somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডে ব্লো-আউট-দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের তিন বছর পূর্ণ ও দুর্নীতির মামলা

০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক গ্যাস ফিল্ডে ব্লো-আউট-দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় নি। বলতে দ্বিধা নেই, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের এই ব্যর্থতা মার অযোগ্য। এই ব্যর্থতার দায় বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারও এড়াতে পারেন না। আর তাই খানিকটা দেরিতে হলেও সরকার ক্ষতিপূরণের মামলা না করলেও দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছেন। বিগত যে সমস্ত সরকার কানাডিয়ান বহুজাতিক কোম্পানী নাইকো’কে এ দেশে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে অনুমতি দিয়ে জাতীয় সম্পদ ও স্বার্থকে ধ্বংস করেছে, তাদেরকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যায় না। বিগত লুটেরা সরকারগুলোর সহায়তায় বিদেশী কোম্পানীগুলো তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-কয়লা সম্পদ নিয়ে যেভাবে হার্মাদ দস্যুদের মতো লুটপাট চালিয়ে আসছিল বা ওই ধরনের লুণ্ঠন চালাবার লাইসেন্স পাওয়ার জন্যই অসম ‘উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি’ সম্পাদনের প্রক্রিয়ার শুরুটা জেনারেল এরশাদের আমল থেকেই। পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সেই লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতাই অব্যাহত রেখেছিল, মাত্রাটা বহু হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়ে। বিদেশী বিনিয়োগের নামে আমাদের দেশের বড় বড় দল বা সরকারগুলো জাতীয় স্বার্থকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলী দিয়ে জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ প্রক্রিয়াকে যেভাবে উন্মুক্ত করেছিল তার উদাহরণ কোনো সভ্য সমাজে পাওয়া যাবে না। ব্লো-আউটের দশ বছর অতিক্রান্ত হলেও মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য দুর্নীতির মামলা দায়ের না করায় গোটা অভিযানটাই প্রশ্নবিদ্ধ। তবুও দুর্নীতি দমন কমিশনের গৃহীত দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে নাইকো মামলাই হতে পারে তার শ্রেষ্ঠতম কাজের মধ্যে অন্যতম।
সকলের জানা যে, টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডে কানাডিয়ান বহুজাতিক কোম্পানী নাইকো’র দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ত্রুটির কারণে ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারী সংঘটিত দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডে এদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীব বৈচিত্র্য-জন সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। বিষ্ফোরণে খননকৃত কূপের রিগসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়, কূপ দিয়ে নির্গত বিপুল পরিমাণ গ্যাস প্রজ্বলিত হয়ে এবং বাতাসে উড়ে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে সৃষ্ট ফাটল দিয়ে গ্যাসের উদগীরণ ঘটে চলে, ওই এলাকার হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস-পানি-প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীব বৈচিত্র্য-জন সম্পদ বিপন্ন হয়ে পড়ে। আগুনে ঘরবাড়ি পুড়ে যায় এবং মানুষকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাচঁতে হয়। পেট্রোলিয়াম ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, এ রকম বিষ্ফোরণকে ব্লো-আউট বলে। এ ব্লো-আউট ১৯৯৭ সালের জুন মাসে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাগুরছড়া গ্যাস কূপে সংঘটিত দূর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। ১৯৯৭ সালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া গ্যাস কূপে এ ধরনের বিষ্ফোরণের পর ৩০ জুলাই ১৯৯৭ প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ওই