কেউ একজন চারচাকার ঠেলাটাকে ঠেলছে। ধাক্কা দিলে একবার সামনে যাচ্ছে আবার পেছনে আসছে। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত লাগে বিরজুর। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরায়। ওপরে বাস টার্মিনালের ছাদের পাশ দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়। সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঘুমভরা চোখে ঠেলাগাড়িটার ভেতর থেকে উঁকি মারে বিরজু। যা ভেবেছিলো, এটা ভুলুর কাজ। ভুলু, বিরজুর পোষা কুকুর। মালিকের ঘুম ভাঙতে দেখে আগ্রহভরে মাথাটা এগিয়ে দেয় ভুলু। ওর খিদে পেয়েছে। পরক্ষণেই চটাশ করে কানের গোড়ায় থাপ্পর এসে পড়ে। কুঁই কুঁই করে দুরে সরে যায় ভুলু। আশপাশ থেকে আরো দু একজন ছন্নছাড়া মাথা উচু করে কুকরটাকে দেখে, আবার কাঁথার নিচে মুখ ঢাকে। ঢাকার আকাশে ভোর হয়।
দু একজন করে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। দুহাত তুলে আঁড়মোড়া কাটে বিরজু। পা দুটো মেলতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারেনা। চার চাকার ঠেলাটা বেশ ছোট। পা মেলে শোওয়া যায়না। চারকোনা একটি কাঠের বাক্সের নিচে চারটা চাকা লাগানো। পেছনে ঠেলার জন্য একটি হাতল। বিরজুর কাজ হলো বাক্সটার ভেতরে বিভিন্ন মালামাল ভরে টারমিনালের এমাথা থেকে ওমাথা ঠেলে নিয়ে যাওয়া আর বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দেওয়া। টার্মিনাল দোকান সমিতি ওকে একাজে রেখেছে। চারচাকার ঠেলাটা ওদেরই দেয়া। সারাদিন কাজ করে রাতের বেলা গাড়ির ভেতরই ঘুম। কবে থেকে একাজ করছে বিরজু ঠিক জানেনা। মাত্র আট বছরের জীবনের শুরুটা ওর খুব বেশি মনে পড়েনা। চোখ বন্ধ করলে ঝাপসা মনে পড়ে কালোমত একজন মহিলার মুখ। অনেক স্নেহমাখা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওই দুটো চোখ বাদে ওর জীবনে ওমন কোন চোখের আদর নেই। না আছে। আরো দুটি চোখ ওর কাছে হঠাৎ হঠাৎ স্নেহময় হয়ে ওঠে। সে হলো ভুলুর চোখ। মাঝে মাঝে কুকুরটাকে ওর মানুষ বলে মনে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে ভুলুর দিকে তাকায়। মালিকের থাপ্পর খেয়ে কিছুটা দুরে বসে আছে। বিরজুর তাকানো দেখেই কুঁই কুঁই করে কাছে এগিয়ে মাথা বাড়িয়ে দেয়। দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে ভুলুকে আদর করে বিরজু। ভুলু ওর গাল চেটে দেয়।
কলপাড়ে এসে দাঁড়ায় বিরজু। হাতে দাঁতের মাজন। সামসু মামু ওকে এই মাজনটা দিয়েছে। ডানহাতের তর্জনিতে মাজন গুড়া নিয়ে ও ঘষে ঘষে দাঁত মাজে। ভুলু একপাশে বসে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কুলি করতে করতে হঠাৎ বিরজুর মনে পড়ে আজ লোকগুলোর আসার কথা। একথা মনে পড়ার সাথে সাথে ওর রাগ লাগে। ঐ লোকগুলোকে ওর ভালো লাগে না। যেদিন ওরা আসে সেদিনটা ওর খারাপ যায় । মুখের মধ্যে পানির ঝাপটা মেরে সামসু মামুর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। মামু সবেমাত্র দোকান খুলে চায়ের কাপ পিরিচ গুছাচ্ছে। বিরজুকে দেখে বলে
- কিরে বিরজু মহারাজ। খিদা পাইছে?
