খুব ছোট বেলার কথা আমার ছোট বোন তখন এই টুকুন। ওকে একদিন আম্মা বলল, দেখিস আমরা যে সামনে ধইঞ্চ্যা গাছের বীজ লাগাইছি কাউরে বলিস না। আমার বোন মাথা নেড়ে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ালো। এরপরের কাহিনী খুবই সরল, রাস্তা দিয়ে যেই যায় তারেই ডেকে গড়গড় করে বলে গেলো “আমরা কিন্তু এইখানে ধইঞ্চ্যা টইঞ্চ্যা কোনো গাছ লাগাই নাই”।
আমি যখন ক্লাস টু’তে পড়ি তখনকার গল্প, অইবার কোরবানির ঈদে আমার জন্য অনেক ঘুরের জামা কেন হোলো না, যাই হোক ঈদের আগের রাতে আমি তো মরা কান্না জুড়ে দিলাম “আমার নতুন জামা চাই, নতুন জামা...” আর আমার ভাই বোন গুলা তো দিব্বি জামাটামা নিয়ে আছে। অতঃপর আম্মা আর আপু আমারে নিয়ে গেলো বাসার পাশের এক মার্কেটে। আব্বা ২০০ টাকা (তখন কিন্তু ২০০ অনেক টাকা ছিল আমার কাছে ! আমি ২০০ পর্যন্ত গুনতেই শিখি নাই তখনো!) আমার একটা জামা দেখালো, আমি হিসাব করলাম ১৬০টাকা, মানে আমার বেঁচে গ্যাছে ৪০টাকা! আম্মা অইতুকুন আমার হিসাবে আর কিছু বলল না, জামা পছন্দ হইছে মানে ঝামেলা দূর হইলো! কিন্তু, সস্তার তিন অবস্থা আমি সেই বয়সেই তের পেলাম, যেই না জামাটা পড়ছি, অম্নি আবার ভ্যা ভ্যা শুরু “আম্মা আমার নতুন জামা ছিঁড়ে গ্যাছে, আমার নতুন জামা”।
আমার ছোট বোন আর আমার সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হতো নামাজ পড়া নিয়ে। কদরের রাতে আমি নামাজে দাঁড়ালেই অম্নি ও দৌড়ে চলে আসতো, খানিক পরপর বলতো তোমার কয় রাকাত হইছে, যদি আমি বলতাম ১২ রাকাত, অম্নি ও আরও ২ রাকাত বেশি পড়ে নিতো, এই ভাবে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ পড়তাম, কারন ও আমার থেকে বেশি নামাজ পড়বে এইটা তো হইতেই পারে না! একটা সময় গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে দুইজন চুক্তি করে সমান পরিমানে নামাজে গিয়ে শেষ করতাম হাসিমুখে।
যদিও আমার এবং আমার বোনের সব কিছুই প্রয়োজনের থেকে বেশিই আছে, তারপর’ও আমার বোনটা যখন নতুন কিছু কিনে, সেইটাই আমার বেশি পছন্দ হয়, এবং মোটামোটি বেশির ভাগ সময় আমি ওর জিনিষ গুলা বগলদাবা করি। তারমানে এই না, আমি ওর সবকিছু নিয়ে নেই, যখন আমি হলে থাকতাম, মানে ভারর্সিটিতে পড়তাম, ছুটিতে বাসায় আসতাম আর কারো জন্য কিছু না আনলেও ওর জন্য কখনও খালি হাতে আসতাম না।
আজও অফিস থেকে, বা ভারর্সিটিতে, বা দোকানে গেলে প্রথমেই ওর জন্য কিনি, দোকানে কার্টুন আঁকা কিছু দেখেই, কিংবা নতুন কিছু দেখলেই ওর জন্য কিনে আনি। তাই বলে ওর কেনা কিছু দেখলেই মেরে দিতে মোটেও দ্বিধাবোধ করি না।
আমার বোনটা বাইরের হাবি-জাবি জাঙ্ক ফুড অনেক পছন্দ করে, ওরে নিয়ে বের হলেই পকেটে নুন্যতম ১০০টাকা বেশি নিয়ে নেই, একটা চিকেন ফ্র্যাই আর একটা কোকের দাম! অবশ্য এইটা নিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়ি না! কিন্তু ও মন খারাপ করে বাইরে গিয়ে খেতে না চাইলে তখনো যেন আবার কেমন কেমন লাগে! কি যেন একটা বাকি থেকে যায় বলে মনে হয়!
