আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলো
এখানেই জানতে পেলাম এতোক্ষণ ধরে পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতধারাটি আসলে নদী নয়, এটি বিখ্যাত সিন্ধু নদ। শিহরিত হলাম। যার থেকে এই উপমহাদেশের নাম হয়েছে হিন্দুস্থান অথবা ইন্ডিয়া আর সনাতন ধর্মীয়রা পরিচিত হয়েছে ইন্ডুস বা হিন্দু নামে সেই বিখ্যাত সিন্ধু নদকে আমি পাশে নিয়ে চলেছি। শরীরে এক অপূর্ব শিহরন বয়ে গেল। খুবই সরু একটা পানির প্রবাহ। কিন্তু সে তার পূর্ণ গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলেছে। পৃথিবীর সেরা প্রাচীন একটা সভ্যতার গর্বিত জনক সে।
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমেছে। গাড়ি এবার সাপের মতো আঁকাবাঁকা কিন্তু সমতল পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ডানপাশে উঁচু পাহাড় আর বামপাশে সিন্ধু নদ। তবে আমার চোখে প্রচন্ড সমস্যা হচ্ছে। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলোর হেডলাইটে আমার চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি এখানকার ড্রাইভারদের আইন মানার প্রবণতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দূর থেকে গাড়িগুলো যখন আসছে তখন সেগুলো তাদের হেডলাইট পূর্ণ শক্তিতে জ্বালিয়ে রেখেছে, অথচ কাছাকাছি আসলেই আলোর পাওয়ার কমিয়ে দিচ্ছে যেন বিপরীতমুখো গাড়ির ড্রাইভারের চোখ ধাধিয়ে না যায়। অথচ বাংলাদেশে সবাই দেখি রাতের বেলায় সবাই পুরোশক্তির হেডলাইট জ্বালিয়ে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালায়, এরফলে বিপরীত ড্রাইভার কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।
খুবই খিদে লেগেছে। আসলে সারাদিন পেটে সলিড কিছু পড়েনি। সেই কোন সকালবেলা দারচাতে ব্রেড অমলেট খেয়েছিলাম। আর সারাদিন টুকটাক গজা চিবিয়ে শেষ করেছি। অবশ্য এখন গজার কথা ভাবলেই জ্বর চলে আসছে। আসলে এ কয়দিন টুকটুক করে আমি এতো গজা চিবিয়েছি যে এটির প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। আমি বোধহয় আর জীবনেও গজা মুখে তুলতে পারবো না। দোষটা আসলে আমারই, দুপুরে প্যাং এ আমার কিছু খেয়ে নেয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে আর কোন সমস্যাই হতো না।
ঘন্টাখানেক পর একটা জায়গায় এসে তানজিং আর তার বাবা নেমে গেল। হাত নেড়ে যখন তাদেরকে বিদায় জানালাম, বুঝলাম যে আমরাও গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। চারপাশে বেশ লোকালয় আর শহুরে শহুরে ভাব দেখা যাচ্ছে। বৌদ্ধদের বিভিন্ন স্তুপা দেখতে পারছি। আশেপাশে গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বেশ এক্সাইটেড অনুভব করছি। মনের মধ্যে খুশির ভাব।
অবশেষে রাত সাড়ে আটটার পর ১৩ ঘন্টা জার্নি শেষে এসে পৌছালাম বহুল আকাঙ্ক্ষার শহর লেহ’তে। এটি সাড়ে এগারো হাজার ফিট উচ্চতার এক শহর। আমি নিজেই বিস্মিত। আমি সত্যিই কখনো কল্পনা করতে পারিনি যে আমি এই প্রাচীন দুর্গম ঐতিহাসিক শহরটিতে আসতে পারবো, বিশেষ করে যেটা বাংলাদেশীদের জন্য খুবই স্পর্শকাতর একটা এলাকা।
