somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের গল্প

১৩ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চায়ের দোকানটা বেশ ছোট। বড়জোর একজন মানুষ বসে চা বানাতে পারে। দোকানের আশেপাশে অনেকটা খোলা জায়গা। পিচঢালা রাস্তার ধারে ঝকঝকে একচিলতে উঠোন । তারপরই বিশাল এক শিরিষ গাছ। গাছের নিচেই দোকানটা। সামনে দুপাশে বেঞ্চি পাতা। পেছন দিয়ে বয়ে গেছে সোহাগী নদী। গাছ আর দোকানের আড়ালে নদীর উপর চমৎকার একটা জায়গা আছে। এখানে আমরা কজন প্রতিদিন কোন কাজ ছাড়াই বসে থাকি। কয়েকটা বাশেঁর খুটির উপর পাটাতন, তার ওপর শীতলপাটি। বাঁশ দিয়ে বানানো ছোট সাঁকো পেরিয়ে পাটাতনটার ওপর যেতে হয়। পাঁচ ছজন বসার মতো জায়গাটা। কোন একসময় হয়তো মাছ ধরার কাজে ব্যাবহার হতো এখন আমরা এটাকে মেরামত করে বসার উপযুক্ত করে নিয়েছি। নদীর ধার ঘেষে বুনো গাছগাছালি থাকায় রাস্তার ওপর থেকে ওখানটায় চোখ যায়না। পাটাতনটায় বসলেই মনে হতো পৃথীবিটা আমাদের। আমরা মূলত চারজন। কলেজের পাট চুকিয়ে অলস সময় পার করছি। কখনো গলা খুলে গান গাই। কখনো কবিতার বই খুলে চিৎকার করে আবৃত্তি করি। আবার কখনো হালফ্যাসনের কাপড় পরে চোখে সানগ্লাস সেটে ভাবে বসে চা খাই। রাস্তা দিয়ে স্কুল কলেজের মেয়েরা হেটে গেলে উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমরা চারজনই ছিলাম কিছুটা অন্যরকম ( অন্তত আমরা মনে করতাম) । চারজনের বন্ধুত্বটা ছিলো বেশ। কিছু অসামঞ্জস্য থাকলেও কোন এক জায়গায় আমাদের ভাবনার মিল ছিলো। এমনও হয়েছে তর্ক করতে করতে লাথি মেরে একজন আরেকজনকে পাটাতন থেকে নদীতে ফেলে দিয়েছি। বাকীদের কোন বিকার নাই। দোকানদার মামু দাঁত কেলিয়ে গামছা বাড়িয়ে দিয়ে বলতো ” মাথাডা মুছি ফালাও নালী ঠান্ডা ধরি যাইবো”।

মাঝেমাঝে আমরা ভাবতাম ঠিক কোথায় আমাদের ভাবনাটা একরকম? আমাদের মাঝে দিপ্তটা একটু সাহিত্যভাব নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতো। ও বলতো আসলে জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা একরকম। আমরা জীবনটাকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে পছন্দ করি। যেমনটা পছন্দ করতেন চেগুয়েভা। জীবনের সব অর্জনের পরও তিনি আবার খুঁড়ে দেখতে চাইলেন। চলে গেলেন আবারও যুদ্ধে!! ওহ কি গভির জীবনবোধ। যদি খুঁড়ে দেখতে না চ্ইাতো তাহলে কি হতো? আমরাওনা ঠিক তেমনি...। দীপ্তর এধরনের কথা শুনলে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হতো পূরব। ও বলতো
- আ্যকচুয়ালি দোস্ত আমরা কি দিয়ে খুঁড়ি কোদাল না গাঁইতি?
- মানে?
- মানে উপকরনটা কি?
- উপকরনতো এখানে বাহ্যিক? এটাতো অন্তনিহিত, ভেতরের ব্যাপার...তুই আমার সাথে ফাজলামি করিস?
- তার মানে তুই বলতে চাইছিস অর্ন্তনিহিত গাঁইতি কোদাল নিয়ে খোঁড়াখুড়ি করতে হবে?
রুপমটা আবার দুজনের কথাই খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিত। প্রথমেই দীপ্তকে,
- ওই বেটা জীবনের কতটুকু দেখছিস যে এত খোঁড়াখুঁড়ির কথা বলিস? দুলাইন মার্কস পড়েই খুঁড়তে শুরু করে দিছিস? জীবনে কোনদিন শীতের রাতে মাথার তলে কেবল একটা ইট দিয়ে রাত পার করছিস? আগে কর তাইলে বুঝবি জীবনে খোঁড়াখুঁড়ি কত প্রকার ও কি কি? এবার পূরবকে, আর তুমি শালা গাইতি কোদালের কথা কও? থাকতো বাপের হোটেলে, আম্মুকে চাবি মারলে আব্বুর পকেটের দরজা খোলে আর ঝরঝরিয়ে টংকা পড়ে। তুমি জীবনের কতটুকু বুঝবা? শালাহ!!
