কিছু বছরের ব্যবধানে মানুষ যে এমন ভাবে বুড়িয়ে যেতে পারে তা ভাবা কঠিন। আর এই হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির সাথে হঠাত করে যে এমন ভাবে এমন পরিস্থিতিতে দেখা হয়ে যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি।
মুহূর্তেই মাথাটা ঘুরে এল, অন্ধকার হয়ে এল চারিদিক। পুরো পৃথিবীটা চেপে অসম্ভব রকম সংকীর্ণ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির একটি কথা, “বাবা, তোমার যদি কখনো হঠাত করে মাথা ঘুরে আসে তবে সেখানেই চোখ বন্ধ করে বসে পড়বে”। আমি যেন যন্ত্রচালিত এর মত বসে পড়লাম চোখ বন্ধ করে। কে যেন কী বলতে বলতে ব্যস্তভাবে আমায় ধরতে এল। তার কথাগুলো কান পর্যন্ত এলেও মাথায় পৌছাল না। একটু আরাম পেলাম। তাকে বললাম, “আমি ঠিক আছি ভাই”।
আরো এক ধাপ চমকালাম, নিজের কথা নিজের কানে শুনে। এটি কী আমার কথা? আমি বললাম? না কী, আমার মুখ দিয়ে অন্য কারো কথা বের হল? আবারো মনে পড়ল এই হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির সাথে পরিচয়ের প্রথম কথাটি, “আমি ঠিক আছি বাবা”।
মানুষটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় দৈনিক বাংলার মোড়ে। রিক্সায় ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে পাশের একটি অস্থায়ী চায়ের দোকানে বসে তাঁর পায়ে পানি ঢেলে দিলাম। তখনও কিছু মানুষ ছুটছে তাদের কাজে। কী হয়েছে তা নিয়ে ভাবার বা তাকিয়ে দেখার সময় তাদের নাই। আর কিছু লোক চারিদিকে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, কাছে এগুচ্ছে না। তাদেরকে আমার কাছে অনুভূতিহীন রোবট ছাড়া আর কিছু মনে হল না। চিতকার করে বললাম, “কি মিয়ার, তামাশা দেখ না? পারলে কাছে এসে সাহায্য কর, আর না পারলে ভাগ, দূরে ভাগ”। কারো কোন ভাবান্তর দেখলাম না। শুধু তাদের মাঝ হতে এক লোক এগিয়ে এল। আমারই পরিচিত, আরমান ভাই। আরমান ভাই বলল, “চলেন ভাই ইনাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার”। আমি বললাম, “হ্যাঁ ভাই, চলেন”।
হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটি একগাল হেঁসে, আমাদের দু জনের মাথায় চোখে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, “আমি ঠিক আছি বাবা”।
আমরা বললাম, “না না চাচা, আপনার পায়ে লেগেছে”। হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটি যেন মনে মনে হাঁসলেন। কিন্তু হাঁসি প্রকাশ না করে বললেন, “বাবারা, পায়ের আঘাত অতি নগন্ন, আপনিই সেরে যাবে। আজ এতগুলো বছর ধরে যে আঘাত মনে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি তার কোন আরগ্য হয় নি বাবা। সে আঘাত আমার শুধুই বেড়েছে। যত দিন গেছে, সে আঘাতের ক্ষত ততই বেড়েছে, বেড়েই চলেছে। আজ তোমাদের এই উপকারে আমার সেই ক্ষত, সেই আঘাত একটু হলেও কমেছে বাবারা, একটু হলেও কমেছে।” রাস্তার দিকে চেয়ে কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর চোখে পানি ছলছল করে উঠল কিন্তু গড়িয়ে পড়তে দিলেন না। তাঁর চোখকে অনুসরন করে আমরাও রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, কিছু চকলেট আর চুইংগাম রাস্তায় চ্যাপ্টা হয়ে ছড়িয়ে গেছে বাসের চাকার চাপায়। বুঝলাম ইনি এই বয়সেও ছোট্ট ঝুড়িতে করে চকলেট আর চুইংগাম বিক্রি করেন। আরমান ভাই তাড়াতাড়ি রাস্তার মাঝে ছড়িয়ে থাকা অক্ষত চকলেট আর চুইংগাম গুলো কুড়িয়ে এনে তাঁর পাশে রাখলেন। এভাবেই পরিচয় এই হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির সাথে।
উনার মনের কষ্ট আমরা কেউই সেদিন বুঝতে পারিনি। তাঁর মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা কষ্ট আমি আর আরমান ভাই বুঝতে পেরেছিমান আনেক পরে। মাঝে মাঝেই উনার সাথে আমাদের দেখা হত। হাতে সময় থাকলে উনার সাথে গল্প করতে করতে আমরা শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে চলে এসেছি, এমনটা অনেক দিনই হয়েছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম উনার কাহিনী, উনার জীবন কাহিনী, বাংলাদেশের কাহিনী। উনার আর আমার জন্মভূমি বাংলা মায়ের জীবন কাহিনী এক সূত্রে গাঁথা, অভিন্ন। আমরা মন্ত্র-মুগ্ধের মত শুনতাম, অবাক হতাম।
কিছুদিন পর আমি ঢাকার বাইরে চলে আসি। অনেক দিন হল আরমান ভাই আর সেই হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। একদিন আরমান ভায়ের চিঠি। এই যুগে চিঠি!। চিঠি খোলার আগেই আরমান ভাইকে ফোন দিলাম, “কি ব্যাপার আরমান ভাই, -চিঠি, ঠিক বুঝলাম না।” আরমান ভায়ের কন্ঠ কেমন মলিন শোনাল, বলল, “পড়ে দেখ, বুঝতে পারবা। আমি মুখে বলতে পারব না।” বলেই ফোনটা কেটে দিল। আমার ক্ষীন সন্দেহ হল, আরমান ভাই ফোনটা কেটে দিল কান্নার ঠিক আগ মুহূর্তে। পুরুষ মানুষের কান্না কাউকে জানাতে বা বুঝতে দিতে নেই, তাই হয়ত। চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করলাম-
প্রিয় সংগ্রামী পথিক ভাই,
আমার সালাম নিবেন। গতকাল বিকেলে সে বুড়ো চাচার রহস্য উতঘাটন করেছি, যা তিনি আমাদেরকে কখনোই জানাননি বা বুঝতে দেন নি। আমরা দুই ভাই মিলে তাঁর মন-কষ্টের আভাস পেয়েছিলাম মাত্র। সেই কষ্টের অট্টালিকার প্রধান ফটকের বাইরে ছিল আমাদের বিচরন, যে ফটক অতিক্রম করে অট্টালিকার দূর্বিসহ দূঃখের সামান্য ছিটেফোটাও আমাদের এপারে আসত না।
গত কয়েকদিন ধরে উনাকে না দেখতে পেয়ে আমি অস্থির হয়ে পড়ি এবং খোঁজাখোঁজি আরম্ভ করি। শেষ পর্যন্ত উনাকে আবিষ্কার করি রাস্তার ধারের ছেঁড়া পলেথিনে ঢাকা শতচ্ছিন্ন খুপরি বস্তিতে। যে রাস্তা ধরে আমরা উনার সাথে হেঁটে হেঁটে বেড়াতাম উনার গল্প শোনার লোভে।
সেখানেই আমার সাথে পরিচয় হল উনার শীর্ণ বৃদ্ধা স্ত্রীর সাথে। বৃদ্ধ চাচা প্রচন্ড আসুস্থ, কয়েকদিন হল বাইরে যেতে পেরেনি, তাই দুটি পেট এই অসুস্থ শরীর নিয়েও উপস। আমার মুখে একদমই কথা সরছিল না। কী বলব, কী বা করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার পৃথিবী এখনও স্তব্ধ হয়ে আছে। বৃদ্ধা চাচীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি বৃদ্ধ চাচা বর্বর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটকা পরেন এবং প্রচন্ড রকম অত্যাচারের স্বীকার হন। তাঁকে অত্যাচারী পাক বাহিনীরা হত্যা করেনি শুধু মাত্র তথ্যের জন্য। কিন্তু তিনি কখনোই মুখ খুলেননি। অবশেষে তিনি আল্লাহর রহমতে বেঁচে যান। তাঁর দ্বিতীয় অত্যাচারের কাহিনী শুরু হয় তাঁরই স্বাধীন করা বাংলা মায়ের মাটিতে। উনারা হারিয়েছেন উনাদের বাড়ি, জমি, জায়গা। সকলের দ্বারে ঘুরেও পাননি কোন কাজ।
