আমার মোবাইলে তোলা প্যানারোমা ডি সেন্ট মার্টিন।
সিলেট থেকে ফিরেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম রোজার পরে আবার কোথাও বেড়াতে যাব। আমার কপালটাই এমন ভাল যে ১৫-১৬ রোজার দিকে যখন সিলেট ভ্রমনের সফরসঙ্গী ও আমার ছোট ভাই ডাঃ সাগর বললো যে আমি সেন্ট মার্টিন যাব কিনা, তখন কোন কিছু না ভেবেই বলে দিলাম "যাব"। 'যাব' কি মতলব 'যাবই-যাব'


মজার ব্যপার হলো, পুরো ম্যানেজমেন্টে আমাকে কিছুই করতে হয় নাই, ছোট ভাইগুলি আমাকে কিছুই করতে দেয় নাই। আমি সেরাম আরাম করছি, খাইছি-দাইছি-ঘুমাইছি আর হেগেছি, বদের হাড্ডি পুলাপানগুলা এর জন্য আমার নাম দিলো গ্রীক দেবতার নামানুসারে "হাগলেজিয়াস"




ঈদের পর দিন রাতে আমারা রওনা দিলাম। বাসে যাব, টিকেট আগেই কাটা ছিলো (লাষ্ট মুহুর্তের টিকেট








আমাদের গাড়ি টেকনাফ পৌছালো সকাল ৭:৩০ মিনিটে। সেখান থেকে শিপে সেন্ট মার্টিন। বাজেটের টানাটানিতে আমাদের কপালে সিট জুটলো না, ফলাফল স্ট্যান্ডিং জার্নি বাই শিপ ফর্ম টেকনাফ টু সেন্ট মার্টিন।
কেয়ারী সিন্দাবাদের ডেকে আমি, অভি ও সাগর।
অভি,সাগর,সুজন ও সাদ ... আরে আমি কই ??? আমার ছবি নাই কেন ???

তবে নাফ নদীর দুই পাড়ের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য সাথে সাগরের উথালি-পাথালি ঢেও, দুরের পাহাড়সারিতে মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে সময়টা ভালই কেটে যাবে।
দুরে কিন্তু বার্মা।
আর আপুরা তো আছেই

অবশেষে বেলা ১২:৩০ মিনিটের দিকে আমরা পৌছে গেলাম আমাদের ডেস্টিনেশন সেন্ট মার্টিনে। এখানে বেশ অনেক গুলো কটেজ, মোটেল, হোটেল ও রিসোর্ট আছে। বলা যায় পুরো দ্বীপ জুড়েই রিসোর্টের ছড়াছড়ি।





আবার ঘাটে ফিরে যাই। শিপ থেকে নেমে প্রথম যে কাজটা আমরা করেছি তা হলো খাওয়া। সেই আগের রাতে মাএ ৬টা রুটি আর দুই প্লেট গরুর ভুনা সাথে সবজি জুটছিলো তারপর আর কিছু জুটে নাই, ব্যাসম্ভব খিদা লাগছিলো। সবচেয়ে কাছের রেস্টুরেন্টে ঢুকে গনহারে খাবারের অডার্র দিয়ে বিল দেখে চোখ কপাল ছাড়িয়ে আসমানে।


হোটেলে ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে দৌড়ে চলে গেলাম বিচে। এই বিচের পাশেই হোটেল ''প্রাসাদ প্যারাডাইস'' ও হোটেল প্রিন্স হ্যাভেন। বিচের পাশেই পাবেন টাটকা নারিকেল ও ফ্রাই হতে থাকা কাকড়া, চিংড়ি ও লবস্টার। দাম খুবই সস্তা।
নারিকেল জিঞ্জিরার নারিকেলের শাস।
এতো পান করছে যে বসে থাকতে কষ্ট হইতেছে। আরেকটা লাগবে সুজন ???
আমরা নারিকেল খাইলাম প্রতিটা ১৫/২০/২৫ টাকা করে (কে বলে "সাইজ ডাজন্ট ম্যটার"