ওর ভাবটাই এমন যেন জীবনের ক থেকে ঃ পর্যন্ত ওর মুখস্ত। আর আমার কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, তর্কের ব্যাপারে আমি বড়ই কড়া। আমার কথার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত আমি থামি না। এক পর্যায় লাথি খেয়ে আমি অথবা অন্য কেউ নদীতে না পড়া অবধি তর্ক চলতে থাকবে (যদি প্রতিপক্ষ চায়!)। তাই আমি চেষ্টা করি তর্ক কম করার অন্যরাও তাই।
সম্পর্ক নিয়ে আমার একটা ভাবনা ছিলো। আমার মনে হতো আমাদের পছন্দগুলোর মিল ছিলো। মিল ছিলো অনভূতির, অনুভবের। যেমন কখনো কখনো মহাতামাক খেয়ে পূর্নিমা রাতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। নৌকা চালাতো দোকানদার মামু। নাম তার চিত্তরঞ্জন। রাতভর নৌকা চলতো। নদীর ধারে, হয়তোবা কোন চরে নৌকা ভিরাতাম। নিস্তব্দ আর থমকে যাওয়া সময়ের মাঝে আমরা অনুভব করতাম, বিশাল খোলা আকাশ। চাঁদ, চাঁদের আলো। নৌকার গায়ে লাগা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আঙ্গুলে সিগারেট, সিগারেটের ধোঁয়া। সবকিছু মিলিয়ে নিস্তব্দতার অনুভব।
যাইহোক, এভাবেই এলোমেলো অলস সময় কাটছিলো। হঠাৎ একদিন প্রকৃতির নিয়মে আমাদের দীপ্ত প্রেমে পড়লো। প্রথম ব্যাপারটা টের পেলাম দীপ্তর হাতে একটা মোবাইল ফোন দেখে ( যে সময়টার কথা বলছি তখনো মফস্বলে মোবাইলের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেনি)। তার আগপর্যন্ত মোবাইল না থাকার কষ্ট ভুলে আমরা আলোচনা করতাম মোবাইল মানুষকে সস্তা করে দেয়। যখন খুশি কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলে হারিয়ে যাবার অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দীপ্তর গলার স্বর বরাবরই উঁচু ছিলো। কিন্তু মোবাইল হাতে আসার পর গনেষ পুরো উল্টে গেলো! প্রথম প্রথম ফোন এলে দীপ্তটা চোরের মতো মোবাইল বের করে ফিস ফিস করে কথা বলে আমাদের দিকে চোরা হাসি দিত। আমরা কোন কথা না বলে তাকিয়ে াকতাম। ও ব্যাখা দিত, আসলে দোস্ত মোবাইল একটাথাকলেও অসুবিধা নাই। এই দ্যাখ মোবাইলটা আমি বন্ধ করে দিলাম আর হারিয়ে গেলাম .. হাঃ হাঃ হাঃ। আমরা কোন প্রশ্ন করতাম না। তাতে ও আরও অস্বস্তিতে পরতো। আমরাও ঠিক তাই চাইতাম। সত্যি বলতে দীপ্ত তখন চাচ্ছিলো আমরা তাকে কোন প্রশ্ন করি, কিছু জানতে চাই। কিন্তু আমরা তা চাইতাম না। ওর পরিবর্তনটা আমরা উপভোগ করতাম। কখনো হয়তো দীপ্ত আগে এসে একা একা মন খুলে কথা বলছে আর হা হা করে হাসছে, আমরা তখন বেড়ার আড়ালে কান পেতে কথা শুনার চেষ্টা করছি। ও টের পেয়ে গেলেই আমরা উদাস হয়ে যাই। সে অবস্থায় দীপ্তর ফ্যাকাশে হাসি।
- কিরে তোরা কি করিস, আমার নির্লিপ্ত উত্তর চা খাই।
যাইহোক, প্রেম আর সিগারেটের ধোঁয়া কোনদিন আড়াল করা যায় না। তবে সিগারেটের ধোঁয়াকে মাঝেমাঝে যেমন কাগজের ধোঁয়া বলে চালিয়ে দেয়া যায়, ঠিক তেমনিভাবে দীপ্ত একদিন আমাদের সামনে তার মনের কথাটি পাড়লো।
- শোন আজ আমি তোদের একটা জরুরী কথা বলতে চাই।
- আমরা তাকিয়ে থাকি।
- না মানে বিষয়টা আমাকে নিয়েই, মানে আমার একটা ঘটনা..
- আমরা একে অপরের দিকে তাকাই।
- আমার একজন বন্ধু হয়েছে মানে.. বান্ধবী
- আমরা নির্লিপ্ত।
- না মানে শুধুই বন্ধবী, অন্যকিছু না। মানে তোরা যেমন ভাবছিস তেমন না হা হা হা।
- পূরব ঠান্ডাস্বরে, আমরা কি ভাবলাম?
- না তোরা কিছু ভাবিসনি, আমি বললাম আর কি হা হা হা।
- ও
- আসলে ও আমার খুব ভালো বন্ধু, এই তোদের মত আরকি। হা হা হা ও বোকার মত হাসতে থাকে। রুপম চরম মেজাজ খারাপ হওয়া চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক এরপরই ও যা বললো তার জন্য আমরা আসলেই প্রস্তুত ছিলাম না। বিষয়টা এমন, কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দীপার সাথে ( মেয়েটির নাম ) ওর পরিচয়। ওখান থেকেই বন্ধু। দীপার সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল কেনা। দীপা একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মারদাঙ্গা টাইপের মেয়ে । অন্যান্য পুতুপুতু স্বভাবের মেয়েদের মত না ( প্রথম প্রথম সবাই বলে)। ভীষন সাহসি এবং মুক্তমনা। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো, ওর জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মত। দীপ্তর ভাষায় খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা টাইপ। ইত্যাদি ইত্যাদি। আসল কথা হলো আমাদের লাইফস্টাইল দীপার পছন্দ হয়েছে। ও চায় পূর্নিমা রাতে আমাদের সাথে নদীর চরে বেড়াতে যেতে। রুপমের একার পে ওকে নিয়ে রাতের বেলা বেরাতে যাওয়া সম্ভব না। আমাদের সাহায্য বাদে ওর কোন ভরসা নেই।
কথাটা শোনামাত্র রপমের মেজাজটা চট করে সপ্তমে উঠে গেলো। কিছু বোঝার আগেই।
- শালা কুয়ার ব্যাঙ, আমাদের তুমি ইতিহাস পড়াও!!
