এই দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলাম। নীল কে দেখব আজ। যেদিন প্রথম কথা হয়েছিল ফোনে সেদিন সে তার নাম বলেছিল নীলা। আমি সাথে সাথে নীলা না ডেকে নীল নামে ডাকার অনুমতি চেয়েছিলাম। নীল হাসি আড়াল করতে চেয়েও পারেনি। ফোনের এ পাশ থেকে আমি নীলের হটাত জোড়ে নিঃশ্বাস নিবার শব্দ টা খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমাকে জিজ্ঞেসা করল নীল নামে কেনো ডাকতে চাচ্ছি?
আমি বললাম “কারণ, বেদনার রঙ যে নীল তাই”।
নীল বলল, “ ভালোবাসার রঙ ও তো নীল হয়ে থাকে”।
আমি বললাম, “ভালোবাসা তো এক প্রকার বেদনাই।’’
এই কথা টি বলার পর নিজে কে খুব জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছিল।নীল জিজ্ঞাসা করল, বেদনা ভালোবাসেন?
আমিঃ বাসি ,কিন্তু একা একা পেতে বাসি না।
নীলঃ আপনি কি কবিতা লিখেন নাকি?
আমিঃ না । কেনো বলুন তো?
নীলঃ না, এমনি। আচ্ছা এবার বলুন, কোথায় থাকেন? কি করেন? আর আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
আমিঃ থাকি কলাবাগান, অনেক কিছু করি, আর আমি একজন কে বলেছিলাম কোনো অপূর্ব সুন্দরী পরীর নাম্বার দিবার জন্য ,উনি আমাকে আপনার নাম্বার দিল।
নীল খুব লজ্জা পেয়েছিল বুঝতে পারছিলাম।
পৃথিবীতে নারীরা সব চেয়ে বেশি খুশি, অহংকার ও লজ্জা বোধ করে তার রূপের বর্ননাতে । আর এই কারনেই হয়ত নীল আমাকে ফোন করতে কড়া ভাবে নিষেধ করেনি।
নীলঃ আপনার তো অনেক সাহস।
আমিঃ কেনো?
নীলঃ আপনার পরিচিত বন্ধু আমার রূপের এই বর্ননা দিবার পর ও ফোন করেছেন। আপনার নিজের উপর অনেক বিশ্বাস দেখছি। দেখতেও অনেক ভাল নাকি?
আমিঃ না আমি দেখতে এত ভাল না। আর এই জন্যই ফোন করেছি কারন পরিসংখ্যান বলে , “পৃথিবীর বেশির ভাগ সুন্দরী নারীই নাকি একটু কম ভাল দেখতে পুরুষের সাথে সম্পর্ক করে থাকে”।
নীলঃ আমার ক্ষেত্রে সেটা না ও হতে পারে। আচ্ছা আমি রাখি । ১১.৩০ টা পর্যন্ত আমাকে ভার্সিটির কিছু কাজ বাকি আছে ,শেষ করতে হবে। এভাবে আর ফোন না করার কথা বলে লাইন কেটে দিল।
আমি নীলের আগ্রহ টা বুঝতে পেরে ১১.৩০ এর পরে আবার ফোন করেছিলাম।
এভাবে কথা বলতে বলতে ১ বছর হল আজ। গুলশান লেকে দেখা করার কথা বিকেল ৪ টায়। তারাতারি তৈরী হলাম। বার বার আয়নাতে নিজে কে দেখে নিলাম। আজকে নিজের চুল গুলো কে খুব অবাধ্য মনে হচ্ছে। কিছুতেই কথা শুনতে চাচ্ছে না। কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে কিছু টা খুঁত খুঁত নিয়েই বের হলাম। বের হতেই শুরু হলো বৃষ্টি। কিছু না বুঝেই দিলাম দৌড়। একদম মেইন রোডে চলে এলাম। কোনো সি.এন.জি নাই। বাসে করে যেতে হবে। অনেকেই রাস্তায় দাড়িয়ে আছে।বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে তারা । আমিও তাদের একজন। অনেকে আবার ছাতা হাতে খুব অহংকারবোধ করছেন। যে যাই করুক মনে মনে ঠিক করলাম, বাসে সবার আগে উঠতে হবে। একটু দূর থেকে বাস আসতে দেখা গেল। আমি রেডি। কাছাকাছি আসার সাথে সাথে একটু আগাতে শুরু করলাম। কিন্তু বাস ড্রাইভার মনে হয় কিছু টা ইচ্ছা করেই আমাকে ওতিক্রম করে অনেকটা দূরে নিয়ে থামাল। ছিলাম সবার সামনে এখন সবার পিছনে। সবাই উঠে যাচ্ছে। এই বাস টা মিস করা যাবে না। কোনো রকম জুতার সামনের অংশ টা বাসের দরজাতে রেখে বানর এর মত ঝুলে পরলাম। ততক্ষন পর্যন্ত এভাবে ঝুলে রইলাম যতক্ষন পর্যন্ত না আমার সামনের লোক টি তার কোমড় টা ঘুরিয়া আমাকে একটু জায়গা দিল। চাপাচাপির মাঝে কাপর এর অবস্থা একে বারে শেষ। এভাবে নীলের সাথে দেখা করা টা কি ঠিক হবে? চিপাচাপা দিয়ে কোনো রকম ভিতরে ঢুকলাম। কিন্তু ভিতরে ও অবস্থা করূন। আমার সামনে এখন একজন সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোক। তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে সে কতটা কষ্টে আছেন। বয়স আমার থেকে ১০ থকে ১২ বছর বেশি হবে। উনার পা এর দিকে তাকিয়ে এত কষ্টের মাঝেও হাসি না দিয়ে পারলাম না। লোক টি কে ফিসফিস করে বললাম, ভাই আপনি তো দুই পা এ দুই জুতা পরে চলে এসেছেন। লোক টি তার পা এবং আমার দিকে একই রকম বিরক্তি নিয়ে তাকাল। কোনো আমলেই নিল না। আমি ভাবলাম এটাই স্টাইল। আর কিছু বললাম না। কিন্তু এভাবে আর দাঁড়ানো সম্ভব না। কখন যে বাস টা একটু খালি হবে? এর মাঝে আবার ভাড়া নিতে দুই তিন বার জাওয়া আসা করে ফেলেছেন কন্টেক্টর। হঠাত নিজের পা এর দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলাম। আরে একি? আমি ও তো দুই পা এ দুই জুতা পরে চলে এসেছি। এখন কি হবে? আমি এটা কিভাবে করলাম? কিন্তু এটা তো সম্ভব না। আবার ভাল করে তাকালাম। বুঝতে পারলাম দুই পা এ দুই জুতা পরিনি। এখানে একটা পা আমার। অন্য টা আরেক জনের। কিন্তু আমার আরেকটি পা এখন কোথায়? মহা ঝামেলায় পরলাম। একটু নড়েচড়ে নিজের হাড়িয়ে যাওয়া পা টা খুজে পেতে চেষ্টা করলাম। সাথে সাথে দুই তিন জন লোক এক সাথে চেচিয়ে উঠল। ভয়ে কিছুখন নড়লাম না। এর মাঝে আরো কিছু যাত্রি উঠল বাসে। কিন্তু একটি পা এভাবে উধাও হয়ে যাবে এটা কোনো কথা হল? আর মানুষের ভয় এ চুপ করে থাকব? আবার চেষ্টা করলাম। এবার সাদা শার্ট পরা লোক টির একটি পা আমার দিকে আসতে শুরু করল। যখন কাছে চলে আসল তখন বুঝতে পারলাম আসলে আমাদের দুই জনের একজন ও দুই রকম জুতা পরিনি।উনার এক পা আমার এক পা প্যাচ লেগে গিয়েছিল। নিজের পা কাছে পেয়ে একটু শান্তি পাচ্ছি। সাদা শার্ট পরা লোক টি কেনো এভাবে তাকিয়ে ছিল এখন বুঝতে পারছি। নীল এর ফোন এল। ফোন ধরতে গিয়ে মোবাইলে তাকিয়ে দেখি ৪.২০ বাজে।প্রথম দিন ই দেরি? কি ভাববে সে? রাস্তায় অনেক জ্যাম। এভাবে আর সম্ভব না।
