সমাজ, ক্রমপরিবর্তনশীল কিন্তু অত্যান্ত শক্তিশালী একটি নিয়ামক যা একজন ব্যাক্তির পাশাপাশি পুরো একটি রাষ্ট্রের উথান-পতনে ভুমিকা রাখে।সমাজ আপন গতিতে চললেও বিভিন্ন সংস্কৃতি ,ধর্ম, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর উপর প্রভাব ফেলেছে আর ফেলছে। ফলে সমাজও তার আপন গতিতে চলার সময় বিভিন্ন পরিবর্তন কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন ও মাঝে মাঝে এক নতুন রুপ ধারন করছে।কিছু কিছু ব্যাপার যেমন একটি দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায় আবার কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা দেশকে টেনে কয়েক যুগ পেছনে নিয়ে যায়, সমাজকে করে তুলে বিভীষিকাময়। তেমনি কিছু প্রধান প্রধান কারন সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১) ছেলেমেয়ের দায়িত্ব সনাক্তকরন।
মুল ব্যাপার হচ্ছে, সমাজে ছেলে বা মেয়ে সবারই দায়িত্ব সনাক্ত করতে হবে।সামাজিকভাবেও ছেলে বা মেয়ের কর্মক্ষেত্র, কাজের গঠন , কাজের ধরণ, কাজের পরিধির যেমন রোডম্যাপ থাকবে তেমনি পারিবারিকভাবেও ছেলের দায়িত্ব ছেলেকে এবং মেয়ের দায়িত্ব মেয়েকে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং সেভাবে তাদের শিক্ষা দিতে হবে।
সেই সাথে সবচেয়ে দরকারি যে বিষয়টি তা হল, ছেলে ও মেয়ে উভয়কে শারীরিক ও মানসিকভাবে মোরালিটি শিক্ষা দিতে হবে। কোন সংস্কৃতি আমাদের সাথে খাপ খাচ্ছে , কোন সংস্কৃতি কোন জেনেরাশন কিভাবে নিচ্ছে,তারা স্কুল-কলেজের পরে বাকি সময় কিভাবে কাটাচ্ছে, কি কি সুযোগ সুবিধা সমাজে তাদের জন্য রয়েছে সব কিছুই সরকারি নজরদারি রাখতে হবে।
একবার চিন্তা করে দেখুন আমাদের সমাজে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার,ফার্মাশিষ্ট, উকিল সবই আছে কিন্তু সবাই নীতি ছাড়া।তাহলে সমাজের কি হবে?
আবার এভাবে চিন্তা করুন, আমাদের সমাজের ছেলেরা অর্ধ-অশিক্ষিত, সহজ-সরল কিন্তু তাদের সবারই একটা নীতি আছে।তাহলে সমাজটা কতই না সুন্দর হত।
ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, লিঙ্গের মানদণ্ড বিলোপ সামাজিক ক্ষয়ক্ষতিতে অবদান রাখে। আমাদের বুঝতে হবে ছেলে আর মেয়ে এক নয়।ছেলেদের কাজ ছেলেদের করতে হবে আর মেয়েদের কাজ মেয়েদের।মেয়েদেরকে নির্দিষ্টভাবে সামাজিকভাবে কাজ দিলে, সমাজে তাদের অবধান নিশ্চিত করলে মেয়েদেরকে আর কেউ অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে না,কেউ মনে করবে না যে মেয়েরা শুধু একটা ভোগ্যপণ্য।সমাজ থেকে ধর্ষণ, ইভতিজিং সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে যাবে।
সর্বোপরি সামাজিক অবক্ষয় রোধ হবে।
২) পরিবার পুনর্গঠন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, একেকটি পরিবার তাদের পরবর্তী প্রজন্মের চরিত্রের জন্য প্রভাবশালী, গঠনমূলক শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে।
একটি সুস্থ সমাজে, প্রতিটি পরিবার একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক প্রভাব দ্বারা নির্দেশিত এবং পরিচালিত হয়। কিন্তু একটি অস্বাস্থ্যকর সমাজে, পারিবারিকগুলি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গুলো ভেঙ্গে ফেলতে চায়।এই ভাঙ্গার ফলে পরিবারটি তাদের মুল সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যায় এবং চলমান, ভিত্তিহীন ও ভঙ্গুর একটি প্রজন্মের নেতৃত্ব দেয়।
পরিবারের অভ্যান্তরিন শৃঙ্খলা ,মূল্যবোধ আর পরস্পরের প্রতি দায়িত্বহীনতার অভাবে আমাদের সমাজের অনেক পরিবার ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে।এইসব ভঙ্গুর পরিবারের সন্তানদের উপযুক্ত নির্দেশনার অভাবে তাদের সৃষ্টিশীলতা অপ্রকাশিত থেকে যায় আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা সমাজের উপর বোঝা তৈরি করে।
বাংলাদেশের সরকার যদিও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করেছে কিন্তু বাস্তবিকভাবে এর প্রয়োগের ব্যাপারে সরকার উদাসিন।ছেলেমেয়ের পড়ালেখা নির্ভর করে তাদের মা-বাবার উপর।ফলে,রাষ্ট্রের নিজস্ব ধারণা থেকে পরিবার ও তাদের ছেলেমেয়ে, সর্বোপরি তাদের পুরো প্রজন্ম অনেক দূরে সরে যায়। ফলে রাষ্ট্রের চাহিদা আর প্রত্যাশার ফলাফলে বিস্তর ফারাক থেকে যায়।