বিষ্ফোরণটি মার্কিন বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী অক্রিডেন্টালের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ত্রুটির কারণে ঘটে এবং এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ গ্যাস ২৪৫·৮ বিসিএফ সম্পুর্ণ ধ্বংস হয়, যা উত্তোলন যোগ্য ছিল, তার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ সহ মোট তির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। তবে তদন্ত রিপোর্টে পানি সম্পদের ব্যাপক তি উল্লেখ করা হলেও পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার, পেট্রোবাংলা, জনগণ, ‘মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের তিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি’, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রা জাতীয় কমিটি, তেল-গ্যাস লুন্ঠন প্রতিরোধ ছাত্র-যুব আন্দোলন, তেল-গ্যাস লুন্ঠন প্রতিরোধ প্রচার সেল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, জাসদ, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, গণ ফোরাম, সাম্যবাদী দল, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, ১১ দল, জাতীয় গণফ্রন্ট, ৫ বাম দল, বিপ্লবী ঐক্য ফ্রন্ট, গণ সংহতি আন্দোলন, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, সিলেট বিভাগ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানসহ অসংখ্য ব্যক্তি ও সংগঠন বহুদিন থেকেই অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর কাছ থেকে এ টাকা তিপূরণ হিসেবে দাবী করে আসছে। কিন্তু কোম্পানী এ টাকা না দিয়েই আরেক মার্কিন কোম্পানী ইউনোকলকে দায়িত্ব দিয়ে সরে পড়ে। পরবর্তীতে অবশ্য একই কায়দায় তিপূরণের টাকা পরিশোধ না করেই ইউনোকল তার সমস্ত মালিকানা বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানী শেভরনের কাছে হস্তান্তর করে চলে যায়।
এদেশের জনগণের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সরকার জি-৮এর অন্তর্ভূক্ত সাম্রাজ্যবাদী কানাডিয়ান কোম্পানী নাইকো’র কাছে সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসকূপে হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ-পানি-প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীব বৈচিত্র্য-জন সম্পদ ধ্বংসের তিপূরণ দাবী করবে এবং যথাযথ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এËেত্র নাইকো কোম্পানী তার পূর্বসূরী মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টালের পথ অনুযায়ী গ্যাস সম্পদ-পানি- প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীব বৈচিত্র্য-জন সম্পদ ধ্বংসের মূল তিপূরণের প্রশ্নে নিরব। হয়তো একদিন দেখা যাবে যে নাইকো কোম্পানী নির্বিঘ্নে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই গ্যাসত্রেটির মূল তিপূরণ না দিয়েই চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের নামে অনভিজ্ঞ ও অপারদর্শী তেল গ্যাস কোম্পানী অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরন-নাইকো’র কাছ থেকে অবশ্যই তিপূরণ আদায়ের সকল পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সীমিত সম্পদের এই দেশের প েমূল্যবান গ্যাস-তেল সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এখনও সময় আছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তËেপর মাধ্যমে অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরন-নাইকো কোম্পানীর দায়িত্বহীন কর্মকান্ডের কারণে আমাদের দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ-পানি-প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীববৈচিত্র্য-জনসম্পদ-লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেষ্ট ধ্বংসের তিপূরণ পুরো মাত্রায় আদায় করার, তারা তিপূরণ দিতে না চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করা।
পত্রিকার রিপোর্ট, প্রাপ্ত তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের অভিমতে প্রতিয়মান হয় যে, টেংরাটিলা কূপে দূর্ঘটনার কারণ হলো মূলত কূপ নকশা ও খনন কর্মে ত্রুটি। এ ত্রুটির স্বরূপ ছিল ১৯৯৭ সালে খননকৃত মাগুরছড়া গ্যাসকূপে অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর ত্রুটির মতোই। মাগুরছড়া গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা শেষে প্রকাশিত রিপোর্টে এ ত্রুটিটিকে স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা হয় এবং এর দায় দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ওই কোম্পানীর অবহেলার ওপর বর্তানো হয়।
তেল-গ্যাস কূপ খনন করার জন্য কূপ নকশা ও খনন পদ্ধতি নির্ধারণে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক নিয়ম হলো, ওই স্থানের আশেপাশে অতীতে খননকৃত কূপের উপাত্ত বিশ্লেষণ ও খনন ইতিহাস বিবেচনা করা। অধ্যাপক ড· এম· শামছূল আলম ও অধ্যাপক ড· বদরুল ইমাম সহ অনেকেই তা-ই মনে করেন। অথচ মাত্র আট বছর আগে খননকৃত মাগুরছড়া গ্যাসকূপের দূর্ঘটনার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায় খনন কাজ করা হয়নি বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। উল্লেখ্য, মাগুরছড়ার গ্যাসকূপের ভ-ূগর্ভস্থ ভূ-তাত্বিক প্রকৃতি একই রকম। তাই টেংরাটিলা কূপে কত গভীরে কী প্রকৃতির শিলাস্তর বা কী প্রকৃতির গ্যাস-স্তর রয়েছে এবং এগুলো কী ধরণের আচরণ বা ব্যবহার করতে পারে খননকারীদের বিস্তারিত ভাবে জানা থাকার কথা। অধ্যাপক ড· শামছুল আলম ও অধ্যাপক বদরুল ইমামের মতে, এখানেই পাওয়া যায় কানাডিয়ান নাইকো কোম্পানীর অদতা ও অবহেলার সাø। বাংলাদেশী কোম্পানী বাপেক্সের এক অভিজ্ঞ খননবিদের মতে, ‘আমরা এ অঞ্চলে অনেক কূপ খনন করেছি ও অনেক কূপ খনন করতে দেখেছি। এখানকার ভূ-গর্ভের এহেন প্রকৃতি তে নরম বালুস্তরে কেসিং না করে খনন করে যাওয়া এবং গ্যাসস্তর পাওয়ার পর কেসিং ছাড়াই পাইপ পুলিং আউট করা নেহাতই অনভিজ্ঞতার সাø বহন করে কিংবা এটা একটা সুইসাইডাল অ্যাক্ট। মার্কিন কোম্পানী অক্সিডেন্টাল ১৯৯৭সালে ১৪ই জুন এ ভূলটি করে মাগুরছড়ায় গ্যাস কূপে দূর্ঘটনা ঘটায় আর কানাডিয়ান কোম্পানী নাইকো ২০০৫ সালের শুরুতেই তার পুনরাবৃত্তি করে চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
নাইকো কোম্পানী টেংরাটিলা গ্যাসকূপে গ্যাস দূর্ঘটনার কারিগরি ব্যাখ্যা যা দিয়েছিল, তা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। গত বছরের শুরুতেই নাইকো কোম্পানী সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাস কূপে খনন, উত্তোলন ও উন্নয়নের নামে কূপ খনন শুরু করে। ১৯৫৯ সালে আবিষ্ড়্গৃত গ্যাসকূপের পূর্বেকার একমাত্র কূপের কাছেই এ কূপের অবস্থান। কূপটি ভূগর্ভে প্রথম একটি নরম ও ভঙ্গুর বালুস্তর (যা ভূতাত্বিক ভাষায় এটি তিপাম স্যান্ড নামে পরিচিত) ভেদ করে নিচে চলে যায়। এ স্তরটি নরম বালিময় হলেও এটিতে কোনো কেসিং করা হয়নি। কূপটি স্টিলের পাইপ দিয়ে বেঁধে দিয়ে সুরতি করাকে কেসিং বলে। প্রায় ৪৭২ মিটার গভীরতায় পৌঁছে কূপটি একটি বড় কাদা শিলাস্তরে ভেদ করে নিচে পৌছলেই ৫৭২ মিটার গভীরতায় সাাৎ মেলে গ্যাস স্তর। গ্যাসস্তর ভেদ করে নিচে ৮০৭ মিটার গভীরতায় পৌছানোর পর খনন পাইপটিকে পুলিং আউট শুরু করা হয়। খনন পাইপ উপরে উঠিয়ে দিয়ে আসাকে পুলিং আউট বলে। এর ফলে নিচ থেকে গ্যাস প্রায় টান খেয়ে ওপরে উঠে আসতে শুরু করে, যা সোয়ারিং নামে পরিচিত। গ্যাস অতি কম সময়েই সজোরে উঠে আসতে থাকলে নাইকো কোম্পানীর খনন কর্মীরা গ্যাস প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় কূপটিতে গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করার ল েব্লো-আউট প্রিভেন্টার (বি ও পি) চাবিটি বন্ধ করে দেয়। প্রথমত এতে কিছুটা কাজ হলেও কিছুন পরেই তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এবং গ্যাসে আগুন ধরে গিয়ে তা বিপুলভাবে প্রজ্বলিত হয়ে বের হয়ে যেতে থাকে। এদিকে ভূগর্ভে ঘটে আরেক বিপত্তি। যেহেতু ভূগর্ভে নরম বালুস্তরটিতে (তিপাম স্যান্ড) কূপটি কেসিং করা হয়নি এবং তা খোলা ছিল, গ্যাস ওপরে ওঠার পথে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই নরম বালুস্তরে ঢুকে পড়ে ও বহু সংখ্যক ফাটল সৃষ্টি করে এবং সেই ফাটলসমূহ বরাবর ভূপৃষ্ঠের বহূসংখ্যক স্থান দিয়ে গ্যাস বের হতে থাকে। এভাবেই কেবল কূপ স্থানটিই নয়, বরং তার আশপাশের বড় এলাকা জুড়ে দুর্ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্যাসকূপ দুর্ঘটনার পর থেকেই কানাডিয়ান নাইকো কোম্পানীর কর্তব্যরত ব্যক্তিবর্গও দুর্ঘটনার কারণ বা দায় দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এদিকে কোনো কোনো মহল থেকে কিছু কিছু বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, যা অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে জনমনে একাধিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
১৯৯৭ সালে ১৪ জুন মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানী কর্তৃক মাগুরছড়ার গ্যাসকূপ দুর্ঘটনার যে কারণগুলো ৩০শে জুলাই প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে শনাক্ত করা হয়েছিল, টেংরাটিলা ঠিক একই কারণে দুর্ঘটনা কবলিত হয় বলে প্রতীয়মান। টেংরাটিলা কূপ ডিজাইন ও ড্রিলিংয়ের সময় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ ব্লো-আউট পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুলাই প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে শনাক্ত করা বিষয় সমূহকে অগ্রাহ্য করা হলো কেন ?
টেংরাটিলা গ্যাসকূপ উন্নয়নটি কানাডিয়ান নাইকো কোম্পানী (৬০%) ও আমাদের দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের (৪০%) যৌথ উদ্যোগে হওয়ার চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি বা লড়রহঃ াবহঃঁৎব সধহধমবসবহঃ পড়সসরঃঃবব গঠন করা হয়, যাতে নাইকো কোম্পানীর ৩ জন ও বাপেক্সের ৩ জন সদস্য রয়েছেন। কূপের ডিজাইন ও খনন পদ্ধতি সবই এই যৌথ কমিটির অনুমোদন ও তদারকীতে হওয়ার কথা । কিন্তু টেংরাটিলা কূপ খনন কার্যক্রমে বাপেক্সের অনুমোদন ও তদারকী ছিল না। বাপেক্সকে এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়নি। সর্বোপরি বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর ড্রিলিং চলাকালে চুক্তি অনুযায়ী ও নিয়মমাফিক পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি ড্রিলিং কাজ তদারকীতে ছিলনা। কোনো কোনো ব্যক্তি অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন যে, টেংরাটিলা গ্যাসকূপের বিস্ফোরিত গ্যাসস্থরটি পকেট গ্যাস জোন এবং এতে মূল গ্যাস জোনের বড়মাত্রার গ্যাস য়ের আশংকা নেই । প্রকৃতপ েএটি সঠিক তথ্য নয়, বলা যায় ডাহা মিথ্যা। এই গ্যাসস্থরটি পকেট গ্যাস নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গ্যাস জোন, যা ভূ পৃষ্ঠের নিচে ৫৭২ মিটার থেকে ৬৪৩ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। নাইকো কোম্পানী ও বাপেক্স কিছুদিন আগে যৌথভাবে ছাতক গ্যাসËেত্রর মজুদ নতুনভাবে নির্ধারণ করে, মোট মজুদ প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ঘনফুট, এ পরিমাণ গ্যাসের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫,৫৬৫·২১ কোটি টাকা। তার মধ্যে কেবল এ গ্যাসস্থরটিতে গ্যাসের মজুদ দেখানো হয়েছে প্রায় ১১৫ বিলিয়ন ঘনফুট। এ পরিমাণ গ্যাসের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা।
কেউ কেউ এই বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন যে, টেংরাটিলা গ্যাসকূপের ভেতর উচ্চ চাপ পরিলতি হওয়ায় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ তথ্যও সঠিক ছিল না। ছাতক গ্যাসËেত্র ইতিপূর্বে একটি কূপে প্রায় ২ হাজার মিটার খনন করেও কোনো উচ্চ চাপ (হাই প্রেসার) পাওয়া যায় নি। টেংরাটিলা কূপে শিলাস্তরে স্বাভাবিক চাপ বা নরমাল প্রেসার গ্রেডিয়েন্ট পরিলতি হয়। সুতরাং হঠাৎ উচ্চ চাপের সম্মুখীন হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে এ কথা সঠিক নয়।
