দাগ দিয়ে যাই
সামিও শীশ
মেখলা নদীর ধারে দু’টি গ্রাম- মধুপুর আর আমতলা।
আমতলা গ্রামে সারি সারি আম গাছ। আমের মৌসুমে এই গ্রামের গাছগুলো রাশি রাশি আমের মুকুলে ভরে ওঠে। চারিপাশ মুকুলের গন্ধে মৌ মৌ করে। ধীরে ধীরে ঝাঁকা ঝাঁকা পাতার মধ্যে থোকা থোকা আমগুলো উঁকি দেয়। আমের গন্ধে পুরো গ্রাম ভরে ওঠে। মৌসুমের এই সময়টাতে মধুপুর গ্রামের বাতাসে ঝাঁক ভরা মৌচাক থেকে মধুর মৌ মৌ গুঞ্জনের সাথে আমের গন্ধ ভাসে।
দু’গ্রামের ঠিক মাঝে প্রতিবছর ‘মধু আম’ মেলা হয়। কথিত আছে, আজ থেকে বহু বছর আগে কোনো দূর দেশের পথিক নদীর ধার ধরে হাঁটছিল। পথে ক্লান্ত হয়ে সে আমগাছ তলায় বসে। দু’টি পাকা আম তার কোলে পড়ে, আম খেয়ে সে বলে ওঠে, ‘আহা! কী মিঠা।” ক্লান্ত, দুর্বল হয়ে সে যখন অসুস্থ প্রায় তখন তার মুখে মধু দেওয়া হয়। সে চাঙ্গা হয়ে যায়। তার বহুবছর পরে বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে সে নৌকায় চড়ে মেখলা নদী পেরিয়ে আবার এখানে আসে। তার শেষ ইচ্ছে, আবার সেই আম খাওয়া আর মুখে মধু দেয়া। শেষ বিদায়ের আগে সে বলে যায়, “আম আর মধুর মিলন, অটুট থাকুক সারাটি জীবন।” এখানেই হয় তার সমাধি। সম্ভবতঃ সেই থেকে তার সমাধির জায়গাটিকে ঘিরেই প্রতিবছর এখানে ‘আম-মধু’ বা ‘মধু-আম’ মেলা হয়। শুধু আমতলা আর মধুপুর থেকে নয়, চারদিকের অন্যান্য গ্রামে থেকেও মেলায় মানুষ আছে, প্রাণ ভরে আম আর মধু খায়।
মেলাতে মধুপুর আর আমতলার সবাই আসে। মেলা শুরুর দিন কতক আগে থেকে আয়োজনকে ঘিরে চলে শিশু আর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে চলে হৈ চৈ আর নানা কলোরল। মেখলা নদীর মাঝিরা এসময় নতুন গান বাঁধে আর নতুন গান গাইতে গাইতে গাইতে নৌকা বায়, মানুষজনকে নিয়ে আসে মেলাতে। মেলা উপলক্ষে আমতলার কুমাররা ছোট ছোট মাটির বাটি বানায়, বাটিতে আম আর মৌমাছির ছবি আঁকে। মধুপুরের তাঁতিরা নতুন নতুন কাপড় বুনে, তাতে নানা ধরনের নকশা আঁকে। গাতকের গানের আসর বসে, গানে গানে প্রতিযোগিতা হয়।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ছিল সাধারণ দৃশ্য। আমতলা আর মধুপুর গ্রামের সীমারেখা নিয়ে তখন কাউকে চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। একই নৌকায় করে দুই গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা পাঠশালায় যেত, রাখালেরা গরু চড়াবার সময় কোন গ্রামের মাটির উপর দিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কখনও ভাবত না। এই দুই গ্রামের মানুষের মাঝে যে একেবারে কোনো তফাতই ছিল না তা নয়। ছিল, যেমন, আমতলার মানুষজন যাকে বলে আ-া, মধুতলাররা তাকেই বলে ডিম। এই আ-া-ডিম নিয়ে মজা করা হত, কিন্তু ঠিক বিরোধ বলতে যা বুঝায় তা কখনও ছিল না।
কিন্তু গেল বছর থেকে অবস্থা ভিন্ন। তার একটা নমুনা, আমতলার দেয়ালে দেয়ালে লেখা “ডিমকে মারি ঢিম” আর মধুপুরের জায়গায় জায়গায় লেখা “আ-াকে মারি ডা-া”। আজ আমতলার ছেলে-মেয়েরা মধুপুরে খেলতে যেতে পারে না, নদীর ধার দিয়ে যাওয়া সময় মধুপুরের ছেলে-মেয়েদের দুয়োদুয়ো করে তাড়িয়ে দেয় আমতলার সীমানা রক্ষীরা।
