বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান শিশুখাদ্যের প্রকৃতি ও গুণগত মানের একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড় করিয়েছে। এক্ষেত্রে সহজপাচ্য, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবারগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে মানা হচ্ছে না এ মানদণ্ড। ফলে সেখানে নানা ধরনের চিপস, ক্ষতিকর উপাদানে তৈরি চকোলেট, চিত্তাকর্ষক রঙে রঙিন ওয়েফারসহ হরেক রকমের খাবারে বাজার হয়ে গেছে সয়লাব। বিক্রিবাট্টা বেশ ভালো হওয়ায় বিভিন্ন বিপণিবিতানে দেখা যায় এসবই থরে থরে সাজানো। চিত্তাকর্ষক ও লোভনীয় মোড়কের পাশাপাশি শিশুদের আকৃষ্ট করতে এসব পণ্যে উপহার হিসেবে দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের খেলনা। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সেঁটে দেয়া বিলবোর্ড কিংবা টেলিভিশন দেখে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে পছন্দসই নানা রকম খেলনা উপহারের কথা জানছে শিশুরা। তার পর সময়-সুযোগ বুঝে তারা অভিভাবকদের কাছে এসব পণ্য কেনার আবদার করে বসছে। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির তৈরিকৃত এসব শিশুখাদ্যের সঙ্গে উপহার হিসেবে যে অতি ক্ষুদ্রাকৃতির খেলনা দেয়া হচ্ছে, তা খাবারের সঙ্গে শিশুরা মুখে দিলে অনেক সময় পেটে গিয়ে ঘটছে প্রাণহানির মতো ভয়াবহ ঘটনা।
বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি চিপসের প্যাকেটের ভেতরে উপহার হিসেবে দেয়া ক্ষুদ্রাকৃতির খেলনা গলায় আটকে প্রাণ হারায় শিশু তামিম। শিশুদের স্বভাবসিদ্ধ পছন্দে নয় মাস বয়সী তামিম চিপস খেতে গেলে এর প্যাকেটের ভেতরে থাকা ক্ষুদ্রাকৃতির খেলনা প্রাণই কেড়ে নিয়েছে তার। পরিবারের ভাষ্যমতে, ওই চিপসের প্যাকেটের মধ্যে থাকা খেলনা তামিমের গলার ভেতরে ঢুকে গেলে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। উপরন্তু, আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিত্সকরা তাকে বরিশাল মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে বেলা ১১টার দিকে সেখানেই নিভে যায় শিশুটির জীবনপ্রদীপ। বাস্তবে শিশু তামিম খেলনা আর খাবারের পার্থক্য বোঝেনি বলে হয়তো খেলনাটিই খেতে গেলে গলায় আটকে তার মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
তামিমের মৃত্যুর সংবাদ সেভাবে সব দৈনিকে না আসায় অনেকে জানতে পারেনি এর ভয়াবহতার কথা। ফলে শিশুখাদ্যের সঙ্গে খেলনা দিয়ে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করার ব্যবসা চলছে ঠিক আগের মতোই। এখনো বিভিন্ন ধরনের খাবার দেদার বিক্রি করা হচ্ছে এমন খেলনার প্রলোভনেই। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কিছু কোম্পানির বিস্কুটের প্যাকেটে মিলছে লাল রঙের এক ইঞ্চি আকারের প্লাস্টিকের হরিণ ও ক্ষুদ্রাকৃতির খেলনা বাঘ। জনপ্রিয় কিছু ব্র্যান্ডের পিলো চকোলেট ওয়েফারের সঙ্গেও দেয়া হচ্ছে নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিকের প্রাণী। এক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে কোনো সতর্কতা বার্তা না থাকায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে সেখানে বলা হয়নি, এসব খেলনা কত বছর বয়সী শিশুদের উপযোগী। ফলে অভিভাবকরা অজ্ঞাতসারে এগুলো তুলে দিচ্ছেন শিশুদের হাতে। তাই অভিভাবকরা সতর্ক নন— এ কথা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই কর্তৃপক্ষের। বিশেষ করে এর মান যাচাইয়ের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানও প্যাকেটের ভেতরে কী আছে, তা না দেখেই এগুলো বিক্রির সনদ দিচ্ছে। অন্যদিকে এর উপাদানগত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকছে না ক্রেতাদের জন্যও। ফলে সবাই সবার দায় এড়াতে পারলেও শেষ অবধি বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না কিছুতেই।
