বিয়ে শব্দটির সংজ্ঞা একেকজন একেকভাবে দেবেন। তবে বেশিরভাগ মানুষ যা বললেন তার মানে দাড়াব - দুটি মানুষের একসাথে জীবন শুরু করার, একে অপরকে ভালোবাসার, সুখ দুঃখে পাশে দাড়ানোর সামাজিক ও ধর্মীয় অসাধারণ নিয়মটির পালন। আমাদের সমাজে এই অসাধারণ ব্যাপারটি নিতান্তই কুৎসিত একটি রূপ পাচ্ছে দিনকে দিন। সেসব নিয়েই আজকের রোস্ট পোস্ট!
পূর্ব রোস্ট পোস্ট: রোস্ট পোস্ট (১) - "আপনি কি কালো, বেঁটে, মোটা? তাহলে আপনার বেঁচে থাকা অর্থহীন!" ওহ মিডিয়া প্লিজ শ্যাট আপ!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অপসংস্কৃতি: যেকোন সংস্কৃতির নানা অংশের মধ্যে বিয়ে একটি অন্যতম অংশ। নানা দেশের বিয়ের রীতিনীতি একেক রকম। বিয়ের পোশাক, খাবার, নাচ, গান, মেহমানদারী, সাজসজ্জ্বা ইত্যাদির মাধ্যমে একটি সংস্কৃতির অনেকটাই প্রকাশিত হয়। কোন দেশের বিয়েতে যদি বিদেশী সংস্কৃতি রাজ করতে থাকে, বুঝতে হবে সেই জাতি অনেকাংশেই এবং নানা দিক দিয়েই অন্য জাতির প্রতি আকৃষ্ট ও নির্ভরশীল।
পোশাক: আজকাল আমাদের দেশের বিয়েগুলো যেভাবে হচ্ছে তার সাথে বাংলাদেশী সংস্কৃতির দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই। শেরওয়ানি হতে হবে গুজরাটি বা কোন বলিউড মুভির নায়কের মতো, কনের পোশাক হবে ইন্ডিয়ান ওয়েস্টার্ন ফিউশন।
বেনারসি বড্ড ব্যাকডেটেড!
"শাশুড়ি নয় সে তো মা, বউ নয় সে তো মেয়ে" নামের ভারতীয় সিরিয়ালে গীতাঞ্জলি তার চতুর্থ বিয়ের দ্বিতীয় ম্যারেজ এনিভার্সারিকে স্মরনীয় করে রাখার জন্যে পুনরায় বিয়ের সময়ে যে লেহেঙ্গা পরেছিল, আমাকেও সেটাই পরতে হবে!
ফটোশ্যুট:
ছোটকালে আমরা খুব মজা করে আত্মীয় স্বজনদের বিয়ের ভিডিও, এলবাম দেখতাম। সেগুলো বিয়ের সেরেমনিতেই তোলা হতো। সবার মুখে হাসি, বর কনের চোখে মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব লেগে থাকত। ব্যাকগ্রাউন্ডে রোমান্টিক গান বাজত। খুব মায়া মায়া ছিল সেসব ব্যাপার।
আজকাল সেসব তো হয়ই। তার সাথে সাথে বিয়ের আগেও ফটোশ্যুট হয়! ফটোশ্যুট শুনলেই তো প্রফেশনাল একটি ব্যাপার মনে হয়। নানা সুন্দর লোকেশনে গিয়ে বর কনে নানা দেশের আউটফিট পরে জড়াজড়ি করে ছবি তোলেন। (মাথা ঘোরানোর ইমো হবে)! বিষয়টি মোরালি ভালো খারাপের নয়, বাংলাদেশী হিসেবে আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়। বিষয়টির লজিকই বুঝিনা আমি।
এগুলো তো ওয়েডিং মডেল অথবা অভিনেতা অভিনেত্রীরা করবে। তারা নাহয় পেশাগত কারণে কৃত্রিমতা মিশ্রিত ছবিগুলো তুলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষেরা তো রিয়েল মোমেন্টের ছবি তুলবে। বিয়ের আগের ছবিগুলো কোথাও বেড়াতে গিয়ে, শপিং করতে গিয়ে হুট করে তোলা হতে পারে। প্ল্যান প্রোগ্রাম করে এসব করার মানে কিরে ভাই?
