সিনেমা হলে নায়ক যখন নায়িকার কোমর জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়, তখন জলিলের ১৪ বছরের শরীররটার ভেতর এক অদ্ভুত শিহরন ওঠে। হল ভর্তি দর্শকের মধ্যে বসে আলো আঁধারিতে চোখমুখ লাল করে ও মাথা ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখে। নাহ কেউ ওকে দেখছে না। শরীরের শিরশিরে অনুভূতিটা অভ্যস্ত হয়ে গেলে সিনেমার গল্পে হারিয়ে যায় ও। মাসের একদিন বন্ধ পেয়ে সিনেমা দেখতে আশার সুখটা প্রাণভরে উপভোগ করতে চায় জলিল।
রাত বারোটা বেজে পনেরো। হল ভাঙ্গার পরপর ফুরফুরে মেজাজে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটছে জলিল। আজকের সিনেমার গল্পটা ওর খুব মনে ধরেছে। আরে! এটাতো ওরই জীবনের গল্প। ওর মত সিনেমার নায়কের জীবনে এক মা বাদে আর কেউ নেই। নায়ক চায় তার বিধবা মা সবসময় সেজেগুজে খুশি মনে থাকুক। কিন্তু গ্রামের সমাজ এটা চায়না। বিধবার আবার সাজগোজ কি? গ্রামের লোক কটুকথা বলে। কিন্তু নায়ক সমাজের এই নিয়ম মানতে চায়। সত্যিইতো সেই যুগ কি আর আছে যে বিধবা হলেই সাদা শাড়ি পরে থাকতে হবে। দির্ঘ্যশ্বাস ফেলে জলিল, সেইযুগ হয়তো নাই, কিন্তু মানুষের মুখতো আছে। সেই মুখতো আর বন্ধ হয়না। মায়ের মুখটা মনে পড়ে জলিলের। সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয়। সামনের মাসের বন্ধে বাড়ি যাবে। তার আগে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবে। গাঢ় রঙের না হলেও হালকা সবুজ হতে পারে। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে খুব ভালো লাগে জলিলের। আজকের আনন্দটা দ্বিগুন হয়ে যায়। পরক্ষণেই মনে হয়, ইস বন্ধটা মাসে যদি দুদিন হতো তাহলে মায়ের কাছে আরো একটা দিন বেশি থাকতে পারতো। চাইলে ও ছুটি নিতে পারে কিন্তু একদিনের ওভারটাইম আর বন্ধ মিলিয়ে লসটা বেশি হয়ে যায়।
যাকগে, সামনের ঈদের বন্ধে বেশি সময় বাড়ি গিয়ে থাকা যাবে। মেইনরোড পার হয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ায় জলিল। অন্ধকার গলিটার এদিক ওদিক ভালো করে দেখতে চায়। বেশ অন্ধকার। কমিশনার ইলেকসনের আগে খুটিগুলোতে লাইট জ্বলবে মনে হয়না। গলির মুখটাতে দাড়িয়ে থাকে ও। অপেক্ষা করে যদি দুএকজন লোক পাওয়া যায় তাহলে তাদের সাথে করে গলিটা পাড় হবে।
এই গলিমুখে মাঝে মাঝে কিছু বেশ্যা আর হিজড়ারা খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। হিজড়াগুলো মুখে মেকাপ নিয়ে ঠোট লাল করে দাঁড়ায়। একদিন এমনি এক রাতে গলির ভেতর অন্ধকারের মধ্যে ভোজবাজির মত দুজন হিজড়া ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ওর চেয়ে একেকজন একহাতের বেশি লম্বা। এর আগে কোনদিন হিজড়া দেখেনি জলিল। এমন নারীসুলভ চেহারার মধ্যে থেকে যখন পুরুষালি গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে এল তখন ও ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছিলো । কম বয়সি একজন ছেলে পেয়ে হিজড়া দুজন খুনসুটি করেছিলো। একজন চোখ দিয়ে ইসারা করে দুপায়ের মা্ঝে হাত দিয়ে চাপ দিয়েছিলো। ডুকরে কেঁদে ফেলেছিলো জলিল। হিজড়া দুজন হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিলো। এরপর থেকে গলিমুখে এলে অন্য মানুষের জন্য অপেক্ষা করে জলিল।
ধুরও একজন মানুষেরও দেখা নেই। গলির মাথায় দাড়িয়ে ভেতরে ভালো করে তাকিয়ে দেখে জলিল। যতদুর দেখা যায় অন্ধকারে কোন মানুষজন চোখে পড়েনা। আবার সবদিন হিজড়াগুলো থাকেও না। যা থাকে কপালে। দুরুদুরু বুকে রওনা দেয় ও। তেমন ভয়ের কিছু নেই। হিজড়া যদি কাছে আসে দৌড় দিবে। বেশ্যা মেয়েগুলো কিন্তু হিজড়াদের মতনা। মেয়েগুলো কারেন্টের খুটির আড়ালে দুইচোখে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কখনো কাছে এসে খুনসুটি করেনা। কতদিন কল্পনায় মেয়েগুলোর সাথে সময় পাড় করেছে জলিল। কত সিনেমার নায়কের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কতশত গল্প পাড় করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এতসব ওলটপালট ভাবনার ভেতর দিয়েই গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে জলিল।
গলিটা লম্বায় একশ গজের মত। মাথায় একটি চায়ের দোকান। দোকানটা থেকে হাত তিরিশেক দুরে ফুটপাতের ধারে একটি প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। নিরিবিলি রাস্তাটাতে রাতের বেলা দুচারটে বাস, প্রাইভেট কার রাখা থাকে। অনেকে হয়তো গ্যারেজ ভাড়া বাঁচিয়ে রাস্তাটাকে ব্যাবহার করে। যাহোক, জলিল হনহন করে নির্বিঘেœ এতটুক পথ পারি দিয়ে চলে আসে। গাড়িটার কাছকাছি আসার পর সকালে কাজে যাবার কথা মনে হতেই ওর বেশ ক্লান্তি লাগে। ঘুম পায় ওর, সেইসাথে তলপেট ভারি হয়ে আসে। কোনকিছু না ভেবেই গাড়িটার আড়ালে লুঙ্গিটা হাটুর উপর তুলে পেশাব করতে বসে পড়ে জলিল। আয়েশি ক্লান্তি শরিরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দুচোখ বুজে সিনেমার নায়কের জায়গায় ও নিজেকে আবিষ্কার করে। গানের ছন্দে আচ্ছন্ন জলিল শহর থেকে গাঁয়ে চলেছে। পথে পরিচয় সেই মেয়েটির সাথে। কত রঙে কত ঘটনায় মেয়েটার রুপ বদলায়। এরপর তারা দুজন আসে মায়ের সামনে। হালকা সবুজ শাড়িটা পরে দুহাত তুলে মা দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দরই না লাগছে মাকে দেখতে। মনের আনন্দ আর বাঁধ মানেনা কখন মায়ের কাছে যাবে। হঠাৎ তীব্র টর্চলাইটের আলোক রশ্মি সাথে একদল মানুষের চিৎকার ওর আচ্ছন্নতা ছুটিয়ে দেয়। লোকগুলো বলছে,
- ঐ শালাই চোর কাল রাইতে এই শালাই গাড়ির পার্টস চুরি করছে। ধর শালারে।
হঠাৎ এমন আক্রমনে ভড়কে যায় জলিল। গাড়ির পাশে বসে প্রাকৃতিক কাজ সারাটাকেই দোষের মনে হয় নিজের কাছে। লুঙ্গিটা আধাভাজ করে কোমরে গুজে পড়িমড়ি করে দৌড় দেয় জলিল। পেছনে চোর চোর বলে ধাওয়া করে মানুষগুলো। ওর মাথায় কিছু কাজ করেনা। ওর মনে একটাই ভাবনা পালাতে হবে। অন্ধকার গলি ধরে ছুটতে থাকে জলিল। অদুরেই চায়ের দোকান। ছুট ছুট ছুট। ওর বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করে। দোকানের সামনে কজন লোক বসা। ওদের কাছে গিয়ে পায়ে পড়ে বুঝিয়ে বললে পাবলিকের মারের প্রথম ধাক্কাটা সামাল দেয়া যাবে। পরে বুঝিয়ে বললে লোকের ভুল ভাঙ্গতে পারে। চায়ের দোকানটা কাছে চলে এসেছে লোকজনের চোর চোর চিৎকারে দোকানের খদ্দেররাও উঠে দাঁড়িয়েছে। জলিলের বুকের সব বাতাস শেষ হয়ে আসে। শরিরের শেষ শক্তি কাজে লাগিয়ে জলিল দোকানের কাছে পৌঁছাতে চায়। আর একটু দুর, লোকগুলোকে বুঝিয়ে