে। নিচে কৃত্রিম ভাবে বানানো কিছু ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়ার সন্মন্ধে আলোচনা করা হল।
১) H1N1 Virus
১৯১৮ সালে বিশ্বজুড়ে একটি মারাত্মক ফ্লু মহামারী দেখা দিয়েছিল। এটি ছিল H1N1 ভাইরাস। এই ভাইরাসে,প্রায় ১00 মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। এই ভাইরাস আক্রান্তদের ফুসফুসে রক্ত প্রবাহিত করে ,আর ফুসফুসের ভিতরে রক্তে ডুবে যাওয়ার আগে তাদের নাক এবং মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে আসতো।
এই ফ্লুটি আবার ২০০৯ সালে ফিরে এসেছিল। তবে এটি আগের চেয়ে কম প্রাণঘাতী ছিল যদিও এটি পরিবর্তিত হয়ে আগের চেয়ে মারাত্মক হওয়ার কথা ছিল । বিজ্ঞানী ইয়োশিহিরো কাওওকা ২০০৯ এর মহামারীর পরিবর্তিত স্ট্রেনের নমুনা নিয়েছিলেন গবেষণা করার জন্য কিন্তু এর থেকে মারাত্মক স্ট্রেন এর একটি ভাইরাস তৈরি হয় যেই স্ট্রেনটি ১৯১৮ সালের মহামারীটির মতো ছিল।
বিজ্ঞানী কাওয়াওকার আসলে ফ্লুর আরও মারাত্মক সংস্করণ তৈরি করার কোন পরিকল্পনা ছিল না। তিনি কেবলমাত্র ফ্লুর মূল সংস্করণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন যাতে এটি কীভাবে পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাটি কিভাবে বাইপাস করতে সক্ষম হন তা অধ্যয়ন করতে পারেন।
মারাত্মক ভাইরাসটি একটি ল্যাবে সংরক্ষণ করা হয় এবং যদি কখনও ছেড়ে দেওয়া হয় তবে তা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
২) Bird Flu
কিছু ডাচ বিজ্ঞানী ইতিমধ্যে বার্ড ফ্লুর একটি মিউট্যান্ট এবং মারাত্মক সংস্করণ তৈরি করেছেন। প্রাকৃতিক বার্ড ফ্লু মানুষের মধ্যে সহজে সংক্রমণ হয় না। তবে গবেষকরা এটিকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছিলেন যাতে এটি মানুষের মধ্যে সহজে সংক্রমণ হতে পারে। তাদের নতুন ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য, গবেষকরা কিছু ফেরেটের (এক ধরনের বিড়াল) উপর এর নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন। ফেরেটগুলি বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ তাদের বার্ড ফ্লুর লক্ষণ গুলো ছিল মানুষের মতো।
এর দশ প্রজন্ম পরে, ইতিমধ্যে পরিবর্তিত ভাইরাসটি আরও রূপান্তরিত হয়েছে আর বায়ুবাহিত হয়ে উঠেছে।কিন্তু প্রাকৃতিক বার্ড ফ্লু বায়ুবাহিত রোগ নয়।
গবেষণাটি বিজ্ঞান মহলে বিতর্কিত হয়েছিল। এর বিতর্ক আরো বেড়ে যায় যখন বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি সবার সামনে প্রকাশ করতে চেয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছিলেন যে,সন্ত্রাসীরা এই গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে একটি মারাত্মক জৈবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে যা বিশ্বের অর্ধেক মানুষকে হত্যা করতে পারে।
৩) Unnamed Virus
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির গবেষকরা এই নামহীন ভাইরাস তৈরি করেছেন যা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং সত্যিকারের ভাইরাসের মতো আচরণ করে। Phi-X174 এর মতো এটি ব্যাকটিরিওফেজ তবে মারাত্মক।
নামবিহীন এই ভাইরাস তার চারপাশে যে কোনও ব্যাকটিরিয়াকে আক্রমণ করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এটি ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে ব্যাকটিরিয়ার শরীরে গর্ত তৈরি করে। গর্তগুলি দ্রুত বড় হয়ে যায়, ব্যাকটেরিয়াগুলির শরীর নষ্ট করে ফেলে। ব্যাকটিরিয়াগুলি এর পরেই মারা যায়।
এর ভীতিকর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, নামবিহীন এই ভাইরাস মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক নয় এবং গবেষনা চলাকালীন সময় মানব কোষগুলিতে আক্রমণ করে নি। তবে এটি প্রাকৃতিক ভাইরাসের মতো মানুষের কোষে প্রবেশ করতে পারে। এই ভাইরাসটি মানুষের জিনকে পরিবর্তন করতে পারে।
অদূর ভবিষ্যতে এটি যদি নিজেকে রুপান্তর করতে পারে তবে তা মানব জাতির জন্য হুমকির সম্মুখীন হবে।
৪) Phi-X17
Phi-X174 হ'ল ল্যাবরেটরিগুলিতে তৈরি করা আরও একটি কৃত্রিম ভাইরাস । এটি মেরিল্যান্ডের রকভিলের ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিকাল এনার্জি অল্টারনেটিভসের গবেষকরা তৈরি করেছিলেন। গবেষকরা প্রাকৃতিক Phi-X174 ভাইরাসের পরে কৃত্রিম ভাইরাসকে মডেল করেছিলেন। Phi-X174 একটি ব্যাকটিরিওফেজ ভাইরাস,যার মানে হচ্ছে এটি ব্যাকটিরিয়া্কে সংক্রামিত করে এবং মেরে ফেলে।
তবে মানুষের উপর এই ভাইরাসের কোনো প্রভাব ফেলেনি।
গবেষকরা কৃত্রিম ভাইরাসটি ১৪ দিনের মধ্যে তৈরি করেছিলেন, তবু এটি প্রাকৃতিক ভাইরাসের সাথে এতটাই সাদৃশ্যপূর্ণ যে এদের মধ্যে কোনও অমিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। গবেষকরা আশা করছেন যে নতুন ভাইরাসটি মানুষের উপকারের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে মিউট্যান্ট এবং কৃত্রিম ব্যাকটিরিয়া বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে।
৫) MERS-Rabies Virus Hybrid
বিজ্ঞানীরা একটি MERS-rabies হাইব্রিড ভাইরাস তৈরি করেছেন। এই হাইব্রিড ভাইরাসটির ধারণা হচ্ছে, এটি ভাইরাসটি ব্যবহার করে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করবে যা আমাদের উভয় ভাইরাস থেকে রক্ষা করবে। rabies একটি মারাত্মক রোগ যা সংক্রামিত কুকুরের কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। কুকুরের লালার মাধ্যমে সাধারণত এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে।
Middle East Respiratory Syndrome (MERS) একটি নতুন ভাইরাস যা কয়েক বছর আগে সৌদি আরবে প্রকাশ হয়েছিল। এটি সারসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং এটি বাদুড় থেকে উট এবং অবশেষে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। MERS প্রথম মহামারীর সময় ১,৮০০ জনকে সংক্রামিত করেছিল এবং ৬৩০ এরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এর মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ।
যেমন আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ২০০৩ সালে মহামারী চলাকালীন সারস আক্রান্ত হয়ে ৮,০০০ জনেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু মাত্র ৭00 জনেরও বেশি মারা গিয়েছিল। যদিও SARS এ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল বেশি , তবে এটির মৃত্যুর হার MERS এর চেয়ে কম। SARS আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ মারা গেছেন। আরেকটা দুঃখের সংবাদ হচ্ছে আপাতত, আমাদের কাছে MERS এর কোনও ভ্যাকসিন নেই।
চলবে....সাথে থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৫:০৪