- বিরজু মাথা নাড়ে।
- মামু একটা বনরুটি নিয়ে ওর হাতে দেয়। আর একটা পিরিচে কনডেন্স মিল্ক ঢেলে দিয়ে বলে, রুটিতে মাখাইয়া খাইতে থাক, চায়ের পানি বসাইছি।
- বিরজু রুটিটার অর্দ্ধেক ছিড়ে ভুলুর দিকে ছুড়ে দেয়। বাকিটা চিবুতে থাকে।
- মামু দোকান থেকে পানির জারটা নামিয়ে রাখে। বিরজু উঠে জারটাকে ওর ঠেলার ওপর তুলে নেয়। টারমিনালের অন্যমাথায় খালি জার রেখে ভরা জার নিয়ে আসতে হবে। এটা বিরজুর দিনশুরুর প্রথম কাজ। যাওয়ার পথে আরো কয়েকটি দোকান থেকে পানির জার তুলে নিতে হবে। ঠেলাটা নিয়ে রওনা দেয় বিরজু। মামু বলে
- আইজকা কিন্তু লেঙড়া মিজানের পোলাপান আইবো, মনে আছেতো? দুরে কোথাও যাইসনা।
- কথাটা শুনে আবারো বিরক্ত লাগে বিরজুর।
লেঙড়া মিজান এই এলাকার মা বাপ। তার দলের পোলাপানের তান্ডব মেনে এখানে ব্যাবসা করতে হয়। ওদের কথার উপর কোন কথা নাই। বিরজু অবশ্য এতকিছু বোঝেনা। মাঝে মাঝে লেঙড়ার পোলাপানরা আসে। বিরজুর তখন কিছু কাজ করতে হয়। কাজ তেমন কিছুনা, ওদের বলে দেয়া কাউন্টার নাম্বার শুনে ঠেলাটা নিয়ে ওখানে যেতে হয়। ওখানে কেউ একজন ঠেলায় কিছু প্যাকেট তুলে দেয়। ওগুলো অন্যান্য মালামালের নিচে রেখে লেঙড়ার পোলাপানের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। ঐ প্যাকেটে কি থাকে জানেনা বিরজু। জানার কোন ইচ্ছাও নেই। শুধু এতটুকু বোঝে ওর ঠেলা পুলিশ চেক করে না। তাই ওকে একাজটা করতে হয়। কাজ করতে আপত্তি নাই, কিন্তু লোকগুলারে ভালো লাগেনা। ওদের কথাবার্তা, হাসাহাসি, চোখের চাউনি সবকিছু মিলিয়ে ওর ভয় লাগে।
ধুর, মাথাটা ঝাকি মারে বিরজু। এসব নিয়ে এত ভাইবে লাভ নাই। ঠেলাটা শক্ত করে ধরে সামনে এগোয় । কদিন আগের কথা মনে করে। টার্মিনালে ওর বয়সি একটা মেয়েকে দেখেছিলো। কি যে সুন্দর মেয়েটা। লাল রঙের একটা ফ্রক পরা। দৌড়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক যায়। মেয়েটার বাবা মা বেঞ্চে বসে মেয়েটাকে দেখছিলো আর হাসছিলো। ওরা বাসের জন্য বসে ছিলো। বিরজু অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়েছিলো। ওর খুব ভালো লাগছিলো। এর দুদিন পর রাতে ঘুমিয়ে ও স্বপ্নে দেখে, ওমা, ওই মেয়েটার সাথে ও খেলে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা ওর বোন আর বেঞ্চে বসে থাকা উনারা ওদের বাবা মা। ঘুম ভেঙ্গে যাবার পরও বিরজুর ঘোর লেগে থাকে। সেই ঘোর আর কাটেনা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বড় একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে বিরজু। ও জানেনা ওর বাপ মা কোথায়। সামসু মামু ওকে বলেছে কেউ জানেনা কারা ওর বাপ মা। কোন একদিন সকাল বেলা মামু দোকান খুলে দেখে দোকানের সামনে টুকরির মধ্যে ছোট একটা বাচ্চা শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। মামুতো অবাক। এরপর অন্যান্য দোকানদাররা এসে দেখে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় ও এখানেই থাকবে সবার মধ্যে বড় হবে, কাজকাম করবে। সেই থেকে কখনো এর কাছে, কখনো ওর কাছে থেকে বড় হয় বিরজু। আর এখন ও বড় হইছে তাই একা একা ঠেলা গাড়িটার মধ্যেই থাকতে পারে। ওর একথা ভাবতে ভালো লাগে এখন ও বড় হইছে। এই ভাবনার সাথে সাথে ওর মনে আরেকটা ভাবনা উকি দেয়। এই টার্মিনালে ও আর থাকবে না। কোথায় যাবে তা ও জানেনা। শুধু জানে ও ওর বাপ মাকে খুঁজতে বের হবে। জানেনা কোথায় খুঁজবে শুধু জানে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবেই।
দুপুর পর্যন্ত কাজ করে বিরজু। এদোকান থেকে ওদোকান, একাউন্টার থেকে ওকাউন্টার চরকির মতো পাক খেয়ে বেড়ায়। সবসময় ওর সাথে থাকে ভুলু। কাজের ফাঁকে হোটেলের পেছনে গিয়ে বাসি ভাত তরকারি, মাছ মাংসের হাড়গোড় নিজেও খায় ভুলুকেও খাওয়ায়। দুপুরের পর কান্ত শরীরে ঠেলা ঠেলে সামসু মামুর দোকানের দিকে এগোয়। দুর থেকে দেখতে পায় লেঙড়া মিজানের পোলাপান দোকানে বসা। ওদের চেহারাগুলো ভয়ংকর। সিগারেট খেয়ে যেভাবে ধোঁয়া ছাড়ে বিরজুর কাছে মনে হয় এককটা যেন বাসের সাইলেন্সার পাইপ। সবার দাঁত, ঠোট কুচকুচে কালো। কোন কারণ ছাড়া ওরা ঠা ঠা করে হাসে আবার অকারনেই রেগে গিয়ে চোখগুলো ভাটার মতো লাল করে রাখে। ঠেলাটা নিয়ে দোকানের কাছে এসে দাঁড়ায় বিরজু। ওদের মধ্যে একজন খেকিয়ে ওঠে
- কিরে চোদানির পোলা আমরা কখন আইছি তুই জানোস?
