somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোর

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভোর 'গল্পটির ঘটনাটি দুঃসহ সত্য ও চরিত্রগুলো রক্তমাংসের। একাত্তরে শহীদ ডাঃ রফিক আহমদ এর স্ত্রী ফাতেমা আহমদ ‘রক্তঋণ’এর প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা প্রথমখন্ড গ্রন্থে শহীদ চিকিৎসক ডাঃ হাসিময় হাজরাকে ঘিরে তার বোন ডাঃ সামিনা চৌধুরীর স্মৃতিকথা পড়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটির অংশবিশেষ, “...গোপনে ঔষধপত্র দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন বলে ১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ সনের নয়টার সময় এশরাক নামাজ পড়ে টেবিলে নাস্তা খেতে বসেছিলেন তখনই দশ বারজন পাক হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা দরজা ধাক্কা দেন এবং ওনাকে ও বাসার সবাইকে ঘর হতে বাহির হতে বলেন। আমরা সবাই ঘর হইতে বাহির হওয়ার পর দেখি আমার সম্মুখেই আমার বড় তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলেকে অস্ত্র দ্বারা জবাই করে দিল আরেক ছেছলে এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে পালাতে চাইলে তাকেও... ধরেই জবাই করে দিল। আর আমার স্বামী পাক হানাদার বাহিনী ও বিহারীদের নিকট বলেছিল যে, আমাকে একবার ওজু করে দুই রাকাত নামায পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। তারা তাঁর ইচ্ছাটুকু পূরণ না করে পেটের ভিতর ছোরা ঢুকিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি সেখানেই শহীদ হয়ে গেলেন।”
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি:১৯৭১’ এর নবম খন্ডে তিনি আরও লিখেছেন, “১৪ এপ্রিল কারফিউ শিথিল হলে কারা যেন আমার স্বামী ও সন্তানদের কোনোরকম জানাযা ছাড়াই মাটি চাপা দিয়ে রেখে যায়। পরে জেনেছি, কবর দেওয়ার সময় তারা দেখেছিল তাঁর (ডাঃ রফিক আহমদ) ও আমাদের তিনজন ছেলের শরীরে কোনো মাছিও বসেনি। মনে হয়েছিল এইমাত্র তারা শহীদ হয়েছে। তাদের নামানুসারে পাকশীর রেলওয়ে কলোনীর নাম রাখা হয়েছে, “চার শহীদের মাজার।”

শহীদ ডাঃ রফিক আহমদের পরিবারের কারো সন্ধান জানা থাকলে দয়া করে আমাকে জানাবেন।
’ভোর’ গল্পটি ’দ্রোহ যাতনার গল্প’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

