১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ! বাঙালির হাজার গৌরব ও অযুত বেদনার বছর। ওই একটি বছরেই পরাভব না মানা দুঃসাহসী বাঙালি তাঁর সত্যিকারের জাত চিনিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। সে সময় স্বাধীনতার জন্য কৃষক, মজুর, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমোর, শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, ছাত্র, কন্যা, জায়া, জননী সবার প্রাণের আবেগ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই মাত্র নয় মাসেই ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল বড় সেই স্বাধীনতা। দেশ মায়ের জন্মযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানহারা বিবাগী মায়েদের আবেগের ফল্গুধারা কোটি বাঙালির হৃদয়স্পর্শ করে অশ্রু ঝরিয়েই চলবে নিরন্তর। আমাদের তেমন একজন বাঙালি মা শহীদজননী জাহানারা ইমাম।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মহাকাব্যিক প্রামাণিক গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ২১ এপ্রিল বুধবারের বিবরণে রুমীর সঙ্গে জাহানারা ইমামের কথোকপথনে উঠে এসেছে রুমীর যুদ্ধে যেতে মা জাহানারা ইমামকে রাজি করানোর বিবরণ।
রুমী বলে- আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?
জাহানারা ইমাম জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন, না, তা চাইনে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা। এভাবে রুমী মা জাহানারা ইমামের কাছ থেকে যুদ্ধে যাওয়ার ছাড়পত্র আদায় করে। যে সময় আমেরিকান স্কলারশিপ নিয়ে রুমীর ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অধ্যয়ন করবার কথা। সেই সুযোগকে পায়ে দলে দেশমাতৃকার স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধের পথিকৃৎ ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য শহীদ শফি ইমাম রুমী।
সংসারের নিয়মই এটা যে, কোনো কিছু পেতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়। আর দেশকে শত্রুমুক্ত করতে দেশপ্রেমিক জাহানারা ইমাম তাঁর সন্তানকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে চরম মূল্যই দিয়েছিলেন। সেই মহীয়সী নারী বীরমাতা জাহানারা ইমামের ৮৭তম জন্মদিন আজ। শুভ জন্মদিন প্রিয় শহীদজননী।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যদি চারটি বইয়ের নাম করতে হয়, তবে সেই তালিকায় অবধারিতভাবেই নাম থাকবে ‘একাত্তরের দিনগুলি’। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত বইটি ১৯৭১ সালের ০১ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লিখেছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল সময়ে অগ্নিগর্ভ ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে তাঁর শহীদসন্তান শফি ইমাম রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। দেশমাতৃকার জন্য যে ছেলের প্রাণদানের পর জাহানারা ইমাম মুক্তিকামী গণমানুষের কাছে শহীদজননী উপাধি পেয়েছিলেন।
স্বাধীনতা ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবার কাছে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। ১৯৪২ সালে মেট্রিক পাসের পর রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। ১৯৪৭ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সানডিয়াগো স্টেট কলেজ থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন জাহানারা ইমাম।
কর্মজীবনে বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন জাহানারা ইমাম।
১৯৯১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির করে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হলে বিক্ষুব্ধ দেশবাসীর সঙ্গে তিনিও রাস্তায় নেমে আসেন এবং ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
ওই কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ একাত্তরের রাজাকার, ঘাতক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণ-আদালতের মাধ্যমে পরিচালিত ঐতিহাসিক বিচারে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম এর মধ্যে দশটি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। যে কারণে তিনিসহ গণ-আদালতের সঙ্গে জড়িত দেশের বিশিষ্ট ২৪ জন নাগরিক তৎকালীন সরকারের বিরাগভাজন হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলারও শিকার হন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পরে তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার কাছে গণ-আদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। সে সময় শত সংসদ সদস্য গণ-আদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন দেন। আর এভাবে ক্রমেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি জনদাবিতে রূপ লাভ করে।
মূলত জাহানারা ইমামের এই গণ-আদালতের দেখানো পথ বেয়েই আজকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ এগিয়ে নিচ্ছে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার। জাহানারা ইমাম ছিলেন অসামান্য এক মা। যিনি নির্দ্বিধায় নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান রুমীকে দেশ-মাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করেছিলেন। সেই জননী সাহসিকা জাহানারা ইমাম কিংবা রুমীর স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ এক নতুন নজির স্থাপিত হয়েছে। এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম ৯০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা মাথায় নিয়ে মারা গেছেন। কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং রুমী হত্যার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পকদের অন্যতম আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকরের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমোচনের পথে এগিয়ে চলেছে। অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের মামলাও বিচারাধীন আছে।
ঘাতকব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী শহীদজননী জাহানারা ইমাম তাঁর জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে লড়াই করে গেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাংলার আপামর দেশপ্রমিক মানুষের কাছে নির্দেশনাসংবলিত এক হৃদয়গ্রাহী চিঠিও দিয়ে যান তিনি। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের একটি হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস- সুসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম রচিত সুপাঠ্য বইটি ক্যানসার আক্রান্তদের মানসিক দৃঢ়তা ও মনোবল রক্ষায় এক অসাধারণ গ্রন্থ। বুকের ভেতরে আগুন, নাটকের অবসান, জীবন মৃত্যু বা বীরশ্রেষ্ঠ প্রভৃতি গ্রন্থ ছাড়িয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে পাঠকপ্রিয় একাত্তরের দিনগুলি। এই একটি গ্রন্থ মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছে। আর জাহানারা ইমাম স্বীকৃতি পেয়েছেন আপামর জনসাধারণের জননী সাহসিকারূপে।
১৩ বছরের জার্মান কিশোরী আনা ফ্রাংকের ডায়েরি থেকে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস রূপের দেখা পাই। আর একাত্তরের দিনগুলি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের হানাদারদের নারকীয় গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রম বিনাশ বা দেশ ধ্বংসের প্রকৃত আয়না। আমাদের স্বাধীনতার সেই আয়নার কারিগর ও প্রতিবাদের দৃপ্ত প্রতীক শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রতি তাঁর জন্মদিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমৃত সুর ও ছন্দে জানাই অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঐ মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে।
মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়তে হয়েছে উনাকে। অসুস্থ্য শরীর নিয়েই দীর্ঘদিন একাত্তরের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরোদ্ধে লড়াই করেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জীবনের শেষমুহূর্তেও তিনি তাঁর দায়িত্বের কথা ভুলে যান নি। মৃত্যুর আগে কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি লিখে গেছেন দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তার শেষ চিঠি।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর শেষ চিঠিটিতে লিখেছেন-
সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরোদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাই নি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা - আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।
এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পন করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই।
জাহানারা ইমাম
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা শেষ এই চিঠি-টি আজও খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বর্তমানে দেশের জন্য একজন জাহানারা ইমামের বড্ড বেশি প্রয়োজন......।
তথ্য-ফারদিন ফেরদৌস ও একাত্তরের দিনগুলি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ৮:৫৮