জাতি হিসেবে আমরা যে খুবই বিচিত্র তার খুব সুন্দর প্রমাণ পাওয়া যায় চা পানের মধ্যে দিয়ে। আর সেই প্রমাণের জায়গা চায়ের দোকান। বাংলাদেশে চা মূলত দুইভাবে বানানো হয়। লাল চা আর দুধ চা। দুধ চায়ে আবার অনেক ভাবে বানানো হয়। কণ্ডেন্সড মিল্ক, তরল দুধ, গুড়া দুধ, ক্রিম দুধ, সর দুধ। আবার এই হরেক ধাচের দুধের মাঝেও আছে চিনির সন্নিবেশ। কেউ দুধ চিনি বেশি দিয়ে পান করে, কেউ দুধ কম চিনি বেশি, কেউ চিনি কম দুধ বেশি, কেউ দুধ ছাড়া চিনি দিয়ে, কেউ বা দুধ চিনি দুটো ছাড়াই সোজা লিকার দেয়া চা পান করে।
লাল চায়ের ক্ষেত্রে আছে চিনি ছাড়া লিকার, আবার কখনো আদা, কখনো আদা, চিনি দিয়ে লিকার, কেউ কেউ আছে যারা লেবু দিয়েও চা পান করে। পুরনো ঢাকার বংশালের একটি চায়ের দোকানে আদা, জিরা, লং, এলাচ, দারচিনি, লেবু, বিটলবণ, পুদিনা পাতা দিয়ে স্পেশাল মশলা চা বানায়, এয়ারপোর্ট স্টেশনের কিছু দোকানে লাল চায়ে কমলা, মাল্টা দিয়েও চা বানায়। বৃহত্তর ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে খেজুরের গুড়ের চা-ও বেশ প্রচলিত। সিলেটের রমেশ নামের একজন চা দোকানদার এক কাপ চায়ের মাঝে একুশ রঙের স্তর দিয়েও চা বানাতে পারেন। রাজশাহীতে জিয়া নামের একজন দোকানদার সর দুধ চায়ের মাঝে আদা বেটে দিয়ে স্পেশাল চা বানায়।
এর সবকিছুর মূলে কি আছে বলতে পারেন কি? এই সবকিছুর মূলে হল আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা যেভাবে চা পান করতে পছন্দ করি, চায়ের দোকানদাররা বা বাসায় আমরা নিজেরাই চা সেভাবে বানিয়ে পান করি। জাতি হিসেবে আমরা যে খুবই বিচিত্র সেটা কেবল আমাদের এই চা পানের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। সবথেকে মজার বিষয়টা হল, এই চা জিনিসটা উৎপন্ন হয় চীনে। চাইনিজরা চা পান করে গরম পানিতে চা পাতা ঢেলে দুধ চিনি ছাড়া। এরপর জাপানীজরা চাইনিজদের এই চা কে নিজেদের পানের সুবিধার্থে দুধ চিনির সন্নিবেশ ঘটিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে। জাপানীজদের এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করে বৃটিশরা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। চায়ের কাপের হ্যাণ্ডেল, পিরিচের প্রবর্তণ, চা পানের বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত ভদ্রলোকী আদব কায়দার গোড়া পত্তণ করে বৃটিশরা।
এক সময় বলা হত, বৃটিশ রাজত্বে সূর্যাস্ত হয় না। ব্যবসার উদ্দেশে আসা বৃটিশরা উপমহাদেশীয়দের মাঝে চা নামের এই অপরিচিত পণ্যটিতে অভ্যস্থ করায় বিনামূল্যে চা পান ও বিনিময়ে উপমহাদেশীয় মুদ্রার প্রলোভন দেখিয়ে। বিনামূল্যে আলকাতরা খায় এই তকমা খ্যাত উপমহাদেশীয়রা আমুদ ফুর্তিতে মেতে ওঠা মজ্জাগত। একদিকে চা পান, আরেক দিকে অর্থ প্রাপ্তি, আরেক দিকে আমুদ ফুর্তিতে খোশ গল্প করতে করতে তারা বৃটিশদের টোপে পা দেয়। সেই আড্ডা, সেই চা পান আজো চলছে। পৃথিবীর আর কোথাও এই ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের মতো চায়ের দোকানে আড্ডা বা চা পান করতে করতে চায়ের কাপে ঝড় তোলাটা দেখা যায় না।
বলা হয়, সকালে চা পানের বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। তবে সেই চা হতে হবে কন্ডেন্সড মিল্ক কিংবা দুধ মুক্ত। অর্থাৎ সকাল বেলা এক কাপ রঙ চা, সবুজ চা কিংবা আদা চা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাই সঠিক স্বাস্থ্য উপকারিতা পেতে নাস্তার আধা ঘন্টা পর সকলেরই এক কাপ চা পান করা উচিত। হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে রক্ষা, চায়ে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যারা চা পান করেন এবং যারা করেন না তাদেরকে নিয়ে একটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব ব্যক্তি প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চা খেয়েছে তাদের হাড়, যারা খায়নি তাদের তুলনায় অনেক বেশি মজবুত আছে। হাড় মজবুত রাখার ক্ষেত্রে চায়ে দুধ দিয়ে খাওয়া ভালো। তবে কন্ডেন্সড মিল্ক না দিয়ে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে চা খেলে প্রচুর ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, চায়ে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। এই দুটি উপাদান শরীরকে ক্যান্সারের ঝুকি মুক্ত করতে সহায়তা করে।
এ তো গেল উপকারিতার কথা, অপকারিতার কথা না বলেই বা থাকি কি করে? বিচিত্র এই চায়ের অপকারিতাও আছে। চা খাবার থেকে আয়রন শোষণ করে। কারণ চা-তে রয়েছে পলিফেনন জেস্টানিন নামক উপাদান যা আয়রন শোষণ করে বা জেস্টানিনরে সঙ্গে আয়রন মিশে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। চা শরীরে থায়ামিন বা ভিটামিন বি শোষণ রোধ করে যা বেরিবেরি রোগের অন্যতম কারণ। চা খাবার থেকে আমিষ ও ভিটামিন শোষণ করে এবং শরীর এই খাবারগুলোকে হজম করতে পারে না। চা এর মধ্যে অ্যাসিডাম টেনিকামস ও জেসথিয়োফিলিনস নামক উপাদান রয়েছে যা পাকস্থলীর হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
“বন্ধু তুমি শত্রু তুমি” চায়ের ক্ষেত্রে এই কথাটি যেন শতভাগ মিলে যায়। একই সাথে চা যেমন উপকারী, তেমনি অপকারিও কম নয়। শুরু করেছিলাম বৈচিত্রতা দিয়ে। শেষটাও হল শুরুর থেকে ধাপে ধাপে অপ্রাসঙ্গিক লেখা দিয়ে। জাতিগতভাবে আমরা যে আসলেই বেশ বৈচিত্রপূর্ণ সেটা আমার এই সামান্য এলোমেলো লেখা থেকেই কি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না?