শুরুটা হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের স্টিকার দিয়ে। তখন বিভিন্ন ধরনের বাবলগামের সঙ্গে ট্যাটু স্টিকার দেয়া হতো। এসব স্টিকারের জন্যই তখন বেড়ে গিয়েছিল ওই বিশেষ ব্র্যান্ডের চুইংগামের বিক্রি। তার পর অনেক চিপসের প্যাকেটের সঙ্গে ইয়ো ইয়ো কিংবা হাতে ঘুরানো লাটিম দেয়া শুরু হয়। কেউ কেউ চিপসের প্যাকেটের সঙ্গে দেয়া শুরু করে হাতে ঘুরিয়ে ওড়ানোর উপযোগী প্লাস্টিকের চরকি। তবে সেক্ষেত্রে এসব উপহারের উপকরণগুলো প্যাকেটের বাইরে দেয়ায় সহজেই অভিভাবকরা বুঝে যেতেন তার গতিপ্রকৃতি। অন্যদিকে সেগুলো আকৃতির দিক থেকে বড় হওয়ায় শিশুদের গলায় আটকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সম্প্রতি বিভিন্ন চিপসের প্যাকেটের সঙ্গে যে খেলনাগুলো দেয়া হচ্ছে, সেগুলো শুধু বর্ণিল ও চিত্তাকর্ষকই নয়; এগুলোর আকৃতিগত ভয়াবহতাও চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ক্ষুদ্র পরিসরের এসব খেলনা শিশুরা খাবারের সঙ্গে সঙ্গে মুখে দিলে অভিভাবকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এটি গলায় আটকে যাওয়ায় অনেককেই নিতে হয়েছে হাসপাতাল পর্যন্ত। কেউ কেউ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পৌঁছে গেছে মৃত্যুর দুয়ারে।
ভয়াবহতার শেষ সীমা হচ্ছে বেশির ভাগ শিশু খাবার থেকে খেলনার জন্যই এসব বিশেষ উপকরণের প্যাকেটের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে নিজেদের ব্যবসা প্রসারের জন্য বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের খাবারে এখন থেকে এমন খেলনা পুরে দিতে চাইবে। ক্ষতিকর প্লাস্টিকের উপকরণে তৈরি এসব খেলনা থেকে যেমন খাবারে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে, তেমনি এতে ঝুঁকি বেড়ে যাবে আরো বহুগুণ। অন্যদিকে বেশির ভাগ অভিভাবক নিরুপায়। কারণ নগরীর ব্যস্ত জীবনে দাফতরিক কাজের ঝক্কি-ঝামেলায় সবাই যখন ব্যস্ত, তখন শিশুদের একমাত্র বিনোদন মাধ্যম টিভি। সেখানে বিজ্ঞাপন দেখে মা-বাবা বাসায় এলে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। ফলে ওই খাবারগুলো কিনে না দিয়ে তেমন পথ থাকে না অভিভাবকদের সামনে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ওইসব খাবার কেনা হলেও শিশুরা নামমাত্র মুখে দেয়, পুরোটা খায়ও না। কারণ তার দরকার এসব কিম্ভুতকিমাকার খেলনা। তবে সব অভিভাবকই জানেন যে, খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে অনেক সময় তা মুখেও দেয় শিশুরা। ফলে এসব খেলনা আবার মুখে আটকে যায় কিনা, এমন আশঙ্কায় চলছে তাদের ঘরবসতি।
শিশুরা লালের পাশাপাশি অন্য যেসব রঙে বেশি আকৃষ্ট হয়, কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে সে রঙই বেছে নিয়েছে। কোম্পানি তাদের ব্যবসার স্বার্থে এটি করলেও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। সবচেয়ে বড় বিষয়, অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শিশুদের খাবারের সঙ্গে উপহার হিসেবে খেলনা দিলেও তার আকৃতি এত ক্ষুদ্র হওয়ার সুযোগ নেই। এসব খেলনা আকৃতিগত কারণেই বিপদ বাড়াচ্ছে। এমনিতেই শিশুরা হাতের কাছে যা পায়, তা-ই মুখে দিতে চেষ্টা করে। সেখানে উদ্দিষ্ট বস্তু যদি তার পছন্দের হয়, তবে ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে এক থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের জন্য এসব খেলনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তথা ব্যবহার অনুপোযোগী। অন্যদিকে এক প্যাকেটে খেলনা দিয়ে পরের প্যাকেট খুলে দেখার জন্য শিশুদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে এক ধরনের আগ্রহের মধ্যে। এতে কোম্পানিগুলো এক কথায় তাদের সঙ্গে গ্যাম্বলিং করছে। অন্তত শিশুদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ প্রশ্নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত এখনই। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বাজারে বাজারে খোঁজ করে এ ধরনের বিপজ্জনক খাবারের প্যাকেটগুলো সরিয়ে নিতে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে হবে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্য সূত্র ঃ বনিক বার্তা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৪