বললেই হবে.. হঠাৎ কেউ একজন ল্যাং মারে। চায়ের দোকানের সামনে মুখ থুবরে পড়ে জলিল। পেছন থেকে লোকগুলো এসে কলার ধরে টেনে তুলেই শুরু করে প্রচন্ড মার। কেউ লাথি মারে কেউবা চুলের মুঠি ধরে পেটে মারে ঘুষি। সবার একটাই কথা শালা গাড়ির পার্টস চোর। জলিল কোন কথা বলারই সুযোগ পায়না। একজন ঘাড় আর মাথাটা চেপে ধরে রাখে অন্য একজন বাঁশের লাঠি ভেঙ্গে বেধরক পেটাতে থাকে। জলিল একবার যেন বলতে পারে ভাইগো আমি চোর না ঐখানে মুততে বসছিলাম। সাথেসাথে চোয়ালের উপর ঘুষি এসে পড়ে।
- শালায় মিছা কথা কয়।
ওর কানে আর কোন শব্দ যায় না। চায়ের দোকানের খদ্দেরদের মাঝে একজন বলে,
- এই যে ভাইয়েরা ওর কথাটা একটু শুনে দেখেন, ওতো চুরি নাও করতে পারে।
- আরে রাখেন মিয়া। এদেরতো চেনেন না। এদের চক্র বিশাল একটারে টাইট দিলে বাকিগুলার খবর ঠিকই বাইর হয়ে যাইবো।
- হ ঠিক কথা। দেখেন গিয়া যে মায়া দেখায় সেও ঐ দলের কিনা। কারো কথা কানে তুলবেন না। মাইরে ঐ শালার হাড্ডি ভাইঙ্গা দেন। যার যায় সেই বোঝে। শালাহ।
- কেউ একজন জলিলের পরনের লুঙ্গিটা টান মেরে খুলে ফেলে দোকানের বাঁশের খুটির আগায় ঝুলিয়ে দেয়। খুটির মাথায় লঙ্গিটা পতপত করে উড়তে থাকে। অনবরত লাথি খেতে খেতে জলিলের দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দোকানের লাইটের আলোয় খুটিতে ঝোলানো লুঙ্গিটা ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকে। দুপুর রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে দুলতে থাকা লুঙ্গিটা যেন সবুজ শাড়ি হয়ে যায়। যে শাড়িটা পরে ওর মা খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। খালের উপর নৌকা ভাসিয়ে মায়ের কাছে যায় জলিল। আর একটুখানি যেতে পারলেই মায়ের হাতটা ধরতে পারবে। গায়ের সব শক্তি খরচ করে বেঠা চালায় জলিল। পথ ফুরোয় না, ফুরোয় না.. .. ..
লেখকের আত্নকথন :
চা খাবো বলে ঐ দোকানটার এককোনে চায়ের কাপ হাতে বসে ছিলাম। হঠাৎ করে একদল হিংস্র মানুষের মাঝে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। আমার দুর্বল অস্তিত্ব কন্ঠস্বর দিয়ে বের হওয়ামাত্র হিংস্রতার প্রবল প্রতাপে তা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আমি জলিলের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। মনে পড়ে ছোটবেলা বাবা বলতো মনে বেশি দুঃখ আসলে আকাশের দিকে তাকাস। দুঃখ কমে যাবে। আর মন ভালো থাকলে মানুষ দেখিস। কেননা মানুষই মানুষের পাশে দাড়ায়। ছায়া হয়ে রয়। হাত বাড়িয়ে দেয়। টেনে তোলে। আলো দেখায়। আজ এই দুপুর রাতে একদল উল্লাসরত মানুষের সামনে দাড়িয়ে আমি নিজের দিকে তাকাই। আমার অশ্লিল নগ্নতা আমার মনকে ভারি করে তোলে। নগ্ন আমি আকাশের দিকে তাকাই। অন্ধকার আকাশের বুকে জলিলের সবুজ লুঙ্গি পতপত করে ওড়ে। মনে মনে ভাবি ঐ লুঙ্গি দিয়ে আমি কি আমার নগ্নতা ঢাকার যোগ্যতা রাখি? পরক্ষনেই মনে হয়, জীবনের শেষ কোথায় তাই যখন জানিনা! তখন একটি সুন্দর সুখের প্রত্যাশা একজীবনের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিলে দোষের কি?
আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে হিংস্র পশুগুলোর উপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হই।