এক লাথিতে দীপ্তকে নদীতে ফেলে দেয়। আমি উদাস মনে সিগারেট টানতে থাকি। এর পরের দৃশ্যটা আরো চমৎকার, দীপ্ত দোকানদার মামুর গামছা দিয়ে মাথা মুচছে আর হতাশমনে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কথা বলছে পূরব।
- দ্যাখ রুপম, ব্যাপারটা ঠিকমত না বুঝেই তোর লাথি মারাটা ঠিক হয়নি।
- রপম বলে, তুই একথা বলছিস, তুই?
- না মানে সব কথা না শুনে রেগে যাওয়া ঠিক না। আমার দিকে ফিরে পূরব বলে ঠিক কিনা সুমন, তুই বল?
- আমি বলি, ঠিক।
- কিসের ঠিক!! ওকি রাগার মত কোন কাজ করেনি?? জেদের সাথে বলে রুপম, লুকিয়ে লুকিয়ে কারে না কারে বান্ধবী বানাবে আর দুম করে এসে বলবে তারে নিয়ে চাঁদনি রাতে ঘুরতে যেতে হবে। তার আবার একা যেতে ভয় করে। শালাহ, যেন সিনেমার প্রডিউসার ওর শ্বশুর আর উনি হলেন নায়ক!! আরে রাত বিরাতে চারটা ছেলে একটা মেয়ে নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হচ্ছি লোক জানাজানি হলে কি হবে ভেবে দেখেছিস?
রুপমের কথায় একশভাগ যুক্তি আছে। ব্যাপারটা যে আমরাও ভাবিনি তা নয়। তারপরও বেচারা দীপ্তর দিকে তাকিয়ে এখন মায়াই লাগছে। শতহলেও বিষয়টা এখন ওর প্রেষ্টিজের ব্যাপার। পূরব ওর প নিয়ে কিছুটা দ্বিধার স্বরে বলে
- আরে আমরাকি লোকজনদের বলে বেড়াতে যাবো নাকি?
- রুপম আরো খেপে গিয়ে বলে, শালা তুই ঠিক করে বলতো দীপ্ত তোকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছে??
- যাই দিক তোকে বলতে হবে নাকি..
রুপম হা করে তাকিয়ে থাকে, যত যাই হোক ও ভেবেছিলো আমাদের পূর্ন সমর্থন ও পাবে। আমার দিকে ঘুরে বলে কিরে তুই কিছু বলবি না??
- আমি উত্তর না দিয়ে দীপ্তর দিকে তাকাই।
- দীপ্ত এই দীপ্ত আমার দিকে তাকা, তুইকি দীপাকে ভলবাসিস? সবাই দীপ্তর দিকে তাকায়। ও মাথা নিচু করে থাকে। কিরে কথা বলছিস না কেনো, ভালবাসিস?
- দীপ্ত যেন পাদ্রির কাছে কনফেসন করছে এভাবে বলে, আমি খুব ভালোবাসি কিন্তু ও মনে হয় বাসে না।
- আমরা সবাই চুপচাপ।
- তখন আমার সোজাসাপ্টা উত্তর, দ্যাখ আমার মনে হয় দীপ্তর জন্য আমরা একটা সুযোগ নিতে পারি।
কথা শেষ হবার পর রুপমের বিরক্তি আর হতাশাটা দেখার মতো ও হালছেড়ে দেয়া মাঝির মত তাকিয়ে থাকে। কী ভেবেছিলো আর কী হলো!! আসলে রুপমের বিরক্তির কারনটা আমরা বুঝি। আমাদের বন্ধত্বটাই এমন। চারজনের মাঝে আমরা নতুন কাউকে ভাবতে পারি না। তার মাঝে দীপ্তর প্রতি রুপমের টানটা একটু যেন বেশি। তাই ওর জেলাসিকে দোষ দেয়া যায়না। যাহোক আমার কথা শুনে দীপ্ত যেন প্রাণ ফিরে পায়। লাথি খাওয়টা নিমিষে হজম করে প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে দীপার কথা বলতে শুরু করে। আমরা উদাসমনে চা খেতে থাকি। সাক্ষী
দীপার সাথে দীপ্ত আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় রুপমের বাসায়। রুপমের আচরনটা তখন ছিলো দেখার মত। রোবটের মতো ওর হাটাচলা, কথা বলা। পরিচয় পর্বটা রুপমের বাসায় করানোর প্ল্যানটা ছিলো আমার। কারন বন্ধুর দুরে সরে যাওয়ার কষ্টটা আমাদের মাঝে রুপমের একটু বেশি হচ্ছিলো। আমার নজরটা ছিলো বিষয়টাকে যতটা সহজ করে তোলা যায় সেদিকে।
দীপ্তর খালাতো বনের পরিচয়ে দীপা যখন ঘরে ঢুকলো তখন আমি বেশ খুটিয়ে মেয়েটিকে ল করছিলাম। এমন কি আছে যার কারনে আমার ব্ন্ধু ওর প্রতি বাউল হয়ে গেলো। নিজেকে একজন অভিভাবকের ভূমিকায় আবিস্কার করে বেশ আতœতৃপ্তি হচ্ছিলো। সবকিছুর উর্দ্ধে বন্ধুর ভালোবাসা বলে কথা।

দীপার সাথে প্রথম পরিচয় পর্বটা কেমন হবে সেটা নিয়ে যে সংকোচ কাজ করছিলো খুব দ্রুত সেটা কেটে গেলো। কারন দীপার সম্পর্কে দীপ্তর কথাগুলো ভূল ছিলো না। চমৎকার মেয়ে দীপা। ব্যক্তিত্বটা বেশ। ওর সৌন্দর্যটা শুধুমাত্র রুপ দিয়ে বিচার্য নয়। ওর ভেতরের মানুষটিও বেশ সুন্দর। বেশ সহজেই ও আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলো। দীপা পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা আঁচ করে রুপমের সাথে যেচে পড়ে সম্পর্কটা সহজ করে নিলো। এক পর্যায় ও হয়ে গেলো আমাদের সবার বন্ধু, শুধুমাত্র দীপ্তর ভালোবাসার মানুষ নয়।