আবার কেউ কেউ এই বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন যে, নাইকো কোম্পানীকে দেওয়ার আগে অতীতে ছাতক গ্যাসত্রেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। প্রকৃতপ েএই গ্যাসত্রেটি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে থাকার পর উৎপাদন স্থগিত ঘোষণা দেওয়া হয়, কখনো পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় নি। অধ্যাপক ড· এম শামসুল আলমের মতে, পুরো ব্যাপারটি ভূল ব্যবস্থাপনার শিকার। প্রকৃতপ েছাতক গ্যাসËেত্র উৎপাদন স্থগিত হওয়ার পর এখানে দেশীয় কোম্পানী বাপেক্সকে দিয়েই কূপ খনন করে গ্যাস উত্তোলন ও বিপণন করা যেত। এ জন্য বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীকে শেয়ার দেওয়ার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। আর্থিêক অনটনের প্রশ্ন অবান্তর। কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্যাস উত্তোলনের জন্য মাত্র ৩০ বা ৪০ কোটি টাকা দিয়ে কূপ খনন করা যায়। এই টাকা সরকার যোগান দিতে পারবেনা তাও মেনে নেওয়া যায় না। এছাড়া পেট্রোবাংলার যে উদ্বৃত্ত ফান্ড থাকে তা সরকার অনুমোদন করলে তেল-গ্যাসত্রে উন্নয়ন খাতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় না। কারিগরি দতার প্রশ্নও অবান্তর। ইতিমধ্যে বাপেক্স ফেঞ্চুগঞ্জ, সালদা নদী ইত্যাদি গ্যাস ত্রে আবিষ্ড়্গার করে উৎপাদন চালু রেখেছে। তাহলে মাগুরছড়া, ছাতক-টেংরাটিলা গ্যাসত্রেটিতে কূপ খনন করতে বাপেক্সের প েকোনো অসুবিধা ছিল না।
বাংলাদেশ সরকার এ দুর্ঘটনার কারণ ও দায় দায়িত্ব নির্ধারণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই গ্যাস দুর্ঘটনার কারণ দেশবাসীকে জানানো হয়েছে, কিন্তু তিপূরণের পরিমাণ যথাযথভাবে নিরূপণ করা হয় নি। এর দায় দায়িত্ব-অবহেলা ও ত্রুটি নির্ধারণ করে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কানাডিয়ান নাইকো কোম্পানী বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি এবং টেংরাটিলার গ্যাস সম্পদ-পানি-প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীববৈচিত্র্য- জন সম্পদ ধ্বংসের তিপূরণ আদায় করা যায় নি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যদি টেংরাটিলা-ছাতক-মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ-পানি-প্রাকৃতিক সম্পদ-পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীববৈচিত্র্য- জন সম্পদ ধ্বংসের তিপূরণ আদায় করতে না পারলে তা হবে জাতির জন্য চরম ব্যর্থতা। সরকারকে এ জবাব দিতেই হবে। এ ব্যর্থতার জন্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কাউকে মা করবে না। এদেশের জনগণের মূল্যবান গ্যাস সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে হবে। সরকার মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার তিপূরন আদায়ে উদ্দ্যোগী হয়েছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। অবশ্য ছাতক গ্যাস ফিল্ডে ব্লো-আউট-দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের তিন বছর পূর্তিতেও আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, এদেশের জনগণ সহ সকল রাজনৈতিক দল গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ রার আন্দোলনে এগিয়ে আসবেন। মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি যারা ধামাচাপা দিয়েছেন বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বিদেশী কোম্পানী অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল-শেভরনসহ আমাদের দেশের ওইসব দুর্নীতিবাজ সরকারের বিরুদ্ধে অবশ্যই দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে হবে। তবে এ কথাও আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিষয়টি যাতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১০:০৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×