পেশা বলতে তেমন কিছু নেই। মোটা বেতনের একটা সরকারী চাকরী ছিলো। কিছুদিন টাকা জমিয়ে সে চাকরী ছেড়ে দিলেন তিনি। সবাই বললো, আরে করলে কি? করলে কি? সরকারী চাকরী কেউ ছাড়ে? ফকর সাহেব বললেন, নটা পাঁচটা চাকরগিরী আমি করতে পারবো না। বাংলাদেশ স্বাধীন, আমিও স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাই। যে টাকা জমিয়েছেন তা দিয়ে খাওয়া দাওয়া, ঘুরাফেরা আর বই। কিশোর বয়সে মঞ্চে অভিনয় করতেন সে ভূতটা একেবারে ঘার থেকে নামেনি তার। তবে এখন আর মঞ্চে নয়, আশে পাশের বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে সিনেমা বানান। কোন সিনেমাই এখনো হিট হয়নি। সব ফ্লপ ছবির নিজেই পরিচালক, নিজেই প্রযোজক। যাদের সাথে তার পরিচয় হয় জোর করে তাদের ধরে নায়ক নায়িকা বানিয়ে দেন।
সিলেট শহরে নতুন বই এর দোকান হয়েছে, “বাতিঘর”। নামের মতোই সুন্দর বাতিঘর। চারদিকে নতুন বইয়ের মো মো গন্ধ। সারাদিন টুল নিয়ে এই দোকানে বসে থাকেন ফকর সাহেব। সিলেটের আরেকটা বই এর দোকানে তাকে প্রায়ই দেখা যেতো। দোকানটার নাম “বইপত্র”। বাতিঘর আসার আগে বইপত্রের মেঝেতে ঠেলা মেরে বসে বসে বই পড়তেন ফকর সাহেব। এখন বইপত্রে তেমন যাননা তিনি। আজ কেন জানি বইপত্রে যেতে মন চাইলো। বইপত্রের মালিক শুভেন্দু ইমাম তার পূর্ব পরিচিত। নিজের পারিবারিক নাম বদলে তিনি অসাম্প্রদায়িক নাম গ্রহণ করেছেন। এজন্য ফকর সাহেব শুভেন্দু ইমামকে খুব শ্রদ্ধা করেন। হিংসা বিদ্বেষ ভরা সমাজে এখনো কিছু আলোকিত মানুষ বেঁচে আছেন বলে পৃথিবীটা এখনো ধ্বংস হয়ে যায়নি।
বইপত্রে বই ঘাটতে ঘাটতে ফকর চৌধুরীর মনে হলো একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটু শিওর হবার জন্য মুখ তুললেন লোকটার দিকে। গোলগাল চেহারা, চোখ ছোট ছোট করে মিটিমিটি হাসছে লোকটা। তাকাতেই ফকর সাহেবকে বললো, “ভাইজান কি আমাকে চিনতে পারছেন না?” ফকর সাহেব চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলেন। নাহ্ সত্যিই চিনতে পারলেন না। লোকটা আবার আগ বাড়িয়ে কথা বললো, “অবশ্য আপনি কত বড় মানুষ। সিনেমা পরিচালক। আমাকে না চেনারই কথা।” অপ্রস্তুত হয়ে ফকর সাহেব বললেন, “আপনি কি আমাকে বলছেন?” আজকাল সত্যি সত্যি মানুষের নাম মনে থাকেনা ফকর চৌধুরীর। কিন্তু চেহারা মনে থাকে। কিন্তু এ লোকটাকে সত্যি মনে করতে পারছেন না তিনি। ভদ্রলোক কিঞ্চিত বিনয়ী হয়ে বললেন, “দুবছর আগে আপনি ভারতবর্ষ গেলেন। তখন হিমালয় প্রদেশে যাবার সময় আমার গাড়িতেই তো উঠেছিলেন। আপনাকে মানালির বাসটাতে আমিই উঠিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নেই? আমার নাম ছিদাম। ছিদাম লস্কর।”