আলী ভাই খুবই শরমিন্দা হলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে ওঠাবেন। এ বিষয় নিয়ে তিনি তার পরিবারের সাথে মোবাইলে লাদাখি ভাষায় কথা বলেছিলেন। লাদাখী ভাষা হলেও মোবাইলে কথা বলার ধরণ আর দুয়েকটা পরিচিত শব্দের কারণে আমি ব্যাপারটি অনুমান করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার বাড়িতে তিনটে মাত্র ঘর। একটাতে তিনি তার পরিবার নিয়ে থাকেন আর অন্য দুটিতে তার আর দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকে। যুবক অতিথি নেবার মতো অবস্থা তার বাড়িতে নেই। তবে আমি কিন্তু আলী ভাইয়ের আন্তরিকতায় প্রচন্ড মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি যে আমাকে তার বাড়িতে নিতে চেয়েছিলেন তাতেই আমি ধন্য অনুভব করছি। তাকে আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সত্যিকারের ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
আলী ভাই লেহ’র মুসলমান কবরস্থানের পাশে গাড়ি দাড় করিয়ে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আমার জন্য হোটেল খুজতে বের হলেন। আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আশেপাশের ঝলমলে দোকানপাট দেখছি। এসময় দেখি দুটো গাধা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ইয়াল্লা, আমি তো ভাবতাম গাধা তো মনে হয় বেশ বড়সড় কোন প্রাণী। কিন্তু এখন তো দেখি এগুলো আমাদের দেশের রামছাগলের চাইতে একটু বড়।
আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলী ভাই বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে বিফল মনোরথে আমার কাছে ফিরে এলেন। একে রাত হয়ে গেছে তার উপর আমি আবার বাংলাদেশী এজন্য তিনি কোন হোটেলওয়ালাকে আমাকে তাদের হোটেলে রাখতে রাজি করাতে পারেননি। আলী ভাই খুবই বিব্রত। কিন্তু বিব্রত তো হওয়া উচিৎ আমার, কারণ আমিই তো তো তাকে হোটেল খোজার এই ঝামেলায় ফেলেছি।
আলী ভাই এবার গাড়ি ঘুরিয়ে লেহ পোলো গ্রাউন্ডে নিয়ে এলেন। তারপর আমাকে আবার গাড়িতে বসিয়ে রেখে এবার এখানকার হোটেলগুলোতে খোঁজ নিতে গেলেন। এদিকে আমার শরীর তখন বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। সারাদিন জার্নি করেছি। বাইরে খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু শরীর এখন খাবার জন্য একটু ভাত আর শোবার জন্য একটা বিছানা চাচ্ছে। গাড়ি থেকে বের হলাম। আশেপাশের পাহাড়ের মাঝখানে এই বিশাল মাঠটাতে দাঁড়িয়ে থাকতে খুবই ভালো লাগছে। অনেক দূরের একটা পাহাড়ে দেখি একটা মন্দিরে ঝলমলে রঙিন আলো জ্বলছে।
এ সময় দেখি বিশাল গদা গদা একগাদা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে নিজেদের মধ্যে মারামারি বাধিয়ে দিলো। কুকুর যে এতো বড়সড় লোমশ আর ভয়ঙ্কর হয় তা আমার জানা ছিলো না। বাপরে! তাড়াহুড়ো করে গাড়ির মধ্যে উঠে বসলাম।
বেশ কিছুক্ষন পর কুত্তা বাহিনী মারামারি করতে করতে অন্যদিকে সরে গেল। আর তারও কিছুক্ষণ পর আলী ভাই ফিরে এলেন। এখানেও তিনি বিফল হয়েছেন। পোলো গ্রাউন্ড এলাকাতেও কোন সুবিধা হলো না। আমি আলি ভাইকে অনুরোধ করলাম যে আমার জন্য তাকে এতো কষ্ট করতে হবে না। আমাকে যেন তিনি লেহ বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেন, সেখানে আমি আমার নিজের ব্যাবস্থা করে নিতে পারবো। কিন্তু আলী ভাই আমার কথা একেবারেই শুনলেন না। তিনি আমার জন্য সফল না হওয়া পর্যন্ত আরো চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
অবশেষে সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে লেহ’র মেইন মার্কেটের কাছে আসা হলো। এখানেও আমাকে রেখে আলী ভাই হোটেল খুঁজতে বের হলেন। গাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে দাড়ালাম। উগ্র সুগন্ধের কারণে ফিরে তাকালাম একটা বিশাল দোকানের দিকে। দেখি সারি সারি কাঁচের বোতল, আর দোকানটাতে বেশ ভিড়। বুঝলাম যে এটা একটা মদের দোকান। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ভুল ভাঙলো। খেয়াল করে তাকিয়ে দেখি এটা একটা ভেষজ ঔষুধের দোকান। যেখানে সারি সারি বোতলগুলোতে মধু আর বিভিন্ন ভেষজ পণ্য সাজিয়ে রাখা। ভুল ভাবার মাশুল হিসাবে হো হো করে হেঁসে উঠলাম।
অবশেষে আলী ভাই সফল হলেন। এই এলাকাতে বাংলাদেশী এই পরিচয় না দিয়ে তিনি আমার জন্য একটা হোটেলের রুম বুক করে এসেছেন। তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন সেই হোটেলে। তবে সমস্যা বাধলো নাম এন্ট্রি করার সময়। পাসপোর্ট বের করলে হোটেলের কর্মচারী বাংলাদেশী বোর্ডার রাখতে অসম্মতি জানালো। কিন্তু আমি তো অপারগ। হোটেল কর্মচারীটিকে আমি আর আলী ভাই মিলে অনেক অনুনয় বিনয় করে মন গলিয়ে অবশেষে একটা রাতের জন্য রুমটা পেলাম।
এবার আলী ভাইকে বিদায় জানানোর পালা। তার প্রাপ্য বাবদ ৫০০ রুপির একটা নোট দিলাম। তিনি কেমন যেন বিব্রত হয়ে গেলেন। বললেন তার ভাড়া নাকি ১,৫০০রুপি। আমি সকালে কিলং থেকে যখন তার গাড়িতে উঠি তখন তিনি নাকি তাই বলেছিলেন। হবে হয়তো। এবার আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। আসলে দোষটা আমারই। কিলং এ আলী ভাই আমাকে বলেছিলেন ওয়ান ফাইভ হান্ড্রেড। মানে ১,৫০০রুপি। আর আমি ভেবেছিলাম একটা পাঁচশো রুপির নোট। অবশ্য তখনই আমার মনে কেমন যেন খটকা লেগেছিল, তাই তো ভাবি এই রাস্তার ভাড়া মাত্র ৫০০ রুপি হয় কিভাবে! যাই হোক নিজের ভুল বুঝতে পেরে আরো একটা এক হাজার রুপির নোট বাড়িয়ে দিলাম আলী ভাইয়ের দিকে।
আমার তো মনে হচ্ছে এই রুটের একজনের ভাড়া হওয়া উচিৎ কমপক্ষে ৩,০০০ রুপি। কারণ এই রুটটা পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন দুর্গম আর ভয়ঙ্কর সুন্দর পথের একটা। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক ভাগ্যবানের সুযোগ হয়েছে এই পথে যাওয়ার। আর আমি তাদের মধ্যে একজন, যে আমি কিনা একাই একটা গাড়িতে খুবই আরামদায়ক ভাবে এসেছি। যেখানে ইচ্ছা হয়েছে নেমেছি, এবং আমি বাংলাদেশী হলেও কোথাও কোন সমস্যা বা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি । সর্বোপরি আলী ভাইয়ের মতো মানুষের সাথে আমার পথ চলা হয়েছে।
তো আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আলী ভাই পুরো টাকাটাই আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি কিছুতেই আমার কাছ থেকে একটা পয়সাও নিতে রাজি হলেন না। বরঞ্চ তার বাড়িতে যে আমাকে অতিথি হিসাবে রাখতে পারলেন না এজন্য বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমি কি করবো একেবারেই বুঝে উঠতে পারছি না। অন্যরকম এক ভালোলাগা আর ভালোবাসায় আক্রান্ত হলাম। ব্যাপারটা আমার জন্য তার প্রতি কঠিন একটা আবেগ তৈরী করে ফেললো।
অথচ মানালি থেকে লেহ পর্যন্ত ট্যাক্সি রিজার্ভ আসলে আলী ভাই কমপক্ষে ২৫,০০০রুপি পেতেন। তারপরও তিনি লেহতে এসে এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে আমার জন্য বিভিন্ন জায়গায় হোটেল খুঁজে বেড়িয়েছেন। সেই এক ঘন্টাও তিনি তার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেননি। তাহলে সেসময় কতোখানি তেল পুড়েছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক তিনি বাড়ি ছাড়া, সন্ধ্যা থেকে তার ওয়াইফ তাকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে তবুও তিনি বাড়ি না গিয়ে আমার সাহায্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন। আর অবশেষে একটা ভালো হোটেলে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে তারপর বিদায় নিচ্ছেন। তার এ ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো! আলী ভাইয়ের উপর আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হোক।
তবে আলী ভাই আমাকে একটা বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন। কোন পুলিশ অথবা অন্য কোন সংস্থার লোক যদি আমাকে চেক করে অথবা এ সংক্রান্ত যদি কোন নিরাপত্তা তল্লাশির সম্মুক্ষীন হই তবে আমি যেন না বলি যে আমি আলি ভাইয়ের গাড়িতে করে লেহ এসেছি। কারন আলী ভাই একজন কাশ্মিরী মুসলমান, আর আমি একজন বাংলাদেশী মুসলমান, যে ব্যাপারটা এমনিতেই সন্দেহজনক। তার উপর তিনি আমাকে সব জায়গার চেকপোস্টেই ইন্ডিয়ান আর তার আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দিয়ে সব চেক পোস্ট পার করে এনেছেন। এই ব্যাপারটা যদি ধরা পড়ে তবে আলী ভাইয়ের খুবই সমস্যা হবে।
আলী ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। শেষবারের মতো আমরা কোলাকুলি আর করমর্দন করলাম। তিনি তার কোন যোগাযোগ নম্বর আমাকে দিলেন না আর আমার কোন যোগাযোগ নম্বরও নিলেন না। আমার মনটা আলী ভাইয়ের জন্য বেশ খারাপ হয়ে গেল। একদিনের পরিচয়ে আমরা সত্যিই খুব আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ব্যাগ-পত্র টেনে আমার রুমের দিকে রওনা দিলাম।
ঘরে ঢুকে আমিতো পুরোপুরি তাজ্জ্বব। এই জ্বাকজ্বমকপূর্ণ ডাবল বেডের রুমটা আমার! বিশ্বাসই হতে চাইলো না। আমার জীবনে থাকা সবচেয়ে লাক্সারিয়াজ হোটেল এটা। এককথায় বলতে গেলে অসাধারণ। তখনও তো জানতাম না যে হোটেলের চমক তখনো বাকী আছে।
রুমে ব্যাগ রেখে খাবার হোটেল খুঁজতে বের হলাম। পেটের ভিতর তখন আগুন জ্বলছে। আমিতো ভেবেছিলাম লেহ মনে হয় খুব ছোট মফস্বল একটা শহর। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যখন আমি বিভিন্ন রাস্তা আর অলিগলি দিয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম তখন আমার চোখ আরো ধাধিয়ে গেল। দামী দামী কারপেট আর শালের দোকান। বৌদ্ধদের বিভিন্ন এন্টিকের দোকান। আর সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বিভিন্ন ট্রাভেল কোম্পানির দোকান। তারা ট্যুরিস্টদেরকে বিভিন্ন দুর্গম আর অস্থির সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবার প্রলোভন দেখাচ্ছে। আর রাস্তায় গাদা গাদা সাদা চামড়ার বিদেশী। আর এই বিদেশীদের মধ্যে অল্পবয়েসি মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এইসব বিদেশী মেয়েরা কেউ কেউ দুজন একসাথে আবার কেউ সম্পূর্ণ একা পিঠে ভারী ব্যাগপ্যাক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে অল্পবয়সী মেয়েও যেমন আছে তেমন ষাটোর্ধ বৃদ্ধাও আছে। সবকিছু দেখে শুনে আমার মনে হলো লেহ হচ্ছে ধনীদের শহর, যে নিরাপদ শহরটি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর সব ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ অবগত হলেও আমরা বাংলাদেশীরা একেবারেই অজ্ঞ।
তবে আমি যা খুজছিলাম সেটাই পেলাম না। বেশ রাতও হয়ে গেছে। আর এই পাহাড়ি শহরটিতে খুব দ্রুত খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। যে কয়টি খোলা আছে সেগুলোর খাবার শেষ, তারা দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। আর বাকী যে কয়টি খোলা আছে সেগুলোতে যাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। সেগুলোতে রঙিন আলো রঙিন পানি আর রঙিলা বিদেশিনী ঝকমক করছে। এই রেস্তোরাগুলোর দিকে হতাশ চোখে তাকাতে তাকাতে আমি আমার হোটেলে ফেরত এলাম। হয়তো আমার মতো দরিদ্রদের খাবারের জন্য কিছু খাবার দোকান তখনও খোলা ছিলো, কিন্তু এই রাতের অচেনা শহরে আমি সেটা খুঁজে পায়নি।
আজকে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। আমার বাড়িতে আজকে হয়তো কুরবানিও হয়েছে। অথচ দেশ থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে আজ সারাদিন আমাকে প্রায় না খেয়ে থাকতে হয়েছে। আমার কাছে কোন শুকনো খাবার পর্যন্ত নেই। তবুও ব্যাগটা ঘাটা-ঘাটি শুরু করলাম। দেখি এক শিশি মধু আছে। আসলে হয়েছিল কি আমি বরফে বেড়াতে যাবো শুনে আমার যেন ঠান্ডা না লাগে এজন্য আমার বড়খালু আমার ব্যাগে জোর করে এক শিশি মধু ঢুকিয়ে দিয়েছে। নূতন করে অনুভব করলাম যে, আমার সকল আত্মীয় স্বজন আমাকে কি পরিমানে ভালোবাসে। ব্যাপারটা ঠিক রজনীকান্ত সেন এর গানের মতো,”আমি অকৃতী-অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি, যা দিয়েছ তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু লওনি।“ আসলে দূরে না গেলে কাছের মানুষের ভালোবাসা টের পাওয়া যায় না। সেই মধু বের করে খাওয়া শুরু করলাম। কি আর করবো! তারপর দু গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। খিদেয় আমার পেট তখনো চোঁ চোঁ করছে।
যখন বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিলাম, তখন হঠাৎ করে দেখি আমার মনটা খুবই বিষন্ন হয়ে আছে। সারাদিন যাত্রাপথে মনটা অন্যদিকে ব্যাস্ত ছিলো বলে টের পাইনি, কিন্তু এখন এই দরজা বন্ধ করা একটা কক্ষের একাকীত্বে আমি যেন সুদূরে চলে গেলাম। নিজের পরিচয়ের থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটারে দূরে এই দুর্গম অঞ্চলে কেন আমি এলাম! এর চাইতে বছরের এই বিশেষ দিনটা নিজের বাবা মায়ের সাথে কাটানো বেশি ভালো ছিলোনা! তারা নিশ্চয় আমার পথ পানে চেয়ে আছে। আমি তাদের একমাত্র সন্তান, আমাকে ঘিরেই তাদের যতো স্বপ্ন। অথচ গত তিন-চারদিন যাবত আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে ফোনেও কথা বলিনি। আর লাদাখ অঞ্চল থেকে বিদেশের কোথাও ফোন করা যায়না, অর্থাৎ আরো বেশ কিছুদিন আমি আমার বাবা-মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পারবো না। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। যদিও সারাদিনের ওই ভয়ঙ্কর পথ চলায় শরীর খুবই ক্লান্ত, আর এখন এতো নরম আর আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আছি আমি। আবহাওয়াও খুবই চমৎকার ঠাণ্ডা, শরীরে একটা উষ্ণ কম্বল জড়িয়ে আছি তারপরও ঘুমাতে পারছি না। মনটা খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই যদি বাড়ি চলে যেতে পারতাম!
অন্য প্রসঙ্গঃ অনেকেই আমার কাছে ব্লগে আর ইনবক্সে একটা বিষয়ে কৌতুহল প্রকাশ করেছেন। সেটা হচ্ছে মানালি থেকে লাদাখ যাবার এই দুর্গম পথে আমি কেন অসুস্থ হইনি! যেন আমার অসুস্থ না হওয়াটা আমার অপরাধ! হা হা!
আমি কার্যকারণটাতে পুরোপুরি নিশ্চিত না তবে অনুমান করতে পারি। এবং আমার অনুমিত ধারণাটি আমি কিন্তু উল্লেখ করে দিয়েছি। আপনারা যারা সত্যিকার ভাবে জানতে আগ্রহী তারা আমার মানালি থেকে রওনা দিয়ে লেহ পৌছানো পর্যন্ত পর্বগুলো একটু খেয়াল করে পড়লেই তথ্যটা জানতে পারবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৪২