তাই নেমে গেলাম। হেটেই যাওয়া শুরু করলাম। যেতে যেতে প্রায় ভিজে একাকার। নীল এর ফোন রিসিভ করিনি তখন। তারাতারি যেতে হবে। রাগ করে আবার যদি চলে যায়। গুলশান এর দিকে বৃষ্টি হয়নি। রাস্তা ঘাট পরিষ্কার।
পার্কের কাছাকাছি আসার পর আবার নিজেকে আবিস্কার করলাম ,আমি খুব নার্ভাস। এতক্ষন রাস্তায় এগুলো কিছু মনেই ছিল না। আজ নীল এর সাথে প্রথম দেখা করতে এসেছি। নীল কি আমাকে পছন্দ করবে? যদি না করে? খুব ভয় হচ্ছে। এত সুন্দরী একজন মেয়ে যদি আমাকে দেখে আর কথা না বলে? যা হবার হবে, এই ভেবে পার্কে ঢুকলাম। ঢুকে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে কে একা বসে থাকতে দেখলাম। কালো শাড়ী পরায় তার গোলাপী গায়ের রঙ আরো গোলাপী দেখাচ্ছে। চুলে সাদা বড় ফুল লাগিয়েছে। আসলেই পরীর মত লাগছে। আমিই ওকে কালো শাড়ি পরতে বলেছিলাম। তার পাশে একটু দূরে একটি বেঞ্চে একটি আন্টি ও ১০/১২ বছর এর একটি ছেলে বসা। ছেলে টি কি নীলের ভাই নাকি? নীল কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারল না? তার ভাই ও তার মাকে সাথে করে নিয়ে আসল? আমি নীলের কাছে গেলাম। নীল এর মা আমার দিকে কিভাবে যেন তাকাচ্ছে। ভয় করছে কথা বললাম। ডানে বায়ে আরেকবার তাকিয়ে বলেই ফেললাম।
আমিঃ আপনি নীল?
নীলঃ না। আপনি কে?
আমিঃ সরি, আমার আসতে দেরি হয়ে গেছে। আমিই মৃদুল।
নীলঃ আপনি ভূল করছেন আমি নীল না। আমি আপনাকে চিন্তে পারছি না।
আমিঃ আপনি মৃদুল নামে কাও কে চিনেন না?
নীলঃ না। যান । বিরক্ত করছেন কেনো?
আমিঃ ok ok. I am sorry. I am sorry.
কি করব বুঝতে পারছিনা। আমাকে না চিনার ভান করল কেনো?
আমি তাহলে ঠিকি ভেবে ছিলাম? নীল এর মত মেয়ে আমার সাথে প্রেম করবে না। মনে খুব কষ্ট পেলাম। চোখে জ়ল চলে এলো। কিন্তু বুঝতে দিলাম না। আমি সরি বলে চলে আসতে নিলাম। পিছন থেকে ১০/১২ বছর এর ছেলে টি এসে আমাকে ডাকল। আমাকে বলল আপনি কি মৃদুল? আমি বললাম হ্যা। নীল এর মা এর দিকে হাত দেখিয়ে বলল, নীলা আপু আপনাকে ডাকছে.........
তাকিয়ে দেখলাম আন্টি ও কালো শাড়ী পরে এসেছেন। . যাকে নীল ভেবেছিলাম সে আসলে নিল না। আর যাকে আন্টি ভেবেছি সে আসলে আন্টি না.।এরপর চোখের জল আর ধরে রাখতে পারি নি.......
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৪৯