পূর্নিমার রাতে নদীতে বেড়ানোর কথা দীপাই শুরু করে। প্রসঙ্গটা ওঠামাত্র আমরা সবাই চুপ হয়ে যাই। কারন যতোই যাই বলি দীপার সাথে পরিচিত হওয়াটাই আমাদের কাছে মূখ্য ছিলো। মফস্বলের সামাজিকতায় এতজন ছেলেমেয়ে রাতে নৌকায় বেড়ানোর ভাবনাকে মাথায় আনিনি। দীপ্তও বিষয়টা বুঝতে পারছিলো। কিন্তু দীপা বুঝতে নারাজ। দিপ্ত বোঝায়,
- দ্যাখ দীপা, বোঝার চেষ্টা কর, দিনের বেলা হতো যেখানে খুশি সেখানে বেড়া, কোন অসুবিধা নাই, কিন্তু সমস্যা হলো রাত। লোকজন দেখে ফেললে নানা কথা তুলবে। এমনিতে মফস্বলে একটা কথা কতভাবে তীল থেকে তাল হয়। আর তুই হলি গিয়ে একটা.. ৃ..
- মেয়েমানুষ, তাইতো? মুখের কথা কেড়ে নেয় দীপা। শোন দীপ্ত, গত চার পাঁচদিন ধরে তোর এই ঈভটিজিং মার্কা কথা শুনে আসছি। পূরবের দিকে ঘুরে, আচ্ছা পূরব রাতের বেলা চড়ে আমাদের কোন মানুষ দেখতে আসবে?? তছাড়া আমি টমবয় সেজে যাবো। শার্ট জিন্স আর মাথায় ক্যাপ পরবো, দুর থেকে বোঝার কোন উপায় নেই আমি ছেলে না মেয়ে । পূরব কিছু বলতে যাচ্ছিলো এরমধ্যে রুপম আমার উদেশ্যে বলে, দোকানদার মামুকে নাহয় ম্যানেজ করা যাবে, কিন্তু কিছু একটা হয়ে গেলে কী জবাবদিহিতা করবো? দীপ্তর ভেতর আশঙকা আরো বেড়ে যায়, তুই যতো যাই বলিস, আশেপাশের মানুষদের নিয়ে অনেক টেনসন, না না এত রিস্ক নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এটা নিয়ে তুই আর অনুরোধ করিস না।
দীপা চুপচাপ শুনে নিচুকন্ঠে বলে,
- তোমরা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবা??
- আমরা জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকি, দীপা বলে
- তোমরা ভয় পাচ্ছো কাদেরকে নিয়ে? গ্রামের মানুষজনদের নাকি নিজেদের !!!
আমরা চারজন স্তব্দ হয়ে যাই। একধরনের পুরুষালি সপ্রতিভতায় হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত লজ্জার বাজ পড়ে। নিজেদের ভেতরটা কেমন কুঁকড়ে যেতে থাকে। দীপা পরিবেশটা আঁচ করতে পারে,
- আমি দুঃখিত, তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনি!
সবার প্রথম আমি নড়েচড়ে বসি, দীপ্তর দিকে চেয়ে বলি, দীপ্ত আগামী পরশু পূর্নিমা, ঠিক রাত দশটায় মামুর দোকানের পেছন দিয়ে নৌকাযাত্রা শুরু হবে। দীপা নরম স্বরে বলে সুমনকি রাগ করে প্ল্যানিং করলা ? আমি হেসে বললাম না দীপা, তুমি আমাদের নতুন বন্ধু তোমার সৌজন্যে আমরা সবাই পিকনিক করবো অনেক মজা হবে। দীপার চোখে কৃত¹তার হাসি ফুটে ওঠে। আমরা সবাই বসে প্ল্যানিং শুরু করি।
আমাদের গন্তব্য মনষার চর। নৌকার উপর রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া এরপর চরের বালুতে শীতলপাটি বিছিয়ে সারারাত আড্ডা। দীপা বাসায় বান্ধবীর বিয়ের কথা বলে বের হবে। এমন একটি আড্ডার জন্য মিথ্যে না বলে উপায় নেই। আমাদের সবার কাছে এবারের বেড়ানোটা অন্যরকম। তবে দীপ্তর কাছে সবচেয়ে আলাদা। ওরতো আনন্দের শেষ নেই। সবার ভেতর কিছুটা সংকোচ কাজ করলেও দীপ্ত দীপার ভালো লাগার মধ্যে দিয়ে তা কেটে যেতে থাকে।
ঠিক রাত দশটায় মামুর দোকানের পেছন দিয়ে আমরা নৌকায় উঠি। এর আগে দীপ্ত দীপার বিষয়টা মামুকে বললে কিভাবে নিবে এই ভাবনায় কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু মামু বেশ সহজ ভাবেই নিলো। যদিও আমাদের প্রতি মামুর পূর্ব ধারনা ভালোই তারপরও সহজভাবে বিষয়টা তার গ্রহন করাটা ভালো লেগেছিলো। সেদিনের জোৎস্নাটা ছিলো অপূর্ব। আমাদের সাথে বের হবে বলে মামু আগেই দোকান বন্ধ করে নৌকা রেডি করে রেখেছিলো। আমরা উঠে বসা মাত্র মামু নৌকাটাকে খানিকটা গভির পানিতে নিয়ে স্রোতের মাঝে হাল ধরে বসে। নৌকার মাঝে ছইয়ের তলে টিমটিমে হ্যারিকেনের আলো। আকাশভরা জোৎস্না, নৌকার গায়ে জোৎস্না মাখানো পানির সাথে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। মামুকে বললাম গান ধরতে, লোকটির গানের গলা চমৎকার। পুরো পরিবেশের সাথে মামুর