চন্দ্র অভিযানের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। আমরা এও জানি যে এপোলো-১১ সর্বপ্রথম যান যা চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছিল। আমরা আর কি কি জানি? বহুল আলোচিত আর সমালোচিত এই অভিযান সন্মন্ধে অনেক কিছু লেখার আছে , আছে অনেক গল্প , কাহিনী। কিন্তু এর কিছু ভিতরের বা পিছনের কাহিনী আমরা কয়জনই বা জানি। সেরকম কিছু ব্যাপার চেষ্টা করেছি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আসুন জানি ব্যাপার গুলো।
১. নভোচারীদের ইউ,এস,এ র কাস্টমস ফর্ম পুরনঃ
ইউ,এস,এ র কাস্টমস বিভাগ এপোলো-১১ এর যাত্রী- নীল আর্মস্ট্রং, বাজ আলড্রইন এবং মাইকেল কলিন্স কে বাধ্য করেছিলেন কাস্টমসের ফর্ম পুরন করতে। সেই সাথে তাদের ঘোষণা করতে হয়েছিল তারা সাথে কি কি নিয়ে এসেছিলেন।এটি ঘটেছিল ২৪শে জুলাই ১৯৬৯ সালে, যেদিন তারা প্যাসিফিক সাগরের উপর দিয়ে হাওয়াইয়ের আশে পাশে কোনও এক সাগরে আছড়ে পরেছিলেন।এক্ষেত্রে ফ্লাইট রুট হিসেবে তারা উল্লেখ করেছিলেন Cape Kennedy, Florida থেকে Moon আর ফিরতি রুট Honolulu, Hawaii
কাস্টমস ফর্মে মালামাল হিসেবে “Moon rock and Moon dust samples”-এই দুইটি জিনিস নথিভুক্ত করেছিলেন। যদিও এসব মালামালের কোনও ট্যাক্স দিতে হয়েছে নাকি তা আদৌ জানা যায়নি।
২। নীল আর্মস্ট্রং এর চাদের বুকে ময়লা ফেলা।
নভোযানটি অবতরন করার পরও নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ আলড্রইন দুজনই কিছু সময় ভিতরে অপেক্ষা করছিলেন পরিস্থিতি বুঝার জন্য। সেই সময় বাজ আলড্রইন খাদ্য বর্জ্য আর অন্যান্য বর্জ্য ভরতি একটি পলিথিন এগিয়ে দেন আর্মস্ট্রং এর দিকে।আর্মস্ট্রং ইতিমধ্যে যান থেকে অবতরন করে অপেক্ষা করছিলেন। পলিথিন টি নেয়ার পর তিনি চাঁদের বুকে পলিথিন টি রাখেন।আর আলড্রইন প্রথম চাঁদের একটি ছবি নেন যেটিতে পরিস্কার ভাবে চাঁদের বুকে ময়লা ভর্তি পলিথিন দেখা যায়।
পরবর্তীতে নভোচারীরা আরও কিছু বর্জ্য আর যন্ত্রপাতি চাঁদের বুকে রেখে আসেন যাতে চাঁদ থেকে পাথর আর বালির নমুনা নিতে যথেষ্ট জায়গা হয়।এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে কিছু শুধু চন্দ্র অভিযানের জন্যই আলাদাভাবে বানানো আর কিছু ইমারজেন্সি যন্ত্রপাতিও আর চাঁদ আর পৃথিবীর মধ্যেকার দূরত্ব মাপার জন্য লেসার রিফ্লেকটরও ছিল।
দুইজন নভোচারী চাঁদে নামার পর আরও একটি কাজ করেছিল। তারা অবতরনের স্থান হিসেবে লুনার যান এর একটি অংশ ফলক হিসেবে স্থাপন করেছিল আর তাতে লেখা ছিল “Here men from the planet Earth first set foot upon the Moon. July 1969, A.D. We came in peace for all mankind.”