যতদিন গায়ে জোর ছিল, গায়ের ঘাম ঝড়িয়ে এই ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে, রাজপথে কিক্সার চাকা ঘুরিয়ে তাঁরই স্বাধীন করা স্বাধীন বাঙ্গালীকে বহন করে জীবন চালিয়েছেন। গর্ব করে তিনি বলতেন, “দেশের জন্য গায়ের রক্ত ঝড়িয়েছি, আর এখন দেশের মানুষের জন্য গায়ের ঘাম ঝড়াচ্ছি। উনারা শিক্ষিত মানুষ, উনারা আমার এই বাংলাকে সোনার বাংলা বানাবে”
তাদের কোন আত্মীয় স্বজন আছে কিনা জানতে চাইলে উনি খুপরির ভেতর টাঙ্গানো একটুকরো লাল সবুজের কাপড় দেখিয়ে দিলেন। আমি আর চোখের পানি না আটকাতে পেরে পকেটে যা ছিল তাই দিয়ে তাদেরকে কিছু খাবার আর জ্বরের ঔষধ কিনে দিয়ে এসেছি। আজ বুঝলাম বেকার মানুষ সবার জন্যই অভিসাপ। সবচেয়ে বড় অভিসাপ নিজের জন্য। তাদেরকে সামান্য সাহায্যও করতে পারছি না। জানি যাদের সামর্থ আছে তারা কিছুই করবে না। আর এত বড় মহান মানুষকে ছোট করার মত সাহস আমার নেই।
যাই হোক ভাই, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন একবার ঢাকায় আসেন। দেখি দুই ভাই মিলে কী করা যায়।
ইতি,
আপনার, আরমান ভাই।
চিঠির মাঝে অনেক জায়গাতেই দেখলাম পানির ফোঁটার চিহ্ন। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু চিহ্ন থাকে যা চাইলেও মোছা যায় না। এই পোড়া চোখের নোনা পানির চিহ্নও তারই অন্তর্ভূক্ত।
“এই খবরদার কেউ কাছে আসবিনা, এক শালাও কাছে আসবিনা। তোদের কারো কাছে আসার অধিকার নেই, শালারা। তামাশা দেখতে আসছিস হ্যাঁ , তামাশা।” বিলাপ বকতে, বকতে বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছে আরমান ভাই। হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির অনেক দিনের অভুক্ত রোগাক্রান্ত জীর্ণ, বাসের চাকায় থেতলে যাওয়া শরীর পড়ে আছে রাস্তায়, ঠিক আমার সামনেই। যে জোয়ান তরতাজা শরীর মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে হঠাত করেই বুড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের সমাজের চোখে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখে। কিছু নাম না জানা ফুল গাছ থেকে পড়েছে উনার গায়ের উপড়। অস্পষ্ট সব বিলাপ করছে হঠাত করে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটির বৃদ্ধা স্ত্রী। কিছু দূরে দাউদাউ করে জ্বলছে চাপা দেয়া সেই বাসটি। আর আমাদের এ কজনের তামাশা দেখার জন্য জড় হয়েছে আবেগহীন অনুভূতিহীন কিছু রোবট যাদের এই রোবকটত্ব মারাত্বক রকম ছোঁয়াচে।
আমার লিখা পূর্বের আণুবীক্ষণিক গল্প সমূহ :
১। “বিছানায় একটি কোল-বালিশ” ( আণুবীক্ষণিক গল্প – ০২ )
২। অনাবৃতা পরিণীতা একটি ফুল । ( আণুবীক্ষণিক গল্প – ০১ )