বিচ ফুটবল। ওই দুই পিচ্চি হইলো খাম্বা মানে গোল পোস্ট


টোটাল টাইমপাস THE FUN UNLIMITED
বিকালে পানি থেকে উঠে হোটেলে ফিরেই দিলাম ঘুম। মরার মত ঘুমালাম রাত ১০টা পর্যন্ত। হোটেল আল বাহারে (হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইসের আগে পরবে) ছুরি,লাক্ষা ও চিংড়ি দিয়ে সারলাম ডিনার। সেখান থেকে সবাই মিলে হাটতে হাটতে গোরালি সমান পানি ভেঙ্গে গেলাম সিটিবিতে। হোটেলের কেয়ারটেকার আমাদের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা সিটিবির সাদে ঢেরা বসালাম রাতের তারা ভরা আকাশ দেখবো বলে। কিন্তু ব্যাডলাক, আকাশ ছিলো মেঘলা, রাতের তারা আর দেখা হলো না। এর ভিতর সাগর গান ধরলো "ও আমার দেশের মাটি, তোমার বুকে ঠেকাই মাথা ..."। পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বিরামহীন ঢেওয়ের আছড়ে পরার তুলনাহীন শব্দ। এর সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না। সারা রাত আমরা সিটিবির সাদে সাগরের ও সাগরের গান শুনে কাটিয়ে দিলাম যেখানে এক সাগর গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়লো আর এক সাগরের কোন ক্লান্তি নাই ... সে বিরামহীন ... সেই সাগর অনন্ত ... আমি ফিলিং স্বর্গ THE PARADISE LOST
ফজরের আজান দিলো মসজিদে। তখন কেন জানি না পুরো দ্বীপের সব কুকুর একসাথে চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করলো। আমি সিরিয়াসলি ভয় পাইছিলাম। এবং জীবনের প্রথম আমি আবিস্কার করলাম যে আমি ভূত-প্রেত-খারাপ বাতাসে বিশ্বাস করি। যতক্ষন আজান হলো ততক্ষনই কুকুরগুলো চিৎকার করলো। এখানে বলে নেই, মাএ ৩ কিমি লম্বা একটা দ্বীপের প্রতি কদমে আপনি ৪-৫ করে কুকুর দেখতে পাবেন। ভাদ্র মাসে যে কি অবস্থা হয় আল্লাহই জানে। একটা দুইটা কুকুর না, শয়ে শয়ে কুকুর। প্রতি বছরে গড়ে ১২০০-১৫০০ কুকুর মেরে দ্বীপের উত্তর প্রান্তে পুতে ফেলা হয়।
সিটিবির সাদে বসে জীবনের প্রথম সকাল হওয়া দেখলাম।
এর আগেও সকাল হতে দেখেছি কিন্তু এমন সকাল আমার জীবনে এই প্রথমই আসলো। চারিদিকে সাগর মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপ। সে দ্বীপে মানুষ মাএ ৭ হাজার। যারা খুবই সহজ-সরল। যাদের লোভ লালসা খুবই কম, যারা ইসলামী অনুশাসনের ভিতর বড় হয়, যাদের জীবন ধারায় ইসলাম মিশে আছে, সেখানে আমি মাটি থেকে ৩৫ ফুট উপরে বসে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সকাল হওয়া দেখলাম ... এর কোন তুলনা হয় না ... এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না ... লাখ টাকা দিয়েও এই সৌন্দর্য বিদেশে গিয়ে পাবেন না ... AGAIN THE PARADISE LOST
বিচ থেকে সূর্য্যোদয় দেখবো বলে আমরা সিটিবি থেকে নেমে বিচে চলে আসলাম। সকালের প্রথম আলোয় গা ভাসিয়ে, সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে হাটতে হাটতে আমরা ফিরলাম আমাদের রুমে। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েই টের পেলাম... গরম ... কারেন্ট এসি কোনটাই নাই ... কিন্তু ঘুম হলো মরার মত ... (চলবে)
তথ্য:-
১) সেন্টমার্টিন আসবেন আর সানস্কিন লোশন আনবেন না, এ হতে পারে না। আমাদের মত ভুল করলে অবশ্য নতুন চামড়া পাবেন। দয়া করে লোশন সাথে আনবেন। জ্বলে রে ... যেখানে ঘষা লাগে সেখানেই জ্বলে ... আমার আম্মা আমাকে দেখে যা বললো তার মানে দাড়ায়, "ওভেন থেকে বের করে আনা ফ্রাই" হয়ে গেছি আমি আর সাগর।
২) ৩-৪ দিন থাকার ইচ্ছা থাকলে দুই লিটারের ২টা পানির বোতল সাথে আনবেন। স্থানীয় পানি আমার পেটে কোন ভাবেই হজম হলো না, ফলাফল "হাগাজিয়াস" টাইটেল।
৩) পানি শেষ হয়ে গেলে কোন টেনশন করবেন না। কারন আপনি আছেন নারিকেল জিঞ্জিরাতে। ৩টা ডাব কিনেন ৪ লিটার প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ পরিষ্কার মিষ্টি পানি পেয়ে যাবেন।
৪) হাগাজিয়াস স্পেশাল টিপস- টিস্যু রাখবেন সাথে। বিপদে কাজে দিবে।
৫) আপনার ডিএসএলআর এর দাম কত? ২ লাক্ষ ??? মানিব্যাগে কত আছে, ৫০ হাজার??? সাথে আরও কিছু দামি দামি জিনিসপত্র??? কই রাখবেন এসব??? সাগরে নামছেন না চুরি যাওয়ার ভয়ে?? ভুলে যান যে আপনি ঢাকার মানুষ ম্যান, আপনি এখন সেন্টমার্টিনে। রাস্তা থেকে একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আসেন। ওর কাছে সব কিছু রেখে ঝাপিয়ে পরুন সাগরে। ধুমাইয়া ঝাপান। ভুলে যান যে কিছু দামীদামী জিনিসপত্র রেখে আসছেন তীরে। আপনি যদি ভুলেও যান যে আপনি কাওকে কিছু দিয়ে আসছিলেন, অসুবিধা নাই, ঐ বাচ্চাটি আপনাকে ঠিকই খুজে বের করে সব ফেরত দিয়ে আসবে। একটা টাকা সরাবে না। বিনিময়ে আপনি যা দিবেন তা-ই নিবে। ৪ দিন টানা পরিক্ষিত। এতোটাই সৎ এখানকার মানুষ।
৬) এখানকার স্থানীয় কোন মেয়েকে আপনি রাস্তায় দেখবেন না। সিরিয়াসলি একটা মেয়েও দেখিনি। শুধু যারা বাইরে থেকে আসে তারাই। তারাই বা কম কিসের ??? একটু রয়ে সয়ে কি চলা যায় না???




