বই আলোচনা:
“বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা ...”ঃ বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি গণট্রাইব্যুনাল
সামিও শীশ
বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি গণট্রাইব্যুনাল
প্রকাশক।। সংহতি প্রকাশন
প্রকাশকাল।। ডিসেম্বর ২০০৯
প্রচ্ছদ ।। অমল আকাশ
মূল্য।। ৭৫.০০টাকা
ওঝইঘ: ৯৭৮-৯৮৪-৮৮৮২-০৭-৮
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ব্রেটন উডসে ইউনাইটেড নেশন মনেটারি এ্যান্ড ফিনানসিয়াল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় যেখানে দু’টি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড (আইএমএফ) এবং ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি বা বিশ্বব্যাংক) করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মূল লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় যে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনা এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করা। আর ১৯৬৬ সালে এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার উদ্দেশ্যকে ঘোষণা করে এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে এই তিনটি সংগঠন ‘উন্নয়ন সাহায্যে’র নামে বিভিন্ন সময় ‘দাতা’, ‘ত্রাতা’র ভূমিকা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশেসহ বিশ্বের বহুদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-অর্থনীতি, কৃষি-শিল্প-অবকাঠামো-শিক্ষা-পরিবেশসহ সকল খাতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে মুনাফার যন্ত্রে পরিণত করেছে এবং করছে। এই দুবৃর্ত্তায়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। সংহতি প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি গণট্রাইব্যুনাল’ বইটি বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পাট, জ্বালানি খাতে এই ত্রয়ী প্রতিষ্ঠান যে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা রেখেছে তার একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণমূলক প্রামাণ্য দলিল।
বিশ্বের অধিকার সচেতন, বিবেকবান মানুষেরা বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কৃষি, শিল্প ও পরিবেশ ধ্বংস করে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা স্ফীতি বাড়াতে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো যে নয়া ঔপনিবেশিক ধারা তৈরী করছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এই বিষয়ে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশেও এই উদ্দেশ্যে একটি গণআদালতের আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে বাংলাদেশের গণমানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন। জনগণের পক্ষে এই ট্রাইব্যুনালে সাতটি খাতে (বইটির ব্যাক কভার ও শুরুতে সম্ভবতঃ ভুলক্রমে লেখা হয়েছে ছয়টি খাতে) বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপন করা হয়। এই বইটিতে সেই ট্রাইব্যুনালের বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে যা এই দেশের জনসাধারণকে উন্নয়নের বাহক বা কখনও কখনও প্রভু হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যে একটি আপাত প্রচার সর্বস্ব অবস্থান আছে তা খণ্ডাতে সহায়তা করবে।
অভিযোগের ক্ষেত্র হিসেবে ‘বাংলাদেশে কৃষিখাত’ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী এবং বাংলাদেশ কৃষক-মজুর সংহতির আহ্বায়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কৃষি, ভূমি. পানি ও সামগ্রিক প্রতিবেশগত বিপর্যয়, অপ্রয়োজনীয় ঋণের বোঝা ও সুদ পরিশোধের জন্য বিপুল অর্থ পাচার,জাতীয় সক্ষমতা ধ্বংস, স্থানীয় জ্ঞান ও কর্তৃত্ব থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করে কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্য কায়েমের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকে সেচ, উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বিতরণ, বাজারজাতকরণসহ বিভিন্ন কৌশলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কী করে কৃষি ও কৃষকের বিপর্যয় ঘটিয়েছে তা এখানে সংক্ষেপে তথ্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ উত্থাপনকারী বলেছেন,
“বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও তাদের সহযোগী গংদের বিভিন্ন সময়ের পরামর্শ, নীতি, প্রকল্প, সংস্কার কর্মসূচি, ঋণ, চাপ বাংলাদেশের কৃষি, মাটি, পানি সহ সামগ্রিক প্রতিবেশকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। বিপুল সংখ্যক জনগণ এর সরাসরি ভুক্তভোগী এবং সারা দেশের জনগণই এই ক্ষতির শিকার। পরিহাসের বিষয় হলো, এই সব বিপর্যয় ও ক্ষতিই আবার সাধিত হয়েছে ‘উন্নয়নের’ নামে।” (পৃ.১৪)
‘বাংলাদেশের শিল্পখাত’ নিয়ে জনগণের পক্ষে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম.এম.আকাশ। অভিযোগের শুরুতেই তিনি বলেছেন,
“বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী চক্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রয়ত্ত শিল্পখাতকে সচেতনভাবে ধ্বংস করেছে এবং তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারকে তথাকথিত সাহায্যের প্রলোভন অথবা সাহায্য প্রত্যাহারের হুমকি প্রদান করেছে। তাছাড়া শর্ত-যুক্ত সাহায্যের অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে। প্রত্যক্ষ আদেশ নির্দেশ দিয়েছে। সার্বভৌমত্ব লংঘন করে ব্ল্যাকমেইল করে ভুল ও ক্ষতিকর এই নীতি আমাদের দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। ”(পৃ.২০)
তিনি এ প্রসঙ্গে কাঠামোগত সংস্কর কর্মসূচি (স্যাপ), সোনালি করমর্দন (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক), বিরাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদির মাধ্যমে কী করে শ্রমিকদের শক্তিকে পদদলিত করে শিল্পখাত হরিলুটের ক্ষেত্র তৈরী করা হয়েছে এই প্রসঙ্গগুলো আলোচনা করেছেন। সেই সাথে বিভিন্ন ভুল তথ্য দিয়ে প্রচারণা (যেমন, ভর্তুকি তুলে দিলে সেই টাকা দিয়ে ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব) করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অবাধ আমদানি নীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অভিযোগ উত্থাপনকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহ দেশীয় যে কর্তাব্যক্তিরা এখানে অংশ নিয়েছেন তাদেরও বিচার দাবী করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড.মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অপতৎরতা প্রসঙ্গে অভিযোগ এনেছেন। আর্থিক খাত সংস্কার, বাণিজ্যিক ব্যাংক পুনর্গঠন, বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কার প্রকল্পের নামে যে বিপুল অর্থের অপচয় এবং সম্পদের ক্ষতি হয়েছে সেই বিষয়গুলো তিনি তাঁর অভিযোগনামায় তুলে ধরেছেন। এই সংস্থাগুলোর পরামর্শে (বা নির্দেশে) ব্যাংকগুলোর যে প্রাইভেটাইজেশন (বিরাষ্ট্রীয়করণ, ব্যক্তিমালিকানা) করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
“ তারা (প্রাইভেট ব্যাংক) মূলত বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের মাঝখানে সঞ্চয়ের পরিবহনের প্রশ্নে শহরমুখী প্রবাহের একটি পরিবাহীর ভূমিকায়, বিনষ্ট রাজনীতিতে সুবিধাপ্রাপ্ত বাণিজ্যসৃষ্ট (বৈধ বাণিজ্য এবং চোরাকারবারী) ক্ষুদ্র, একটা ভোগীশ্রেণীর অনুকূলে এবং রাজনৈতিক দলসমূহের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেন।... তারা মানি লন্ডারিং এবং পুঁজি স্থানান্তরও সম্পন্ন করে থাকেন। ”(পৃ.২৬-২৭)
বাংলাদেশের পাটখাত ধ্বংসের পিছনে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের পক্ষে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন সেন্টার ফর ল’ রিসার্চ এন্ড সাপোর্ট এর আহ্বায়ক শাহ আলম। পাট খাত, পাটের শ্রমিকদের জীবনের নানা বঞ্চণার সাথে দীর্ঘসময় থেকেই সাম্র্জ্যাবাদী শক্তি ও আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক জড়িত। লেখক বলেছেন,
“... পাটের ন্যায্য দাম হতে বঞ্চিত হতো বলে ও পাটশিল্প শ্রমিক-কর্মচারী স্বীয় দুর্ভোগ হতে মুক্তিলাভে এবং ব্যাপক জনগণের স্বার্থের প্রতিবন্ধক মর্মে আই.এম.এফ.-বিশ্বব্যাংকের শর্তাধীন ক্লায়েন্ট ও আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক মিত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করা সহ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, বিশ্বব্যাংকের ঋণের বাজার সংরক্ষণ ও পুঁজিবাদী স্বার্থের হেতুবাদে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানী খুনী বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন-সাহায্য ও সহযোগিতাকারী বিশ্ব পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকা স্বীয় পুঁজিবাদী স্বার্থে এবং ১৯৭১ সালের পরাজয়ের বদলা নিতে বাংলাদেশের সাংবিধানিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস ও নির্র্মূলীকরণে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অনুঘটক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ও বৈদেশিক ম্দ্রুা আয়ের প্রধানতম পণ্য- পাট ও পাটশিল্পকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে নানাবিধ চক্রান্ত অব্যাহত রাখে।” (পৃ.৩০)
পুঁজিবাদীদের স্বার্থে কী করে আমাদের পাটশিল্প ধীরে ধীরে লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে এবং অনেক সম্ভাবনাগুলোকে কী করে হত্যা করা হয়েছে, দক্ষতার ব্যবহার করার সুযোগ না দিয়ে নিম্নজাতের বীজের অনুপ্রবেশ করিয়ে পাটশিল্প এবং এ খাতে জড়িত শ্রমিকদেরকে বঞ্ছণা করা হয়েছে তার বিবরণ এই অভিযোগনামাতে আনা হয়েছে।
মানুষের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় খাত স্বাস্থ্য, এই খাতকে ‘মুনাফালোভী বাজারমুখী’ করার যে কৌশল বিশ্বব্যাংক সহ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে ও চাপে বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে নেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে অভিযোগ এনেছেন চিকিৎসক সংসদের সহ-সভাপতি ডা.মুশতাক হোসেন। তিনি যথার্থভাবে বলেছেন,
“বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন মাপা হয় ক’জন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয় তা দিয়ে, কিন্তু চিকিৎসার ফলাফল কী দাঁড়ালো তা মাপা হয় না। ফলে টাকা খরচ ও মুনাফার হিসাব-নিকাশ সহজ হয়, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন হল কিনা তা নিশ্চিত হয় না।” (পৃ.৩৯)
জনসম্পদ সৃষ্টি, মানুষকে অধিকার সচেতন করে একটি গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বব্যাংকের নানা পরামর্শ ও চাপ আর এই অভিযোগগুলোই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল(বাসদ) এর কেন্দ্রীয় বর্ধিত ফোরামের সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ তুলেছেন। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা (আর এন.জি.ও.র মাধ্যমে ‘শিক্ষার সুযোগ’ প্রদান, এখানে শিক্ষা অধিকার নয়, সুযোগ এমত ধারণা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস), নানা প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় বিভিন্ন অভিযোগ তথ্যসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষাকে চক্রান্ত করে একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা, মুনাফালোভী ব্যবস্থায় পরিণত করার কৌশল হিসেবে অভিযোগকারী বিশ্বব্যাংকের কয়েকটি কৌশল তুলে ধরেছেন,
“সরকারি বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে স্ব আয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রতিষ্ঠিত করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহকে সন্ত্রাসের আখড়া উল্লেখ করে আবাসন ব্যবস্থা প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়সমূহ যেমন: সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি পড়ানো বন্ধ করে ফ্যাশন ডিজাইন, ক্যাটারিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট এন্ড ট্যুরিজম জাতীয় মুনাফা ভিত্তিক বিষয়সমূহ পড়ানো হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন রাখা যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর মঞ্জুরি কমিশনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ও গবেষণার বিষয়বস্তু - মুনাফালোভী সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতা অনুসারে নির্ধারণ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না। যা বাংলাদেশের সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।
