টিভি খুললেই নানা ধরণের সেক্সিস্ট, রেসিস্ট, ডিজগাস্টিং, ফলস, হরিবল কনসেপ্টের এড দেখা যায়। আমি সবসময় ভাবি যে এগুলো লিগ্যালি কিভাবে মিডিয়ায় জায়গা করে নিচ্ছে? কেউ কি এদের বিরুদ্ধে কেস করেনা? যুগের পর যুগ কিভাবে ব্যাবসা করে যাচ্ছে এদের মালিকেরা? এমনই কিছু জঘন্য বিজ্ঞাপনী কনসেপ্টকে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মেখে পোড়ানোর চেষ্টা করব এই লেখায়।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ফেয়ারনেস ক্রিম!
এসব বিজ্ঞাপন যেকোন কিছুকে কালো ফর্সার সাথে জুড়ে দেয়। একটা মেয়ে চাকরি পাচ্ছেনা, ক্রিম মেখে ফর্সা হয়ে চাকরি পেয়ে গেল! একটা মেয়ে ধারাভাষ্য দিতে যাবে, তার জন্যেও নাকি তাকে ফর্সা হতে হবে! স্পোর্টসে নাম করতে চান? ভালো খেলার সাথে সাথে দরকার একটুখানি ক্রিম? ওমা নানা ম্যাগাজিনে আপনার ছবি ছাপা হবে, কালো হলে বিদঘুটে দেখাবে না? আপনার জীবনের স্বপ্ন যাই হোক না কেন, পূরণে দরকার একটুখানি ক্রিম! দ্যাটস ইট! তার সাহায্যে আপনি হয়ে উঠবেন ফর্সা (পড়ুন সুন্দরী), এবং তাহলেই সকল সাফল্য আপনার পায়ে ধরা দেবে!
আপনি জন্মগতভাবে যে রং নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছেন, যা আপনার দেশ, জাতি, পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছেন, তা কত সময়ের মধ্যে ফর্সা হয়ে যাবেন জানেন? মাত্র ৭ দিন!
লিমিট থাকে সিরিয়াসলি লিমিট থাকে ধোঁকাবাজির, সেই লিমিট এসব ক্রিম কোম্পানি ক্রস করে দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। প্রতি বছরে নতুন নতুন আইডিয়া! কখনো প্রাকৃতিক আমাজনের জংগল থেকে আসা উপাদান, কখনো আধুনিক লেজার প্রযুক্তি ক্রিমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে!
একসময়ে মেয়েদেরকে অত্যাচার করা হতো এসব দিয়ে, এখন জেন্ডার ইকুয়ালিটির!!!! যুগে বিভিন্ন রকম মেন ফেয়ারনেস ক্রিমও চলে এসেছে। ওগুলো মাখা মাত্রই চার পাঁচটি মেয়ে ফর্সা ছেলেটির জ্যাকেট ধরে ঝুলতে থাকে! বাহ বাহ!
একটা জিনিস খেয়াল করবেন আজকাল খুব কুচকুচে কালো মেয়ে অথবা ছেলেদেরকে এসব এডে দেখা যায়না, মোটামুটি শ্যামলাদের নিয়েই এডগুলো হয়। তারা হয় এটা বোঝাতে চাচ্ছে যে বিশ্বের সকল কালো মানুষকে তাদের ক্রিম শ্যামলা বানিয়ে ছেড়েছে অথবা কালোদের কোন ভবিষ্যৎই নেই!
যে তিনটি জিনিস আমরা শিখতে পারি যেকোন ফেয়ারনেস ক্রিমের এড থেকে,
১) কালো মানুষ সুন্দর হতে পারেই না, সম্ভবই না।
২) আপনি যত কালো হবেন আপনার ভবিষ্যৎ ততোই অন্ধকার হবে, কোন পেশাতেই সফল হতে পারবেন না যতোই শিক্ষিত, মেধাবী, পরিশ্রমী হোন না কেন। আপনার জায়গাটি নিয়ে নেবে কোন এক ফর্সা মানব মানবী।
৩) অপোজিট সেক্সকে আকৃষ্ট করতে না পারলে, চার পাঁচ জনের সাথে টাইম পাস করতে না পারলে জীবন বৃথা, কালো মানুষের প্রেমে তো কেউ পড়তে পারেই না!
প্রত্যেকটি ডাইরেক্ট বর্ণবাদী ম্যাসেজ, কোন রাখঢাক নেই! এরা ব্যানড কিভাবে হয়না আমি সেটা ভেবে অবাক হয়ে যাই!
