অফিসের ইফতার পার্টি হবে ম্যানেজার, বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের নিয়ে- তাই যেনতেন রেস্টুরেন্ট না স্বয়ং পাঁচ তারা রেস্টুরেন্টে হবে ইফতারির আয়োজন, আবার মেনুও খোদ এইচআর ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের ঠিক করে দেয়া, তিনি ফোনও করে দিয়েছেন! তাইলে আহাদ গিয়ে কি করবে! এইজন্যই আহাদের মেজাজ খারাপ, কেবল মাত্র বুকিং ঠিক মতন হইছে কিনা এবং, প্লেসটার ডেকোরেশন ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্যই ওকে সেই উত্তরা থেকে ঢাকার আরেক প্রান্তে যেতে হবে! ছাতার পিয়নের চাকরী! মাত্র কটা টাকার জন্য জানটাই দিয়ে দিচ্ছে অথচ পান থেকে চুন খসবার উপায় নাই। কিন্তু সারাদিন লিপস্টিক ঘষা আর নেইল পালিশ লাগাতে থাকা শমি হইলো ম্যানেজার টাইপ! এমডির ভাস্তি বলে কথা!
যাইহোক পেপার চেকিং, বুকিং, এবং যাবতীয় অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখে, আহাদ বের হবে তখন দেখলো, পাশের বলরুমটায় ইফতারির আয়োজন করা হচ্ছে, মনে হয় একটু পর একটা অনুষ্ঠান হবে, বা ইফতার পার্টি। ওর সামনে দিয়ে এক বয় দারুন একটা প্লেটে বিশাল লবস্টার নিয়ে গেল, আহা কি দারুন তার ঘ্রাণ! কি তার রঙ! কি বিশালই না লবস্টারগুলো! খাওয়া তো দুরের কথা আহাদতো এই রকম লবস্টার চোখেই দেখলো আজ প্রথম! আহাদ হা করে তাকিয়েই থাকলো। সম্বিধ ফিরে পেলো ম্যানেজারের ডাকে, স্যার আর কি কোনো হেল্প করতে পারি। না না ধন্যবাদ বলে আহাদ বের হয়ে পরে। বাইরে বের হয়ে দেখলো বুফেতে খাবার সাজানো আছে, অনেকেই কিনছে, আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছে কেবল। আহাদ এবার একটু সাহস করে এগিয়ে যায়, মুরগী আস্ত আস্ত রান্না করা, দাম দেখে ভিমরি খেলো, মুরগীর দাম ১৬০০টাকা!! সব কিছুরই এতো দাম! অবশ্য সবকিছুই দেখতে এত লোভনীয়! আহাদ লবস্টারটা খুঁজলো। খাইছে!! ১২০০ টাকা!!! নাহ......।। বড়লোকদের ভাবই আলাদা! একবেলা ইফতার করতে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে একমাত্র ওরাই পারে! আহাদের বেতনই তো সবসুদ্ধু হাজার চারেক টাকা মাত্র! সাবলেট থাকে বলে কোনমতে খেয়ে পড়ে ঢাকা শহরের মতন জায়গায় বেঁচে আছে!
চাচা আইজ আমরা আলুর চপ খাবো, বীথি রিতি- আহাদ ঢুকলেই ওকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলল। তাই মামুনি, তা তোমরা আজ সারাদিন কি করলা? চাচা আম্মা আইজ সারাদিন আমাদের জন্য লাল জামা বানাইছে, অইযে আব্বা একটা লাল শাড়ি কিনে আনছিল না, অইটা দিয়া! বীথি কথা শেষ করতেও পারলো না, তার আগেই পাশের রুমটা থেকে সাহানা মানে ওদের মায়ের গলা সোনা গেলো, বীথি রিতি ভিতরে আয় মা, চাচারে আগে ঠিক হইতে দে। আযানের আর বেশি বাকি নাই। চাচা তুমি যাও তাড়াতাড়ি আইসো, নাইলে কিন্তু চপ পাইবা না। ওরা দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। আহাদ শফিক আর সাহানার ঘরের বাইরের রুমটায় মাত্র ১৩০০টাকায় ভাড়া থাকে এবং ওদের সাথেই খায়। সম্পর্কে ও ওদের কিছুই হয় না, রুম ভাড়া হবে দেখে মাস পাঁচেক আগে আহাদ এই রুমটা মানে খানিকটা জায়গা ভাড়া নিয়েছিল, যা সারাদিনই প্রায় দুই যমজ বোন, বীথি রিতির দখলে থাকে। তাতে আহাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই।
ইফতারিতে বেশির ভাগদিনই থাকে খেজুর তারপর ভাত। আজ বীথি রিতির জন্য আলুর চপ করা হয়েছে, মেয়েদুইটা আলু খুব পছন্দ করে। কিন্তু আহাদ আজ চোখ খোলা রেখেও সেই লবস্টার দেখতে পারছে! নাহ, এই জিনিষ একবার চেখে দেখতেই হবে।
পরের দুইটা দিন আহাদের মাথা থেকে লবস্টারটার ছবি মুছলো্তো নাই, বরং এখন যেন ও লবস্টারটার ঘ্রাণও পাচ্ছে! তার উপর আবার অফিসের সবার মুখে মুখে সেই ইফতার পার্টির প্রসংশা! আহাদ কান পেতে শুনে তার বর্ণনা, লবস্টার শব্দটা কেউ বললেই আহাদের কান আরও উৎক্রিন হয়ে ওঠে। লবস্টারটাই নাকি অসাধারন হয়েছিল খেতে, সেটা নাকি একদম আসল সামুদ্রিক লবস্টার! আহা! আহাদের যদি ভাগ্য হইতো অমন লবস্টার খাওয়ার!
শেষ পর্যন্ত আহাদ হিসাব করতেই বসলো। এইবার বেতনের ৪১০০ টাকা বাদেও আহাদ বোনাস পাবে, আর তা ১৪০০টাকা! আহাদ ভেবে রেখেছিল, এই টাকাটা জমিয়ে রাখবে। আহাদ একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছে, একদিন যখন ওর ৫০ হাজার টাকা জমে যাবে, তখন ও এই পিয়নের চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজের একটা দোকান দিবে। কিন্তু নাহ, অই লবস্টারটা দিন দিন ওর মাথাতে গেঁড়ে যাচ্ছে!
কাল বেতন দিবে। তাই আজ আহাদের মনটা অনেক খুশি। বীথি রিতির প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আজ আর অনন্যা দিনের মতন ক্লান্ত লাগছে না এতোটুকুও! চাচা আমাদের জামা দেখবা না? ওরা দৌড়ে ভিতরে চলে যায় কিছু বলার আগেই। দুইজন ফিরে এলো জামা হাতে! মাস খানেক আগে শফিক সাহানাকে যে লাল শাড়িটা দিয়েছিলো, সেটা কেটে বানানো। মনে হয় সাহানা নিজেই বানিয়েছে, মেয়েটা মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিলো, ভালবেসে মা-বাবার অমতে শফিককে বিয়ে করার জন্য আজ মেয়েটা এই বস্তিতে! কিছুই পারে না, তবে চেষ্টা করে সব কিছু ঠিক মতন করার! তবুও দুই বছরের বীথি রিতির জামা দুইটাকে ঠিক সুস্থ জামা বলে মনে হচ্ছে না!
বেতনের টাকা গুনে আহাদের মনটা ভালো হয়ে গেলো। বোনাস! এইবার ঠিক’ই ও লবস্টার খাবেই। আহাদ একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
ওইতো দেখা যাচ্ছে, ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসে আছে, সুন্দর পোশাকের হোটেল বয়গুলা। সামনে মুরগী, হাঁস, খাসি, গরুর মাংস, কাবাব, আর নাম না জানা শ’খানেক খাবার। আর সেই লবস্টার!
আহাদের চোখের সামনে কেন যেন হটাৎ বীথি রিতির হাসি হাসি মুখ ভেসে উঠলো। ওদের চাওয়ার লাল জামা। ওর বাবা-মার সাধ্য নাই বলেই সাহানা তার সাধের লাল শাড়িটা কেটে ওদের জামা বানাতে এতটুকু কার্পণ্য করে নাই! নিজেরা না খেয়েও মেয়ে দুইটার জন্য আলুর চপ জোগাতে সেদিন ওরা স্বামী স্ত্রী মিলে কেবল ভাত খেয়েই রোজা রেখেছিল। কোনদিন যা বীথি রিতি বা আহাদকে বুঝতে দেয়নি। কিন্তু আহাদ অইদিন ওদেরকে ভাত খেতে দেখে ফেলছিল। আহাদ জানে, দিনের পর দিন গারমেন্টস শ্রমিক শফিক হেঁটে হেঁটে কিংবা দুপুরে শুকনা রুটি খেয়ে কাটায় কেবল বউ আর মেয়েদুইটার কথা ভেবে! কি বিচিত্র এই ভালোবাসা নামক বন্ধন!
১৪০০ টাকায় একটা লবস্টার আর আহাদের তৃপ্তি আবার এই ১৪০০টাকা দিয়ে আহাদ কিনতে পারে একটা পরিবারের মুখের হাসি।
নাহ, আহাদ আসলেই পারবে না, ১২০০টাকা দামের একটা মাছ খেতে, তা সামুদ্রিক লবস্টারই হোক না কেন! না হয়, আজ নিউ মার্কেট থেকে ফিরার পথে ১০০ টাকা দিয়ে পাঁচটা রাস্তার পাশে ভাজা চিংড়ির মাথা কিনে ফিরবে, যেগুলো হয়তো এই হোটোলের মাছেরই ফেলে দেয়া অংশ দিয়ে বানানো!
আহাদ বাড়ি ফিরছে। দুইটা জামা কিনতে ১৫৬০ টাকা বের হয়ে গেছে! এইটুকু এইটুকু জামার এত দাম ক্যাম্নে হয়, আহাদের মাথার ঢুঁকে নাই! ওর অন্য হাতে চিংড়ি ভাজা! সামনে একটা বেলুনওয়ালা সুন্দর সুন্দর রঙের বেলুন বিক্রি করছে! আহাদ আজ দুইটা কিনেই ফেলবে নাকি!??