জার্নি বাই নৌকা....উইথ দালাল ....টু ইতালি।
জার্নি বাই নৌকা....উইথ দালাল ....টু ইতালি। (পর্ব - ২)
আজ ২ দিন ধরে ট্রলার চলছে।ট্রলার এর দায়িত্তে আছে ১ জন মাঝি ও তার ২ সাগরেদ।আর রঞ্জুদের দায়িত্তে আছে ২ জন লোক।দেখতে আফ্রিকানদের মতো হলেও কথা-বার্তা,চাল-চলনে বুঝা যায় আফ্রিকান না।খুব অল্প পরিমান ইংলিশ আর মূলত ইশারা ইঙ্গিতে তাদের সাথে কথা বার্তা চলছে।২জন-ই খুব রুক্ষ প্রকৃতির।কথার চাইতে ধমক আর মারামা্রিতে সাচ্চন্দ বোধ করত বেশি।অলরেডি সবাইকে একবার জানিয়ে দিলো ,কেউ যাতে কোন ঝামেলা না করে।সে এই সব কাজ সামলাতে সে খুব দক্ষ।রঞ্জু শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল,ওস্তাদ এই যে আপনি এত এত লোককে দক্ষতার সাথে ইটালি তে নিয়ে যাচ্ছেন,আপনার কি একবার-ও ইটালি যেতে ইচ্ছে করেনি?এত লোকের ভাগ্য গড়তে সহায়তা করছেন,অথচ ঘুরে ফিরে আপনি এই ভাঙ্গা ট্রলারে ফিরে আসছেন কেন?রঞ্জুর ভঙ্গি আর বয়স দেখে ওস্তাদ ওর দিকে এমন রাগত ভাবে তাকাল যে রঞ্জু আর কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল।ওস্তাদ ওর সাগরেদের কানে কানে কিছু বলল।মনে হয় ইয়াং পোলাপান সব সময়ই ঝামেলার এই কথাটাই বলল। তবে রঞ্জু বুঝে গেল যে,রঞ্জুকে যাতে সবাই নজরদারিতে রাখে সেই ইশারা দেয়া আছে।রঞ্জু ইতিমধ্যে বুঝতে শুরু করলো যে,ট্রলারে উঠে সে কতো বড় ভুল ই-না করলো।তার বাবা, মা সবার কথাই মনে পড়তে লাগলো।তার বন্ধুবান্ধব, নীল টিপ দেয়া সেই মেয়েটি তাদের কাউকেই আর কখনো দেখা হবে না।তার পরিচিত চেয়ার, ফুলের টব, জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া দৃশ্য যত সব অদ্ভুত জিনিস তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। আগের জীবনটা এত সুন্দর ছিল তা আগে কখনও জানা ছিল না।
ট্রলারের মধ্যে খাওয়া বলতে শুধু ২ বেলা ভাত আর সাথে কিছু শুকনো মাছ।পানি ছিল সীমিত।প্রতিদিন শুধু নির্দিষ্ট সময়ে পানি পাওয়া যেত।এর পর মারা গেলেও আর পানি পাওয়া যাবে না।পানির জন্য বেশি জোর করতে গেলে সাথে আছে সঙ্গিদের খবরদারি,মাতব্বরি আর গালাগালি।তাদের কথা হল,ভাই পানি কি শুধু আপনি একলাই খাবেন?আমাদের সবারি তো বাচতে হবে।
ট্রলার চলছে তো চলছে।ওস্তাদ এর সারাদিন-ই মেজাজ খারাপ থাকত।ঝাল মেটাত ওর সাগরেদ এর উপর আর তার সাগরেদ রা ঝাল মেটাত রঞ্জুদের উপর।সকাল থেকে রাত অব্দি ট্রলার চলত।রাতে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হতো।টানা ৭ দিন চলার পর ট্রলার কোন এক দ্বীপে এসে থামল।সব লোক দেখতে কালো কালো টাইপ এর।ট্রলারের সবাই জায়গাটাকে আফ্রিকা বলে চালিয়ে দিলো।ট্রলার আধা বেলা ওই দ্বীপে ছিল।ওই আধা বেলা ওস্তাদ আর তার সঙ্গিদের ট্রলারের উপর ছিল করা নজরদারি।কারন কেউ যাতে ওই দ্বীপে নেমে যেতে না পারে।আসলে কেউ নেমে গেলে ওস্তাদদেরই সুবিধা।ট্রলারের রসদ কম ব্যাবহার হবে।কিন্তু তাদের ভয় ছিল তাদের কথা জানাজানি হয়ে যাবে এবং এতে তারা বিপদে পরবে।দীর্ঘদিনের রসদ নিয়ে ট্রলার আবার চলতে শুরু করলো।
গতকাল থেকেই রঞ্জু লক্ষ্য করছে সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা হিংস্র হিংস্র ভাব চলে এসেছে।সামান্য কথায় মারামারি,ছোটখাটো বিষয় থেকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে লাগলো।অথচ রঞ্জু তার মাঝে কোন চেঞ্জ খুজে পাচ্ছে না।শুধু গোঁফদাড়ি একটু লম্বা হয়ে গেছে।মুখ দিয়েও তিব্র গন্ধ আসছে আর চুল গুলো কেমন যেন কুকরিয়ে যাচ্ছে।সে ভাবল,”সি-সিকনেস” আস্তে আস্তে সবার মাঝেই আসছে।কারো আসছে মনে আর কারো আসছে শরীরে।সারাদিন শুধু রঞ্জু ট্রলারের আগায় যে গাছের পাটাতন টা আছে সেখানে বসে থাকতো,সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকত আর গুনগুন করে গান গাইত “আমায় ভাসাইলি রে...আমায় ডুবাইলি রে...আকুল দরিয়ার বুজি কুল নাই রে...”