গলাখুলে গান আমাদের কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। সবচেয়ে ভালো লাগছিলো দীপ্ত আর দীপাকে দেখতে। দুজনের চোখেই হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। একটা বিষয়ে আমি শিওর হয়ে গিয়েছিলাম তাহলো দীপাও দীপ্তকে ভালোবাসে। কারন দীপার চোখে আমি দেখেছিলাম দীপ্তর প্রতি ভালোবাসার বিশ্বাস। যে বিশ্বাস ওকে দীপ্তর সাথে অনিশ্চিতের পথেও পা বাড়াতে জড়তা কাটিয়ে দেয়। আকাশে ছাড়া ছাড়া মেঘ তার ভেতর দিয়ে গলে পড়া জোৎস্নাা। যতদুর চোখ যায় নদী আর নৌকাটা বাদে পৃথীবিতে আর কিছু নেই। চারিদিকে ঘোরলাগা অনুভূতি। বুেকর ভেতর চাপ চাপ ভাললাগা। সময়, সম্পর্ক, অস্তিত সবকিছু¡ ভাবনার মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যেন ভাবনার অনুভূতিটুকু বাদে আমার কোন অস্তিত্ব নেই, মিশে গেছি মহাবিশ্বের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকার সঙ্গে। এরমাঝেও ভেসে আসে কিছু স্বপ্ন, কিছু আকাংখা কামনাগত সম্পর্কের ভাবনা। পরনেই মাথায় আসে রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাষ্টার ” ফিরিয়া ফল কি পৃথীবিতে কে কাহার”। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবালুতা থেকে ফিরে আসতে আসতে অনুভব করি জাগতিক সকল সম্পর্কের ভাগফল নিঃশেষে ১ হয়।
মনষার চড়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত্রি বারোটার মত বেজে গেলো। ছেট এই চরটির বেশিরভাগ জায়গাই বালুতে ভরা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে চরটা দুশো থেকে আড়াইশো ফিট। জনমানুষের বসতি নেই। কারন বর্ষাার সময় চর পানিতে তলিয়ে যায়। চরটা নদীর মাঝামাঝি। আমরা যেখানটায় নেমেছি সেখান থেকে চরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দেখা যায়। দুপাশে গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষ সমান কাশবন। দীপ্ত বলতো এই কাশফুলগুলো পথের পাঁচালির অপু দূর্গার কাছ থেকে ধার করা। রুপম শুনে বলতো, চল কাশবনের ভেতর দিয়ে একদৌড় দেই, ওপাড়ে অপুদের ট্রেনটা দেখে আসি। আমরা হাসতাম প্রাণখুলে।
চরের বালুতে সবার আগে লাফ দিয়ে নামলো দীপা। পড়েই ও ছুটতে শুরু করলো। পেছন পেছন দীপ্ত
- এই দীপা স্যান্ডেল পর ভাঙ্গা শামুকে পা কেটে যাবে, বলতে বলতে দুজন উধাও। রুপম কিছুক্ষন ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে এরপর ভীষন বিরক্তমুখে রান্নার ষ্টোভটা জ্বালাতে জ্বালাতে বলে
- দীপ্ত শালার আনন্দ দেখেছিস, রান্না করবো আমরা আর দৌড়াদৌড়ি করবেন উনারা, শালাহ।
- পূরব বলে আমার কিন্তুু ভালোই লাগছে, দীপাতো আর দীপ্তকে নিয়ে দুরে সরে যায় নাই আমাদের মাঝেই আছে।
- তুমিতো বলবাই, কদিন পর দেখবো তুমিও একটারে ধরে এনেছো তেনার আবার অমাবস্যার রাতে শ্মশানঘাট দেখার সখ হয়েছে!! শালাহ...!
রুপমের কথায় পূরব জোরে হেসে ওঠে, হঠাৎ খেয়াল করে রুপম কঁটমট করে চেয়ে আছে, পূরব হাসি গিলে ফেলে, থাক বাবা পরে আবার কি করে বসে। না ঘাঁটানোই ভালো।
আমি আমাদের দোকানদার মামুর খোঁজ করছিলাম। ব্যাটা নৌকা বেঁধেই সম্ভবত মাছ দেখতে গেছে। চরের বিভিন্ন জায়গায় মামু জাল পেতে দিয়ে যায় পরে এসে খোঁজ নেয় মাছ পড়লো কিনা। আমি বেশি চিন্তা না করে রান্নার আয়োজনে মন দেই। বড় শীতলপাটিটা বিছিয়ে ফেলে তার উপর হাড়ি পাতিল নামাতে থাকি। পূরব লাকড়ির বান্ডিলটা এনে পাশে রাখে। রুপম পানির বোতলগুলো নামাতে ব্যাস্ত। দুর থেকে দীপ্ত দীপার খিল খিল হাসি ভেসে আসছিলো। পূরব কান পেতে কিছুক্ষন শুনে আমার দিকে চেয়ে বলে
- দোস্ত দীপ্ত গাধাটা যাই বলুক, আমি কিন্তু শিওর দীপাও দীপ্তকে খুব ভালোবাসে।
- আমি বললাম, কেন মনে হলো তোর।
- চোখমুখ দেখলে বোঝা যায়। তুই ওসব বুঝবি না। তোর আবেগ অনুভূতি অনেকটা রোবট শ্রেনীর। তবে আমি যা বললাম সেটা তুই পরে টের পাবি।
- পূরবের বলার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেলি।
- কি? হাসলি কেন? আমার কথা তোর ঠিক মনে হচ্ছেনা?