“হিমালয়? মানালি?” বিরবির করছেন ফকর। তারপর একগাল হাসি হেসে বললেন, “উহু! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কোনদিন হিমালয় যাই নি। হিমালয় কেন? ভারতেই যাইনি। আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আপনি বোধহয় আমাকে অন্য কেউ ভেবে বসেছেন।” এবার একটু অবাক হলো লোকটা। ভ্রু কুচকে বললো, “কি বলেন ভাইজান। এই ছিদাম লস্কর আপনাকে চিনতে ভুল করবে না। আপনারা কত মজা করলেন আমার টেক্সিতে। আপনার একটা কাছের বন্ধু কি যেন নাম, ও হ্যাঁ পায়েল পায়েল। ভুলভাল হিন্দীতে কথা বলছিলো। সে নিয়ে আপনি আর আরেকটা বন্ধু কি যেন নাম। হ্যাঁ হ্যাঁ পাপ্পু পাপ্পু। আপনারা কত হাসাহাসি করলেন। আরেক বন্ধু প্রীতম তালুকদার সে শুধু ট্যাক্সির পেছনে ঘুমাচ্ছিলো। আপনি ফকর চৌধুরী না?” ফকর সাহেব ফ্রিজের মতো জমে গেলেন। বিষ্ময়ে তার চোখ যেন বেড়িয়ে যাবে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “২০১৭ সালের কথা বলছেন তো? ঠিক কোন মাসে আমাদের দেখা হয়েছে বলতে পারবেন?” গোলগাল লোকটা একটু ভেবে বললো, “এপ্রিল মাসে আপনারা ভারত গিয়েছিলেন। ঝড় বৃষ্টির সিজন ছিলো। আসামে গিয়ে আপনারা বৃষ্টির কবলে পড়লেন। হোটেল খোঁজে পাচ্ছিলেন না বলে, স্টেশনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আপনার কি একেবারে মনে নেই?” স্বস্থির হাসি হাসলেন ফকর সাহেব, “না না ভাই। আপনার সত্যিই ভুল হচ্ছে। এপ্রিল মাস আমার জন্মমাস। এ মাসে আমি ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই না। তাছাড়া এতোবড় একটা ঘটনা। হিমালয় ভ্রমণ! অন্য আরেকটা দেশ। এই ঘটনা আমার জীবনে ঘটবে, আর আমি মনে রাখবো না, তা কি করে হয়?” বইপত্র থেকে বই না কিনেই ফকর চৌধুরী বেড়িয়ে যাচ্ছেন। ছিদাম লষ্কর নামের লোকটি ফ্যালফ্যাল করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
জিন্দাবাজার পয়েন্টে অনেক ভীর। সিলেটে আজকাল ঘরে ফেরার জন্য রিকশা পাওয়া যায় না। দূর্বল গলায় ফকর চৌধুরী রিকশা ডাকছেন কিন্তু কোন রিকশা থামছে না। ভাড়া দ্বিগুন দেবেন বলে একটা রিকশা পাওয়া গেলো। রিকশায় উঠেই ভাবনার আকাশ তার মাথার উপর বনবন করে ঘুরছে। কে এই ছিদাম? ভন্ড মানুষে দেশ ভরে গেছে। কিন্তু পায়েল, পাপ্পু, প্রীতমের নাম বললো কি করে? মিছেমিছি গল্পটা বললোই বা কেন? দুই বছর আগের স্মৃতি, ভুলে যাবার তো কথা না। তাহলে কি তার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। মাথাটা কেমন যেন চক্কর মারছে।
তার খুব কাছের বন্ধু ছিলো পায়েল সরকার। কবিতা সংঘ করতো দুজন। ছোট্ট একটা কবিতা নিয়েই একবার গ্যাঞ্জাম বেঁধে গেলো। ঘর সংসার নিয়ে সে সুখে আছে। ছোট গ্যাঞ্জাম না মেটাতে মেটাতে বড় দেয়াল হয়ে গেছে। এ দেয়াল আর ভাঙেন। পায়েলের সাথে যোগাযোগ হয় না বহুদিন। পাপ্পু শহরের নামকরা ব্যবসায়ী। ঠিকাদারী করে কোটিপতি হবার পর খাইরুল আলম পাপ্পু বদলে তার নাম হয়ে গেলো পাপ্পু ঠিকাদার। প্রীতমের খোঁজ নেই বহুদিন। শেষবার যখন কথা হলো সে পাকাপাকি ভাবে ইউরোপ যাবার চিন্তা করছিলো। কে জানে, এতো দিনে হয়তো চলেই গেছে। ফকর চৌধুরী আজকাল কারো সাথেই মিশে না। কারো সাতে নেই, পাঁচে নেই। মানুষের ভীরে থাকতে থাকতে মানুষের প্রতি তার অরূচী ধরে গেছে। একা একাই থাকছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা তাকে টেনশনে ফেলে দিলো।
ঘরে ঢুকেই ফ্রিজ থেকে বের করে ঢকঢক করে দুই গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলো। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে আরাম কেদারায় হেলান দিলো। লোকটা তার কাছে শুধু শুধু একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলবে কেন? নাকি তার কোথাও ভুল হচ্ছে? এতো বড় একটা স্মৃতি বেমালুম ভুলে যাবে? পুরনো একটা বই খুলে পড়ায় মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো ফকর চৌধুরী। দুই পাতা পড়েই আবার বইপত্র দোকানের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ছিদাম লস্কর কি করে এতো সুন্দর একটা গল্প বলতে পারলো। গল্পটা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। নাড়ি-নক্ষত্রসহ মনে হলো ঘটনাটা বলে দিলো। সবচে আশ্চর্য্য লাগলো পায়েল, পাপ্পু, প্রীতমের নাম শুনে। আচ্ছা মাঝখান থেকে বইয়ের পাতা মাঝে মাঝে ছিড়ে যাওয়ার মতো কি মানুষের ব্রেইনও কিছু স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়? সে কি সত্যি হিমালয় গিয়েছিলো তার তিন বন্ধুর সাথে? মনে পড়ছে না কেন!
বই এ আর মন দিতে পারছেন না ফকর চৌধুরী। পাশের ঘর থেকে মোবাইল এনে পাপ্পুর নম্বরে ফোন করলো।
-হ্যালো পাপ্পু কেমন আছো?
-আরে ফকর ভাই, কত মাস পর তোমার গলাটা শুনলাম।
বন্ধুর মতো হলেও পাপ্পু ফকর চৌধুরীর কয়েক বছরের ছোট। সম্মান করে এখনো সে ভাই বলে ডাকে।
-আছি ভালো। ব্যবসাপাতি কেমন চলে?
-ভাই, আমার জীবন কামলার জীবন। একটুও শান্তি পাই না। টাকাই কি সব, বলো ভাই? তোমাকে দেখলে হিংসা হয়। নিজের জীবনটা নিজের মতো করে উপভোগ করছো।
-আরে না না। টাকার দরকার আছে।
একটু কেশে নরম গলায় ফকর সাহেব পাপ্পু ঠিকাদারকে জিজ্ঞেস করলেন
-আচ্ছা পাপ্পু একটা দরকারে তোমাকে কল করেছি।
-কি যে বললে ভাই, জীবন তো আমার ধন্য হয়ে গেলো। কোনদিন তুমি আমার কাছে দরকারে ফোন দাওনি। বলো কি দরকার? এই পাপ্পু তোমার জন্য জীবন দিয়ে দিবে।
-আরে না না। জীবন দিতে হবে না। একটা বিষয় জানতে চাইছিলাম।
-অ্যা! কি বিষয়? অ বুঝেছি বুঝেছি। আবার নতুন নাটকে হাত দিয়েছো? তোমার লাস্ট নাটকটা দেখেছি ইউটিউবে। উফ্ কি সুন্দর নায়িকা। কোমরটা যে সুন্দর ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে হাঁটে ভাই। মাথা আউলা হয়ে যায়। কই পাও এসব।
-অইটা নাটক না গাধা। অইটা শর্টফিল্ম।
-অই একই কথা। আচ্ছা বলো ভাই, কি যেন জানতে চাও।
-আচ্ছা পাপ্পু দুই বছর আগে। মানে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তুমি আমি মানে পায়েল, প্রীতমসহ আমরা কি ভারত ঘুরতে গিয়েছিলাম? মানে ভারতের হিমাচল গিয়েছিলাম।
-অ ভাই, কি হইছে তোমার? তুমি কি দিন দুপুরে মদ নিয়ে বসেছো? এটা কোন কথা বললা ভাই? অত ঘনঘন মদ খেওনা ভাই, শরীর খারাপ করবে। আমার কাছে একটা বিদেশী মাল আছে। জ্যাক ডেনিয়েলস্। দুদিন পর আসবো তোমার বাসায়। তারপর দুই ভাই মিলে মজা করে খাবো নে।
-না না পাপ্পু। আমি ড্রাংক না। সিরিয়াসলি বলো না, আমরা কি কোনদিন মানালি গিয়েছিলাম বরফ ধরতে?
-ফকর ভাই আর মশকরা করো না। সেই ট্যুরের কথা কি ভুলতে পারি? গোয়াহাটি গিয়ে দেখি হিমাচলের ট্রেন নাই। তারপর আমরা দিল্লী গেলাম। কুতুম মিনার দেখলাম। কতকিছু দেখার পর হিমাচল গেলাম। মানালিতে বরফ খেলতে গিয়ে তোমার উপর পাথর উঠে গিয়েছিলো, মনে নাই? পেটের কাছে কেটে কুটে অস্থির অবস্থা। সেই কি রক্ত! তারপর ফেরার সময় কত মজা হলো। ভুলে গেলা?
ফকর সাহেব আর শুনলেন না, খটাশ করে ফোনটা কাটলেন। ফোন রেখেই শার্ট উঁচু করে পেট দেখলেন। পেটের ডান দিতে একটা কাটা দাগ আছে সত্য। কিন্তু এটা তো এপেন্ডিসাইট অপারেশনের কাঁটাদাগ। নাকি মানালির বরফের পাথরে আঘাত পাওয়া কাঁটা দাগ। সত্যি সত্যি কি ফকর চৌধুরী ঘটনাটা ভুলে গেলো? তার ব্রেইন কি স্মৃতিটা মুছে দিয়েছে। কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। ডাক্তারকে একটা কল করা দরকার। তখনি মন্দিরে ঘন্টা বাজার মতো ঢং করে দরজায় বেল পড়লো। দরজার বেলে পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠলো যেন। আস্তে করে দরজাটা খুললেন ফকর চৌধুরী। ফুল হাতে মিসেস নুসরাত সুলতানা দাঁড়িয়ে আছেন।
নুসরাত সুলতানা স্বামী হারিয়েছেন একবছর হলো। কিন্তু মুখের মেকাপ দেখে উপায় নেই তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর কষ্টে আছেন। ফকর চৌধুরীর বাসায় তিনি নিয়মিত আসেন। বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট কেউ বাসায় চলে আসলে ফকর চৌধুরী এমনিতেই বিরক্ত হন। তিনি একটু একা থাকতে চান, অযাচিত অতিথি তার একদম অপছন্দ। নুসরাত সুলতানাকেও তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না। মেয়েরা সিম্পল সাজে সুন্দর। কিন্তু অদ্ভুত কারণে মিসেস নুসরাত ভারী মেকাপ নিয়ে ফকর চৌধুরীর বাসায় আসেন। নুসরাত সুলতানার গলা ফ্যাসফ্যাসে, মিষ্টি করে কথা বললেও মনে হয় তিনি খুব রেগে রেগে কথা বলছেন। তবে কোন কারণ ছাড়া তিনি ফকর চৌধুরীর বাড়ি আসেন না। গত ক’মাস থেকে তিনি সিনেমায় অভিনয় করার বায়না ধরেছেন। আজ ঘরে ঢুকেই তিনি ফকর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাইয়া কেমন লাগছে আমাকে, সিনেমার নায়িকাদের মতো না? এই শাড়িটা নতুন কিনলাম। কাভি খুশি কাভি গাম ছবিতে কাজল এই শাড়িটা পড়ে নেচেছিলো। আমি একটু স্টাইল করে শাড়িটা পড়লাম। এই দেখুন নাভি দেখা যাচ্ছে।” অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন ফকর সাহেব। নাভীতে তাকাবেন না মুখের দিকে তাকাবেন বুঝতে পারছেন না। নিচের দিকে তাকিয়েই মিসেস নুসরাতকে বললেন, “ইয়ে মানে নুসরাত, আজকে আমার শরীরটা বেশি ভালো নেই। আমরা আরেক দিন গল্প করবো না হয়।” একটু ন্যাকা ন্যাকা চেহারা নিয়ে মিসেস নুসরাত ফকরের দিতে এগিয়ে গেলেন। “আরে তাইতো, কি হয়েছে ফকর ভাই। আপনার চেহারাটা এরকম লাগছে কেন? একটু স্যুপ বানিয়ে দিই।” ফকর সাহেবের মাথায় হুট করে বুদ্ধি এলো। ছিদাম লষ্করের গল্পটা মিসেস নুসরাতের সাথে আলোচনা করলে কেমন হয়।
-না না নুসরাত, স্যুপ লাগবে না। আচ্ছা নুসরাত তোমার কি মনে হয় আমাদের ব্রেইন আমাদের সাথে বিট্রয় করতে পারে? মানে ধরো ব্রেইনের হুট করে মনে হলো সে কোন স্মৃতি জীবন থেকে মুছে দিবে। তা কি সম্ভব?
-কি বলেন এগুলা ভাইয়া। কিছুই তো বুঝলাম না।
-আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি, তুমি কি কোন ঘটনা বা কোন স্মৃতি ভুলে গিয়েছো যা আবার বহুদিন মনে পড়েছে?
শাড়ির আঁচলটা ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়ে বুকের কাছে তুলতে তুলতে নুসরাত বলে,
-চুলায় দুধ গরম করতে দিলে আমি মাঝে মাঝে পাতিলের কথা ভুলে যাই। এর চে বেশি কিছু ভুল আমার হয় না। সব মনে থাকে। আমার ব্রেইন অনেক ভালো। আপনি যদি আমাকে সিনেমায় একটা পার্ট দেন, খুব সুন্দর ডায়লগ ডেলিভারি দিতে পারবো।
ফকর চৌধুরীর চোখ চক চক করে উঠে। দ্বিগুণ উৎসাহে সে এবার নুসরাতকে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা নুসরাত তোমার সাথে পরিচয় আমার কত দিনের?
-এই দুই তিন বছর। তবে এই দুই তিন বছরে আপনাকে আমার চেয়ে কেউ বেশি চিনেনা। আপনার আশে পাশে দেখি কয়েকটা পুচকে ছেলে মেয়ে ঘুরে। এই কদিনেই আপনি তাদের সিনেমার রোল দিয়ে দিলেন। অথচ আমি কত অভাগী। আপনার কাছের-মানুষ হতে পারলাম না ফকর ভাই।
-আরে বাদ দাও তো সিনেমা। আচ্ছা নুসরাত, এই দুই বছরে আমি কি কোনদিন তোমাকে হিমালয় ভ্রমণের গল্প বলেছি। এই ধরো বরফ ধরা, ট্যাক্সি করে ঘুরা, ভারতের মানালি যাওয়া এরকম কিছু?
-হ্যাঁ বলেছেন তো। আপনারা ৪ বন্ধু হিমালয় গিয়ে বরফের পাহাড় দেখেছেন। এস্কিমুদের মতো পোশাক পড়ে বরফে গড়াগড়ি খেয়েছেন।
মিসেস নুসরাতকে থামায় ফকর চৌধুরী। “থাক্ থাক্ আর বলতে হবে না। তুমি এবার এসো, আমার শরীরটা সত্যি ভালো নেই।” নুসরাতকে বিদায় করে তার ব্যক্তিগত ডাক্তার বন্ধু জগলুল হায়দারকে ফোন দিলেন।
-আরে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ফকর চৌধুরীর ফোন। কি খবর বন্ধু? তোর সিনেমায় ডাক্তারের ক্যারেক্টার আছে নাকি?
-জগলু কেমন আছিস?
-এ যুগে সবচে বড় মিথ্যে কি জানিস, ভালো আছি। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে অথবা প্রেমিকার ছ্যাকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছে এরকম লোককেও যদি বলিস, ‘ভাই কেমন আছেন’, সে বলবে, “ভালো আছি”। আরে ব্যাটা মিথ্যে বলার দরকারটা কি। যাই হোক বন্ধু, কেন ফোন দিয়েছিস বলে ফেল্। বিকাল হয়ে এলো আমাকে পপুলার ডায়গনস্ট্রিক সেন্টারে যেতে হবে। বুঝিসই তো রোগীর পেট কেটে কেটেই তো আমাদের সংসারটা চলে।
ফকর সাহেব জগলুল হায়দারকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন। সিদাম লস্কর, পাপ্পু ঠিকাদার, মিসেস নুসরাত কারো কথা বাদ দিলেন না।
-তুই কি কোন বিষয় নিয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে আছিস?
-না না। আমি একদম ঠিক আছে।
-মানে যেভাবে নিজেকে একলা করে ফেলেছিস, ভাবলাম মন টন খারাপ থাকে কি না। অথবা কোন বিষয় নিয়ে প্রেশারে আছিস।
-একদম না। মন চাইলে বই পড়ি না চাইলে শুয়ে থাকি। নতুন কোন প্রোডাকশনেও হাত দিচ্ছি না।
-আসলে কেসটা আমার কাছে একেবারেই নতুন, অভিজ্ঞতার বাইরে।
-যে করেই হোক আমার অসুখটা সাড়িয়ে দে প্লিজ। সারাটা দিন আমার মাথাটা নষ্ট হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবো। যতটাকা লাগে খরচ করবো। প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাবো। তবু অসুখটা..
-আরে দাঁড়া দাঁড়া। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। তুই বহুদিন ঘরে একা একা পড়ে আছিস। এক কাজ কর্ দ্রুত কোথাও থেকে ঘুরে আয়। মানালি যেতে পারিস। সত্যি বলছি! ভারতের হিমালয় প্রদেশ চলে যা। তোকে তো আমি চিনি, পায়েল বা প্রীতমকে জীবনেও নক করবি না। পাপ্পুও ব্যস্ত। বরং তুই একাই ঘুরে আয়। বরফের পাহাড় বা পুরনো লোকেশনগুলো দেখলে স্মৃতিটা মনে পড়তেও পারে।
-বুদ্ধিটা ভালো। আগামী সপ্তাহেই আমি মানালি যাচ্ছি। এ রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
পরের সপ্তাহে ফকর চৌধুরী হিমালয় চলে গেলেন। একা একা পুরো মানালি শহর ঘুরে দেখলেন। রোটাং পাস, সোলাং ভ্যালি সবখানেই গেলেন। ওল্ড মানালিতে বিয়াস নদীর পাশে বসে বিয়ার খেলেন। প্যারাগ্লাইডিং করলেন। আইস স্কেটিং করতে গিয়ে পাথরে মাথা ফাটালেন। তবু তার কোন স্মৃতি মনে পড়লো না। তবে স্মৃতি মনে না পড়লেও তার মনের ভেতর আর অশান্তি রইলো না। প্রকৃতি দেখে খুশি মনে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সাত দিন পর ফকর সাহেব সিলেট ফিরলেন।
ঘরে ঢুকেই দরজার নিচে একটা চিঠি পেলেন।
সাদা খামের উপর লেখা “ব্যক্তিগত ও জরুরী”। হাতের লাগেজ মাটিতে রেখে তিনি চিঠিটা খুললেন।
প্রিয় ফকর ভাই,
প্রিয় না বলে আপনাকে অপ্রিয় বলা উচিত। কারণ আপনার মতো অহংকারী মানুষ আর নাই। অহংকারী মানুষটাকে একটু শাস্তি দিতে আমিই এ কাজটি করেছি। নিজেকে আপনি কি ভাবেন? বিশ্বের সবচে বড় সিনেমা পরিচালক? স্পিলবার্গ, হিচকক, ক্রিস্টোফার নোলান নাকি সত্যজিত রায়? সিনেমাতে একটা ছোট্ট রুলের জন্য আপনার পেছনে কতদিন ঘুরেছি, কত কিছু করেছি। একটুও পাত্তা দিলেন না। অবশেষে আমি মালেক আফসারি ভাই এর দেখা পেয়েছি। তিনি আমাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিবেন। তাই যাবার আগে একটা ছোট্ট প্রতিশোধ নিলাম। বইপত্রের ছিদাম লষ্কর আমার নতুন সিনেমার কো আর্টিস্ট। পাপ্পু ভাইকে এক রাতে গিয়ে কনভিন্স করে ফেলেছি যাতে সাজানো গল্পটা বলে। আপনি থাকুন একা একা আপনার অহংকার নিয়ে।
ইতি
নুসরাত সুলতানা।
চিঠিটা শেষ করে মোবাইলটা খুললেন ফকর সাহেব। সাথে সাথে ডাক্তার জগলুল হায়দারের ফোন।
-কি বন্ধু দেশে ফিরেছিস? কিছু মনে পড়লো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ সব মনে পড়েছে। মানালি গিয়ে পাথরের সাথে বাড়ি খেয়ে সব স্মৃতি ফিরে এসেছে।
-কি বলিস? পাথরের সাথে বাড়ি খেয়ে স্মৃতি ফিরে এসেছে!
-তা আর বলছি কি? শোন জগলু, আমি ফোনটা কাটছি।
ফোন কেটে কাপড় ছেড়ে গোসলখানায় ঢুকলেন ফকর সাহেব। পানি ছেড়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, তিনি কি সত্যি অহংকারী? পায়েলকে একটা ফোন দিতে হবে। বহুদিন তার সাথে আড্ডা হয়না।