somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“বিছানায় একটি কোল-বালিশ” ( আণুবীক্ষণিক গল্প – ০২ )

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"একাকী ব্যাচেলর মানুষের মন, বলা তো যায় না কখন কী অঘটন ঘটে যায়"।

শরীফ উদ্দীন সাহেব ব্যাচেলর মানুষ। মিরপুর-১ এর চাইনিজের গলিতে ছোট্ট একটি রুম নিয়ে আছেন আজ বছর আষ্টেক হল। অত্যন্ত ছিমছাম শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক। যে চাকুরী করেন তার মাইনে খুব বেশি না হওয়ায় রান্নার জন্য বুয়া বাড়তি খরচ। সকালে যা হোক কিছু একটা মুখে দিয়ে অফিসে যান আর ঘরে ফেরেন সেই সন্ধ্যার পরে। শুধু রাত্রের রান্নাটা কোন রকম নিজেই সেরে নেন। তাছাড়া একাকী ব্যাচেলর মানুষের মন, বলা তো যায় না কখন কী অঘটন ঘটে যায়। তাই তার সাবধানতার দরুন ঘরে কোন বুয়ার হাতের ঝাড়ু পড়েনি কখনো।


ঘরে একটি সিঙ্গল খাট, একটি টেবিল ফ্যান, একটি বই এর তাক, তাতে কিছু বই, এক সেট টেবিল চেয়ার আর তার আমুদে কোল-বালিশ, এই নিয়ে তার ছোট্ট ব্যাচেলর সংসার। কোল-বালিশ ছাড়া তার ঘুম আসে না। এ তার ছোট বেলার অভ্যাস। সংসারে তার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যপার হচ্ছে তার খাট। তাতে উঠার সময় আর নামার সময় ক্যাচ-ক্যাচ শব্দে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। তার আমুদে কোল-বালিশটি দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে এর তুলোগুলো গিয়েছে শক্ত চ্যাপ্টা হয়ে, বাইরেরটা হয়েছে ঘেন্না রকম তেল চিটচিটে। এবার মাইনে পেলে প্রথমেই একটি খানদানি টাইপের কোল-বালিশ কিনবে বলে তিনি ভেবে রেখেছেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর যদি একটু শান্তিতে ঘুমই না হয় তাইলে আর চাকুরী কীসে।


আজ শরীফ উদ্দীন সাহেব বেজায় খুশি। মাইনে পেয়ে দুপুরের পরে অফিস থেকে ছুটি নিলেন তার আমুদে কোল-বালিশ কিনবেন বলে। অফিসে বসের কাছে ছুটি নেয়ার সময় অবশ্য লজ্জায় তিনি কোল-বালিশের কথা বলেননি। বলেছেন এক অসুস্থ আত্মীয় আসবে। তিনি কখনও মিথ্যে বলেননা। আজ অনায়াসে বিনা হৃদ-কম্পনে তিনি কীভাবে মিথ্যা বললেন সেটা ভেবে নিজেই অবাক হলেন। মিরপুর-১ এর মোড়ে যখন বাস থেকে নামলেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাজার রোডের দু-ধারে কিছু কাঁথা-বালিশের দোকান। কিন্তু কিছুতেই তার কোল-বালিশগুলো পছন্দ হচ্ছে না। এ দোকান ও দোকান করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে। চারিদিকের ঘোর আবছা আলো শেষ বিকেলের পরিবেশটাকে কেমন জানি বেদনাময় করে তুলেছে। মাজারের কাছাকাছি আসতে তিনি দেখলেন রাস্তার ফুটপাতে একটি পাটি পাতা আর সেই পাটিতে রাখা হয়েছে একটি জমকেশ কোল-বালিশ। যার উজ্জ্বলতা এই ম্লান আলোতেও দূর হতে শরীফ উদ্দীন সাহেবকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হল। কোল-বালিশটির কাভার পুরোটাই কোমল আর চকচকে মখমল কাপড়ের। এমন নরম তুলতুলে যেন ভেতরে তুলো বা পালকই নেই, আছে অজ্ঞাত কোন জিনিষ। আর কোল-বালিশের সাইজটাও এমন যেন একমাত্র তৈরী হয়েছে তারই জন্য। শরীফ উদ্দীন সাহেব লক্ষ করলেন কোল-বালিশটির বিক্রেতা একজন বৃদ্ধা। মাথার কাপড় টেনে ঢাকা পুরো মুখটা। শরীরটা একেবারে নতজানু। হাত এবং পা জোড়া খোলা, তাতে চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। কোল-বালিশটির দাম জিজ্ঞেস করতে বৃদ্ধা মিহি অথচ ঘড়ঘড়ে কন্ঠে বললেন “দুই শত টাকা”। শরীফ উদ্দীন সাহেব আর দ্বিতীয় কথাটি না বলে পকেট থেকে দুটি একশত টাকার নোট বের করে কোল-বালিশটি কিনে যখন ঘরে ফিরলেন তখন একেবারে সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে।


আহ! কী একখানা খাসা কোল-বালিশ, এমনটা তিনি আর কখনো দেখেননি, তাও আবার মাত্র দুইশত টাকা। এসব চিন্তা করতে করতে রান্না শেষে তিনি খোস মেজাজে গোসল সেরে যখন ঘরে ঢুকলেন তখন ঘড়িতে রাত দশটা। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শরীফ উদ্দীন সাহেব বিছানায় বসলেন। আজ ক্যাচ-মেচে শব্দটা যেন তিনি খেয়ালই করলেন না। খাবার পরে যতক্ষন ঘুম না আসে কিছুটা সময় বিছানায় শুয়ে অথবা টেবিল চেয়ারে বই পড়া তার নিত্য অভ্যাস। কিন্তু আজ এই নতুন তুলতুলে আমুদে কোল-বালিশ শুধু ঘরের একটা পরিবর্তনই করেনি বরং শরীফ উদ্দীন সাহেবের অভ্যাসেও পরিবর্তন সাধিত করল। আজ বই পড়ার কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন। তবে ঘরে যে পরিবর্তনটা তিনি লক্ষ করলেন তা বাতাসে কেমন যেন চেনা অথচ অচেনা এক সুবাস ঘরময় মৌ মৌ করছে। ভাবলেন হয়তো নতুন কাপড়ের সুবাস। পরম তৃপ্তিতে কোল-বালিশ জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেলেন তা বুঝতেই পারলেন না।


গভীর ঘুমের মাঝে হঠাত এক চাপা অস্বস্থিতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। নাকে আসল গোলাপজল, আতর, কর্পুর আর আগরবাতির সমন্বয়ে তীব্র অদ্ভুত সুগন্ধ। অনুভব করলেন শক্ত খটখটে ঠান্ডা কী যেন তিনি জড়িয়ে ধরে আছেন আর সেটাও ভয়ংকর ভাবে তাকে চেপে ধরে আছে। চোখ খুলতেই জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোয় যা দেখলেন তাতে এই গরমেও তার গা বেয়ে নেমে গেল ঠান্ডা শিহরন, লোমগুলো গেল এক সাথে খাঁড়া হয়ে। বিষ্ফোরিত হল তার দু-চোখ। হৃদপিন্ডটা যেন এখনই বেরিয়ে আসবে বুকের খাঁচা থেকে। কোথায় তার আমুদে কোল-বালিশ! তিনি জড়িয়ে ধরে আছেন একটি আস্ত নর-কঙ্কাল। সে নর-কঙ্কালটিও তাকে জাপটে ধরে আছে যেন আর ছাড়বে না। শত চেষ্টাতেও তিনি তা ছাড়াতে পারলেন না। অবশেষে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে দু পায়ে সজরে লাথি দিয়ে তিনি বন্ধন মুক্ত হয়ে এক লাফে খাট থেকে নেমে দরজা খুলে যখন বাইরে বেরুলেন হোঁচট খেয়ে পড়লেন একেবারে সিড়ি ঘরে। পড়েই জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তেই যেন শুনতে পেলেন এক হৃদয় হিম করা নাঁকি মেয়েলি গলায় করুন কান্না।


যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সবে রাতের আধাঁর কাটছে। ধাঁই করে মনে পড়ে গেল রাতের এক মুহূর্তের সেই ভয়ংকর ঘটনা। সভয়ে ঘরে ঢুকতে দেখলেন তার সাধের আমুদে কোল-বালিশটা মেঝেতে পড়ে আছে। তবে ঘরের সেই অদ্ভুত শিহরন জাগানো সুগন্ধ এখন ও বিদ্যমান। তিনি উষ্কখুষ্ক চুল, পরনে রাতের গেঞ্জি আর লুঙ্গি নিয়েই কোল-বালিশটি এক হাতে খামচে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে ঝড়ের গতিতে হাঁটতে হাঁটতে চললেন মাজার রোডের দিকে। এই ভোর বেলাতেও তিনি দেখলেন কিছু মানুষ জটলা করে আছে সেই জায়গাটায় যেখানে তিনি কাল সন্ধ্যায় কোল-বালিশটি কিনেছিলেন। জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলেন একজন বৃদ্ধা মরে পড়ে আছে। সামনের পাটি যেখানে কোল-বালিশটি ছিল সে রকম ফাঁকাই রয়েছে। মৃতা বৃদ্ধাটির মুখটিও সেই রকমই ঢাকা রয়েছে মাথার কাপড় দিয়ে। পাশেই পড়ে আছে কালকের সেই দু-খানা একশত টাকার নোট। শরীফ উদ্দীন সাহেব সেখানে আর থাকতে পারলেন না। কোল-বালিশটি পাটিতে রেখেই দিলেন এক দৌড়। এক দৌড়েই মিরপুর-১ এর মোড়।


হাঁপাতে হাঁপাতে ধীর পায়ে হেঁটে চললেন তার ঘর চাইনিজের মোড়ের দিকে। রাস্তার ধারের ফুটপাত দিয়ে তখন চলেছে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করা অসংখ্য মহিলা শ্রমিক। তিনি যেন তাদের ভীড়ের মাঝে মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলেন একটি বৃদ্ধাকে, যার মুখটা পুরোটাই ঢাকা মাথার কাপড় দিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধ চোখে এক দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে রইলেন সেই দিকে। শরীফ উদ্দীন সাহেবের চমক ভাংল যখন একটি গার্মেন্টস কর্মী অপর একজনকে কনুই দিয়ে গুতো মেরে জোরে জোরে বলল, “দেখছস নি জরিনা? বুড়া ব্যাডায় আমগো দিকে কেমনে ড্যাবড্যাবানি চোহে চাইয়া রইছে”। রাস্তার উঁচু-উঁচু বহুতল ভবনের নিচে শরীফ উদ্দীন সাহেব যেন চাপা পড়ে থেতলে গেলেন। কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না, আবার ধীর পায়ে হাঁটা ধরলেন। সকালের মায়াময় ঠান্ডা লাল আভায় শরীফ উদ্দীন সাহেবের ভীত মুখটা দেখাচ্ছে অদ্ভুত আর তার ছায়াটা যেন এঁকেবেঁকে গিয়ে ঠেকেছে মাজার রোডের সেই জায়গাটায়।

আমার লিখা পূর্বের আণুবীক্ষণিক গল্প সমূহ :
১। অনাবৃতা পরিণীতা একটি ফুল । ( আণুবীক্ষণিক গল্প – ০১ )
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:৪২
৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×