- ঠিক না কচু!! কোনদিক দিয়ে রুপম এসে পাটির ওপর পানির বোতল নামাতে নামাতে বলে। আসলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়াচ্ছে। দুদিন পর যখন ছ্যাকা দিবে তখন ওর কান্না দেখার জন্য আমরা বাদে কেউ থাকবে না দেখিস।
- এবার আমরা দুজনেই হেসে ফেলি। রুপম ভ্যাবাচেকা চোখে চেয়ে থাকে। আসলে সময় বলে দিয়েছিলো ওদের কি হবে? আর সে রাতে এসেছিলো এক অভূতপূর্ব সময়।
রান্না চড়িয়ে দেবার কিছুন পরই মামু চলে আসে। যা ভেবেছিলাম তাই। পাতানো জালে দুটা স্বরপুটি আর একটা বেশ বড় সাইজের একটা শোল মাছ আটকেছে। চাঁদের আলোয় মাছগুলি চকচক করছিলো। মামু মাছগুলোকে ঝটঁপট কেটেকুটে রান্না চাপিয়ে দেয়। এর মধ্যে খিচুরি, মাংস রান্না শেষ। দুর থেকে দীপ্ত আর দীপার ছায়া দেখতে পাই। দীপাকে মোটেই মেয়ে মনে হচ্ছিলো না। জিন্স, শার্ট, মাথায় ক্যাপ পরা দীপা দৌড়ে এসে বলে
- আমি কিন্তু তোমাদের কোন কাজেই সাহায্য করছি না, কারন আজকের চাঁদের আলোটা আমি উপভোগ করতে চাই। তোমাদের এর বিনিময় আমি স্পেশাল রান্না করে খাওয়াবো। মামা আপনারও দাওয়াত থাকবে মামিসহ।
বলেই হাসতে হাসতে দৌড় দেয় দীপা, পেছন পেছন দীপ্ত।
- রুপম গজগজ করে শালা ভেউরা। আমরা হাসি। মামুও হাসে। আমি বলি মামু তুমি মামিরে আনলে পারতা, তাহলে পিকনিকটা আরো মজা হতো।
- বলছিলাম, হে কয় রাইতবিরাতে চরের মইধ্যে ছুটাছুটি করা হইলো গিয়া পাগলগো কাম, আমি পাগল না। তয় তোমার লগের পাগলডিরে কইয়ো, আমাগো বাড়িত আইয়া আমার হাতের রান্ধন খাইয়া যাইতে। সেদিনও চান্নিপশর রাইত থাকবে া আর আমি উঠানে পাটি বিছায় দিবো।
বাহ.. আমি বলি এরকম একটা মামিতো আমাদের দরকার।
- রুপম বলে মামা? তুমিকি ভাইগা বিয়া করছিলা?
- মামু বলে মাইনে?
- মাইনে, পিড়িত কইরা আরকি..
- মামু গলা খুলে হাসে। কাশবনের ভেতর মামুর হাসি ভেসে বেড়ায়। ছড়িয়ে পড়ে পুরো চড়ে। দীপ্ত দীপা দৌড়ে আসে,
- দীপা বলে কি হলো এত হাসির কি হলো??
- আমি বলি এইমাত্র আরেকটা পিকনিকের দাওয়াত পেলাম।
- বাহ কোথায়?
- কোন এক চাঁদনীরাতে মামুর বাড়ির উঠোনে, মামি দাওয়াত দিয়েছে।
- গ্রেট, সেদিন মামি আর আমি মিলে রান্না করবো।
- দীপ্ত বলে তুই সেদিনও যাবি?
- হ্যা, আমার বন্ধুদের আর মামার যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে তোর কোন সমস্যা আছে? কি বলো রুপম?
