শান্তি-শিক্ষা কী?
সামিও শীশ
In peace children bury their parents. War violates the order of nature and causes parents to bury their children. - Herodotus
আজকের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রবিনসন ক্রসোর মতো নিঃসঙ্গ, মানবসমাজ বিবর্জিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হওয়া প্রায় অসম্ভব। অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংঘটিত ঘটনাবলী থেকে ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক গঠন ও বিকাশকে প্রভাবমুক্ত করে রাখা যায় না। এমনকি, মানুষের সঙ্গ ছাড়া দিন-যাপন করতে চাইলেও প্রকৃতি, পরিবেশ,প্রতিবেশের ওপর জীবন-যাপনকে নির্ভর করতেই হবে। আর এই জীবন-যাপনে প্রায় অনিবার্যভাবে চলে আসছে সংঘাত-সংঘর্ষ। আবার, সংঘর্ষকে এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (নিজের সাথে নিজের, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, মানুষের সাথে প্রকৃতির, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের) করার প্রচেষ্টাও চলেছে অবিরত। এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে শান্তি-শিক্ষা বা পিস-এডুকেশনের উদ্ভব।
ইংরেজি ‘পিস এডুকেশন’কে যদি আক্ষরিক অনুবাদ করি তবে শব্দটি হয় শান্তি-শিক্ষা। শান্তি-শিক্ষা শব্দটিকে বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন প্রকারের কারক, বিভক্তি ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন, শান্তি-শিক্ষা অর্থ শান্তিকে (কী) শিক্ষা, শান্তির শিক্ষা, শান্তির জন্য শিক্ষা, শান্তি হইতে শিক্ষা। শান্তি শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করতে গেলে এই প্রতিটি শাব্দিক বিশ্লেষণই যথার্থ হয়। শান্তি কী, কী ভাবে শান্তি অর্জন করা যায়, কী করে শান্তিকে রক্ষা করতে হয়, শন্তি থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায় এসবগুলোই শন্তি-শিক্ষার বিষয়বস্তু।
শান্তি অর্জনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সচেতন হয়ে, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে - শন্তি-শিক্ষা তাই প্রত্যাশা করে। একজন চিকিৎসাশাস্ত্রের শিক্ষার্থী যেমন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলবার শিক্ষা নেয়, শান্তি-শিক্ষার শিক্ষার্থীরাও তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কী করে সন্ত্রাস বা নিপীড়নের মাধ্যমে নিরসন না করে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়- সেই শিক্ষা অর্জন করে। সামাজিক সন্ত্রাস, সশস্ত্র য্দ্ধুকে একটি ব্যাধি বা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে, কী করে আলোচনা, অস্ত্র, আতংক, সহিংসতার মাধ্যমে তাকে দমন না করে, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, অহিংসার মাধ্যমে এই সব রোগ হতে আরোগ্য লাভ করা যায়- সেই শিক্ষাই শান্তি-শিক্ষাতে দেওয়া হয়।
শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি অর্থ এডুকেশন। এই এডুকেশন শব্দটি এসেছে লাটিন শব্দ এডুকেয়ার থেকে। এডুকেয়ার শব্দটিকে যদি দুইভাগে ভাগ করি, এডু মানে শেখানো (টিচ) আর কেয়ার মানে যতœ, স্নেহ। আর তাই এই শব্দটির সাথে পিস বা শান্তি যখন যুক্ত হয় তার অর্থ দাঁড়ায় মানুষকে শান্তির মর্ম ও অর্থ উপলব্ধি করিয়ে পরস্পরের মূল্যবোধের প্রতি শ্র্দ্ধাশীল ও সহনশীল হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবে সহাবস্থান করার শিক্ষা। শৈশব থেকে পূর্ণাঙ্গ বয়স যেকোনো সময়ই এই শিক্ষা লাভ ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্র। শান্তি-শিক্ষা তাই মানুষের শক্তি, ক্ষমতা, বিবেক,বুদ্ধি, বোধকে সার্থকভাবে চর্চা করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার নীতি, পন্থা, কৌশল শিক্ষা দেয়।
কী করে সমাজে শান্তি অর্জন করা যায় সেই শিক্ষা প্রচারের সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণীকক্ষে একটি পরমতসহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে শিক্ষাক্রম তৈরী ও চর্চা করা হয় শান্তি-শিক্ষা কার্যক্রমে। আশা করা হয়, এই শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে শান্তি বিষয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটবে এবং তার প্রতিফলন শিক্ষার্থীদের আচরণ এবং চরিত্রে ঘটবে এবং পরস্পরের প্রতি ভালবাসা, যুক্তিবোধ, সহযোগিতার মনোভাব তৈরী হবে। এই গুণাবলীর বিকাশের বিষয়টিকে শান্তি-শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কিন্তু একটু যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাই তবে দেখব দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে সশস্ত্র, সহিংস নীতি, কৌশলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দেওয়া হয় এবং দেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। রাষ্ট্র বা আজকের বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিকভাবে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের পক্ষে জয়গান করার শিক্ষাদান করা হয়। আমাদের ইতিহাসের বইয়ে যুদ্ধ, যোদ্ধাদের নিয়ে যত ব্যাপক আলোচনা করা হয়, শান্তি-প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা সংগ্রাম করেছে তাদের কথা তত আলোচিত হয় না, অনেক সময় উপেক্ষাও করা হয়। সামরিক শক্তিকে সমীহ ও অস্ত্রের আধিপত্যকে চিরন্তন হিসেবে ধরে নেওয়ার জন্যে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়া হয়। পাশাপাশি সহিংসতা, মারামারিতে ভরা বিভিন্ন মিডিয়া অনুষ্ঠান বা গেমকে শিশুদের কাছে অতি সহজলভ্য করে তোলা হয়- এটিকে উপস্থাপিত করা হয় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। এই সহিংস, নৃশংস কাজগুলোকে প্রশ্ন করার শিক্ষা কিন্তু দেওয়া হয় না। শান্তি-শিক্ষা এই বিষয়গুলোকেই প্রশ্ন করার শিক্ষা দেয়, যেন সশস্ত্র, সহিংস, সামরিক দমন নীতি অনুসরণ না করেও রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সংঘাতগুলোকে নিরসন করা যায়।
শন্তি-শিক্ষার একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে দেখা যাবে ব্যক্তি, কাল এবং তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। যেমন, ইউরোপীয় শান্তি-শিক্ষাবিদ স্টেহার ভর তাঁর ঊফঁপধঃরড়হ ভড়ৎ চবধপব ধহফ ঝড়পরধষ ঔঁংঃরপব প্রবন্ধে লিখেছেন, দদঞযব রহরঃরধঃরড়হ ড়ভ ষবধৎহরহম ঢ়ৎড়পবংংবং ধরসরহম ধঃ ঃযব ধপঃঁধষরুধঃরড়হ ধহফ ৎধঃরড়হধষ ৎবংড়ষঁঃরড়হ ড়ভ পড়হভষরপঃং ৎবমধৎফরহম সধহ ধং ংঁনলবপঃ ড়ভ ধপঃরড়হ”। তিনি এভাবেই প্রথম দিককার পর্যায়ের স্কান্ডেনিভিয়ান দেশগুলোর শান্তি শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেন। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী শান্তি-শিক্ষা সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার কৌশল শেখায়। আবার “চবধপব জবংবধৎপয ধহফ ঊফঁপধঃরড়হ রহ ধ এষড়নধষ চবৎংঢ়বপঃরাব” প্রবন্ধে জাপানি শান্তি-শিক্ষাবিদ মুশাকোজি বলেছেন, “ চবধপব বফঁপধঃরড়হ রং পড়হপবৎহবফ রিঃয ঢ়বধপবষবংং ংরঃঁধঃরড়হং.” আর এই শান্তিহীন অবস্থা বুঝাতে তিনি ক্ষমতা, সম্পদের জন্য সংঘর্ষ, আদিবাসীদের সাথে সংঘাত, শিশু নির্যাতন, যুদ্ধ পরিস্থিতি ইত্যাদির কথা বলেছেন আর শান্তি-শিক্ষাতে এই সংঘাত সৃষ্টিতে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে এবং তার পক্ষে সমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা করে -তাদের বিষয়ে অধ্যয়ন করা হয়। আমেরিকান শান্তি-শিক্ষাবিদ বেট্টি রেয়ারডন শান্তি-শিক্ষা বিষয়ে বলেছেন, “...... ষবধৎহরহম রহঃবহফবফ ঃড় ঢ়ৎবঢ়ধৎব ঃযব ষবধৎহবৎং ঃড় পড়হঃৎরনঁঃব ঃড়ধিৎফ ঃযব ধপযরবাবসবহঃ ড়ভ ঢ়বধপব”. নিরাপত্তার অজুহাতে যুদ্ধ, সংঘাতের ঘটাবার বিষয়টিকে সমালোচনা করে তিনি প্রকৃত নিরাপত্তা কী সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়া পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোগতভাবেই যুদ্ধ আর সংঘর্ষের কারণ এ অভিমত তিনি দিয়েছেন।
নিরাপত্তার প্রশ্ন বা ক্ষেত্র বিশেষে অজুহাত নিয়ে নানা ধরনের প্রচার চলে, আর সে কারণে শান্তির উপায় কী তা নিয়েও থাকে ভিন্ন ভিন্ন মত। ইসরায়েলের শিক্ষাবিদ সালোমান তাঁর ঞযব হধঃঁৎব ড়ভ ঢ়বধপব বফঁপধঃরড়হ: ঘড়ঃ ধষষ ঢ়ৎড়মৎধসং ধৎব পৎবধঃবফ বয়ঁধষ প্রবন্ধে বলেন যে সংঘর্ষের প্রকৃতি যেহেতু ভিন্ন, তাই শান্তি-শিক্ষার প্রকৃতিও হবে ভিন্ন । প্রতিটি সংঘর্ষ নিরসনের জন্য প্রয়োজন সংঘর্ষের স্বরূপ অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আর এর কৌশলও হতে হবে সংঘর্ষভেদে পৃথক। যে কোনো সংঘর্ষ বা যুদ্ধ বাঁধাবার জন্যে শত্র“ সম্বন্ধে একটি চিত্র বা ইমেজ তৈরী করা হয়, সে রহস্যভেদ করার মাধ্যমে যুদ্ধ বাঁধানো বা যুদ্ধংদেহী অবস্থা বা মনোভাবকে ঠেকানো যায়। যেখানে জাতিগত দ্বন্দ্ব, দাঙ্গা বা সংঘর্ষ রয়েছে সেখানে এই সংঘাতে পরস্পরের ক্ষতির ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরে শত্র“ভাবাপন্ন মনোভাবকে নিরসন করে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হতে পারে। শান্তি- শিক্ষার কর্মীরা সংঘাতের ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরে এর মূল কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পরিবেশ রক্ষা করার কথা বলেন এবং অহিংস নীতি ও কৌশলের শক্তি কতটা তা মানুষকে উপলব্ধি করানো চেষ্টা করেন।
পেশাভেদেও শান্তি-শিক্ষা বিষয়বস্তুর মাঝে তারতম্য ঘটে। সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক জীবনের সংঘাত নিরসনকে শান্তি-শিক্ষার বিষয় মনে করবেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলবেন বিশ্বরাজনীতির নানা দ্বন্দ্ব, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে এ শিক্ষার আলোচ্য বিষয়। মনোবিজ্ঞানীদের কাছে মানুষের মনের মাঝে থাকা হিংস্র বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ ও সমাজে নৃশংসতা ঘটে এবং তা অধ্যয়ন ও নিরসন করাই শান্তি-শিক্ষার বিষয়। নৃতাত্ত্বিকেরা তর্ক করেন যে সংহিংস ও অহিংস ব্যবহার সমাজের মানুষের সম্মিলিত চেতনার প্রতিফলন আর তা শান্তি-শিক্ষার বিষয়বস্তুও তাকে অনুসরণ করে নির্দিষ্ট হবে। আবার, ইতিহাসবিদেরা মানুষের শান্তি আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবেন। সাহিত্যের অধ্যাপকেরা শিল্প, সাহিত্যের মাঝে শান্তির বাণী খুঁজে পান। শিক্ষাবিদেরা শিশুদের শৈশব থেকে শান্তি-শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বিদ্যালয়ে শান্তি-শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন।
শান্তি-শিক্ষা একটি সমন্বিত উদ্যোগ। মানুষের নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, সমাজ, অর্থনীতি, ইতিহাস, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ এরা সকলেই শান্তি-শিক্ষার জন্য অধ্যয়ন করার বিষয়। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে য্দ্ধু, সংঘাত, সামরিক বাহিনী, নিরাপত্তা বিষয়ে যে সকল ধারণা শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও মননে তৈরী হয়, তা থেকে ভিন্ন একটি ধারণা সৃষ্টি করে সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষা নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে জীবন-ধারণ করার জন্য শান্তি-শিক্ষার উদ্ভব। শান্তি-শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।