এখনকার দিনের আধুনিক রমজান মাসে সবকিছুই আছে। আছে অনেক বেশি বেশি, তারপরেও মনে হয় কি যেন নেই, কি যেন শূন্যতা। আসলে রমজান মাসটা এখন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে গ্যাসের চুলা, হীটার, ওভেন, রেফ্রিজারেটর, ব্লেন্ডার, মোবাইল এ্যালার্ম, রমজান অ্যাাপস আরো কত কি !!! কেন যেন মনে হয় নেই শুধু সেই মমত্ব বা দরদ। সব খাবারই রেডিমেড, ইফতারী/জিলাপির দোকানের সামনে ত্রানের চেয়েও বেশী বড় লাইন। আহাা কোথায় সেই আমাদের রমজান,
- সকালে ঘুম থেকে ঊঠেই মায়ের ছোলা ভিজিয়ে রাখা, দুপুরের পরেই তার রান্না ঘরে ঢোকা, কাঠের চুলার ধোয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মা ধোয়াশা সরিয়েই বেরিয়ে আসতো বিভিন্ন প্রকার ইফতারী নিয়ে। মায়ের হাতে মাখানো চিড়া, হাতে তৈরী বেলের সরবত আহা সেই স্বাদ আর এই ব্লেন্ডারের যুগে পাইনা।
- তখনকার দিনে ঘরে ঘরে এতো ফ্রিজ ছিলো না, প্রচন্ড গরমের রমজানের দিনে রাস্তার পাশে চালের কুড়া বিছানো বড় বড় বরফের চাক কেটে কেটে বিক্রি হত কেজি দরে। ১/২ টাকা কেজি, পাটের রশি দিয়ে বেধে লোকে হাতে হাতে নিয়ে ঘরে ফিরতো। কূড়ালদিয়ে কাটার সময়ে ছিটে আসা সেই বরফ কুচি যেন তুষারপাতের শ্রান্তি এনে দিতো। আমাদের টিনের ও কাচের জগে এনে ঢেলে দিতাম সেই বরফ। কেন যেন সেই বরফ পানির প্রশান্তি এই রেফ্রিজারেটরের যুগের ঠান্ডা বটলড ওয়াটারে পাইনা।
- মাঝে মাঝে বিদ্যুৎহীন অন্ধকার ঘরে টিমটিমে ল্যাম্প বা হারিকেনের আলোয় ইফাতারিটা যেন এক অন্য রকম আবহ তৈরী করতো। এক হাতে হাত পাখা নিয়ে ইফতারীরত সবাইকে বাতাস দিতে থাকতো ক্লান্তিহীন মা। আহ, সেই হারিয়ে যাওয়া মায়ের হাতপাখার শান্তি এখন আর এই ঘুরন্ত পাখা বা হিমশীতল এসি তে পাই না।
- টিনের প্লেটে ইফতারী বেড়ে নিয় সবাই ঘরের মেঝের মাদুরে গোল হয়ে বসতাম। আব্বা কোরানশরীফ পড়া শেষ হলে সবাই মিলে মুনাজাত ধরতাম। ইহকালের ভুল গুলির ক্ষমা, আগামী দিনের প্রত্যাশা ও পরকালের শান্তির জন্য সেই নিখাদ কামনা আজ শাহী জিলাপী্, বটি/শিক কাবাব অথবা হালিম বিরানীর কামনার কাছে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
- আমাদের সময়ে ছিলনা অ্যাালার্ম/ মোবাইল/ বা অ্যাাপ্স। মধ্যরাতের সেহেরীপার্টির সুরময় গজল ও উচ্চকন্ঠের ডাকে সবাই জেগে ঊঠতাম, উৎকণ্ঠা নিয়ে খেতে থাকতাম সময় শেষের সাইরেন বাজার। আমাদের সময় সাইরেন বাজানো হতো, ইফতারীর সময় উতকর্ণ হয়ে কান পেতে থাকতাম কখন সাওময় হবে আর খেতে পারবো। সেই সাইরেন ফিলিংস এখনকার অ্যাালার্ম কোনোভাবেই দিতে পারেনা।
- ইফতারীর সময় খেতে খেতে আব্বা/আম্মা কখন তাদের প্লেট ঠেকে কিছু ঊঠীয়ে দেবে, অথবা একটা বেগুনী বা চপ দুই ভাইকে ভাগ করে দিবে সেই অপেক্ষায় থাকতাম। কখনো বা ধীরে ধীরে খাওয়া বড় আপুর প্লেটে জমে থাকা খাবার থেকে কিছু চলে আসতো ছোট ৪ ভাই বোন দের প্লেটে। তাদের এই উঠিয়ে দেওয়াতে যে ভালোবাসা থাকতো তা এখন সামনে সাজিয়ে রাখা থেরে থরে ইফতারীরেতে খুজে পাইনা।
- আর বড় হয়ে যাবার পর, ১৯৯৮-২০০৪ সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম আমাদের পূর্ব বানিয়াখামার বড় মসজিদের ইফতারীর খাদিমদার। এলাকার মাসুম নামে এক মামা সহ দুজনে মিলে বিভিন্ন বাসা থেকে আসা ইফতারগুলি সম্ভাবে বন্টন করতাম মসজিদে ইফতারী করতে আসা অসংখ্য ভিক্ষুক, গরীব অথবা মুসাফির। চট বিছিয়ে দিতাম সারি করে, মাটির পাত্রে বেড়ে দিতাম সবাইকে, সামনে একটা করে প্লাস্টিকের গ্লাস। কোনদিন পরিমানে বেশী, কোনদিন কম। গরীব সেই মানুষগুলী বা মুসাফিরের সেই চকচকে চোখ আর সন্তুষ্টিভরা মুখগুলী আমৃত্য মনের দেওয়ালে টানানো থাকবে।
.........আহা, কোথায় সেই দিনগুলো; নিষ্টুর সময় সব কেড়ে নিলো, সব