ভোর

আকাশের অন্ধকার এখনও পুরোপুরি কাটেনি, জ্বলজ্বলে ধ্রুব তারাটি স্পষ্ট হয়ে আছে, চাঁদটিকেও দেখা যাচ্ছে। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার কেটে লালিমার আভা ছড়িয়ে পড়ছে। শরীর জুড়ানো শীতল হাওয়া বইছে। শুনশান চুপচাপ চারপাশে কোলাহল নেই, কোনো টুংটাং শব্দ নেই। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে ভেসে আসে আজান। রফিক সাহেব খুব মন ভরে শুনছেন ফজরের আজান। ‘‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম’’ শুনেই তিনি প্রতিদিনের মতো ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় আসেন। বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে কলঘরের দিকে এগিয়ে যান। ওজু করেন।
ওজু করার সময় তার কানে ভেসে আসে বাঁশির সুর, রফিক সাহেব বারান্দার কোণে তাকান, গণেশ বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। রফিক সাহেবের গণেশের এই বিষয়টি খুব পছন্দ, সেও প্রতিদিন খুব ভোরে ওঠে এবং বাঁশি বাজায়। রফিক সাহেব শৈশবে পড়া ‘‘আরলি টু বেড আরলি টু রাইজ’’ বাক্যটি খুব মানেন। তার আফসোস তার তিন ছেলের কেউই এ কথাটি পালন করে না। ভোরবেলার কী সৌন্দর্য তা তাদের জানা নেই।
রফিক সাহেব বারান্দায় হাঁটতে থাকেন, একবার দাঁড়িয়ে গণেশকে দেখেন। ’৬৫তে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় গণেশের পরিবারের সবাই দেশ ছেড়ে যায়, শুধু দু’বছরের গণেশকে পার করানো যায়নি, তার বাবা কী কারণে, কোথায় উধাও হয়ে যান তা এখনও অজ্ঞাত, তবে রফিক সাহেব উড়ো কথা শুনেন যে তাকে জবাই করা হয়েছে। রফিক সাহেব স্পষ্ট দেখতে পান ধুতি পরে গণেশের বাবা গণেশকে বৈঠক ঘরের বেতের সোফায় বসিয়ে চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছে। রফিক সাহেব গণেশের বাবার সেই অসহায় মুখটা কখনই ভুলতে পারেন না। রফিক সাহেবেরও জীবনে কখনও নিজেকে এতটা নিরুপায় মনে হয় নি। এখনও মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন, মনে হয়, কখনও যদি এমন বিপদ আসে যে নিজের ছেলে-মেয়েকে ফেলে তাকে পালিয়ে যেতে হয়। যখনই এমন ভাবনা আসে, তিনি আয়তুল কুরসি পড়ে দোয়া করেন আল্লাহ দুনিয়ার কোনো মানুষকে কখনও এমন দুঃসময় দিও না।
সেই থেকে বছর ছয়েক ধরে গণেশ এই বাড়িতেই থাকে। বছর চব্বিশ আগে রফিক সাহেবের বয়স যখন ষোল তখন তিনি দেখেছেন ধর্ম নিয়ে কী ভয়ংকর বীভৎসতা, কী করে দেশ ভাগ হয় মানুষ তার ঘর বাড়ি ছেড়ে বুক ভরা জ্বালা নিয়ে যাত্রা করে না জানা পথে, অন্য এক রাষ্ট্রে। আর যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা, ভিটে মাটি ছাড়ার ব্যথা মাথা পেতে নিতে হয়। মনে হয়, এই পৃথিবীতে যারা নির্যাতন করতে পারে, নিষ্ঠুর হতে পারে তারাই জয়ী হয়।
গণেশের পাশে খানিকক্ষণের জন্য রফিক সাহেব দাঁড়ান, দাঁড়িয়ে বাঁশির সুর শুনেন। শুনতে শুনতে আকাশের দিকে তাকান। গাঢ় অন্ধকারকে কাটিয়ে লালিমার আভাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রফিক সাহেব তার চেম্বার ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।
চেম্বার ঘর থেকে জায়নামাজটি বারান্দায় নিয়ে এলেন, জায়নামাজ পাতলেন। গণেশ বাঁশি বন্ধ করল। রফিক সাহেব জায়নামাজে দাঁড়িয়েছেন, আস্তে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে নামাজ আরম্ভ করলেন। ফজরের নামাজ তার খুব বেশি প্রিয়, এই নামাজের সময় ভোরের হাওয়া বইতে থাকে, এজন্যে তিনি ফজরের নামাজ মুক্তস্থানে আদায় করেন। নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করে চেম্বার ঘরে ঢুকলেন। গণেশের খুব ভাল লাগে রফিক সাহেবের নামাজ পড়ার দৃশ্যটি, সে খুব মন দিয়ে নামাজের এ দৃশ্যটি দেখে, তারপর আবার বাঁশি বাজানো আরম্ভ করল।