শুধু আমাদের এশিয়ায় নয়, আফ্রিকাতেও একই ভাবে শয়ে শয়ে ফেয়ারনেস ক্রিম যুগ যুগ ধরে রাজত্ব করে আসছে। ওখানে অনেক মেয়ের স্কিন নষ্ট হয়ে চাকা চাকা কালো দাগ হয়ে গিয়েছে এসব ব্যবহারে। কেননা ক্রিমগুলোতে প্রচুর ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা লাভ তো দূরের ত্বকের ১২ টা বাজিয়ে দেয়।
একটা ৩০ বছরের বিবাহযোগ্য নিম্ন মধ্যবিত্ত্ব পরিবারের মেয়ে, নিজের অসহায় বাবা মাকে ভারমুক্ত করতে কত আশা নিয়ে দিনের পর দিন একেকটি টিউব শেষ করে, আর হা করে আয়নায় তাকিয়ে ভাবতে থাকে, একটু ফর্সা কি হয়েছি? প্রতিদিন আশাহত হয়।
কোন ছেলে যখন কালো হবার কারণে বন্ধুদের কাছ থেকে "কাউলা, কালা, তেলাপোকা" ডাক শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, মেন ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করে, লুকিয়ে লুকিয়ে মাখে আর আশা করে থাকে রং একদিন ফর্সা হবেই। এসব অসহায় মানুষদের অসহায়ত্ব নিয়ে ব্যাবসা করতে লজ্জা লাগে না মিডিয়া ও কোম্পানিগুলোর?
এসব কোম্পানিগুলো কি বুঝতে পারেনা তারা কত বড় ক্ষতি করছে মানুষের? ওপেনলি রেসিজন কনসেপ্টকে ভিত্তি করে এড বানিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিচ্ছে কালোবিরোধী চিন্তা চেতনা! টিভি খুললেই এসব দেখলে ছোট বাচ্চাটি থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার মন মগজে ঢুকে যাচ্ছে কালো মানুষ অসুন্দরই শুধু নয় কোন সুখ, সাফল্য, ভালোবাসার দাবীদার নয়! স্বাভাবিকভাবেই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ প্রোডাক্টগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কালোদের ফর্সা করার অসাধ্য সাধন করতে পারছেনা, কিন্তু সমাজটা কালো অন্ধকার ভাবনায় ছেয়ে যাচ্ছে এদের কল্যাণে।
হাইট বাড়িয়ে দেওয়া জুতো!
আমি যখন দেশে ছিলাম সকালে টিভি খোলামাত্র সব চ্যানেলে এমন জুতোর এড দেখাত যা পরে দৌড়ালে লম্বা হওয়া যায়। একেক চ্যানেলে একেক নামের প্রোডাক্ট রিপেটেডলি প্রকাশিত হতো। সেখানে একেকটি কেস দেখা যেত, অভিনেতারা নানা সিচুয়েশন বর্ণনা করেন যেমন কারো বিয়ে, চাকরি, বন্ধু, প্রেমিক/প্রেমিকা জোটাতে পারছিলনা কম হাইটের কারণে, এই প্রোডাক্ট ব্যবহারের তিন মাসের মধ্যে নাকি তারা লম্বা হয়ে জীবনে সবকিছু এচিভ করে ফেলেছে! হাউ রিডিকিউলাস!
ছেলেরা কালো হলেও চলে যায়, তাই সেখানে মেয়েদেরকে বেশি টার্গেট করা হয়। আর হাইটের ক্ষেত্রে ছেলেদের স্ট্র্যাগলটা বেশি থাকে। কম হাইটের হলে ছেলেদেরকে বন্ধুমহলে নানা ধরণের কৌতুকের পাত্র বানিয়ে দেওয়া হয়। হীনমন্যতায় পরে এসব মানুষ যাই পান তা দেখে ঝুলে থাকেন একটু লম্বা হবার আশায়। একটা বয়সের পরে মানুষ আর বাড়তে পারেনা সেভাবে, নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে একটু বড়সর, শক্তিশালী লাগতে পারে। কিন্তু কোন ঔষুধ খেয়ে, জুতো পরে কয়েকমাসের মধ্যে লম্বা হওয়া জাস্ট সম্ভব না! এতে টাকা খরচ করার মানেই হয়না। এসব অনেক প্রোডাক্ট প্রতিবেশী দেশের, বিদেশী কিছুর প্রতি তো আমাদের বেশি আগ্রহ ও ভরসা থাকেই। তাই ফোন করে ইউজলেস জিনিসগুলো অর্ডার করার আগে কেউ বেশি একটা ভাবে না, কিন্তু এতে করে আপনার পকেটের টাকা অন্য দেশের মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে। আপনার ক্ষতি, দেশের ক্ষতি।
ওজন কমিয়ে দেওয়া বেল্ট!
উফফ! পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর, নিম্নমানের ফটোসপ দেখতে চাইলে এসব বেল্ট, জেল ইত্যাদির এড দেখা উচিৎ যা দশ মিনিটে বডি ফ্যাট পুড়িয়ে ফেলে! হাহা। প্রথমে অনেকগুলো পোশাক পরা বাজে এংগেল থেকে তোলা ছবি, পরেরটি বিকিনি পরে তোলা ছবি! মানে এরা জানে পাবলিককে বোকা বানাতে বেশি এফোর্ট লাগেনা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে মোটা হবার অপরাধাে সবার হাসির পাত্র হয়ে যায়। সবখানেই এদেরকে টিপস দেবার মানুষের অভাব হয়না। এই ডায়েট সেই ডায়েট, এই থ্যাইল্যান্ডের পিল সেই ইন্ডিয়ার আয়ুর্বেদ, কতজনের কত কথা! কত টিটকারি। আরেহ ভাই যে মোটা সে নিজের টাকারটা খেয়ে মোটা, আপনার এত কি? আপনাকে কে অধিকার দিয়েছে কাউকে নিয়ে তামাশা করার?