- রুপম অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে হাসতে থাকে। ওর হাসি দেখে আমরাও হেসে উঠি।
এর মধ্যে কখন রাত তিনটা বাজে কারো খেয়াল নেই। রান্নার গন্ধে সবার পেট মুচড়িয়ে ওঠে। পূরব সালাদ বানিয়ে রেডি। সবাই খেতে বসে যাই। দীপ্ত বলে আজকের রান্নায় স্পেশাল একটা আইটেম যোগ হয়েছে সেটা কি জানিস? পূরব বলে কি? সেটা হলো জোৎস্না। রুপম ভাত চিবানো বন্ধ করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। আমি হেসে ওকে চোখ ইশারা করি। খাওয়ার স্বাদ হয়েছিলো অসাধারন। তার উপর মামা এনেছিলো মামির হাতে বানানো আঁচার। তাতে ষোলকলা পূর্ন হয়েছিলো।। খাওয়াদাওয়ার পরের পর্ব হলো গান। কথাছিলো সবাই গাবো, তবে গান শুরু করবে মামু। তার গানের গলা আসলেই সুন্দর। সুরের মাঝে মাটির টান পাওয়া যায়। চাঁদটা পশ্চিমদিকে হেলে পড়ছিলো বিশাল গোল থালার মত। সবার ভরা পেট চোখগুলো ঢুলুঢলু। মামুর দরাজ গলা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ভেসে বেড়াচ্ছিলো। সামনে রাখা নৌকা, নদীর পানি, কাশফুল, আকাশভরা জোৎস্না সবমিলিয়ে মনে হচ্ছিলো আমরা বুঝি কোন শিল্পীর আঁকা ক্যানভাসে ঢুকে পড়েছি। অপূর্ব প্রকৃতি।
হঠাৎ করে মামুর গলা থেমে যায়। দেখি কান পেতে চুপচাপ কিছু শোনার চেষ্টা করছে। আমরা নড়েচড়ে বসি। এতন আমরা যেন ঘোরের মাঝে ছিলাম। হঠাৎ নিস্তবব্ধতা আমাদের ঘোর কাটিয়ে দেয়। মামু খুব সন্তপর্নে এদিক ওদিক চায়। কিছু ঠাওর করার চেষ্টা করে। হঠাৎ ঘুরে আমাকে বলে একটা কান্নার আওয়াজ পাইতাছো? বাচ্চার কান্না!! আমরা কান পাতি। হালকা বাতাসে অনেকদুর থেকে মৃদু একটা সুরেলা গোঙ্গানির মত শব্দ ভেসে আসে। যারা গান শুনছিলাম তারা গানের সুরের সাথে এই সুর হয়তো মিলিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু যে ভেতর থেকে গায় তার সুরে অন্য সুর ব্যাঘাত ঘটায়। একারনে গায়ক মামুর কানে কান্না আগে ধরা পড়েছে। মনে হচ্ছিলো অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে শব্দটা।
- পূরব বলে, আরে নদীপাড়ে কোন বাড়ি থেকে আসছে শব্দটা।
- না মামু, এই চরের মইধ্যেই। একদম ছোট বাচ্চার কান্না। একথা শুনে রুপম চেপে গিয়ে দীপ্তর গা ঘেষে বসে।
- দীপা বলে এখানে এতরাতে মানুষ আসবে কোথা থেকে?
- দীপ্ত বলে আমারও তাই কথা। আচ্ছা জ্বীন টিন নাতো।
-আমি বললাম চল গিয়ে দেখি। জীবনে জ্বীন দেখারও একটা অভি¹তা থাকা দরকার হা হা হা। বোকার মত হাসলাম আর কেউ হাসলোনা।
- রুপম একটু ভিতস্বরে, আরে না কি দরকার!! আমার মনে হয় কেউ নৌকা ভিরিয়েছে সেখান থেকে শব্দটা আসছে।
- মামুও বললো তা হইতে পারে। চলো দেইখ্যা আসি।
- রুপম কাঁচুমাচু স্বরে কি দরকার!! গানটাইতো ভালো ছিলো।
- দীপা উঠে দাঁড়ায়, না না দেখতেই হবে বিষয়টা কি। যদি চোর ডাকাতও হয় তাহলে আমাদেরই আগে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এরপর আর বসে থাকা চলে না। সবাই উঠে দাঁড়াই্। সবার ভেতরে কেমন ছমছমে অনুভূতি কাজ করছিলো। আমরা কাশবনের ভেতরে ঢুকে যাই। কান্নার শব্দটা থেমে থেমে আসছে। অনেক দুর থেকে। কখনো যেন জোরে কখনো আস্তে। আমরা মামুর পেছন পেছন যেতে থাকি।
এরকম উথালি পাথালি জোৎস্নায় কান্নার শব্দটাও ছিলো ভয়াবহ। প্রকৃতির সৌন্দর্য তখন ভয়ংকর হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। কারন মনের উপর চাপ লাগছিলো। অজানার ভয়, অনিশ্চয়তার ভয়। মনে হয় সবারই এই অনুভূতি হচ্ছিলো । এর মাঝেও আমার একটু হাসি পেয়ে গেলো। দেখি রুপম শক্ত করে দীপ্তর হাত ধরে আছে। বেচারা দীপ্ত মনে হয় চাচ্ছিলো দীপার হাত ধরতে। কিন্তু রুপম দীপ্তর হাত ছাড়তে নারাজ।
কাশবনের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা এসে ফাঁকামত জায়গায় কান্নার শব্দটা যেন বেড়ে যায়। কিছুন আগে হালকা বাতাস শুরু হয়েছিলো। এলোমেলো বাতাস, দিকহিন যে কারনে শব্দটা ঠিক কোন দিক দিয়ে আসছিলো বোঝা যাচ্ছিলো না। মনের ওপর চাপটা আরো বাড়তে থাকে। কারন চরের আশেপাশে কোন নৌকা আমরা এখনো দেখিনি । তাহলে কিসের শব্দ। কিসের তা বলা ভুল হবে কারন একটা ছোট বাচ্চার কান্না তা সবাই বুঝতে পারছিলাম। ঠিক বামদিক বরাবর শব্দটা ভেসে আসছিলো। হঠাৎ আমাদের মামু দৌড়ে বামদিকের কাশবনে ঢুকে গেলো। আমরা হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। রুপম ফ্যাসফ্যাসে গলায় দুবার ডাকলো মামু, মামু। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি । এখন রুপম ধরে আছে দীপ্তর হাত আর দীপ্ত ধরে আছে দীপার হাত। সবাই বিমূঢ় যেন দাঁড়িয়ে থাকাটাই সত্য এবাদে আর কিছু নেই। মনে হলো দীর্ঘ্যন পর মামুর গলা ভেসে এলো। মামারা এদিকে আসো দেইখ্যা যাও।
