পৃথিবীতে কাশ্মীরের তিনটা অংশ। একটা পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর, একটা চীন শাসিত কাশ্মীর আর একটা ইন্ডিয়া শাসিত কাশ্মীর। পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরটির নাম হচ্ছে “আজাদ কাশ্মীর”। আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী হচ্ছে মুজফরবাদ।
চীনের মধ্যে কাশ্মিরের যেটুকু রয়েছে তার সবচাইতে বড় অংশের নাম তিব্বত। স্বভাবতই এর রাজধানী হচ্ছে লাসা।
এছাড়া রয়েছে জিঞ্জিয়াং।
চীন থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত কাশ্মীর অংশ দিয়ে একটা হাইওয়ে আছে। নাম কারাকোরাম হাইওয়ে। আমার ধারণা এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আন্তর্জাতিক সড়ক।
ইন্ডিয়াতে কাশ্মিরের যে অংশ রয়েছে তা ইন্ডিয়ার একটি স্বতন্ত্র রাজ্য। এই রাজ্যটার নাম হচ্ছে “জম্মু এন্ড কাশ্মীর”। এই জম্মু এন্ড কাশ্মীর রাজ্যের তিনটা অঞ্চল রয়েছে। একটা হচ্ছে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু অঞ্চল। যে অঞ্চলটার সবচাইতে বড় শহর হচ্ছে জম্মু। জম্মু হচ্ছে ভারতের “জম্মু এন্ড কাশ্মীর” রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী।
আরেকটা হচ্ছে মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীর অঞ্চল। যে অঞ্চলটার সবচাইতে বড় শহর হচ্ছে শ্রীনগর। শ্রীনগর হচ্ছে “জম্মু এন্ড কাশ্মীর” রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। মজার ব্যাপার হচ্ছে একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েও জম্মুবাসী আর কাশ্মীরবাসী মোটামুটি কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না।
আর আরেকটা অংশ হচ্ছে লাদাখ অঞ্চল। বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আর শীতল মরুভূমি অঞ্চল। লাদাখ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহরটির নাম হচ্ছে লেহ। কোন একসময় দুনিয়ার বুকে যখন লাদাখ একটা আলাদা রাজ্য ছিলো তখন লেহ ছিলো লাদাখের রাজধানী।
আমরা বলে থাকি লেহ হচ্ছে লাদাখের রাজধানী। হয়তো কোন একসময় তাই ছিলো। কিন্তু এখন বাস্তবতা হচ্ছে লেহ ভারতের জম্মু এন্ড কাশ্মির রাজ্যের লাদাখ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর। রাজধানীর মর্যাদা সে বেশ আগেই হারিয়েছে।
লাদাখি ভাষায় জুলে শব্দটার মানে হচ্ছে, সুপ্রভাত থেকে শুরু করে শুভরাত্রি, ধন্যবাদ, সালাম, সম্ভাষণ সবকিছু।
*** আমার তথ্যে কিছুটা ভুল থাকতে পারে, তবে মোটামুটি পুরো ব্যাপারটি প্রায় এরকমই। উপরের ছবিগুলো নেট থেকে সংগৃহীত।
আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্ব
২৬শে সেপ্টেম্বর’১৫
ভোর প্রায় সাড়ে ছটার দিকে ঘুম ভাঙলো। আড়ামোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। আমি বেশ রাতেই এই হোটেলটাতে এসেছি। খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে তখন ভালোভাবে কোন কিছু লক্ষ্য করিনি। এখন কৌতুহলবশত রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম, আর কি দেখলাম জানেন! আমার রুমের সামনে হোটেলের বাগান। ভোরের প্রথম সূর্যের আলো দূরের বরফ জমা পাহাড়গুলোতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে এসে পড়ছে সেই বাগানে।
আর সেই বাগানে নানান ধরনের অর্কিড ফুলের মধ্যে কতোগুলো আপেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে, যে গাছগুলোতে ধরে আছে টসটসে লাল আপেল।
লাদাখ অঞ্চলে এসে নাকি প্রথম দুদিন গোসল করতে নেই। এতো উচ্চতার এই ঠান্ডা অঞ্চলের সাথে শরীরের খাপ খাইয়ে নেবার জন্য নাকি প্রথম দুদিন শুধুই বিশ্রাম নিতে হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে ঢুকে হুড়মুড় করে গোসল করে নিলাম, অবশ্যই ঠান্ডা পানি দিয়ে। কারণ আমি তো জানি একবার গরম পানি দিয়ে গোসল করা শুরু করলে শরীর আর ঐ আরাম ছাড়তে চাইবে না। তখন দেখা যাবে আমি ঘোরাঘুরি না করে সারাদিন ধরে শুধু হোটেলের বাথরুমে গরম পানি দিয়ে গোসল করেই চলেছি। এইদিন অবশ্য লেহ শহরের তাপমাত্রা ছিলো ১০ ডিগ্রীর কাছাকাছি।