সরকারের উচিত শিশুদের সম্পূর্ণ আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে গন্য করে একটি বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন করা এবং সর্বোপরি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া।
৩) ভার্চুয়াল জগতে বিচরন।
দৃঢ় নাগরিক বন্ধন সমাজের মৌলিক নীতি।আজ বিশ্বব্যাপি সবারই একটি প্রধান সমস্যা হল নাগরিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এর পিছনে মুলত ও প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়াই দায়ী। এই সোশ্যাল মিডিয়া এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যে একজন ব্যাক্তি তার সমস্ত ভাল কিছু শো করে তার প্রোফাইল তৈরি করে এবং সবার সাথেই তার সম্পর্ক তৈরি হয়।এই সম্পর্কের অন্তরজাল বাস্তবের সব সম্পর্ক ছাড়িয়ে আলাদা একটি সমাজ তৈরি করে যেখানে কারো কোনও নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ নায়। এই ভার্চুয়াল সমাজ আজ বাস্তবিক সমাজ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে বাস্তব সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। ।
সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ মডেলে পুরো দেশে ইন্টারনেট সবার কাছেই সহজলভ্য করে দিয়েছে।একটি জিনিসের উপযুক্ত ব্যাবহার,প্রয়োগ, সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না করে,সবাইকে এই ব্যাপারে শিক্ষা না দিয়ে সবার হাতে ইন্টারনেট তুলে দেয়ার ফলে এর ভাল দিক গুলোর চাইতে খারাপ দিকগুলো বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে অনলাইনে যৌন সহিংসতা,অপরাধ, হয়রানি এসব বেড়ে যাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মত, আধুনিক ভিডিও গেমও স্পষ্টভাবে ভার্চুয়াল জগতের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয়কারি।প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এমন সব গেম ডিজাইন করা হচ্ছে যাতে বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়রাও এতে আগ্রহ পাচ্ছে আর তাদের সেই ভার্চুয়াল পরিবেশগুলি মনে হচ্ছে পুরস্কৃত ও মজাদার আর বাস্তব জগৎ হয়ে পড়ছে কঠিন এবং বিরক্তিকর ।
যারা এই ভার্চুয়াল জগতের ফাঁদে যারা পড়েছেন তারা আর যাই করতে পারুক তারা তাদের নারী ও শিশুদের রক্ষার ক্ষেত্রে আর শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে অক্ষম।
তারা সেই মানুষ যারা কৃত্রিম কৃতিত্বের জন্য প্রকৃত ক্রিয়েটিবিটি ত্যাগ করে।
সমাজের মধ্যে পুরুষদের সেই কণ্ঠস্বর ধরে রাখতে হবে যাতে তারা সমাজের নেতৃত্ব, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কাধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাড়াতে পারেন।
৪) প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা
বর্তমান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, কল্পনা, আর কার্যকলাপ বিজ্ঞানের সাথে এতো ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, মানুষের সীমাবদ্ধতার সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগামিতা যোগ হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাচ্ছে। আগে মানুষ তাদের সীমাবদ্ধতার কারনে ধর্মীয় অনুভুতি, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ সমস্ত কিছুই কাজে লাগাত এবং ভাল-মন্দ বিবেচনার মাধ্যমে সমাজ কে এগিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে টেকনোলজির এতো বেশি উন্নয়ন হয়েছে যে, মানুষ আর তার বুদ্ধির চর্চা করার দরকার হচ্ছে না।মানুষ দিন দিন যান্ত্রিক মন মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। এই বুদ্ধিবৃত্তির সীমাবদ্ধতা তাদেরকে সমাজের প্রতি উদাসীন করে দিচ্ছে।
চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৫০