আমি যে গ্রামে জন্মেছিলাম তার নাম বটিয়া। এটি ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার একটি সাবেক জয়পাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম। জয়পাড়া ইউনিয়নটি এখন পৌরসভা । এটি কখনো দোহার পৌরসভা আবার কখনো জয়পাড়া পৌরসভা নামে মাঝে মাঝে সাইন বোর্ড বদল করে। ২০০০ সালে নির্বাচনের পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি। ফলে এখানকার মেয়র-কাউন্সিলররা আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন বলে ধরে নেয়া যায়।
দোহার থানা থেকে গ্রামটি খুব বেশী দূরে নয়। ৫/৬ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে যাওয়া যায়। গ্রামটি মোটামুটি বড় না হলেও আদর্শ সাইজের একটি গ্রাম। একটি ছোট খাল (সাহেব খালীর খাল নামে পরিচিত) গ্রামটির পশ্চিমপাড়েকে একটি ছিট মহল বানিয়ে রেখেছে। সেখানে মাত্র ৩টি বাড়ি। এই ছিটমহলে আমার প্রথম আগমন। কাগরে কলমে আমাদের বাড়ি ছিল জয়পাড়া ইউনিয়নে। এখন দোহার/জয়পাড়া পৌরসভার অধীনে। তবে যেহেতু আমরা কোন পৌর সুবিধা ভোগ করি না তাই এখন আমরা পুরোমাত্রায় ছিট মহলবাসী।
ছিট মহল হওয়াতে আমাদের অংশে কোন চিঠি-পত্র আসত না। বাজারের বড় কোন দোকানের ঠিকানা দিলে চিঠি আসত। ভোটের সময় পাশাপাশি ২ টি ইউনিয়নের প্রার্থীরা ভোট চাইতে আসত আমাদের বাড়ি। দুই ইউনিয়নের পোস্টারই শোভা পেত আমাদের বাড়ির বেড়ায়।
বাড়ির সাথে খাল থাকাতে কিছু কিছু সুবিধার সাথে সাথে অসুবিধাটিই ছিল অনেক বেশী। কারণ খাল পার হয়ে অপরপাড়ের কারো সাথে খেলাধুলা করার সুযোগ আমার হয়নি। ফলে খেলার জগত থেকে আমি পড়লাম পিছিয়ে। অন্য পারের স্কুলে যেতে অসুবিধা। কারণ যেই সময়ের কথা বলছি সে সময় লটাখোলার কানাইয়ের খেয়া/গুদারা ছাড়া আর কোন খেয়া নৌকা ছিল না। অথচ বটিয়ার এক মাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান স্কুলটি খালের অপরপাড়ে অবস্থিত। তাই আমার খাল পাড়ের উপায় ছিল কলা গাছের ভেলা। নৌকা খুব বেশী মানুষের ছিল না। নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে অত নগদ টাকা কই যে নৌকা কিনবে? বাড়িতে কলাগাছ ছিল। তাই কেটে কেটে ভেলা বানানো হত।
কলাগাছের ভেলা বানিয়েও শান্তি ছিল না। কারণ, খাল পার হয়ে স্কুলে যাবার পর অন্য মানুষ তা নিয়ে চলে আসত। ফলে স্কুলের ছুটির পর আমাকে বাড়ি আসতে হত খাল সাতরিয়ে । এক হাতে বই আর জামা-প্যান্ট ধরে সেই হাতটি পানির উপর উচু করে ধরে অনেক কষ্টে সাতার কেটে খাল পার হতে হত। স্রোতের টানে অনেক দূরে গিয়ে উঠতাম। ততক্ষণে হাসফাস অবস্থা। ক্লাশ টেন পর্যন্ত খাল সাতরিয়ে পার হওয়া ছিল বর্ষা মৌসুমে আমার নিত্য দিনের ঘটনা।
এখন আমাদের নিজস্ব নৌকো আছে। আমি খুব ভাল নৌকো চালাতে পারি। এক নাগারে এক ঘন্টা বৈঠা চালালে আমার কোন কষ্ট হয় না। কত মানুষকে যে আমি এই জীবনে খাল পার করে দিয়েছি তার কোন ঠিক নেই। আগের মতো এখন আর সাতরিয়ে খাল পার হতে হয় না। তবে নৌকায় করে পার হবার সময় এখনো ভাবি কি করে একটি ছোট্ট বালক বই খাতা সহ সাতরিয়ে খাল পার হত ঐ ছোট্ট বয়সে।