মেকআপ:
একসময়ে কনের বান্ধবী, আত্মীয়রাই বিয়ের মেকআপ আন্তরিকতার সাথে করে দিতেন। সেই সারল্যে সৌন্দর্য থাকত, নব্য কনের মুখে লজ্জার রেশ কড়া মেকআপে মুছে যেত না। কিন্তু এখন? কনে সেই ভোরে গোসল করে বেড়িয়ে যায়, বিকেলে মেকআপ করে বাড়ি ফেরে!
একটা সত্যিকারের লজ্জার কাহিনী বলি।
একবার ক্লাসে আমি একটি লাল রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরে গিয়েছি। আমার পাশে বসা আফ্রিকান সহপাঠী ও বন্ধু আমাকে হেসে হেসে বলল "তোমাকে বেশ ব্রাইডাল লাগছে!" আমিও হেসে ফেললাম। সাদামাটা হলেও সেই কামিজটিতে সোনালী চুমকির কাজ ছিল বলে হয়ত এমন মনে হয়েছে তার। অথবা সে জানে আমাদের দিকে বিয়েতে লাল প্রাধান্য পায়। তার বলার এক্স্যাক্ট কারণ আমি জানি না। তবে এভাবে গল্পটা এমন দিকে মোড় নিল যে পাশের আরো কজন বন্ধু নিজের নিজের দেশের ব্রাইডদের ল্যাপটপে দেখাতে লাগল। এক কোরিয়ান দেখালো, এক কানাডিয়ান স্টুডেন্টও শেয়ার করল।
আমার কানাডিয়ান সহপাঠী বলল , "আই ওয়ান্ডার হাও ব্যাংলাদেশী ব্রাইডস লুক!" আমিও সাথে সাথে সার্চ দিলাম গুগলে, দেখানোর জন্যে
দেখে ওর প্রথম কথা ছিল, "ওহ মাই গড! সিমস লাইক দে হ্যাভ এ লট অফ মেকআপ অন!" হেসে ফেলল এটা বলে।
ওর কথা শুনে আমি খুঁজে গেলাম নরমাল সাজের কোন বাংলাদেশী কনেকে। কিন্তু যেই ছবিই চোখে পরে সবার পুরু অদ্ভুত মেকআপ!
কানাডিয়ান, ও কোরিয়ান ব্রাইডদের মেকআপ বেশ অভিজাত ছিল, স্কিনের সাথে মিশে ছিল। আর আমাদেরটা মনে হচ্ছিল স্কিনের ওপরে দশ কেজি আটার কারুকাজ! টিচার এসে গেলেন এসব করতে করতে, আর আমি ভাবতে লাগলাম, অন্য দেশের ব্রাইডেরা সুন্দর সব কম্প্লিমেন্ট পেল, আর আমার দেশেরটাকে দেখে হেসেই ফেলল!
আমরা আধুনিকতা ও সৌন্দর্যের নামে যা করছি তা যে আমাদেরকে হাসির পাত্র বানিয়ে দিয়েছে সেটা বোঝাতে এই ঘটনাই যথেষ্ট। আমি আর কিছু বললাম না বিষয়টি নিয়ে।
নাচ গান: বিয়েতে নাচ গান হওয়া স্বাভাবিক, তবে সেটা মনের আনন্দে আসা উচিৎ। আগেকার দিনে বাড়ির লোকেরাই যেমন চাচী খালা গোত্রীয় মানুষেরা বেসুরে গলায় গান গাইতেন, বাচ্চারা গোল হয়ে হাত পা নেড়ে নাচত। কেননা তাতে সুর তাল লয় মিলছে কিনা সেটা জরুরি নয়, দুটি মনের মিল হলো কিনা সেটা জরুরি। কিন্তু আজকালকার দিনে রীতিমত কোরিওগ্রাফার এনে নাচ প্র্যাকটিস করে বিয়েতে পরিবারের বুড়ো থেকে বাচ্চা সবাই একেকটি আইটেম পরিবেশনা করেন! (হতবাক হবার ইমো হবে)! সেটিও ভিনদেশী গান ও নাচের অনুকরণে!
view this link
সতর্কতাবানী: দূর্বল হৃদয়ের ব্যক্তিরা নিচের ভিডিওটি পুরোটা দেখবেন না, সহ্য করতে পারবেন না!
লীলাবালির আধুনিক ভার্সন! view this link
অনেকে হয়ত ভাবছেন সমস্যা কি?কেউ যদি নিজের মতো করে নিজের বিয়েটা এনজয় করতেই চায়? পারসোনাল চয়েস!
সমস্যা অনেকগুলো, তবে প্রধান সমস্যা দুটো:
১) বিষয়গুলো আমাদের নিজেদের আইডিয়া নয়, অদ্ভুত কনসেপ্টের বিদেশী সিরিয়াল দেখে এগুলো আমাদের "করতেই হবে" ভাবনাটি এসেছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে করা ব্যাপারগুলোতে একটি বাংলাদেশী পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই সহজ হতে পারছেন না। বাড়ির বড়রা, যারা সাদামাটা বাংলাদেশী ট্রাডিশনে এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তাদের জন্যে একটু পরে পরে ছোটদের কাছে শোনা, "উফফ! তুমি কিচ্ছু জানো না, আজকাল এটাই ফ্যাশন!" ভীষনই অসম্মানজনক। কোরিওগ্রাফারদের তালে তাল মেলানো অনেক লজ্জাদায়ক। আমাদেরকে স্নেহ করেন বলে তাদের ওপরে এসব চাপিয়ে দেবার মানে হয়না। আমি নিজেই এযুগের মেয়ে হয়ে এসবে অস্বস্তি বোধ করব। আর বয়স্ক, মধ্যবয়স্কদের কথাটা ভেবে দেখুন। পরিবারের হাতেগোণা ইয়াং কিছু ডিজিটাল পোলাপান এবং ভারতীয় সিরিয়ালে এডিক্টেড আন্টি ছাড়া এসব আসলে কারো জন্যেই আনন্দের নয়। বরং চরম বিরক্তির।
২) আমি যখন ভিনদেশী কিছুকে আনছি, অবশ্যই সেটি আমার নিজস্বতাকে বাতিল করে সেই স্থানেই আনছি। কিন্তু ভিনদেশীদের তো আমি নিজের সংস্কৃতিতে প্রভাবিত করার যোগ্যতা রাখতে পারছিনা। মানে যা দাড়াল, "তুমি তোমার সংস্কৃতি অনুসরণ করছ, আমিও তোমার সংস্কৃতি অনুকরণ করছি!" তাহলে কি আমার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হবে না? যদি আদান প্রদান বিষয়টি দুদিক থেকেই হতো, তাহলে সে ভয় থাকত না। কিন্তু সব দেশের মানুষ তো নিজস্বতাকে বলি দেবার মতো বোকামি করবেন না। যা হারানোর আমরাই হারাব। বিয়ে ব্যাপারটি ব্যক্তিগতই শুধু নয় সামাজিক বন্ধন, তাই এতে সমাজিক কিছু দায়বদ্ধতা থাকা আবশ্যক।
তাই সোজা বাংলা ভাষায় আমি এসব পারসোনাল চয়েস ও আধুনিকতার চৌদ্দ গুষ্টি কিলাই!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পোস্ট আর বাড়াতে চাচ্ছিনা, কিন্তু এখনো অনেক কথা রয়ে গিয়েছে। শিরোনামের সবকিছু কভার করতে গেলে পর্বটি অনেক বেশি লম্বা হয়ে যাবে। আরো কিছু ভয়াবহ অশনী সংকেতের ব্যাপারে লিখব পরের পর্বে।
আপনারা হয়ত কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন এবং নতুন জামানার কোন রীতি দেখে আপনারও মাথায় বাজ পড়েছে! আমি যা লিখেছি
তার বাইরের কোন আজব ব্যাপার আপনাদের চোখে পড়লে মন্তব্যে জানান।
ছবিসূত্র: সকল মামার সেরা মামা, গুগল মামা গুগল মামা!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ ভোর ৪:২২