somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সখি হাম: ভানু সিংহের নিষিদ্ধ প্রেম

১০ ই মে, ২০১৫ রাত ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কে ছিল পীর আলি? যশোরের রাজার উজির। হয়তো মুসলিম রাজত্বের স্থায়ী অবসানের কথা গুরুত্বের সাথে তখনো চিন্তা করে উঠতে পারেন নি। তাই হয়ে গেলেন ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম। সঙ্গে তাঁর আত্মীয় কয়েকজন। শুধু যাঁরা বিধর্মী হলেন তাঁরাই না, তাঁদের সব আত্মীয়ও একঘরে হলেন হিন্দু সমাজে। ছি, ছি, ব্রাহ্মন হয়ে এই কাজ? পুরো গোষ্ঠির নাম হয়ে গেল পীরালি ব্রাহ্মন।
যেহেতু হিন্দু সমাজ অচ্ছুৎ করে রাখল, এবং অবশ্যই এদের সবার মুসলিম হয়ে যাওয়ার কোন আগ্রহ ছিল না, সুতরাং অনেকে নতুন প্রচলিত ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দিলেন। দেব-দেবীর পূজা থেকে অব্যাহতি পেলেন। নিরাকার একেশ্বরবাদ শুধু প্রাক্তন শাসক মুসলিম না, নতুন রাজা-জাতিরও পছন্দ। জাতিভেদের জটিলতা নেই, পাশ্চাত্য শিক্ষা বা সংস্কৃতিতে পন্ডিত হতে বাধা নেই। বেশ দ্রুত এগিয়ে গেলেন এই আধুনিক মনোভাবের মানুষগুলি।

রাজা রামমোহন রায়ের পরে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে চলে এলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে, যিনি রামমোহনের এংলো-হিন্দু কলেজে লেখাপড়া করেছিলেন। কিছুদিন বাপ-দাদার ব্যবসা দেখা শুনা করে শান্তি পেলেন না দেবেন্দ্রনাথ। আবার মহাভারত উপনিষদের ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে হলো। দেশ-বিদেশে ঘোরার অভ্যাসও এলো। তবে এর ফাঁকে ফাঁকে জনক হলেন তেরোটি বাচ্চার। তিনজন ইতিহাসে খ্যাত – সত্যেন্দ্রনাথ , যিনি ছিলেন প্রথম দেশী আই সি এস অফিসার, জ্যোতিন্দ্রনাথ সংসারবিমুখ নাট্যকার, সম্পাদক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী। যদিও বড়ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রথম বাংলা সঙ্গীতে স্বরলিপি লেখার ব্যবস্থা করেন, ঠাকুর বাড়িকে পরিশীলিত সঙ্গীতভবনে রূপান্তর ঘটান নানা যন্ত্রে পারদর্শী জ্যোতিন্দ্রনাথ। পরে বছর দশেকের ছোট রবীন্দ্রনাথ তৈরী সুরে কথা সংযোজন করে সম্পূর্ণ গান সৃষ্টিতে হাতে খড়ি নেন। জ্যোতি শরীরচর্চাতেও পারদর্শী ছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ স্কুল পালালেও ভাই জ্যোতির সাথে নিয়মিত কুস্তি-ব্যায়াম করে শরীরটা বেশ সুন্দর সুস্থ করে গড়ে তুলেছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ায় অনুৎসাহী রবিকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরলেন উপনয়নের পরে, অর্থাৎ এগারো-বারো বছর বয়সে । বাড়িতে গৃহশিক্ষকেরা সাহিত্য-বিজ্ঞান-গণিত সবই শিখিয়ে যেত। ষোল বছর বয়সে পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যন্ডের ব্রাইটনে যেখানে জমিদার পরিবারের নিজস্ব বাড়ি ছিল এবং সেখানে সরকারী কর্মকর্তা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়ে থাকতেন। ব্যারিস্টারি পড়ার চেষ্টায় বিফল হয়ে আবার দেশে ফিরে এলেন।

সে সময় কেউ কেউ মৈথিলী ভাষার কৃত্রিম পরিশীলিত ব্রজবলি রূপে লেখার অভ্যাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ ভানু সিংহ নাম নিয়ে তাঁর বিখ্যাত পদাবলী লিখেছিলেন এ সময়। শোনা যায় অল্পবয়সী তরুণের চিন্তার মধ্যে স্বাভাবিক কামভাবের পদধ্বনি। আছে চুম্বনের কথা, দৈহিক মিলনের কথা।

ব্যক্তিগত জীবনেও রবীন্দ্রনাথ আসক্ত হয়ে পড়েন বৌদি কাদম্বরী দেবীর প্রতি। এই ভাইটি তাঁর সবচেয়ে নিকটজন হলেও এবং তাঁর জীবনে অনেক বিষয়ে গুরুর ভূমিকা পালন করলেও বৌদিকে রবীন্দ্রনাথ অন্য চোখে দেখতে শুরু করেন। নষ্টনীড় গল্পে তার স্বীকারোক্তি আছে। স্বামীর অবহেলায় কাদম্বরীও হয়তো সুবিবেচনার বিরুদ্ধেই এদিকে এগিয়ে যান।

ঠাকুরবাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিলেন ভবতারিনী। তাঁর বাবা পরিবারের বাজার সরকারের অবস্থানে।
__________________________________________________
এর পরের অংশ ইতিহাস নয়, কল্পনা। কিন্তু অসম্ভব কি?
___________________________________________________

মাঝে মাঝেই আজকাল রবির মনটা কেমন খচখচ করে। বৌদির সঙ্গে এই সম্পর্কটা তাঁকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে? কথাটা তাঁর বাবার কানেও গিয়ে পৌঁছেছে। সেদিন ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
- রবি, লেখাপড়া কেমন্ চলছে?
- ভালোই, বাবা।
- তুমি তো আর স্কুলে গেলে না। একটা অভিজ্ঞতা হলোনা তোমার।
- কি, বাবা?
- এই, সমবয়সী ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব। কত কি জানা যায় বন্ধুদের কাছ থেকে, যদি তারা আলোকিত পরিবার থেকে আসে, বুদ্ধিমান হয়। আমাদের সমাজে সৎ বন্ধুর অনেক গুরুত্ব।
- কিন্তু আমার তো…
হঠাৎ থেমে যায় রবি। বাবা কি বলতে চান এখন একটু মাথায়্ ঢুকছে।
দেবেন ঠাকুর এবার মুখটা গম্ভীর করেন।
- আমাদের সমাজে কিছু রীতিনীতি আছে। সমাজকে রক্ষা করতে হলে তা দরকার। সব রকম বন্ধুত্বই গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু কিছু সম্পর্ক একেবারেই পরিত্যাজ্য। তুমি বুদ্ধিমান, কিন্তু নির্বোধের মত একজনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছ, নিজেরও সর্বনাশ ডেকে আনছ। আমি নিশ্চিত আমি কি বলতে চাই তা তুমি বুঝতে পেরেছ।
রবীন্দ্রনাথের মাথা বন বন করে ঘোরে। বাবা রুষ্ট হয়েছেন, কি লজ্জা! কি লজ্জা! এত স্নেহ করতেন বাবা তাঁকে। কত দেশে নিয়ে গেছেন। কত কথা তাঁর সাথে স্বদেশে বিদেশে হয়েছে। তিনি তাঁকে একজন ভালোমানুষ হিসেবে তৈরী করতে চেয়েছেন। কিন্তু ঊনিশ বছর যখন শরীরে আসে, তখন সব কেমন ওলট-পালট হয়ে যায়। সম্ভব-অসম্ভবের জ্ঞান লোপ পায়, তিনি ভানু সিংহ হয়ে যান, তাঁর মন শুধু এক রাধাকে খোঁজে, যার সাথে সম্পর্ক অনৈতিক।

কাদম্বরী ডেকে পাঠান।
- কি, আজ যে নিজে থেকে এলে না, আমাকেই ডেকে পাঠাতে হলো।
রবীন্দ্রনাথ কপটতার আশ্রয় নেন।
- মাথাটা একটু ব্যথা করছিল।
- টিপে দেবো একটু? হাসির ছলেই বলেন কাদম্বরী। অন্য কোনো দিন হলে রবিও হাসতেন, মজার কিছু বলতেন। কিন্তু আঁতকে ওঠেন্ আজ।
- না, বৌদি, আমি বরং ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের ঘরে গিয়ে ভাবতে থাকেন।। শুধুই ভাবেন। কুল কিনারা দেখেন না। ক্রমে ক্রমে কাদম্বরীর সাথে সাক্ষাৎ কমতে থাকে। কাদম্বরী ডাকলেও অনেক সময় শরীর খারাপেরর অজুহাত দেখিয়ে নিজের ঘরে বসে কবিতা লেখেন। সে কবিতায় আগের প্রিয় মানুষটি নেই।

কি ছিল বিধাতার মনে। একদিন দেখা হয়ে যায় বালিকা ভবতারিনীর সাথে। চপলা তাঁর দিকে চোখ ড্যাব ড্যাব করে নিঃসঙ্কোচে তাকিয়ে থাকে।
- কি নাম গো তোমার?
- ভবতারিনী। বেশ গাম্ভীর্যের সাথে নামের গুরুত্ব উপস্থাপন করে মেয়ে।
রবির পছন্দ হয় না। বলে –
- আমি তোমার নাম দিলুম মৃনালিনী।
- তুমি আমার নাম দেবার কে গো?
রবি হাসেন।
- দেখা যাক।
এর পর থেকে মাঝে মাঝেই বাজার সরকারের মেয়ের সাথে দেখা হয় রবির। কিছু কিছু কথাও হয়। এ এক অন্য ধরণের আনন্দ। বৌদি তো ছিলেন সমবয়সী আর ভীষণ বুদ্ধিমতী। সমানে সমান। কিন্তু এখানে যেন দুজন সম্পূরক।

কথা বৌদির কানে যায়। তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। তাঁর এত দিনের বন্ধু, এত নিকট বন্ধু, তাঁকে ছেড়ে এক বালিকাকে ভালোবাসে? না, না, এ ভালোবাসা নয়, ক্ষণিকের মোহ। তিনি মোহভঙ্গের অপেক্ষায় থাকেন। তার পর ভাবেন দেবেন ঠাকুর বাজার সরকারের মেয়ের সাথে কিছুতেই ছেলের বিয়ে দেবেন না।

দেবেন্দ্রনাথের কানেও গল্প যায়। পল্লবিত হয়েই যায়। দুজনকে নাকি ঘনিষ্ঠ দেখা গিয়েছে। একদিন চরের পরামর্শ মত অভিসারস্থানেও লুকিয়ে দেখে আসেন। রবি নয়, ভানু সিংহকে।

দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতা। তিনি কোনো অপবিত্রতা দেখতে পারবেন না, প্রশ্রয় দেবেন না। সবাইকে ডেকে বললেন-
- যাও, বিয়ের আয়োজন কর।
- কিন্তু রাজাবাবু, ওর বাবা যে আমাদের বাজার সরকার।
- ও সব সামাজিক বিভেদ আমি মানি নে।
কিন্তু আসল কারণটি কাউকে বললেন না। রবির জীবন থেকে শনি চলে যাবে, এই আনন্দেই তিনি খুশী। বৌদি তো মায়ের মতো। ব্রাহ্মদের কাছেও। কুমারিত্ব এত বড় হলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের বন্দনা গায় কেন সবাই?
__________________________________

এর পর আবার ইতিহাস
__________________________________


বিয়ে হয়ে গেল। কাদম্বরী দেবী নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত সব দেখলেন। বধু বরণ করলেন। তারপর একদিন বিষ পান করে নিঃশেষ হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ সংবাদটি বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাঁকে দেখানোও হলো না। প্রভাবশালী পরিবার তাদের গৃহবধূর আত্মাহুতির কাহিনী অপমৃত্যু নামেই শেষ করে দিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে কাদম্বরী জীবনের এক অতীত গভীর সুখ ও বেদনার স্মৃতি হয়ে রয়ে গেলেন।
____________________________________________


ভানু সিংহের নয়, ঋতুপর্ণের ছবির প্রিয় মৈথিলী গান:
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:২৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ সকাল ৮:৫৩

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা



ইদানিং নারীনীতি নিয়ে দেশে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। আলেম-ওলামা এবং ইসলামপন্থীরা যখন পাশ্চাত্যঘেঁষা নারীনীতির সুপারিশকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনই মূলত এই আলোচনার বিস্তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারদের হতে হবে দেশের চিন্তাশীল সমাজের অগ্রনায়ক

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৬

আমার ৭ বছর ১১ মাসের ব্লগিং ক্যারিয়ারে ১০,০৭৩টি কমেন্ট করেছি। প্রতি পোস্টে গড়ে যদি ২টা করে কমেন্ট করে থাকি, তাহলে, আমি কম করেও ৫০০০টি পোস্ট পড়েছি। এর অর্থ, বছরে প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭৮

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ দুপুর ২:৩৭



আমার বন্ধু শাহেদ। শাহেদ জামাল।
খুবই ভালো একটা ছেলে। সামাজিক এবং মানবিক। হৃদয়বান তো অবশ্যই। দুঃখের বিষয় শাহেদের সাথে আমার দেখা হয় মাসে একবার। অথচ আমরা একই শহরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার অটোরিকশা

লিখেছেন শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৪

সেদিন একটা রিপোর্টে দেখলাম ঢাকা শহরে প্রায় ২০ লাখ রিক্সা রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিক্সার সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ! ২০১৯ সালের একটা জরিপে রিক্সার সংখ্যা ছিলো ১৩ লাখ। তার মানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৃষ্টির ঋণ....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ রাত ৮:২৭

সৃষ্টির ঋণ....

মধ্য দুপুরে ডেল্টা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সিএনজি, বাইক, উবার কিছুই পাচ্ছিনা। অনেকটা পথ হেটে বাংলা কলেজের সামনে বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা রিকশা পেয়েছি....ঘর্মাক্ত ষাটোর্ধ কংকালসার রিকশাওয়ালাকে দেখে এড়িয়ে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×