আমি আর পূরব আগে হাটা শুরু করি। কাশগুচ্ছের ভেতর দিয়ে অন্যমাথায় চরের কিনারে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসি। দেখি মামু একটি টুকরির মত কিছু একটার উপর ঝুকে আছে। টুকরিটার ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আমরা টুকরিটা ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াই। দু তিন দিনের একটি ফুটফুটে বাচ্চা। বচ্চাটার কান্না তখন বন্ধ হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ড্যাবঢ্যাবে চোখ মেলে আমাদের দেখছে, কাঁথায় মুড়নো যেন ছোট একটা পুতুল। দীপা প্রচন্ড অবাক হয়ে দুর থেকে ভেসে আসা স্বরে, কি সুন্দর বাচ্চা, ও এখানে কিভাবে এলো? মামুকে খেয়াল করলাম দৌড়ে নদীর কিনারায় চলে গিয়ে এদিক ওদিক কি যেন দেখার চেষ্টা করছে, কিছু যেন খুঁজছে। আমরা হতভম্বের মত এদিক ওদিক তাকাই। দ্রুতগতিতে মামু আমাদের কাছে ফিরে আসে। বেশিন হয় নাই বুঝলা মামারা, অল্প কিছুন আগেই ফেলে গেছে, বালুর উপর পায়ের ছাপ ওখনো আছে। কিন্তু যারা এই কাজ করছে তারা আর এই চরে নাই। পালায় গেছে। দীপা তখনো বুঝে উঠতে পারে না। ও বলে কিন্তু এতটুকু বাচ্চাকে এভাবে ফেলে যাবে কেন? মামু বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বড় করে দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে, আহারে কার যে অবৈধ সন্তান। টুকরিটার ওপর মামু আরও ঝুকে পড়ে। আহারে সোনা আমার, বিধাতার এ কোন চক্রান্তে তুই পড়লি? কেনইবা তোরে আনলো আর কেনইবা....। দীপার চোখদুটো স্থীর হয়ে যায়। সব কিছু ওর কাছে পরিস্কার হয়। ঝুকে বাচ্চাটিকে বুকে তুলে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে কিন্তু আমরা এতন ওর কান্না শুনিনি কেন। আমি বলি হয়তো ঘুমিয়ে ছিলো সে অবস্থায় কেউ ফেলে চলে গেছে। আমি ঘুরে মামুকে বলি এখন কি হবে? কি আর হবে আমরাত আর নিতে পারবো না, এখানেই পড়ে থাকবে কাক শকুনে ঠোকড়ায় খাবে। এইডাই বাস্তবতা।
আমার চিন্তা ভাবনা কেমন ভোঁতা হয়ে আসে। সবার চোখের দিকে তাকাই। সবার চোখে কেমন এক ভাষাহীন আকুতি। কিছু বলার,কিছু শোনার, কিছু করার। কিন্তু আমরা কোন পথ খুঁজে পাইনা। কি করবো!!
- নাহ কাক শকুনে খাবে না, ও ভালো থাকবে। সবাই চমকে উঠি। কথাটা বলেছে দীপ্ত!! ওর গলার দৃঢ়তা শুনে ঘুরে তাকাই। এ কোন দীপ্ত! দীপ্ত দীপার দিকে ঘুরে বলে,
- আমার দিকে তাকা।
- দীপা বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে।
- আমাকে বিয়ে করবি??
- দীপা দুর থেকে ভেসে আসা স্বরে তার মানে??
- মানে সহজ তুই আমাকে বিয়ে করলে বাচ্চাটাকে আমরা দত্তক নিবো।
আমরা সবাই হা করে দীপ্তর দিকে চেয়ে থাকি। আর অপো করি দীপার উত্তরের। সেই অপোর প্রহর যেন শেষ হয়না। একজন মানুষের জীবনমৃত্যু যখন দুজন মানুষের ভালোবাসার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে তার জন্য অপোর প্রহর কত দীর্ঘ্য হতে পারে আমি জানি না!!
সময়টা ছিলো বড় অদ্ভুত। চাঁদ অস্ত যাচ্ছে। সূর্য্যরে প্রথম আলো আকাশটাকে নীল করছে। চরের বালুচরে অপূর্ব, অপার্থিব আলোয় দীপা বাচ্চাটিকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। তারপর ঠোটের কোনায় মৃদু হাসির আভা ছড়িয়ে দীপ্তকে বলে,
- আমাকে বিয়ে করলে খাওয়াবি কি?
- ক্যান আমি যা খাবো তুইও তাই খাবি।
- আমি চাকরি করবো, রান্নাবান্না ভালো লাগেনা। তুই কি আমায় রান্না করে খাওয়াবি?
- হ্যা... দরকার হলে বুয়া রাখবো।্
আকাশ ফাটিয়ে মামু হাসতে শুরু করে সাথে আমরাও। দীপা বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে নীল আকাশটাকে সামনে রেখে নদী পাড়ে হাটতে থাকে, পাশে দীপ্ত। এই চর নদী আর আকাশকে সাি রেখে ওরা ওদের স্বপ্ন সাজায়।
শালাতো গ্রেট প্রেমিক। আমি রুপমের কথায় ঘুরে তাকাই। ওর দুচোখ ভরা জল। দেখলি কিভাবে শালা একরাতে বাজিমাত করে দিলো। পূরব রুপমকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে।
আমি দেখি প্রাণ ভরে দেখি। এই দ্যাখার, এই ভালো লাগার যেন শেষ নেই। মামু গলা খুলে গান ধরে। ভোরের প্রথম আলোয় পৃথীবির সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্য দেখতে দেখতে বুকের ভেতর সুখের হাহাকার ওঠে। জীবন আহারে জীবন।
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×