গাদাখানিক জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে রুম থেকে বের হয়ে হোটেলের বাগানটিতে গেলাম। ছোট্ট একচিলতে বাগান, কিন্তু বাগানটি তার মালিকের রুচির বর্ণনা দিয়ে চলেছে। কতোগুলি গোলাপ গাছের মাঝে বসার জন্য কতোগুলি চেয়ার আর টেবিল রয়েছে আর সেগুলোকে ছায়া দেবার রয়েছে জন্য বড় বড় গার্ডেন আমব্রেলা। হোটেলের একপাশের দেয়ালজুড়ে লতানো ঝোপ, আমার কাছে মনে হলো এগুলো আঙুরগাছ। আর পুরো বাগানজুড়ে কতো ধরনের রং-বেরঙের অর্কিডের সমারোহ রয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।
আমি আপেলগাছের তলে দাড়িয়ে ছবি তুলছি এসময় এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা বিল্লি বিল্লি বলে ডাকাডাকি শুরু করলেন।
প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও একটু পরে বুঝলাম বেচারীর সাধের বিড়াল ছানা হারিয়ে গেছে। তিনি সেটাই খুজছেন। আমিও কিছুক্ষণ তার সাথে বিড়াল ছানা খুঁজলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ধাড়ী বিড়ালকে দেখিয়ে বললাম যে আমি তার বিড়ালটাকে খুঁজে পেয়েছি। সেটিকে দেখে তিনি জানালেন যে এই ধাড়ী বিড়ালটা না, তার বিড়ালটা হচ্ছে ছোট্ট একটা বাচ্চা বিড়াল। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তার বিড়াল খোঁজা বাদ দিয়ে আমি আবার আমার ফটোসেশন শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা একটা চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন সকালে আমার রুমে চা দেয়া হয়েছে কিনা। ধন্যবাদ দিয়ে তাকে জানালাম যে আমি চা পান করতে চাচ্ছি না। টুকটাক গল্প করলাম তার সাথে। তিনি এ হোটেলের মালকাইন। তার বাপের বাড়ি সিকিমে। তিনি টুকটাক বাংলা জানেন। প্রেমের বিয়ে করে এসে উঠছেন লেহতে। এখন তিনি তার স্বামীর হোটেলটা দেখাশোনা করেন। লাদাখ তার খুব ভালো লাগে। শীতকালে এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। যদিও এখনো শীতকাল আসেনি, তবে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রীর নীচে চলে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই। তখন এই পুরো এলাকা চাপা পড়বে একরাশ বরফের তলায়।
লেহ শহরের দ্রষ্টব্যগুলো কি কি, কোথায় কোথায়, আর কিভাবে সেগুলোতে যেতে হবে তা ভদ্রমহিলার কাছ থেকে জেনে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেল থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বের হয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। কাল সারাদিন আমি সকালের ওই পাউরুটি ছাড়া আর কিচ্ছু খাইনি। তার উপর ঐ ভয়ঙ্কর রাস্তায় ১৩ ঘন্টা জার্নি করেছি। আমার এখন ভয়াবহ খিদে লাগেছে। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা না খাওয়ার কারনে খুবই ক্লান্ত অনুভব করছি। খাবার দোকান খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু এতো ভোরে কোন দোকানই খোলেনি।
হাঁটতে হাঁটতে লেহ শহরের মসজিদের সামনে এলাম। ওমা এখানে দেখি কাছাকাছি দুটো মসজিদ আছে।
আমার মনে হয় এদুটি মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মসজিদ। কারণ লেহ শহরটি ১১,৬০০ ফীট উচ্চতায় অবস্থিত। মসজিদ দুটির কারুকার্য খুবই সুন্দর। বড় মসজিদটি অনেক পুরানো। এটি ১৬৬৬-৬৭ সালে তৈরী হয়েছে। তিব্বত নাকি একবার লাদাখ আক্রমণ করেছিলো, ঘটনাটি সপ্তদশ শতাব্দির শেষ ভাগে। তখন লাদাখের রাজা নামগয়্যাল মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। সেসময় লাদাখ রাজা আর মোঘল সম্রাটের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে চুক্তি হয়। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে এই সুদৃশ্য মসজিদটি।