সেই সব যন্ত্রপাতি, লুনার যানের অংশ আর ময়লা ভর্তি পলিথিন এখনও বহাল তবিয়তে সেই চাঁদে রয়ে গেছে।
৩। চন্দ্রভিজানের সফলতা নিয়ে খোদ প্রেসিডেন্টের সন্দেহ।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই চন্দ্রভিজানের সফলতা নিয়ে খোদ সন্দেহে ছিলেন। এই জন্য তিনি একটি জাতির উদ্দেশে বলার জন্য একটি ভাষণও তৈরি করে রেখেছিলেন।নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উনার ধারণা ছিল নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ আলড্রইন এই দুজনই চাঁদে আটকে যাবেন। তারা আর ফিরতে পারবেন না।
নাসার Apollo 11 spacecraft নিয়ে কনফিডেনট থাকলেও লুনার মডিউল নিয়ে তাদেরও সন্দেহ ছিল।
নাসার ভয় ছিল হয়তো লুনার মডিউল ঠিকমত টেকঅফ করবে না বা যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিবে বা ঠিকমত টেকঅফ করলেও মুল command module এর সাথে কানেক্ট হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তাদের পরিনতি হবে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু, অনাহারে মৃত্যু অথবা আত্মহত্যা।
এই ভাষণ তৈরির জন্য নাসারও সহায়তা নেয়া হয়েছিল।তারা তাদের তৈরি ভাষণ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের স্পিচ রাইটার William Safire কে দিয়ে হোয়াইট হাউসে পাঠিয়েছিল চন্দ্রভিজানের প্রায় একমাস আগে।
তাদের কর্মসূচী ছিল ভাষণের আগে প্রেসিডেন্ট মৃত দুই নভোচারীর স্ত্রীদের ফোন করে সমবেদনা জানাবেন আর ভাষণের প্রথম লাইন ছিল , “Fate has ordained that the men who went to the Moon to explore in peace will stay on the Moon to rest in peace.”
৪। নীল আর্মস্ট্রং এর শুধু একটি ছবিই আছে যেটাতে সম্পূর্ণ শরীরের ছবি দেখা যায়।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে নীল আর্মস্ট্রং এপোলো-১১ এর দিকে মুখ করে কিছু একটা করছেন। আসলে চন্দ্রভিজানের সব ফটো কিন্তু বাজ আলড্রইন এর ক্যামরায় তোলা। নীল আর্মস্ট্রং এর কাছেও ক্যামেরা ছিল কিন্তু তার কাজ ছিল শুধু বাজ আলড্রইন এর ছবি তোলা।বাজ আলড্রইন কি মনে করে এই ছবি তুলেছিলেন তা তিনি জানেন না কিন্তু এই ছবি নীল আর্মস্ট্রং এর জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গেল।
৫। দুর্ভাগা ৩য় নভোচারী যিনি কখনই চাঁদ স্পর্শ করতে পারেননি।
আমি কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলাম যে,প্রেসিডেন্ট নিক্সন মৃত নভোচারীদের জন্য যে ভাষণ তৈরি করেছিলেন তাতে শুধু ২ জনের নাম ছিল।
কমান্ড মডিউলে যে যাত্রীটি ছিল তার নাম মাইকেল কলিন্স।নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ আলড্রইন যখন চাঁদে ঘুরাঘুরি করছিলেন তখন তিনি ছিলেন চাঁদের কক্ষপথে। তিনি নামতে পারেননি কারন কেউ একজনের কমান্ড মডিউলে থেকে কন্ট্রোল করার দরকার ছিল।তবে তিনি কন্ট্রোলের পাশাপাশি ছবিও তুলছিলেন।তিনি সর্বমোট ২০ ঘণ্টা একা মডিউলের ভিতর ছিলেন।
তাকে নির্দেশ দেয়া ছিল যে, অপর ২ জন যাত্রী যদি কোনও কারনে ফিরে আসতে না পারে তবে সে যেন দ্রুত ফেরত আসে।
তাদেরকে ফেলে একা চলে আসার এই নির্দেশ তাকে কুড়ে কুড়ে বিপর্যস্ত করছিলো।টাই সে যখন কক্ষপথে ঘুরছিল তখন সঙ্গীদের উদ্দেশে একটা নোট লিখেছিল যে, তোমরা যদি ফিরে না আসো বাকি জীবন এই যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরবে।
৬। আর্মস্ট্রং বলেছিলেন যে তাঁর বিখ্যাত উদ্ধৃতি ভুল ছিল ?
আর্মস্ট্রং কি বলেছিলেন যে,
“That’s one small step for man, one giant leap for mankind”
নাকি
“That’s one small step for a man, one giant leap for mankind”?