মোটা কমানো সম্ভব তবে তার কোন স্বল্পমেয়াদী উপায় নেই। প্রতিদিন ব্যায়াম করে, পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ওজন কমানো সম্ভব। তবে একবার ওজন কমানোর পরেই যে আবার অনিয়মিত জীবনে ফিরতে পারবেন তা কিন্তু নয়। মোটা মানুষদের ওজন গেইন করার টেনডেনসি থাকে, ফিট থাকতে চাইলে পুরো জীবনই নিয়ম মেনে চলতে হবে। উল্টো পাল্টা প্রোডাক্টে টাকা খরচ না করে বাড়িতে ইউটিউবে নানা ধরণের এক্সারসাইজ দেখে সেগুলো নিয়মিত করে যেতে পারেন। কঠিন মনে হচ্ছে? অন্যেরা আপনাকে নিয়ে হাসছে সেজন্যে নয়, আপনি নিজের সুস্বাস্থ্য ধরে রাখার জন্যে, নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে সবকিছু করুন। তাহলেই পারবেন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শেষ কথা: অনেকেই আছেন যারা বন্ধুদেরকে মোটু, বাটু, কালু ইত্যাদি নামে ডেকে থাকে। ভাবে যে এটা একটা ইন্নোসেন্ট মজা। কিন্তু আপনার এই মজার অংশ আপনার সেই বন্ধুটি মলিন হাসিতে যোগ দিলেও তার আত্মবিশ্বাস ও আত্ম ভালোবাসা কমতে থাকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। ভার্সিটি স্টুডেন্ট নিজের চেহারা নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকায় সুইসাইড করেছে এমন খবর পেপারে পড়েছেন নিশ্চই? আপনি কি চান আপনার কোন বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতর সাথে তেমনই হোক? নিশ্চই নয়, তাই বলব কালো লুকস নিয়ে ক্ষেপানো, পচানোর বিষয়টিকে এড়িয়ে চলুন, অন্যকেও সতর্ক করুন এ ব্যাপারে। আপনি নিজেও নিশ্চই পারফেক্ট নন? আপনি অন্যকে সম্মান দিয়ে চললে, অন্যদের কাছ থেকেও অসহ্য মন্তব্যগুলো পেতে হবেনা আর।
যারা নিজেদের বাহ্যিক আবরণের কারণে নানাবিধ মনোকষ্টে আছেন, তাদেরকে বলব এই পৃথিবীতে প্রচুর আকর্ষনীয় মানুষ আছেন যারা পেশাগত জীবনে অসফল, ৩/৪ বার বিয়ে ভেঙ্গেছে। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন যাদেরকে সমাজ অসুন্দরের তকমা দেবার পরেও তারা নিজ ফিল্ডে সফল, এবং সুন্দরভাবে সংসার করে যাচ্ছেন। এমন অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, সফল ব্যবাসায়ী ও চাকুরে, সাহিত্যিক, আঁকিয়ে তো রয়েছে পৃথিবীতে উদাহরণ হিসেবে। তাই এসব ভন্ড মিথ্যে প্রোডাক্টের পেছনে একটা টাকা খরচ না করে, নিজের সময় নষ্ট না করে নিজের প্যাশন অনুযায়ী কাজ করে যান। পচে গলে যাওয়া সমাজের চোখে "সুন্দর" বলতে যা বোঝায় তা হয়ত হবেন না, তবে নিজের মনে প্রকৃত সুখ, শান্তি ও আত্মমর্যাদা খুঁজে পাবেন নিশ্চই।
নাম্বারিং দেখে হয়ত বুঝতে পারছেন, এটি একট সিরিজ, নানা বিষয় নিয়েই রোস্ট পোস্ট আসতে থাকবে। লেখালেখির প্রধান উদ্দেশ্য তো সমাজের চোখ খোলা, সেই কাজে গঠনমূলক আলোচনা, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ারের মাধ্যমে পাশে থাকুন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পাঠকের জন্যে প্রশ্ন: আমি একটা জিনিস কখনোই বুঝতে পারিনা, ৭ দিনে ফর্সা, ১০ মিনিটে পাতলা, ৫ দিনে লম্বা করে দেওয়া প্রোডাক্টগুলো মানুষজন কেন ব্যবহার করে যাচ্ছে দিনের পর দিন? এসব অসম্ভব তাতো সহজেই বোঝা যায়, তবে কেন সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এসব এত জনপ্রিয়? আপনাদের কোন আইডিয়া থাকলে আমাকে বোঝান।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪১