ব্যবসা ! যার শুধুমাত্র একটি লক্ষ্য থাকে আর তা হল মুনাফা। কোনও ব্যবসাই মুনাফা ছাড়া ঠিকে থাকতে পারেনা আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুলো তা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের পলিসি বা ফন্দি ফিকির করে থাকে।এর মধ্যে হয়ত কিছু পলিসি আছে ভালো আর কিছু পলিসি আছে যা মানুষ ও সমাজের ক্ষতি করে।কিছু কিছু পলিসি এতো কৌশলী যে,যার কারনে আমরা এর ভালো মন্দ বুঝতে পারিনা বা কোম্পানিগুলো সুকৌশলে এর মন্দদিকটা আড়াল করে রাখে।আমরা কি কখনো জানার চেষ্টা করেছি মন্দ দিক গুলো কি? আর এগুলো কি আমাদের সত্যিই শারীরিক বা মানসিক বা আর্থিক কোনও ভাবেই ক্ষতি করছে না?তেমন অসংখ্য অনেক ব্যাপারের মধ্যে আমি সামান্য কিছু ব্যাপার আপনাদের জানাচ্ছি।
১। সুপারমার্কেটের লাল, ফ্রেশ মাংসঃ
মাংস কেনার ব্যাপারে প্রথম যে ব্যাপার টা মাথায় আসে তা হল এর রঙ।লাল রঙের মাংস দেখতে কতই না ফ্রেশ লাগে।
ভালো। কিন্তু মাংস লাল রঙের হলেই যে ফ্রেশ হবে তা কিন্তু না।প্রতিষ্ঠান গুলো মানুষের এই সাইকলজি ব্যাবহার করে মাংস লাল রাখতে চেষ্টা করে।আর এই জন্য তারা ব্যাবহার করে কার্বন-মনো-অক্সাইড নামক ক্ষতিকর গ্যাস যেটা গাড়ির এক্সজস্ত দিয়ে বের হয়।তারা মাংস কে এই গ্যাস দিয়ে সিক্ত করে,ফলে এটি দেখতে লাল রঙের হয়ে যায়, এমনকি পচার পরেও।
মাংস সাধারণত কাটার কিছুদিনের মধ্যেই বাদামি বা ধুসর রঙ ধারন করে।এটি দূর করার জন্য তারা “modified atmosphere packaging (MAP)” টেকনিক আবিস্কার করেন,যাতে মাংস প্যাকেটে ঢুকানোর আগে কার্বন-মনো-অক্সাইডে উন্মুক্ত করা হয়।এর ফলে মাংস এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফ্রেশ দেখা যায়।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে,আমেরিকার ৭০% মাংস এ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত।
যদিও এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভাবে সোচ্চার হয়েছিলো,কিন্তু তাদের দাবি ধোপে ঠিকেনি।কারন, স্বভাবতই বিশাল ব্যাবসা আর অর্থ এর সাথে জড়িত।
২। “PLANNED OBSOLESCENCE” বা পরিকল্পিতভাবে বিলুপ্তকরন।
আপনারা অনেকে এই নাম প্রথম শুনে থাকলেও নাম শুনে আশা করি বুঝে গেছেন এর কাজ কি?এটি হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে আপনার ব্যবহারের যন্ত্রাংশের ক্ষতিসাধন করা। আর এটি করে থাকে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিজেই।এটা কোম্পানির একটা নীতিহীন পলিসি যাতে আপনি আপনার প্রোডাক্ট তাদের হালনাগাদ প্রোডাক্ট দ্বারা উন্নীত করেন।
সর্বপ্রথম গত বছর অ্যাপেল কে এই ব্যপারে দোষী করা হয়েছিলো।তাদের নামে অভিযোগ ছিল যে, তাদের পুরনো মডেলের আইফোন গুলো স্লো হয়ে যাচ্ছিল যাতে তারা নতুন মডেলের আইফোনের দিকে ঝুকে পড়ে।এই কাজটি তারা করেছিল গোপনে একটি স্পামকোড আপডেটের সাথে ঢুকিয়ে দিয়ে।
শুধু যে অ্যাপেল এই কাজ করে ধরা খেয়েছে তা কিন্তু না।বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্নভাবে এই স্যাবট্যাঁজ করে থাকে।তবে অধিকাংশই সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে এই কাজ করে থাকে।
গাড়ির কোম্পানির ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা দেখা যাই।এক্ষেত্রে তারা গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশ এমনভাবে তৈরি করে যাতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর যন্ত্রাংশ গুলো ভেঙ্গে যায় বা বিকল হয়ে যায়।আর নয়ত প্রতি বছর তাদের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি গুলো কে চালাবে?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই স্যাবট্যাঁজ আমেরিকাতে অবৈধ না।কিন্তু ফ্রান্স এই ব্যাপারে খুবই কঠোর।আজ যদি অ্যাপেল কোম্পানি ফ্রান্সএ হত তাহলে তাদেরকে বিপুল পরিমান জরিমানা গুনতে হতো আর হয়তো কিছু মানুষের হয়ে যেত ফাঁসি।
৩। গ্লুটিন ফ্রী – ফালতু একটা বিষয়।
দিন দিন মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে আর প্রতিটা পণ্য সন্মন্ধে ধারণা পাচ্ছে ঠিক তেমনি চিকিৎসক,ব্যবসায়ী আর প্রতিষ্ঠান গুলো নিত্য নতুন বুদ্ধি আর ধোঁকাবাজির মিশ্রণে প্রতিটি পণ্যকে করে তুলছে আকর্ষণীয় আর কৌশলী।তার মধ্যে গ্লুটিন ফ্রী খাদ্য হচ্ছে একটা সর্বাধুনিক ধোঁকা।এই ধোঁকাবাজির কারনে কার্বোহাইড্রেড সমৃদ্ধ ব্রেড এর বিক্রয় যেমন একটু কমে গেছে সেই সাথে গ্লুটিন ফ্রী মানুষের খাদ্য তালিকায় ভালোই স্থান পেয়েছে।
আজকাল বেকারির সব খাদ্যই গ্লুটিন ফ্রী দেখা যায়।এমনকি গ্লুটিন থাকার কথা না এমন সব খাদ্যতেও লেখা থাকে গ্লুটিন ফ্রী।গত ৩-৪ বছর ধরে এই ব্যাপারটা বেড়ে গেছে।
কিন্তু বাস্তব ব্যাপার হচ্ছে,অধিকাংশ মানুষের উপরই গ্লুটিন এর কোনও প্রভাব নাই।চিকিৎসকরা শুধুমাত্র যারা “CELIAC DISEASE” এ আক্রান্ত তাদের কেই গ্লুটিন ফ্রী খাদ্যের পরামর্শ দিয়ে থাকে।এই রোগটি হচ্ছে এমন যেখানে আপনার “immune system” গ্লুটিন দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।সাধারণত ১০০০ জনের মধ্যে ১ জনের এই রোগ দেখা যায়। বাকি সব হচ্ছে কোম্পানির ভণ্ডামি।
৪। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কারসাজি।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে,ফার্মা কোম্পানি গুলো তাদের ওষুধ বিক্রয়ের জন্য চিকিৎসকদের মোটা অঙ্কের টাকা প্রদান করে থাকেন।তাই বুঝতে পারছেন,ওষুধ বিক্রয়ের জন্য এর গুনগত মান বড় কথা নয়, চিকিৎসকের মন মেজাজ টাই বড়।কিছু কিছু কোম্পানি ওষুধের গুনগত মান বজায় রাখে,সে সব কথা আলাদা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে,একটা কোম্পানির রিসার্চ আর ডেভেলপমেন্টে যে টাকা খরচ হয় তার চেয়ে বেশি খরচ হয় এর মার্কেটিং এ, ডাক্তারের পিছনে। গত দশকের শুরু থেকে এই চর্চাটা চালু হয়।
টাকা ছাড়াও কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের বিভিন্ন ভেকেসন, ফরেন ট্যুর, গলফ কোর্স বা বিভিন্ন ভাবে এন্টারটেইন করিয়ে থাকে।
২০০২ সাল থেকে pharmaceutical research & manufactures of America” এই চর্চাটাকে বন্ধ করতে আর এই সেক্টরকে রেগুলেট করতে চেষ্টা করে। তারা চিকিৎসকদের সরাসরি টাকা প্রদান পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। যদি দরকার হয়,তবে তারা চিকিৎসকদের কোনও শিক্ষামূলক ভ্রমন অফার করতে পারে আর উপহারের ক্ষেত্রে এর মূল্যমান যাতে $১০০ এর উপর না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখে।
৫। প্রিন্টারের কালি –অরিজিনাল নাকি ক্লোন- কোনটা ভালো?
আপনি খেয়াল করে থাকবেন যে, প্রিন্টার কোম্পানি গুলো আপনাকে তাদের তৈরি কালি ছাড়া অন্য কালি ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত বা সতর্ক করে।তাদের মতে এই কালি ব্যবহার করলে আপনার প্রিন্ট কোয়ালিটি খারাপ হবে আর হয়ত প্রিন্টারের সমস্যা হবে।
এটি ডাহা মিথ্যা কথা।প্রিন্টার কম্পানিগুলা এই কাজ করে থাকে শুধু তাদের নিজেদের বিজনেস মডেলের জন্য।
প্রিন্টার প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানি যেমন- HP, EPSON,CANON এরা নিজেরা প্রিন্টার বানানোর চেয়ে প্রিন্টারের কালি ব্যাবসার সাথে বেশি জড়িত।তারা নামমাত্র মুল্যে প্রিন্টার বিক্রি করে শুধুমাত্র তাদের কালির ব্যাবসা চালু রাখার জন্য।আর এ দিয়েই তারা মুনাফা বের করে নেয়।
আর ৩য় পক্ষের কালি প্রস্তুতকারকরা শুধু কালি বানিয়েই থাকে যার ফলে তাদের কালির খরচ ৯০% কমে আসে।আর আমরাও কম খরচে কালি কিনতে পারি।
প্রিন্টার প্রস্তুতকারকরা কালির কার্টিজে একটি চিপ লাগিয়ে রাখে যাতে তারা বুঝতে পারে ৩য় পক্ষের কালি ব্যাবহার হচ্ছে কিনা।
তাছাড়া, এখন নির্দিষ্ট মডেলের প্রিন্টারের সাথে নির্দিষ্ট মডেলের কার্টিজ বানায় যার ফলে আমরা চাইলেও ৩য় পক্ষের কার্টিজ ব্যাবহার করতে না পারি।
বিখ্যাত কোম্পানি HP এ ক্ষেত্রে একটু অন্য ব্যবস্থা নিয়েছে।তারা তাদের প্রিন্টার এমন ভাবে প্রোগ্রামড করেছে যে, আপনি ৩য় পক্ষের কার্টিজ ডুকালেই স্ক্রীনে মেসেজ আসবে শুধু HP এর কালি ব্যবহার করতে।
আজ এই পর্যন্তই। সুস্থ থাকুন, চোখ-কান খোলা রাখুন। নিজের যত্ন নিজেই নিন। যত্নের নামে নিজেকে কারো হাতে সঁপে দিবেন না বা অন্ধ বিশ্বাস করবেন না।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:২১