নিরাপদ সড়ক চাই--@সূত্র zakir bcs special
জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ বিশ্বে ১৩তম আর এশিয়ায় ৭ম । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ এ প্রতিবছর ২১ হাজার নিরপরাধ মানুষের তরতাজা প্রাণ অকালে নিভে যায় ! পিচ ঢালা কালো রাজপথটা আবিরের রঙে রন্জিত হয় ! যে গেল, সে ত গেলই ! কিন্তু যার গেছে হায় ! সেই বোঝে হায় , হারানোর কী যন্ত্রণা !! এরকম ভয়াবহতায় আমি দুরপাল্লার ভ্রমণে কখনো নিজে যেমন বাসে যাই না তেমনি আমার আশেপাশের সবাইকেই নিরুৎসাহিত করি । লোকে আমাকে নন্দলাল বলে বলুক !জীবনের মূল্য অনেক বড় !
নিরপরাধ মানুষ মারার রাস্তার দানব একদিকে সরকার , অন্য দিকে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবাই ।
নিরাপদ সড়ক চাই স্লোগানকে নিয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন একুশে পদক পাবার আশায় ২৫বছর ধরে আন্দোলন করেনি ; সেখানে রয়েছে স্বজন হারানো হৃদয় ফাটানো তীব্র যন্ত্রণা ! , কিন্তু আমরা কখনো কি তাঁর সেই আর্তনাদে কর্ণপাত করেছি? যখন নিজের কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন একটু চেতন ফেরে ! মিশুক -মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে গণমাধ্যম একটু নড়ে বসে! কিন্তু প্রতিদিন যে শত শত মিশুক -মুনীর অকালে প্রাণ হারায় তার খোঁজ কেউ রাখে না ! সম্প্রতি স্কুল শিক্ষার্থীরা সহপাঠী হারানোর বেদনায় মৃত্যুকে , পুলিশকে , বৃষ্টিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ঢাকা শহরে আন্দোলনে নেমেছে । এর দাবানল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে । এজাতির জন্য শিশু -কিশোরদের এই আন্দোলন একটি চরম লজ্জা । কারণ সুকান্ত পণ করেছিলেন এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে রেখে যেতে কিন্তু আমরা পারিনি । তাই শিশু- কিশোররা নিজেরাই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য রাস্তায়....!! সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের জনগণের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা খরচ করে পালিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ যখন ব্যর্থ , তখন জান ও যানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমেছে এদেশের হাজার হাজার স্কুল - কলেজ পডুয়া ছাত্রছাত্রী ! আর এই মহৎ কর্ম করতে গিয়ে গতকাল এক ছাত্রকে পিষে দিয়েছে রাস্তার দানবরা !! তবুও থেমে থাকে নি অকুতভয় শিশু - কিশোররা । ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে করে গাড়ী ছাড়ছে! এমনকি মন্ত্রীর গাড়ী উল্টো পথে আসলে প্রটোকলসহ ফিরিয়ে দিয়েছে অদম্য শিশু - কিশোররা!
এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির জন্য ক্লাস -পরীক্ষা বাদ দিয়ে ওরা এখন রাস্তায় ।
গর্বিত আমি এদের নিয়ে ! এরাই জাতিকে সঠিক পথ দেখাবে । দেশ ভালো হবে যদি অদম্য শিশু - কিশোর, তারুণ্য ভালো হয় , অধিকার - দায়িত্ব সচেতন হয় !
ওদের এই আন্দোলনটা যেন গোটা বাংলার সব মানুষের হয়ে উঠেছে । ওদের নেই কোনো নেতা , আছে শুধু একতা ও অদম্যতা । নেই কোনো ফেইসবুক গ্রুপ তাই সরকার জামাত শিবির তকমা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে পারছে না ।ভয়ে আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সুকান্তের ‘১৮ এর কাছে সবাই মাথা নত করতে বাধ্য এটা প্রমাণিত । ওদের এই আন্দোলনে থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত । কেননা
বাচ্চা ছেলগুলো " জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো' স্লোগান থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিদীপ্ত সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে । সেটির প্রমাণ ওদের স্লোগানগুলো
১. যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ।
২. আমরা যদি না জাগি মা ক্যামনে সকাল হবে।
৩. আম্মুর নির্দেশ, গুলি না নিয়ে বাসায় ফিরবি না।
৪. বিবেক তবে কবে ফিরবে।
৫. মুজিব কোটে মুজিবকেই মানায়, চামচাকে না।
৬. জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে।
৭. মা তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, আমি আর ঘরে ফিরবো না।
৮. আমরা ৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই
৯. 4G স্পিড নেটওয়ার্ক নয়, 4G স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই।
১০. পুলিশ আংকেল, আপনার চা-সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না।
১১. পুলিশের গাড়ির লাইসেন্স নাই
১২. ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই।
১৩. বিচার চাই না, বিচার করতে হবে।
১৪. শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যে দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে।
।
ওরা আগামীর বাংলাদেশ তাই স্লোগানে থেমে থাকেনি কাজে পরিচয় দিয়েছে ! যেমন:
* ধানমণ্ডির ভাঙ্গা কাঁচে ভরা রাস্তা পরিষ্কার করার দৃশ্যটাই ছিল একটা যুগান্তকারী মুভমেন্ট।
* ক্রাচ নিয়ে রিকশায় ভীত বোনটিকে মিছিল সরিয়ে যেতে দেয়াই ছিল একটা আন্দোলন।
* ভেঙ্গে যাওয়া পা নিয়ে রিকশায় যাওয়া মাকে রাস্তা ক্লিয়ার করে হাসপাতালে যেতে দেয়া একটা মুভমেন্ট।
* লাইসেন্স চাইতে গিয়ে ট্রাকের নিচে পিষে মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোই ছিল একটা মুভমেন্ট।
* একেকটা ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বের করে আন্দোলনের স্লোগান বানানো একটা মুভমেন্ট।
* উল্টো পথে আসা ভিআইপি (খোদ বাণিজ্য মন্ত্রীকে বলে আইন সবার জন্য এক, We want justice ) গাড়িকে ফেরত পাঠানো ছিল একটা মুভমেন্ট।
* পুলিশের গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স চাওয়া এবং না পেয়ে গাড়িতে লেখা, লাইসেন্স নাই, এটাই আন্দোলন।
* বাইকে চড়া পুলিশের মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেয়া মুভমেন্ট।
* এক লাইনে সব রিকশা, তীব্র জ্যামযুক্ত রাস্তাটি নিমিষেই জ্যাম বিহীন! এটাই পরিবর্তন।
*ওরা শত শত অ্যাম্বুলেন্সকে রাস্তাপারে সহযোগিতা করে শত শত প্রাণ বাঁচিয়েছে - এটিই ছিল একটি মানবতা !
*একটা ১২-১৩ বছরের ছেলে মোটা গ্লাসের চশমা চোখে খুটিয়ে খুটিয়ে লাইসেন্স দেখছে! ও আগামীদিনের ম্যাজিস্ট্রেট !
এই ১২-১৮বছরে অদম্য শিশু কিশোর , তরুণরা এমন একটি বিষয়কে নিয়ে আন্দোলন করছে যা রাষ্ট্র ও সাধারণ জনগণের টনক নড়িয়ে দিয়েছে । এই সর্বগ্রাসী , মহামারীরুপী সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বলিষ্ট পদক্ষেপ সরকার ও সচেতন জনগণ না নেওয়াই আজ ওদের রাস্তায় নামতে হয়েছে ! অথচ হিসাব ছিল অন্য রকম।
কেননা :
১। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর জিডিপির ২% নষ্ট হয় , আর ট্রাফিক জ্যামে নষ্ট হয় জিডিপির ২% । এর মূল্যমান কত জানেন? বার্ষিক প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা । যা দিয়ে প্রতিবছর ১টা করে পদ্মাসেতু , একটা করে মেট্রোরেল কিংবা ১ একটা করে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিষেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অন্তত তিন লক্ষ ৪৭ হাজার মাস বেতন দিতে পারতাম। অথচ জিডিপিতে ১.৩% অবদান রাখা পদ্মাসেতু নিয়ে কথার ফুলঝুরি ছড়ায় দিন-রাত!
২। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে , ২০১৬ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৬০৫৫ জনের। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার পরে ২০১৭ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৭৩৫৭ জনের (সূত্রঃ যুগান্তর)। সহজ বাংলায় পরবর্তী এক বছরে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর ৪২ শতাংশই ছিলেন নিরিহ পথচারী
৩।২০০৭ সালে করা ব্র্যাকের করা এক গবেষণা অনুসারে ভারী যানবাহনের ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ চালকই ‘ওস্তাদে’র (মূল চালকের) সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, দেশে ভারী যানবাহনের প্রায় আড়াই লাখ চালক রয়েছেন। তাঁদের ১ লাখ ৯০ হাজার লাইসেন্স পেয়েছেন পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে। তাঁরা লাইসেন্স পান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে।
।
৪। দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।এই তথ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)।
৫। সর্বোপরি, প্রতিবছর যে ২১ হাজার নিরপরাধ মানুষের জীবন অকালে ঝরে যায় তার মূল্যমান দুনিয়ার কোনো প্যারামিটার দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয় ।
অথচ সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো ও নিরাপদ সড়কের জন্য ব্যাপারে লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যান নিষিদ্ধ করণে এবং পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের দৌরাত্ম্য দূরীকরণে রাষ্ট্র বরবারই উদাসনীতার পরিচয় দিয়েছে । জনগণের রক্ত পানি করা ট্যাক্সের টাকায় পালিত পুলিশ বাহিনী সহ সড়ক ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ হয়েছে ঘুষ - দুর্নীতির হরি ঘোষের গোয়াল !
১২-১৮ বছর বয়সীদের এই আন্দোলন জাতির দীর্ঘদিনের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র ! আমরা ওদের জন্য নিরাপদ সড়ক দিতে পারিনি , কিন্তু ওরা আমাদের দিয়ে সুকান্তের কবিতার উল্টা অঙ্গীকার রচিত করে যাবে । ওরা অদম্য, ওদের জয় নিশ্চিত ! ভালো থাকুক ওরা- সড়কে , ক্যাম্পাসে!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৭