গ্রামের নাম অনুরাধাপুর। বাইক্কার বিলের পশ্চিমকোনে সদর রাস্তা থেকে কিলোখানেক ভেতরে এই গ্রাম। শীতের সময় বাদে গ্রামটাকে দ্বীপ বলা ভালো। বীলের উথালি পাথালি জলের মাঝে ছোট এই দ্বীপে বড়জোর শখানেক মানুষের বাস। শুকনার সিজনে সদর পর্যন্ত পায়ে হেটে যাওয়া যায়। অন্যসময় নৌকাই ভরসা। এই গ্রামের মিয়া বাড়ির উঠোনের পাশে, গোয়ালঘরটার পেছনে যে বছর লালুর জন্ম হয় সে সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। চোখ ফোটার পর চারপায়ে ভর দিয়ে লালু যেদিন উঠে দাঁড়ায়, সেদিন থেকেই ও দেখেছিলো মাটির কিনারে দাঁড়ালে বাকি পৃথীবি ভরা জল আর জল। কুইকুই করে মাকে চিনে নেওয়ার সাথে সাথে ও ওর পৃথীবিটাকেও চিনতে থাকে। সাদাকালো ছোপপড়া বাচ্চা কুকরটাকে গ্রামের সবাই ভালোবাসে। ঐ গ্রামে লালু আর ওর মা বাদে অন্য কোন কুকুর ছিলো না। লালুর বাবা শীতের শেষে সদরে গিয়েছিলো তারপর আর ফেরেনি। এর মাঝে বর্ষা শুরু হয়ে যায়। অনুরাধাপুর গ্রাম আবার দ্বীপে পরিণত হয়। লালুর মা লালুসহ আরো পাঁচটি বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাগুলোর চোখ ফোটার আগে হঠাৎ কোন একরাতে বীলের জলে সমুদ্রের গর্জন ওঠে। বানের টানে বাচ্চাগুলো ভেসে যায়। রাতের আঁধারে বানের জলে হাবুডুবু খেতেখেতে লালুর মা কেবল লালুকেই দাঁতে আটকে তীরে উঠতে পেরেছিলো। এরপর মায়ের সাথে একা একা বেড়ে ওঠা লালু যেন ছিলো কুকুরদের মাঝেও একটু বেশি ভোলাভালা। এই ভোলাভালা লালু একবার এক বীরত্বের কাজ করে ফেললো। একদিন সুনসান দুপুরে মিয়া বাড়ির ছেলের ঘরের ছোট নাতিটা জলে পড়ে গেলো। আশেপাশে তখন কেউ ছিলোনা। হঠাৎ গ্রামের মানুষ লালুর চিৎকারে বীলের ধারে দৌড়ে আসে। বাচ্চাটা তখন জলে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। লালু জলে ঝপিয়ে পড়ে বাচ্চাটার পাশে সাতরাচ্ছিলো। লালুও বুঝতে পারছিলোনা কিভাবে ব্চ্চাাটিকে জল থেকে তুলবে। তখন ও গগন বিদারি ঘেউ ঘেউ শুরু করে। তাতেই কাজ হয়। গ্রামের লোকজন ঝাপিয়ে পড়ে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে।
গ্রামের হাঁস মুরগি থেকে শুরু করে অন্যান্য পশুপাখিগুলোর সাথেও লালুর সুন্দর বন্ধুত্ব ছিলো। কতদিন ও হাস মুরগির ছানাগুলোকে চিল, বাজের আক্রমন থেকে বাঁচিয়েছে। কত ফড়িং, প্রজাপতির সাথে হুটোপুটি খেলেছে। গোয়ালের কোন গাভির বাচ্চা মাকে হারিয়ে কাঁদতে শুরু করলে লালু গিয়ে পথ চিনিয়েছে। এটা গ্রামের সবাই জানে। সবাই লালুকে ভালবাসে।