প্রক্টরের নেতৃত্বে ক্যাম্পাস পুলিশ গঠন করতে হবে, (যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাত্র আন্দোলন দমন করা), ইত্যাদি।” (পৃ.৪৬)
“‘বিদেশী সাহায্য’ ‘টেকনিক্যাল এসিসট্যান্স’, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’, ‘রুটিন এডভাইজ’ ইত্যাদি একটি মাধ্যম ব্যবহার করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি কীভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাধারণ সম্পত্তি, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিপর্যস্ত করে ও জাতীয় সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির দখলে নিয়ে যায় তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ বাংলাদেশের জ্বালানি খাত।” (পৃ.৫১)
এই কথাগুলো দিয়েই ‘বাংলাদেশের জ্বালানি খাত ও জাতীয় সক্ষমতা’ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও তাদের সহযোগী গংদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অভিযোগপত্রে দেখানো হয়েছে কী হয়েছে কী করে বহুজাতিক কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ একই ভাবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের জনগণ যে জ্বালানি সম্পদের মালিক সেই সম্পদের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে, নানা মিথ্যা অজুহাত, দুর্নীতির মাধ্যমে সেই সম্পদকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্তগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। এই চক্রান্তের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো ধ্বংস হচ্ছে। অভিযোগকারী খুব গুরুত্বের সাথে বলেছেন,
“বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বহুজাতিক কোম্পানিগুলির পাওনা পরিশোধের জন্য সরকারকে চাপ দিতে কখনও ক্ষান্ত হয়নি। কিন্তু যেসব সংস্থার হাতে দেশের গ্যাসব্লকগুলো তুলে দেবার জন্য তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থা সবসময়ই নীরব ছিল। এই দুই বিষ্ফোরণের ঘটনায় যে ক্ষতিপূরণ পাবার কথা তা বিশ্বব্যাংক-এডিবির সম্মিলিত ঋণ অনুদানের প্রায় তিনগুণ। অর্থাৎ এই ক্ষতিপূরণ টাকা আদায় করলে ঋণজাল থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে সম্পূর্ণ সচল ও স্বনির্ভর করতে সক্ষম।” (পৃ.৫৫)
উপনিবেশ-উত্তরকালে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের খবরদারি, প্রভুত্ব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বপুঁজি, সাম্রাজ্যবাদীগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছে আর যার বিনিময়ে বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীর সম্পদ ও সম্ভাবনাগুলো ধ্বংস ও নিষ্পেষিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাসমূহ কেবলমাত্র যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ, প্রযুক্তি, কারিগরি সহায়তা, বুদ্ধি পরামর্শ প্রদান করে তা নয়, আমাদের অনেকের চিন্তা-চেতনাতেও তাদের নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। বিশ্বব্যাংক বা ‘দাতা’রা কী বলল, তারা সাহায্য বন্ধ করলে কী হবে, তারা সন্তুষ্ট কি না - এমন হাহাকার করতে দেখা যায়। আবার, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ‘সাহায্য প্রদান’, ‘ঋণ সাহায্য’ করছে এমন ঘটনা ফলাও করে প্রচার করা হয়, অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা খুব গর্ব করে তা ঘোষণা করে। কিন্তু এর অন্তরালে যে ভয়াবহ, সর্বনাশা একটি কৌশল আসছে তা নিয়ে গণমানুষের জাগরণ, সচেতনতা অতি আবশ্যক। এই জাগরণ ঘটাতে, চিন্তা-চেতনাকে শাণিত করতে ‘বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি গণট্রাইব্যুনাল’ বইটি সাহায্য করবে। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য কিন্তু গভীর চিন্তার-খোরাক জাগাবার প্রয়াস এই বইটি খুব জরুরী পাঠ্য।