ট্রলার চলছে সম্ভবত আজ ১২ দিন হবে।দিন তারিখের হিসাব অনেক আগেই ভুলে গেছে।ভাতের চালগুলো এখন দেয়া হচ্ছে আধা-সেদ্ধ অবস্থায়।গলা দিয়ে ঢুকতে কষ্ট হয়।সাগরেদকে জানাতেই বলল এভাবে খেলে খেতে আর না খেলে নাই।এই চাউল পেটে গিয়ে জমাটবদ্ধ হয়ে গেছে।আজ ২ দিন ধরে রঞ্জু টয়লেটে যেতে পারছে না।পেটের ভিতর কেমন যেন সুক্ষ ব্যাথা।অনেকবার টয়লেটে গিয়ে হাল্কা হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হল না।পেটের ব্যাথা মনে হয় আরও বাড়বে।পেথের ব্যাথা মনেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।হটাত কানে এলো ট্রলারে কেমন যেন চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে।দৌড়িয়ে বের হয়ে এলো এবং দেখল সাগরেদরা সবার কাছে যা যা আছে সব জোর করে কেঁড়ে নিয়ে নিচ্ছে আর সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে।কারন জিজ্ঞেস করতেই বলল,ট্রলারের ওজন নাকি বেশী হয়ে গেছে যা এই মধ্য সমুদ্রে খুব-ই ভয়ঙ্কর।রঞ্জু দৌড়িয়ে গেলো তার ব্যাগের কাছে এবং ব্যাগ থেকে সিডি গুলো বের করে কাঠের পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখল। যথাসময়ে সাগরেদ এসে তার কাছ থেকে ব্যাগ কেঁড়ে নিলো।সুদুমাত্র তাকে ভালভাবে চেক করলো আর তার অসাবধানতার দরুন সিডি গুলো দেখে ফেলল।সিডি গুলো নিয়ে ফেলার সময় রঞ্জু অনেক কাকুতি মিনতি করলো শুধু সিডি গুলো দিয়ে দেয়ার জন্য এবং সেই সাথে বাধাও দিতে লাগলো।এক পর্যায়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে রঞ্জুকে চড় মেরে দিলো এবং সিডি গুলো সমুদ্রে ফেলে দিলো।রঞ্জুর দু-চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো।
তার আশা ছিল শেষ সম্ভল হিসেবে সিডি গুলো তার কাছে রাখবে এবং কোনও এক দিন সে গানগুলো শুনবে।একেই বলে আশাবাদি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের আশা গুলো কতো তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার সেই তুচ্ছ আশা মানুষকে নতুন করে বাচাতে শেখায়।
ট্রলারের এই ঘটনার পর থেকে রঞ্জুর আর কিছু ভাল লাগে না।অথই সমুদ্রে খড়কুটো ধরে বাচার যে আশা ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল।সারাদিন শুধু ট্রলারের পাটাতন এর উপর বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকতো।চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছিল অসহায়।সেদিন রাতে সে তার বাবাকে স্বপ্ন দেখল।স্বপ্নে তার বাবা তাকে হাত বাডিয়ে ভাত খেতে ডাকছে আর বলছে এত রাগ করে থাকিস কেন বাবা,দুনিয়াটা তো দুদিনের।মন শক্ত করো। মধ্যরাতেই রঞ্জুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।উঠেই হাউ মাউ করে কান্না।সে মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে।হাউ মাউ করে কাঁদছে আর অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে,যেন আর একটু হাত বাডালেই বাবাকে ছোঁয়া যাবে।
(চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩০