আগের পর্বগুলোর থেকে এটা অনেক আলাদা হবে। অন্য পর্বগুলোতে সাধারণত পুরো একটা ঘটনা লিখি। এখানে টুকরো টুকরো কিছু অভিজ্ঞতা লিখব। আগের পর্বগুলো পড়ে অনেকে আমাকে দৃঢ়চেতা বলেছেন, ভালো মানুষকিতার ভেবে সম্মান জানিয়েছেন। তাদের বিনয়ের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু এ পর্বে আমার চরিত্রের জঘন্য এক দিক প্রকাশ পাবে।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
১) আমি এবং মি: জি. মি: জি. আমার E.S.L টিচার ছিলেন, আর আমি ওনার T.A. (teaching assistant). E.S.L ক্লাসে সাধারণত টিচাররা অন্য সবার দেশের অনেক গল্প শুনতে চায়। আর আমি T.A. হওয়ায় আরোই বেশি কথা বলার সুযোগ পেতাম মি: জি. এর সাথে। তিনি একজন সুদর্শন, ছিমছাম, ফ্যামিলিম্যান ছিলেন। আমি বলতাম বাংলাদেশ অনেক সবুজ, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, সুন্দরবন আর যা যা আছে এবং এটা সব প্রবাসীরাই করে। দেশকে ভালভাবে প্রেজেন্ট করার চেষ্টা আরকি। তো একদিন ওনার পাশে দাড়িয়ে আছি। উনি বসে ল্যাপটপে নিজের বাচ্চাদের ছবি দেখাচ্ছিলেন আমাকে। হঠাৎ করে কি মনে হল বললেন, তোমার দেশের এত কথা শুনেছি দেখতে ইচ্ছে করছে। বলে বাংলাদেশ লিখে গুগলে টাইপ দিতে গেলেন।
আর আমার গলাটা কেউ যেন খামচে ধরল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। আমার দেশ মনের চোখে যতোই সুন্দর হোক না কেন, ক্যামেরার চোখে অন্য অনেক কিছু ধরা পরে যায়। এখন তো বাংলাদেশের আধা উলন্গ গরিব কিছু বাচ্চা, হরতাল, ঘিন্জি শহরের ছবি উঠে পরবে!! আমি এখন কি করি। নিজেকে মনে মনে বলছি ভাব জলদি কিছু ভাব তুই, অন্য কথা তুলে আটকা। কিন্তু কি বলি, কি করি? এককাজ করি অজ্ঞান হওয়ার নাটক করি। তাহলেতো ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে পরবে। (এখন লিখতেও হাসি পাচ্ছে, কি সিলি চিন্তা ছিল)। কিন্তু ল্যাপটপ ওনার সামনে ছিল আর তাড়াতাড়িই টাইপ করে ফেললেন। আমি কোন প্ল্যানই আমলে আনতে পারলাম না ওইটুকু সময়ে। আমি নিজের হাত নিজে খামছে ধরেছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরাও গোল হয়ে জড়ো হয়েছে। সুন্দর দেশ বাংলাদেশ দেখবে! লোড হচ্ছে আর আমি আমার রক্তশুন্য মুখে ফ্যাকাশে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি। আগেই বলেছি E.S.L ক্লাস হচ্ছে একটা পুরো বিশ্ব। আমার দেশটা বিশ্বের সামনে ছোট হবে আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। ছিহ। নিজের ওপরে এতো রাগ লাগছিল!!
একটু একটু করে লোড হচ্ছে। আর এদিকে আমার বুক ড্রামের শব্দে ধরফর করছে। তো ফাইনালি লোড হল। আর একি? এতো সব সুন্দর সুন্দর ছবি!! যা সবাইকে বলেছিলাম তার চেয়েও সুন্দর। সবুজ মাঠ, হলদে শস্য, নীল নদী, আকাশ, রয়েল বেংগল টাইগার। একেকটা ছবি যেন একেকটা স্বপ্নপুরি। কেমনে কি? কয়েদিন আগেও তো বাংলাদেশ টাইপ করলে অন্যসব ছবি আসত। পরে খেয়াল করলাম মি: জি. ফোটো সেকশনের নেচার অপশনে ক্লিক করেছেন। কেননা আমার গল্প শুনে ওনার নেচার দেখারই বেশি আগ্রহ ছিল। শুধু বাংলাদেশ টাইপ করে scroll করলে সমস্যা ছিল কিন্তু নেচার সেকশনের ছবি তো সুন্দর হবেই। তো উনি বললেন তুমি এত সুন্দর জায়গায় থাকতে? আর E.S.L. কিডরা বারবার বলছিল Really beautiful!! আমিও সেই ভাব নিলাম যে আমিতো আগেই বলেছিলাম আমার দেশ কতো সুন্দর!! কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুুক ধরফরানি তখনো কমেনি!