রফিক সাহেব চেম্বার ঘরের দরজাটা চাপিয়ে দিলেন। অন্যান্য দিন এই সময় তিনি দরজা খোলা রাখেন Ñ ঘরের ভেতর হাওয়াকে খেলতে দেন। আজ দরজা বন্ধ রেখে, টেবিলের নিচ থেকে একটা বাক্স বের করলেন। বাক্সটা খুললেন, বুকটা ধড়ফড় করছে।
বাক্সের ওপরটায় ওষুধ গুছিয়ে রাখছেন। বাক্সের নিচের তলানিতে হাত দিতেই হঠাৎ পুরো শরীর ছলাৎ করে উঠল, কেমন যেন চমকে উঠলেন তিনি। ওষুধের নিচে কয়েকটা গ্রেনেড। রাতে ছেলেটা আসবে, তখন দিতে হবে। পাক্কা খবর যে ঢাকায় অপারেশন হচ্ছে। এখন পাকিস্তানি মিলিটারি বেশ তৎপর হয়েছে। একেবারে রাজধানীতে এসে অপারেশন করে যাচ্ছে এটি বেশ অশনি সংকেত পাকিস্তানি মিলিটারির জন্যে। বেশ ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে। রফিক সাহেব ঘটনাচক্রে এই গ্রেনেড রাখার সাথে জড়িয়ে গেছেন। গেরিলারা এখন সাময়িক গা ঢাকা দিয়েছে। কার্ফু, রাস্তায় রাস্তায় চেক পোস্ট, তাই এ গ্রেনেডগুলো তারা বহন করে নিয়ে যেতে পারছে না। তিনি গ্রেনেডের ওপর কতগুলো ওষুধ, ব্যান্ডেজ নিজে বুদ্ধি করে রেখে দিয়েছেন। তিনি বোঝেন হঠাৎ করে ঘা, কাটা থেকেও বড় ইনফেকশন হতে পারে। তিনি সিনেমায় দেখেছেন, যোদ্ধারা জলাজঙ্গলার মধ্যে থাকে, সেই ইমেজই তার চোখে ভাসে। তবে সিনেমায় দেখেছেন সব ইউনিফর্ম পরা, মাথায় হেলমেট দেয়া সোলজার, ঠিক লুঙ্গি পরে কেউ যুদ্ধ করছে সেই দৃশ্যটা তিনি কল্পনা করতে পারছেন না। তবে কাঁটার ঝোপ পেরিয়ে, খাল-বিল- নদী সাঁতরিয়ে, গায়ে কাদা মাটি মাখামাখি করে যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধারা তা তিনি কল্পনায় আঁকতে পারেন। কাটা ছেঁড়া, জ্বর, আমাশার কিছু ওষুধ বাক্সে ভরে দিয়েছেন। যতক্ষণ বাক্সটা ঘরে ততক্ষণ মন অস্থির হয়ে থাকবে। পুরো বাক্সটা ঢেকে আবার ঢুকিয়ে রাখলেন আগের জায়গায়। অন্যদিনের মতো আজ আর ঘরের দরজাটা খোলা রাখলেন না, দরজা ভেজিয়ে আবার বারান্দায় এলেন। চারিপাশে আলো ফুটছে। এই সময়টা রফিক সাহেবের খুব ভাল লাগে।
ঘর থেকে বের হয়ে তিনি আবার বারান্দায় এলেন। তার দু’বছরের মেয়ে কেঁদে উঠেছে। প্রতিদিনই এ সময় তার মেয়ে কেঁদে ওঠে। মা এখন মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় আসবেন। এ সময়টা রফিক সাহেবের খুব পছন্দ। অন্ততঃ তার মেয়ে আর মেয়ের মায়ের সাথে তো ভোরের হাওয়াকে ভাগ করা যায়। তার খুব শখ এক ভোরবেলা তার স্ত্রী, তিন ছেলে, মেয়ে, গণেশের সাথে এই উঠোনে সময় কাটাবেন। সেই ভোরটি কি আসবে?
তিনি শুকরিয়া করেন যে তার তিন ছেলে আর একমাত্র মেয়ে এরা চারজন জন্মেছে চার ঋতুতে। তাদের নামও রেখেছেন শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত, বর্ষা। তার মনে গেঁথে আছে গ্রামের দিনগুলো Ñ জ্যৈষ্ঠের গরমে পুকুরে ডুবে থাকা, কালবৈশাখীর সময় আম কুড়ানো, ঝমঝম বৃষ্টিতে কাদা মাটি মাখামাখি করে মাঠের পর মাঠ দৌড়-ছুট, নতুন ধান ওঠার পর পিঠা খাওয়া। রফিক সাহেব নিজের অজান্তেই বলে ওঠেন, “আহারে।” পাখির গান ভেসে আসে ফুলের গন্ধের সাথে, সঙ্গে থাকে হিমেল হাওয়া। রফিক সাহেবের আবারও ইচ্ছা জাগছে সবার সাথে এই উঠোনে একটা ভোরে মিলিত হওয়ার। ভোরে সবাই মিলে উঠোনে থাকবে, সবার শরীর ছুঁয়ে যাবে ভোরের প্রথম আলো।

এর প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরের ঘটনা।

রাত শেষ হয় হয়। প্রচণ্ড ঘন অন্ধকার হয়ে আছে, আর একেবারে শুনশান চারিপাশ, সব শব্দ থেমে আছে। গণেশ বাঁশি নিয়ে বসেছে, রফিক সাহেব ওজু করছেন। রফিক সাহেব আবার চেম্বার ঘরে ঢুকলেন, জায়নামাজ হাতে নিয়েছেন। বাক্সটা গতরাতে পার করতে পেরেছেন। খানিকটা স্বস্তি ও শান্তি। আজ ভোরে তিনি আল্লাহ্র কাছে দোয়া করবেন, যেন তিনি ছেলেগুলোকে নিরাপদে রাখেন। কত বড় ঝুঁকি নিয়ে, কী সাহসী কাজ তারা করছে, ভাবতেই চোখের কোণ থেকে একটু পানি বের হয়ে যায়।
রফিক সাহেব বারান্দার দিকে যাচ্ছেন, ঘরের পর্দা সরিয়ে বারান্দায় পা রাখলেন। গণেশ বাঁশি বাজানো থামাল। রফিক সাহেব জায়নামাজ বিছিয়েছেন। একবার আকাশের দিকে তাকালেন। নিয়ত করে এখন ইকামত দিচ্ছেন। হঠাৎ বিকট জোরে সদর দরজা ধাক্কাবার ‘ধাপ ধাপ’ শব্দ। দরজার ওপাশ থেকে “বায়েন চোত, মালাউনকা আওলাদ দরওয়াজা খোল্” বলে কয়েকজনের হুংকার শোনা যাচ্ছে। প্রচণ্ড জোরে দরজা ধাক্কার শব্দ হতে হতে হঠাৎ মচ্মচ, ঢাস একটা আওয়াজ হলো। দরজার একপাটের কাঠের খানিকটা ভেঙে গেছে, কপাট নড়বড় করে উঠেছে। গণেশ দেখে বিশাল ছুরি আর দা নিয়ে বাড়ির ভিতরে উঠানে কয়েকজন ঢুকে গেছে, দা-ছুরি ঘষার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। সাথে সাথে গণেশ চিৎকার করে ওঠে। চিৎকার করার মাঝেই গণেশকে দু’জন টেনে হিঁচড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে। গণেশ দেখে জায়নামাজে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, রফিক সাহেবের পেটে ছোরা ঢুকানো হয়েছে, তার পেট থেকে রক্ত ঝরছে। বিকট চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেছে। রফিক সাহেবকে উঠোনে চিৎ করে শোয়ানো হচ্ছে। গলায় ছুরির একটা পোঁচ দিয়েছে। গলগলিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে উঠানে, রফিক সাহেবের গলার রগগুলো ছিঁড়ে ছারখার হয়ে গেছে। রক্ত গলগলিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে বড় দুই ছেলেকেও ঘাড় ধরে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট ছেলে ছুটছে, লাফিয়ে দেয়াল ডিঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পালাতে পারেন নি, ধরা পড়ে গেছে। এখন বাবা, তিন ছেলে, গণেশ সবাই উঠোনে। দা আসছে গলার কাছে। সাংঘাতিক ভয়ে চোখ বড় হয়ে আছে বসন্তের, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, শ্বাসের গতি বাড়তে থাকে। শরৎ “আ, আ” চিৎকার করছিল, এখন গলার সাথে মাথার মাঝে কয়েকটি রগ জোড়া লেগে আছে, মুখ বেয়ে রক্ত ঝরে যাচ্ছে। বড় বড় ফোঁটা রক্ত টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে, গলার রগ কেটে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে। হেমন্তকে চিৎ করে শুইয়ে গলার ওপরে দা দিয়ে পোঁচ মারা হয়েছে। গলার ওপরের কয়েকটা রগ কেটে রক্ত ছিটকে ছিটকে পড়ছে। দায়ের আরো কোপ পড়ছে, গলার রগগুলোকে আরো বেশি করে আলগা করে দা-টা ভিতরে ঢুকে যাছে। চোখ কোটর থেকে, জিভ মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে, রক্তের ছিটা পড়ছে চারপাশে।
বসন্তের গলার উপরের রগে একটা কোপ পড়েছে, চাপাতিটা একটু একটু করে গলার রগগুলোকে ছিঁড়ছে। প্রথম কোপের পর এখন চাপাতিটা ঘুরানো হচ্ছে রগগুলোর উপর। যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে সে। মাথাটা শরীর থেকে প্রায় ছিন্ন। পাশে মেঝেতে শরৎ এর কাটা মস্তকটি ঝরা রক্তের মাঝে গড়াগড়ি করছে। হেমন্তর গলার কয়েকটি রগ এখনও শরীরের সাথে মাথাটাকে যোগ করে রেখেছে, গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে তো ঝরছেই।

