somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার
আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সালাম এক বীরযোদ্ধা,কালের ধূলোয় হারিয়ে যাওয়া এক বালক

০৪ ঠা মে, ২০১৬ রাত ৮:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩টা ৪৫ বাজতে চলল প্রায়। ক্যাপ্টেন আমীন নিঃশব্দে এগোচ্ছেন, সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই কোম্পানি সৈন্য।৩০০ সেনার মধ্যে রেগুলার আর্মির মাত্র ১০ জন, বাকিরা বেশিরভাগ মাত্র এক সপ্তাহের ট্রেনিং নিয়েই চলে এসেছে যুদ্ধে, কিশোর-ছাত্রজনতা... ময়মনসিংহ সীমান্তের নকশি বিওপিতে দুর্ভেদ্য পাকিস্তানীরা, মাইন ফিল্ড, সূচালো বাঁশের কঞ্চি আর কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা পুরো ঘাঁটি, এর আগেও একবার আক্রমণ চালানো হয়েছিল, কোন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে ফিরতে পারেনি। এবার শুধু ইন্ডিয়ান আর্মির আর্টিলারি সাপোর্টটা যুক্ত হয়েছে, এই ই যা... সেটাও সীমিত পরিসরে... তবুও কেউ ভয় পাচ্ছে না, মৃত্যুকে ভয় পায় না এরা আজ অনেকদিন হল...
ঠিক ৩টা ৪৫ মিনিটে রেডিওতে আমীনের গলায় শোনা গেল “জোরে মার” চিৎকার, আর্টিলারি অংশ গোলাবর্ষণ শুরু করল সাথে সাথে। কিন্তু আফসোস, অন্ধকারে রেঞ্জ ঠিকঠাক ক্যালকুলেট করতে না পারায় গোলা এসে পড়ল একদম সামনে থাকা পদাতিক বাহিনির উপর, মুহূর্তে সব এলোমেলো হয়ে গেল। বহুকষ্টে আমীন আবার সবাইকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনলেন, আহতদের সরিয়ে নেবার আগেই শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ, কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। কিন্তু আমাদের আর্টিলারি শেলিংয়ে ওদের বাংকারগুলোতে কিছুই হল না, অনেক হাই লেভেলের সিকিউরড ওগুলো...
এদিকে আহতের মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দুটা কিশোর, ১৬ বছরের বেশি হবে না বয়স, কাতরাচ্ছে কয়েক গজ সামনে, কোনটা হাত কোনটা পা বোঝার উপায় নাই, রক্তের স্রোত সব একাকার করে দিয়েছে, একটু আগে মর্টারের শেল পড়েছিল ওদের পাশেই।সাঁই সাঁই করে গুলিবৃষ্টি, তার উপর মর্টারের শেলিং, পায়ের নিচে একটু পর পর মাইন বিস্ফোরণ, ক্যাপ্টেন আমীনের মনে হল আজো বোধহয় হল না। আর ২০-২৫ গজ সামনেই শত্রু অবস্থান, কিন্তু একের পর এক যোদ্ধা পড়ে যাচ্ছে, ঘাঁটি দখল করবেন কিভাবে? তারপরও হাল ছাড়লেন না আমীন, গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছেন, আগে বাড়ো, জওয়ান, মরতে ভয় পাও নাকি?
হঠাৎ পায়ের নিচে পাকিদের পুঁতে রাখা ধারালো বাঁশের কঞ্চি বাম পায়ে ঢুকে গেল আমীনের, পড়ে গেলেন তিনি, এক পাকি ছুটে এল বেয়নেট বাগিয়ে, চার্জ করবে। আমীনের চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেখলেন বাঘের গর্জনে তার পাশ থেকে একটা ছোট্ট ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিটার উপর, ৩০৩ রাইফেলের মাথায় থাকা বেয়নেটটা হৃদপিণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল আমূল, মরার আগে পাকিটার অবাক দৃষ্টি চোখ এড়াল না আমীনের, মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে ছেলেটা , অবাক হওয়ারই কথা...
সালামের বাপ ছিল ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর, বাড়ির উঠানে চোখের সামনে বাপরে জবাই করে মারছিল রাজাকারেরা, কোরবানির গরু জবাই দেয় যেমনে... পাশেই অষ্টাদশী বোন আর মাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছিল পাকিস্তানী শুয়োরগুলো, ধর্ষণ শেষে বেয়নেটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় গলা থেকে যোনি, সালাম একটা টুঁ শব্দ করতে পারে নাই। খাটের নিচেই সালামের মৃত্যু হইছিল, মরে গিয়েছিল সালামের হৃদয়, অন্তর, আত্মা...
সেই মুহূর্ত থেকে সালাম একটা চলমান লাশ, বহুদিন, বহুবার ক্যাপ্টেন আমীনকে সে অনুরোধ করছে তাকে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আমীন তো জেনেবুঝে একটা ছেলেকে মরতে দিতে পারেন না। বহুভাবে বুঝাইছেন তিনি সালামকে, সালাম কিন্তু বুঝে নাই। সে খালি একটা জিনিসই জানে, পাকিস্তানী মারতে হবে তাকে, নিজের হাতে, টুকরা টুকরা করে, যতগুলা পারে... এই অপারেশনে আসার আগে অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় সবার পেছনে লুকায়ে ছিল সালাম, আমীন বুঝেও কিছু বলেন নাই। এতো করে চাইতেছে, যাক একটা যুদ্ধে, ওরে তো আর ফ্রন্টে আসতে দিতেছি না। আমীন আসলে চিনতে পারেন নাই সালামরে, কেই বা চিনছিল?
পায়ে কঞ্চি ঢুকে গেছে,অসহ্য যন্ত্রণা, অর্ধেকেরও বেশি যোদ্ধা হয় নিহত নাহলে আহত, শত্রু অবস্থান থেকে বিরামহীন গোলাবর্ষণ হচ্ছে, সালামকে সামনে দেখে সেকেন্ডের জন্য সব ভুলে গেলেন ক্যাপ্টেন আমীন। “তুমি সামনে আসছ কেন? পিছনে থাকতে বলছি না? সাহস কত তোমার, কমান্ডারের অর্ডার মানো না... বকতে বকতেই হঠাৎ খুব কাছে আরেকটা গোলা এসে পড়লো, চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। আমীন বকাটুকু শেষ করতে পারলেন না। বেয়াদবটার অবশ্য এদিকে কোন খেয়াল নেই, এক মনে ফায়ার করছে। শত্রু অবস্থান যখন আর মাত্র পাঁচ গজ, হঠাৎ গুলি লাগলো আমীনের বা হাতের কনুইয়ে, ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলেন আমীন। শত্রু পিছিয়ে যাচ্ছে, শেষবারের মত ঝাঁপ দেবে বলে। মেশিনগানার পড়ে গেল হঠাৎ, ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে আমীনের শরীর থেকে, দিশেহারা মুক্তিযোদ্ধারা...
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো সেই ছেলেটা, ছেলেটার নাম সালাম, মাত্র ১২ বছর বয়স... এলএমজিটা তুলে নিল,জয় বাংলা চিৎকার দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল, একেবারে পাকিস্তানী বাংকার লক্ষ্য করে... কোনোদিকে তাকাচ্ছে না ছেলেটা, দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে,” আব্বা গো, ও আব্বা, দেখো, আমি ভয় পাই নাই, তোমার সালাম ভয় পায় নাই.. দেইখা যাও আব্বা, দেইখা যাও...
সালামের লাশটা পাওয়া যায় বাংকারের পাশে, গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। গুলি ফুরিয়ে যাবার পর বেয়নেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সালাম, একটা পাকিস্তানীরেও বাঁচতে দেয় নাই। রক্তের স্রোতের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল ছেলেটা, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছিল, আমাদের সালাম, ক্লাস এইটে পড়া বারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে, যার বীরত্বগাঁথা আজকে ধূলা পড়া অতীত মাত্র.

সূত্র-স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ও
মুক্তিফৌজ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ রাত ৮:৩৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×