- বিরজু চুপ করে থাকে।
- কিরে কথা কস না কেন? মাইর খাওনের শখ হইছে? কথা কবিনা?
- বিরজু কি বলবে খুঁজে পায়না।
- একজন এসে ওর পেটে খোঁচা মারে। এহ.. নবাবে পেটভরে খাইছেতো তাই ওহন গলা দিয়া স্বর বাইর হইতাছে না। খিক খিক করে হাসে।
- খাড়া আইজ তোরে কথা কওয়াই ছাড়ুম। একজন এসে টান দিয়ে বিরজুর লুঙ্গীটা ওর মাথার ওপর তুলে ধরে। বিরজু অসহায়ের মত হাতড়াতে থাকে। অন্যরা সবাই ঠা ঠা করে হাসে ।
- সামসু মামু বিড়বিড় করে বলে ছাইড়ে দেন পোলাপান মানুষ।
- একসময় লোকটা বিরজুকে ছেড়ে দেয়। প্রচন্ড রাগ লাগে বিরজুর কান্না পায়। ওদের মাঝে একজন বলে
- যাক মেলা তামসা হইছে। ওহন ১৯ নম্বর কাউন্টারে চলে যা। যাবি আর আইবি কুইক।
- পারুম না। ঘাড় গোজ করে বলে বিরজু।
- মাইনে। সবাই অবাক হয়।
- আমি আর এহানে থাকুম না।
- কই যাবি?
- যামুগা। এহানে আর কাম করুম না।
- একজন বলে কাম করবি না বুঝলাম কিন্তু যাবিটা কই?
- বিরজু চোখমুখ শক্ত করে বলে আমার বাপ মায়েরে খুঁজতে যামু।
ওর কথা শুনে সবাই কিছুণ চুপ করে থেকে অট্টহাসিতে গড়িয়ে পড়ে। ওদের মাঝে নেতা গোছের একজন বলে
- আরে আমরাই তো তোর বাপ তুই আবার কোন বাপরে খুঁজতে যাবি? হা হা করে হাসতে থাকে সবাই।
- বিড়বিড় করে সামসু মামু বলে, আহ এগুলানকি ওরে না কইলে হয়না? ছোডমানুষ।
- নেতা গোছের লোকটা বলে, ঠিকই কইছোস সামসু, ছোডমানুষ। ওতো আর বোঝেনা যে ও হইলো গিয়া বীর্য্য, মাইনে আমাগো সবার বীর্য্য! তাইতো ওস্তাদে ওর নাম দিছে বিরজুমিয়া। হা হা হা। ওরা একদল পিশাচের মত হাসতে থাকে।
বিরজুর দিকে তাকিয়ে মামু চলে যাওয়ার ইসারা করে। ও ঠেলাটা নিয়ে হাটা ধরে ।
আসলেই ওদের কথাবার্তা ঠিকমত বোঝেনা বিরজু। ওর শুধু রাগ হয়। অনেক রাগ। রাগের চটে পেটের মধ্যে কেমন মোঁচড় মারে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। চোখদুটো জ্বলে। সামনের পৃথীবিটা কেমন ঝাপসা লাগে। ঝাপসা চোখে ও ভুলুর দিকে চায়। ভুলুর মায়াভরা দুচোখ দেখতে পায়। ওই দুচোখ ধীরে ধীরে একজন কালো মহিলার চোখ হয়ে যায়। যে চোখে থাকে আদর। অনেক আদর। বিরজুর জীবনে অমন চোখের আদর আর নেই।