কিছু পরে, বর্ষাকে কোলে নিয়ে রফিক সাহেবের স্ত্রী এখন দাঁড়িয়ে আছেন উঠোনে। ঘরের উঠোনে একটু একটু আলোর আভা ছড়াচ্ছে, বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আরেকটি ভোর হচ্ছে। আর এই ভোরে উঠোনে পড়ে আছে রফিক সাহেব, তিন ছেলে আর গণেশর দেহ। ভোরবেলার এ মুহূর্তটিতে পরিবারের সবাই উঠোনে আছে। ভোরের প্রথম আলো এসে পরশ বুলাচ্ছে রফিক সাহেব আর তার তিনছেলের দেহে। রফিক সাহেবের খুব ইচ্ছা ছিল একটি ভোরে সবার সাথে উঠোনে থাকবেন।
সে স্বপ্ন কি পূরণ হ’ল?

...............................
গল্পটির ঘটনাটি দুঃসহ সত্য ও চরিত্রগুলো রক্তমাংসের। একাত্তরে শহীদ ডাঃ রফিক আহমদ এর স্ত্রী ফাতেমা আহমদ ‘রক্তঋণ’এর প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা প্রথম খণ্ড’ গ্রন্থে শহীদ চিকিৎসক ডাঃ হাসিময় হাজরাকে ঘিরে তার বোন ডাঃ সামিনা চৌধুরীর স্মৃতিকথা পড়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটির অংশবিশেষ, “...গোপনে ঔষধপত্র দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন বলে ১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ সনের নয়টার সময় এশরাক নামাজ পড়ে টেবিলে নাস্তা খেতে বসেছিলেন তখনই দশ বারজন পাক হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা দরজা ধাক্কা দেন এবং ওনাকে ও বাসার সবাইকে ঘর হতে বাহির হতে বলেন। আমরা সবাই ঘর হইতে বাহির হওয়ার পর দেখি আমার সম্মুখেই আমার বড় তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলেকে অস্ত্র দ্বারা জবাই করে দিল আরেক ছেলে এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে পালাতে চাইলে তাকেও... ধরেই জবাই করে দিল। আর আমার স্বামী পাক হানাদার বাহিনী ও বিহারীদের নিকট বলেছিল যে, আমাকে একবার ওজু করে দুই রাকাত নামায পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। তারা তাঁর ইচ্ছাটুকু পূরণ না করে পেটের ভিতর ছোরা ঢুকিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি সেখানেই শহীদ হয়ে গেলেন।”
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি:১৯৭১’ এর নবম খণ্ডে তিনি আরও লিখেছেন, “১৪ এপ্রিল কারফিউ শিথিল হলে কারা যেন আমার স্বামী ও সন্তানদের কোনোরকম জানাযা ছাড়াই মাটি চাপা দিয়ে রেখে যায়। পরে জেনেছি, কবর দেওয়ার সময় তারা দেখেছিল তাঁর (ডাঃ রফিক আহমদ) ও আমাদের তিনজন ছেলের শরীরে কোনো মাছিও বসেনি। মনে হয়েছিল এইমাত্র তারা শহীদ হয়েছে। তাদের নামানুসারে পাকশীর রেলওয়ে কলোনীর নাম রাখা হয়েছে, “চার শহীদের মাজার।”
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হামিদ ভাই দেশ ছাড়ছে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ৮:৫৩

hahaziz1957-1746715922-38fdac3_xlarge.jpg]







সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ ছাড়া আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী... ...বাকিটুকু পড়ুন

কওমী শিক্ষা ইসলামের বিকলাঙ্গ শিক্ষা

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৫৬



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত জন্তু,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাত্রদের কারা মাইনাস করতে চায় ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:১৭


আজ তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম 'কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা' শিরোনামে ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, ইন্টেরিম সরকারের ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। তাই ইচ্ছা করলেই ছাত্র-জনতার সকল দাবী পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শুধুমাত্র চোর এবং কাপুরুষরাই রাতে আক্রমণ করে

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:৩৪



ভারতের সম্প্রতি হামলা নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সম্প্রতি একটি আবেগঘন বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন "শুধুমাত্র চোর এবং কাপুরুষরাই রাতে আক্রমণ করে। যদিআ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নবীজির জন্মের আগে আরবে গজব অবস্থা ছিলো

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৯ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:০২



নবীজির জন্মের আগে আরবে বেশ কিছু ধর্ম ছিলো।
ধর্ম না বলে কুসংস্কার বলা ভালো। সেই সময় মানুষ রসিকে সাপ মনে করতো। মগজহীন মানুষ দিয়ে ভরা ছিলো আরব। সেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×