এভাবে লালুর জীবনে ৯টি মাস পার হয়। এক বর্ষার শুরুতে লালুর জ্ন্ম হয়ে ধীরে ধীরে শীতকাল এসে পড়ে। একদিন কুয়াসাচ্ছন্ন ভোরবেলা লালু গ্রামের কিনারে এসে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে দেখে জলের বুকে জমিনের দাগ। জল সরে গিয়ে সাপের মত আঁকাবাঁকা মাটির পথ চলে গেছে দুর থেকে বহুদুর। এতদিন গ্রামের মাটি আর জল ছাড়া পৃথীবি সম্পর্কে আর কোন ভাবনা লালুর ছিলোনা। তাই নতুন এই মাটির রাস্তা লালুর কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়। দিনের মধ্যে কয়েকবার করে ও গ্রামের কিনারে এসে দাঁড়ায়, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কদিন পর রাস্তার দুধারের জল আরো নেমে যায়। দুপাশে ঝোপঝাড় জলাভূমি জেগে উঠে। মানুষজন পথ দিয়ে আসা যাওয়া শুরু করে। লালু বুঝতে পারেনা মানুষগুলো কোথায় যায় আর কোথা থেকেইবা আসে। একদিন মিয়া বাড়ির ছোট ছেলে ঐ পথে নেমে লালুকে দেখে শিষ দেয়। লালুও সাহস পেয়ে পথে নামে। ছেলেটির পিছনে পিছনে যেতে থাকে। বেশকিছুক্ষণ পর পেছন থেকে মায়ের ঘেউ ঘেউ ডাক ভেসে আসে। ঘাড় ঘুড়িয়ে লালু তাকিয়ে দেখে অনেকদুরে ওদের ছোট গ্রামটাকে পিছে রেখে মা দৌড়ে আসছে আর রাগি স্বরে ঘেউঘেউ করছে। মায়ের ডাকে লালু বুঝে যায় মা চাচ্ছেনা ও দুরে যাক। ফিরে আসে লালু।
পরের কটা দিন লালু আর ওপথ মারায় না। কিন্তু ছোট গ্রামটার আদার বাদার যতই চষে বেড়াক, দিগন্তের টান যখন বুকে লাগে তখন তা ভুলে থাকা মুশকিল। কোন এক পূর্নিমা রাতে লালু এসে গাঁয়ের পশ্চিমকোনে দাঁড়ায়। ঝকঝকে জোস্নায় আঁকাবাঁকা পথের দিকে চেয়ে থাকে। দুকান খাড়া করে দুরের শব্দ শোনে। এতদিন জলের বুকের শব্দ কানে ভাসতো। আজ যেন শব্দের রকম পাল্টে যায়। দিগন্তের অজানা শব্দে লালুর রক্তে কাঁপন জাগে। সৃষ্টির আদি থেকে প্রাণিকুলের ভেতর অজানাকে জানার যে কৌতুহল তার টানে পথে নেমে আসে লালু। দৌড়াতে শুরু করে। পেছনে পড়ে থাকে ছোট গ্রাম অনুরাধাপুর।
আঁকাবাকা মাটির রাস্তা কেবলই দিগন্তের সাথে মিলিয়ে যায়। পথ যেন ফুরায় না। অজনা শব্দ কানের মাঝে আরো জোরে বাজতে থাকে। ধীরে ধীরে সূর্য্যরে আলো ফুটতে শুরু করে। বড় একটা বাঁক ঘুড়ে আঁধো আলো অন্ধকারে হঠাৎ দৌড় থামিয়ে মাথা উচু করে দাঁড়ায় লালু। অবাক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে থাকে। অদূরে সদরে ঢোকার মুখে হাইওয়ের রাস্তা দিগন্তের এপাস থেকে ওপাস চলে গেছে। রাস্তার উপর দিয়ে প্রচন্ড শব্দ করে ধেয়ে যাচ্ছে নানাধরনের যানবাহন। লালু পায়ে পায়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। হাইওয়ের পরই তিন রাস্তার মোড়। রাস্তার কাছাকাছি এসে নিরাপদ দূরত্বে একটা ঝোপের পাশে বসে।
তিনরাস্তার মোড়ে একজন ট্রাফিক পুলিশ ভোর ছয়টায় এসে ডিউটিতে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সদর রাস্তায় গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। নিয়ন্ত্রন করতে ট্রাফিক সাহেবের গলধঘর্ম অবস্থা। শুরু হয় তার খিস্তিখেউর। এটাই তার প্রতিদিনের ডিউটি।