৭) ফাস্টএইড বক্সটা সাথে রাখবেন প্লিজ। কাজে দিবে।
৮) একটি হাসপাতাল আছে এখানে কিন্তু ডাক্তার নাই।
৯) কোস্টগার্ড পুলিশ আছে ২২ জন। ক্রাইম জিরো বলা যায় এলাকাটিকে।
১০) দ্বীপটিতে তিনটি মাদ্রাসা, একটি প্রাইমারি স্কুল ও একটি ইসলামি রিসার্স সেন্টার আছে।
১১) টেকনাফ থেকে আপনি ট্রলারে করেও আসতে পারেন। আর যদি "মানি ডাজন্ট ম্যটার" হয়ে থাকে তাহলে স্পিডবোট কেন নয় ???(চলে না বলে

১২) যত পারেন মাছ খান। সাগরপারের দ্বীপে এসে মুরগি খুজে তাদের দ্বীপে যাওয়াই উচিত না। এমন আবালের সংখ্যা কম না।
১৩) ভুলেও প্যাকেজে যাবেন না প্লিজ। সেন্ট মার্টিনের ১০০ ভাগের ১ ভাগও দেখতে পারবেন না। তার চেয়ে সময় হাতে নিয়ে নিজে চলে যান। খুবই ভাল লাগবে, গ্যারান্টি দিলাম, না লাগলে নগদে পয়সা ফেরত। (মানসিক ভাবে অসুস্থরা এর আওতামুক্ত)
১৪) তথ্য:- টিকেট ননএসি ১১০০ টাকা, এসি ১৮০০টাকা, ঢাকা-টেকনাফ। গাড়ি মাঝে দুইবার থামে।
১৫) বেসরকারি কম্পানি 'কেয়ারী' এর দুইটা শিপ চলে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে, কেয়ারী সিনবাদ (ভাড়া ৫৫০ টাকা, আপ-ডাউন, খুব বেশি ভির থাকলে দালালই ভরসা,৫০ টাকা বেশি লাগবে।) ও কেয়ারী ক্রুজ (১০০০-১২০০-১৪০০ টাকা, আপ-ডাউন, অফ সিজনে বন্ধ থাকে)। টিকেট কাটার সময়ই কনফার্ম করবেন আপনি কবে ফিরছেন, তাহলে আপনি সিট পাবেন। তাছাড়া সিট পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। লিখিয়ে নিবেন টিকেটে যে আপনার একটা সিট আছে। আমরা যেহেতু অফ সিজনে (ঈদের পরদিন গেছি বলে ভির ছিলো কিন্তু অন সিজনের চেয়ে ভির কম) গিয়েছি সেহেতু যাত্রী ছিলো কম তাই এখানেও লেট। শিপ ছাড়লো ১০ টায়। অন্যান্য দিন টেকনাফ থেকে ছাড়ে ৯ টায়, আর সেন্ট মার্টিন থেকে বেলা ৩টায়।
১৬) হোটেল সেন্ডসোরের এক রাতের সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ৫০০/১০০০/১৫০০/২০০০ টাকা (অফ সিজন-সিজনে), ব্লু মেরিন রিসোর্টের ভাড়া ১২০০-৩৫০০ টাকা(অফ সিজনে)। হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইসের ভাড়া ২০০০ টাকা। আমরা দুই রুম ডাবল বেড তিন রাত-চার দিনের বিল এসেছিলো ৫০০০ টাকা। অফ সিজন বলে ...

১৭) মেইন সমস্যা কারেন্ট। রাতে হোটেল রুমে গরমে ঘুম আসে না। দুপুরে হোটেলের নিজস্ব জেনারেটর ও দ্বীপের জেনারেটর মিলে ২ ঘন্টা আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত কারেন্ট থাকে।
১৮) সেন্ট মার্টিনে আপনি সব ধরনের নেটওয়ার্কই পাবেন। টেলিটকটা একটু ডিসটার্ব করে।
বালের নেটওয়ার্ক জিপির। ছবি আপলোডই করতে পারতাছি না। পরে করে দিব নি কেমন???
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০৬