আপাত দৃষ্টিতে শুধু একটা এর পার্থক্য হলেও এই একটি কিন্তু পুরো বাক্যটির অর্থ চেঞ্জ করে দেয়।একটির অর্থ হচ্ছে “একজনের পদক্ষেপ” আরেকটি হচ্ছে “একটি জাতির পদক্ষেপ”। যদিও আর্মস্ট্রং বার বার বলছিলেন যে উনি আ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
আ শব্দটিতে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রথম কারন হচ্ছে রেডিওর অস্পষ্ট শব্দ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আর্মস্ট্রং এর North American Midwest accent।
৭। পতাকা নিয়ে বিতর্ক।
এই অভিযানের পরপরই দুইটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এর পতাকার মালিকানা নিয়ে দাবি করে। আরও দুটি কোম্পানি দাবি করেছে যে পতাকাটির জন্য ব্যবহৃত নাইলন ফ্যাব্রিক তারা সরবরাহ করেছে।যদিও নাসা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
নাসা একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিল যে তারা পতাকাটি সিয়ারস সিটি থেকে কিনেছিল যেখানে সেসময় Annin নামের একটা প্রতিষ্ঠান পতাকা সরবরাহের দায়িত্তে ছিলেন।অপরদিকে নাসার ইঞ্জিনিয়ার Jack Kinzler একটি বইয়ে লিখেছিলেন যে পতাকাটি সরকারের তালিকা থেকে কেনা হয়েছিল।যদি এটি সত্যি হয় তবে পতাকার মালিকানা গিয়ে দাড়ায় Valley Forge নামের প্রতিষ্ঠানের যারা সে সময় সরকারকে পতাকা সরবরাহ করতো।
সে হিসেবে Burlington Industrial Fabrics এবং Burnsville plant ও পতাকার জন্য ব্যবহিত নাইলনের মালিকানা দাবি করেছিল।
৮। নভোচারীদের লাইফ ইনসিওরেন্স।
আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, নভোচারীদের ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ আর সেই জন্য তারা ইনস্যুরেন্স করার চিন্তা করেছিল।কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলো
তাদের নিশ্চিত ক্ষতি বুঝতে পেরে বীমার দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল।ফলে এপোলো-১১ এর যাত্রীরা কিছু অটোগ্রাফ তাদের পরিবারকে দিয়ে গিয়েছিল যাতে তাদের মৃত্যুর পর সেগুলো তারা ভালো দামে বিক্রি করতে পারে।
এপোলো-১১ এর যাত্রীরা মিশনের অনেক আগ থেকেই পপুলার হয়ে গিয়েছিল আর তাদের অটোগ্রাফের জন্য তাদের ফ্যানরা ছিল মুখিয়ে।
তাই তারা তাদের অটোগ্রাফগুলো একটা খামে ভরে যাত্রার দিন তারিখ লিখে সাইন করে তাদের পরিবারকে দিয়ে গিয়েছিল যাতে তাদের ভাগ্যে যাই হোক তাদের পরিবারের একটা আর্থিক সাপোর্ট থাকে।
৯। Quarantined
আজকালকার কোন মিশনে নভোচারীরা মিশন শেষ করেই জনসাধারনের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু , তখনকার সময় যাত্রীরা চাঁদ থেকে আসার পর ৩ সপ্তাহ তাদেরকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছিল।
আসলে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা হিসেবে নাসা এই কাজটি করেছিল। নাসা তখনও নিশ্চিত ছিল না যে, চাঁদে কোনও microorganisms আছে কিনা।তাই নাসা সিধান্ত নিয়েছিল তাদেরকে আলাদা করে রেখে চাঁদের নমুনা আর স্পেস স্যুট ও অন্যান্য নমুনা পরীক্ষা করে দেখবে কোনও জীবাণু বা এর সংক্রমন আছে কিনা।
পরবর্তীতে এপোলো -১২ আর এপোলো -১৪ এর যাত্রীদেরও আলাদা করে রাখা হয়েছিল। এপোলো -১৫ থেকে নাসা এ ব্যবস্থা বাদ দেয় কারন ততদিনে তারা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে চাঁদে সেধরনের কোনও সম্ভাবনা নেই।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৬