ঝোপের আড়ালে লালু উঠে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপাড়ে একটা বাড়ির সামনে পুকুর দেখতে পায়। এতক্ষণ দৌড়ানোর জন্য লালুর জলের তেষ্টা পায়। ও বুঝতে পারে মোড়ের ঐ মানুষটাই চলন্ত জিনিসগুলোকে সামাল দিচ্ছে। লোকটার প্রতি লালুর বিশ্বাস তৈরি হয়। ও রাস্তা পাড় হতে চায়। কিন্তু এতগুলো য্ন্ত্রদানবের মাঝ দিয়ে পাড় হওয়া অসম্ভব। ও অসহায়ের মত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চায়।
ট্রাফিক সাহেব লালুকে দেখতে পান। একটু পরপর লালুর রাস্তার ভেতরে মাথা গলিয়ে দেয়া, তার জন্য গাড়ির হর্ন বেড়ে যাওয়া সব দেখে উনার মেজাজ সপ্তমে ওঠে। লালু কোনভাবেই রাস্তা পেরুতে পারে না। জলের তেষ্টায় ওর কষ্ট বেড়ে যায়।
ট্রাফিক সাহেব বিরক্তচোখে লালুর দিকে চেয়ে শিষ দেয়। এই শব্দটা লালুর পরিচিত। ও মানুষটার দিকে তাকায়, চোখে চোখ পড়তেই দুকদম এগোয়। সামনে দিয়ে দানবের মত শো শো শব্দে ট্রাক চলে যায়। অল্পের জন্য বেচে যায় লালু। রাস্তার ধারে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকে।
ট্রাফিক সাহেবের ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে। রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে চোখের কোন দিয়ে সে লালুকে দেখে। এদিকে শিষের শব্দে ভোলাভালা লালু ট্রাফিক সাহেবকে ভালবেসে ফেলে। ও চুপচাপ ট্রাফিক সাহেবের ইসারার অপেক্ষায় থাকে।
একসময় রাস্তা কিছুটা ফাকা হয়। ট্রাফিক সাহেব হঠাৎ একটা হাত উপরে তোলে। লালু সন্তপর্নে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় একটা বাস আসতে দেখা যায়। হাত দশেক দুরত্ব থাকতে ট্রাফিক সাহেব শিষ বাজায়। লালুও দৌড় দেয়। লালুর দৌড় দেখামাত্র ট্রাফিক সাহেবের ঠোটের কোনে হাসিটা আরো দীর্ঘ্য হয়।
লালু দৌড়ে বাসটাকে পার করেই ভুলটা বুঝতে পারে। পেছনেই আরেকটা ট্রাক দানবের মত ধেয়ে আসে। লালু বুঝে ফেলে আর কিছু করার নেই। তবুও জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে ও লাফ দেয়। এর মাঝে ট্রাফিক সাহেবের চোখের দিকে তাকায়। খিকখিক করে হাসতে থাকা আনন্দে মত্ত মানুষটার দিকে তাকিয়ে লালুর শুধু মনে হয়, মানুষ এমন কেন?
পাঁচদিন পর একটা সিটি করপোরেশেনের গাড়ি তিন রাস্তার মোড়ে এসে থামে। গাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে রাস্তার উপর ব্লিচিং পাউডার ছিটায়। সামনে ডিউটিরত ট্রাফিক সাহেব নাকে রুমাল চেপে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুত্তার বাচ্চাটাকে অভিসম্পাত দেয়।