২) পাকিস্তানি ভদ্রমহিলা: একটা গোলগাল মুখের ফর্সা চেহারার মহিলা। মাথায় কাপড় দেয়া, কিন্তু শার্ট, প্যান্ট পরা। উনি স্কুলের disabled বাচ্চাদের দেখাশোনা করার কাজ করতেন। একদিন আমি লকার থেকে কি জানি একটা নিয়ে লাইব্রেরীতে যাচ্ছি। উনি আমাকে হঠাৎ করে এসে বললেন আমি কোন দেশের? ইন্ডিয়ার? আমি বললাম না বাংলাদেশের। উনি বললেন উনার বরও বাংলাদেশী আর উনি পাকিস্তানি। আমার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল।
আরে বাংলাদেশে মেয়ের অভাব পরেছে যে শত্রু দেশের মেয়ের সাথে বিয়ে করতে হবে?? আর ফর্সা, লম্বা মেয়ে বাংলাদেশেও আছে, কোন অভাবে ওদের মতো খুনি, রেপিস্টদের সাথে সংসার করতে হবে? এসব কথা লিখতেও এখন লজ্জ্বা লাগছে। জীবনে কোন পাকিস্তানির সাথে পরিচয় না হওয়া আমি ওইটুকু কিশোরি মনে এত ঘৃণা কি করে রেখেছিলাম!! এতটা রেসিজম আমার মনে ছিল!! রেসিজমকে আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে জঘন্য পাপ মনে করা হয়। আর আমার মধ্যে তা তীব্রভাবে ছিল পাকিস্তানিদের জন্যে। আসলে আমাদের দেশে অনেকে বাচ্চা বয়স থেকেই ভারত, পাকিস্তানকে ঘৃণা করে। হ্যা ওদের খারাপ কাজগুলোকে ঘৃণা করা উচিত, বাংলাদেশের প্রতি ধেয়ে আসা কালো হাতগুলোকে পিষে ফেলা দরকার। কিন্তু সব পাকিস্তানি, ভারতীয় খারাপ এটা ভাবা তো রেসিজমের মধ্যে পরে। যেটা আমার মধ্যে তখন পুরোদমে ছিল।
তো উনি আমাকে ইংলিশে বললেন, "তোমাকে অনেক দিন ধরেই ফলো করছি। স্কুলের বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি। পরিচয় করব করব করেও করা হয় নি। তোমার আউটফিট অনেক সুন্দর। ট্রাডিশনাল পোশাক পরেও স্কুলের সব জায়গায় কনফিডেন্টলি ঘুরে বেড়াও!!! কোন জড়তা নেই। You are such a strong minded lady!!" আমিতো বেশ খুশি। আমার মতো বাচ্চা কিশোরিকে লেডি বলছে!! আমার আর কি চাই? হা হা। তো উনি আরও বললেন, "আমরা চেষ্টা করছি আমাদের মেয়েও যেন এরকম পোশাক পরে, কিন্তু ও মানছে না। স্কুলে নাকি হাসাহাসি করবে (তার মেয়ে অন্য স্কুলে ছিল)। তোমাকে দেখাব একদিন। তোমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। তোমাকে দেখে যদি আমার কথা মানে।"
এরপরেও কয়েকবার শর্ট কনভার্সেশন হয়েছিল ওনার সাথে। অনেক সুইট ছিলেন এবং মনে হতো আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করেন। আমি যেন ওনারই দেশের, ওনারই কালচারকে ধরে রেখেছি! উনি কয়েকমাসের মধ্যেই ট্রান্সফার হয়ে অন্য স্কুলে চলে যান, আর নিজের অজান্তেই আমার মন থেকে অযাচিত কিছু ঘৃণা দূর করে দিয়ে যান!!
তবে একটা কথা, এখনো কেন যেন বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের বিদেশি ছেলেমেয়েদের বিয়ে করাটা ঠিক মেনে নিতে পারিনা। এটা নিঃসন্দেহে আমার সংকির্ণমনতা। কিন্তু আমার সংকির্ণমনতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা আমি করব। যখন কোন দেশি বিদেশি বিয়ে করে প্রথম কয়দিন খুব ভালো চলে। কিন্তু পরে সমস্যা শুরু হতে থাকে। অনেক কিছু আছে যা বাংলাদেশি মেয়েরা মেনে নিতে পারেনা কিন্তু বিদেশি ছেলেদের মধ্যে আছে। যেমন মদ খাওয়া, লেট পার্টি করা, মাসের শেষে বেতন নিজে মতো করে খরচ করা। আর অনেক কিছু আছে বাংলাদেশি ছেলেরা মেনে নিতে পারেনা যেমন বউয়ের অনেক ছেলের সাথে বিয়ের আগে গভীর সম্পর্ক থাকা, শশুরবাড়ির সাথে তেমন যোগাযোগ না রাখা। আসলে আমাদের কালচারে যা মহাপাপ ওদের দেশে তা ডালভাত। বিয়ের আগে কিছু মনে নাহলেও বিয়ের পরে মাথায় বাজ পরে। আর দুজনের কেউই সাধারণত একে অপরের পরিবারের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনা। আমেরিকায় কোন এক গবেষনায় দেখা গিয়েছিল পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দেশের, কালচারের মানুষের ডিভোর্সের হার মহামারি আকারে বেশি। তা আমি কানাডায় নিজে দেখেছি।
কিন্তু সব কথার বড় কথা, ভালোবাসা থাকলে বিয়ে টেকে সে বিশ্বের যে প্রান্তেরই মানুষ হোক না কেন। এমন হাজারটা বিয়ে আছে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে দাড়িয়ে আছে। তবে বেশি প্রতিকূলতা সম্পর্ক টেকার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। আর এজন্যে আমি মেনে নিতে পারিনা। খারাপ মনে করিনা শুধু মনে হয় বিয়েটা যেন না ভাংগে। আর বেশিরভাগ সময়ই আমার দোয়া কোন কাজে লাগে না!!
এরকম আরও অনেক টুকরো টুকরো ছবি মনে ভাসছে। ব্লগাররা বড় পোষ্ট পড়তে বিরক্ত বোধ করবেন বলে আর লিখলাম না। পরের পর্বে পাঠক চাইলে অবশ্যই লিখব। কোন বিশেষ বিষয়ে আগ্রহ থাকলে কমেন্ট করে জানান। যারা প্রতি পোস্টে "পরের পর্বের অপেক্ষায়" লেখেন তাদের জন্যেই আমার লিখতে থাকা। তাদেরকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ৭:০৯