লেহ শহরের সব জায়গা থেকে যে ভবনটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে লেহ প্যালেস। এটি হচ্ছে একসময়ের লাদাখ রাজ্যের রাজার রাজপ্রাসাদ। শহরের প্রানকেন্দ্রের সবচাইতে উঁচু পাহাড়ে এটি অবস্থিত। নয়তলা উঁচু এই প্রাসাদটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাতিক্রমী প্রাসাদ। মাটির তৈরি এই ভবনটি পাহাড়ের গায়ের সাথে একেবারে মিশে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে তৈরী হওয়া এই স্থাপনাটি কয়েক শতাব্দি ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসাবে বিবেচিত ছিলো। শুধু নয়তলা দেখলে তো চলবে না। জায়গাটির অবস্থানও তো দেখতে হবে, ৩.৫০৫ মিটার।
পুরো লেহ শহরটাতে খোড়াখুড়ি চলছে। দেখে মনে হলো শহরের সব ড্রেন, রাস্তা আর ফুটপাতগুলোর সংস্কার কাজ চলছে। বিশেষ করে মেরামত করা হচ্ছে শহরের প্রধান রাস্তাটি। এই সুন্দর শহরটি আরো সুন্দর করে গড়ে তোলা হচ্ছে। লেহ শহরের মসজিদের সামনের রাস্তাটির মাঝখান ধরে স্থায়ী বড় বড় ফুলের টব আর বসার জায়গা তৈরী করা হচ্ছে। দেখে মনে হলো লেহ শহরের এই রাস্তাটিকে সিমলা, মানালি বা দার্জিলিং এর ম্যালের মতো করে তৈরী করা হচ্ছে।
পরে জেনেছিলাম, লেহ রাজপ্রাসাদ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত ১০০ টি প্রত্ত্বতাত্তিক নিদর্শনগুলোর একটি। এজন্য সরকার এই ভবনটি সংস্কারে বেশ জোরে-শোরে হাত দিয়েছে। শুধু রাজপ্রাসাদটিই নয়, পুরো পুরানো লেহ শহর বেশ ব্যায়বহুলভাবে সংস্কার করে পুরানো রূপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পরিপূর্ণভাবে এই কাজ শেষ হলে লেহ শহরটি নিশ্চয় আরো আবেদনময়ী হয়ে উঠবে। ইশ!! সেই রূপটা যদি দেখতে পেতাম!!
লেহ প্রধানত বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল। তবে বেশ বড় সংখ্যক মুসলমানও বাস করে এখানে। এদেরকে লাদাখী মুসলমান বলা হয়। যারা মূলত শীয়া মতাবলম্বী। লেহ শহরটি মূলত ক্যান্টনমেন্ট দ্বারা আবৃত। এই শহরটি বছরে প্রায় পাঁচ মাসের জন্য সড়ক পথে খোলা থাকে। তবে শ্রীনগরের যাবার রাস্তাটি আরো কিছুদিন খোলা থাকে। বাকী সময়টা বরফের তলায় শহরটা লুকিয়ে থাকে। তখন পৃথিবীর সাথে এর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে লেহ শহরের বিমানবন্দরটি। এর মাধ্যমে এটি শ্রীনগর আর দিল্লীর সাথে আকাশপথে যোগাযোগ রক্ষা করে। শীতকালে লেহর তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়।
লাদাখীরা খুব ফুল পছন্দ করে। বিভিন্ন রঙের অর্কিড ফুলের সমারোহ দেখলে সত্যিই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি বাড়ির ছাদ আর জানালার কার্নিশে এইসব অর্কিডগুলো লাগানো।
এখানকার বাড়িগুলোর স্ট্রাকচার একটু অদ্ভূত। সকল জানালা, সানসেট আর কার্নিশগুলো এতো সুন্দর কাজ করা যে সেগুলো থেকে চোখ ফেরানো দায়। ভবনগুলো সাদা রঙের। আর জানালাগুলো নীল অথবা মেটে রঙ করা। তবে আমার মনে হয় কাঠের কারুকার্যে লাদাখীরা সারা বিশ্বকে ছাড়িয়ে গেছে। লেহ শহরের প্রত্যেকটা বাড়ি বেশ সাদামাটা কিন্তু একটু খেয়াল করলে এর কারুকার্য মন হরণ করে।
এখনো পর্যন্ত কোন খাবার দোকান খোলা পেলাম না। খিদেতে প্রায় মারা যাবার মতো অবস্থা। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ভাবলাম সময়টুকু নষ্ট না করে শান্তিস্তূপাটা দেখে আসি। শহর থেকে কিছুদূর ছাড়িয়ে শান্তিস্তূপা। এটা বৌদ্ধদের একটা বিশাল বড় মন্দির। দূর থেকে আমি মন্দিরটা দেখতে পারছি, কিন্তু যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আসলে অনেকগুলো সরু সরু রাস্তা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে বলেই এই সমস্যা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৮