কেন এমন হল এর উত্তর খুব সহজ নয়, আর তার বিস্তারিত বিবরণ অন্য গল্পের জন্যে তোলা থাক। কাহিনী সংক্ষেপ হচ্ছে, খুব দূর দেশ থেকে কিছু মানুষজন এসেছিল, তারা নির্ধারণ করেছে যে এই হবে দুই গ্রামের সীমানা আর তৈরি করে দিয়েছে সীমানা পেরুবার অনেক জটিল আইন-কানুন। এই কাজও যে খুব সহজেই করেছে তা নয়, নানা কৌশল করতে হয়েছে এ জন্য। ‘ডিম-আ-া’তত্ত্ব তারই একটি উদাহরণ। সেই সাথে সীমানা রক্ষার জন্য দুই গ্রামকেই দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে নানা অস্ত্রপাতি। আর এই অস্ত্রপাতি কিনতে কিনতে দুই গ্রামেরই প্রায় দেউলিয়া অবস্থা। তা-ই আমতলার গাছের আম এখন গ্রামবাসী পেট আর মন ভরে খেতে পায় না, এই সব বিক্রি করে যোগাতে হয় সীমান্ত রক্ষার খরচ। একই ঘটনা ঘটছে মধুপুরের মধুর বেলাতেও।
এই যখন অবস্থা তখন আবার আসলো ‘আম-মধু’ বা ‘মধু-আম’ মেলার সময়। আগে ‘আম’ নাকি ‘মধু’ কোনটি আগে বলতে হবে তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা ছিল না, কিন্তু এখন এই কথা বলা নিয়ে অনেক সাবধান থাকতে হচ্ছে। সবার মাঝে দুঃশ্চিন্তা কারণ মেলার জায়গাটি কোন গ্রামের সীমান্তে পড়বে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি, হয়তো ইচ্ছে করেই করা হয় নি। এই জন্য আমতলা আর মধুপুরের সীমান্তরক্ষীরা সদা সতর্ক থাকছে, মাঝে মধ্যেই লিপ্ত হতে হচ্ছে নানা বচসায়।
আগামীকাল মেলা বসার দিন, কিন্তু কী হবে?
সন্ধ্যা শেষে রাত আসছে, রাত গভীর হচ্ছে। এমন সময় একটু একটু করে মেলার জায়গায় জড়ো হয়েছে আমতলা আর মধুপুরের ছোট ছেলে-মেয়েরা। কী করে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে তারা জড়ো হলো, সে গল্প পরে কখনও বলা যাবে, কেননা প্রত্যেকের এখানে আসার ঘটনাই একেকটি চমকপ্রদ গল্প।
আমতলার ছেলে-মেয়েরা আমপাতা আর আমের খোসা নিয়ে এসেছে। মধুপুরের ছেলে-মেয়েরা মৌচাক থেকে এনেছে মধু আর মোম। সমাধি স্থানে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে তারা কী করছে, তা দূর থেকে কেউ দেখতে বা বুঝতে পারছে না। তা বুঝবার জন্য আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
যখন আলো ফুটল, তখন দুই গ্রাম থেকে সবাই ছুটে আসছে মেলার জায়গাটির কাছে। সীমান্তরক্ষীরাও প্রস্তুত, একপক্ষ আরেকপক্ষের দিকে অস্ত্র তাক করে বসে আছে, দুই পক্ষেরই আজ ইচ্ছা জায়গাটিকে দখল করার।
কিন্তু কেউই দখল করতে পারে নি? কারণটি বুঝতে হলে জানতে হবে গত রাতে এখানে জড়ো হয়ে বাচ্চা-কাচ্চারা কী কা- ঘটিয়েছে। গতকাল রাতে ছেলে-মেয়েরা তাদের ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মোম গলিয়ে পাতার সাথে সাথে আমের খোসা আর পাতাগুলোকে লাগিয়ে বানিয়েছে একটা বড় তক্তি (বোর্ড) । অনেক দিন ধরে তারা একটু আম আর মধু খেতে পারে নি, একটু বেশি পেটুক কয়েকজন বাচ্চারতো মুখ থেকে লালা বের হয়ে যাচ্ছিল মধু আর আম খেতে। কিন্তু তারা কেউ খায় নি। আমের আঁটিগুলোতে মধু মাখিয়ে সারি সারি করে তাদের সাজিয়েছে। খুর দূর থেকে দেখলে মনে হবে এলোমেলো কতকগুলো দাগ। দূর থেকে দেখে সবার তাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সবাই যখন কাছে এল দেখে, এগুলো কেবলই অগোছালো দাগ নয়। হাতে, পায়ে, গায়ে, পেটে আমের রস, মধু মেখে আমের খোসা আর পাতার তক্তিতে তারা না খাওয়া ডাসা ডাসা রসে ভরা আমে মধু মাখিয়ে লিখেছে,
“আমতলা আর মধুপুরের মিলন,
বাঁচিয়ে দাও আমাদের জীবন। ”