ঈদ, কিংবা ওর জন্মদিনের আগে মনে মনে বলি “হে আল্লাহ এইবার যেন লিস্টটা একটু ছোট হয়!” কিন্তু বিধিবাম, দিন যায়, ও বড় হয়, লিস্টও বড় এবং দামেও বড় হয়। ওর এইবারের জন্মদিনের ৩টা ফতুয়া চেয়েছিল। যাইহোক মুখ কালো করে কিনতে গিয়ে, কম দামের মধ্যে কিনে ফেলে আমি হাসি মুখে ফিরে এলেও, ওর মুখ কালো হয়ে যায়! কারন দামটা ওর পছন্দ হয় নাই! (এখানে বলা ভালো যে দিন দিন ওর চাহিদার মতন করে আমারও আয় বাড়ছে!) এই ঈদে ওর শেষ বায়না, একটা মোবাইল কিনে দিতে হবে, অবশ্যই টার্চ স্ক্রীন। আমিও হাসি মুখে বলে দিয়েছি অবশ্যই কিনে দিবো, তবে যাই চাবি তার ক্লোন! মানে চায়না সেট! নোকিয়া লুমিয়া বললে নোকিয়া লুমিয়া, আই-ফোন বললে আই-ফোন, তবে সাথে ক্লোন অ্যাড হবে! শুনে ও শুকনা মুখে রাজি হয়েছে বলে রক্ষা!
ওর গত জন্মদিনের কথা না বলেই না, তখন কাপ্তান-ওয়ালা ড্রেস (কি নাম এগুলার কে জানে!) নতুন এসেছে, ওর যে অনেক পছন্দ এইটা অসংখ্যবার শোনা হয়ে গেছে। একদিন ওই জামা কিনব বললাম, ও তো বিরাট খুশি! আমি ওরে বললাম খবর্দার আমার জামা তুই হাত’ও দিবি না। ও বিশ্বাস করলো না। পড়ে যখন কিনে আনলাম এবং ওরে হাতও দিতে দিলাম না, ও মন খারাপ করে বলল আমি একবার খালি পড়বো, দাও না! আমি কঠিন ভাবে না বললাম, ওর মুখ আরও কালো হয়ে গেলো। পড়ে রাতে যখন ১২টার সময় ওরে দিলাম, ও জামাটা ধরে কতক্ষণ খালি হাসি মুখে তাকিয়েই রইলো! কিছু আর বলে না। অনেকক্ষণ পর বলল “এইটা আমার জামা!”
ওরে আমি অনেক জ্বালাই, এই সত্যটা না স্বীকার করলেই না, পানি আন, চা খাব (ও খুব ভালো চা বানায়, যদিও চায়ে এত পরিমান চিনি দেয়!) কিন্তু মাঝ রাতে ওর জন্য ফ্রেঞ্চ ফ্র্যাই বানাতে, বা একটু ছুটি পেলে পাকোড়া বানাতে আমারও ভালোই লাগে।
পরিশেষে, বাবা মারা যাবার পর থেকে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে, ওরে এবং আমার ছোট ভাইটাকে মানুষ করতে হবে, এই টেনশনটা দিন দিন বেড়ে চলছে। কবে যে ওদের পড়াশোনা শেষ হবে আর আমি আমার বোনের কাছে ওর মতন করে একটা বিরাট ফদ্দ ধরিয়ে দিবো!!