সুরমা পুরান ব্রিজের নিচে কয়েকজন নারী দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে কমবয়সী জন শুধু লাল পেটিকোট পরে আছেন। তিনি একটু পরপর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছেন। পাশের নারীটি তাকে ধমকের সুরে বলে উঠলেন- ”ঘরে খাওন নাই, রাস্তায় কাস্টুমার নাই, আরেকজনের শইল্যে হাসি আহে। অতো দেমাক ভালা না।” পেটিকোটওয়ালির কড়া লিপস্টিকের ঠোটে আবারো হাসির বান ডাকে। গাজা খেয়ে টলতে টলতে এক যুবক আসে। যুবককে দেখে নিয়ন আলোর নিচের নারীরা লোভাতুর নয়নে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় একটা রিকশা সাই করে গাজাখুরের প্রায় গা ঘেসে চলে যায়। খেকিয়ে উঠে গাজাখুর- ”ঐ শুয়রের বাচ্চা, চোখের মাথা খাইছস নাকি?”
টুটুলের আজ মন ভাল নেই। মন খারাপ থাকলে সে রিকশা করে শহরে ঘুরে। “ড্রাইভার সাহেব, আস্তে চালান। আমার অতো তাড়াহুরা নাই।” ফোনটা বের করে রুমির নম্বরে আবার ডায়াল করলো। দু:খিত এই মূহুর্তে আপনার ডায়াল করা নম্বরটি বন্ধ আছে, একটু পর আবার…. রুমি খুব জেদী। অল্পতেই সম্পর্ক শেষ করে দেয়। বিয়ের আগেই যদি এরকম করে, বিয়ের পর না জানি কি করবে। বন্দরে লোকারণ্য এলাকায় চিৎকার কেরে গান গেয়ে উঠে টুটুল- আশা ছিল মনে মনে প্রেম করিব তোমার সনে…বন্দর পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজের কাজ করা শ্রমিকরা টুটুলের গান শুনে হেসে উঠে।
আজাদের বাড়ি বগুড়ায়। সিলেট আছে পাঁচ বছর ধরে। প্যাসেঞ্জারের গান শুনে নিজের পরিবারের কথা মনে পরে গেল- কতদিন বউ পোলারে দেহিনা। পোলাডা নিশ্চয় এখন আব্বা ডাক শিখে গেছে। ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে সেদিন ফোন দিয়েছিল। কিশোরী বউ ফুপিয়ে কেঁদেছে। “সিলেট তোমার কে আছে গো? তুমি কি আরেকটা বিয়া করছো? ক্যান তুমি বাড়িত আহো না?” আজাদ কিছু বলতে পারে না। বউ ছাড়া রাতে তার ঘুম আসে না, শুধু এপাশ ওপাশ করে। সারারাত মন ও শরীরের সাথে যুদ্ধ করে, সকাল বেলা লাল টকটকে চোখ নিয়ে আবার রিকশা নিয়ে বেড়ুয়। বাড়তি ইনকামের আশায় বৃষ্টির দিনেও সারা রাত রিকশা চালাবে। সামনের ইদে বগুড়া যাবার ইচ্ছা। ভাবতে ভাবতে জিন্দাবাজার চলে আসে। এক প্যাসেঞ্জার বিদেয় করে আরেক দুজন পেয়ে যায় সে।
মুন্নি তান্নি দুই বোন। পর্দানশীল পরিবারের মেয়ে। সন্ধ্যে হলেই মুরগীর মতো খোপে ঢুকতে হয়। রাতে তাদের ছেলে বন্ধুরা যখন ফেইসবুকে ঘুরাঘুরির স্ট্যাটাস দেয়; দু:খে মরে যেতে ইচ্ছে করে। কেন যে মেয়ে হয়ে জন্মালাম। তবে কেনাকাটার নাম করে তারা রাতে শহরে ঘুরে। মা আর কাজের মেয়েকে অন্য রিকশায় তুলে দিয়ে দুবোন এ দোকান থেকে ও দোকান যায়। কেনাকাটা মূখ্য নয়, ইচ্ছে করেই দেরী করে তারা। আজ প্রায় এগারটা বেজে গেল। রিকশায় উঠেই তান্নির দরদ মাখা কথা- ”আপা তোর বিয়ে হয়ে গেলে, তুইতো দুলাভাইয়ের সাথে ঘুরতে পারবি। আমি কার সাথে ঘুরবো।” বোনের সাথে মজা করার জন্যই মুন্নি বলে- “তুই রিকশাওয়ালার সাথে ঘুরবি। এই ড্রাইভার তুমি আমার বোনকে বিয়ে করবা। এই দেখো আমার বোনটা পরীর মতো সুন্দর।” তান্নি মজাটা হজম করতে পারে না। জেলরোডের কাছে এসে রাগে দুঃখে রিকশা থেকে লাফ দেয় সে।
”খুনটা না করলেও পারতাম”- মনে মনে ভাবে কবির। জেলখানায় বসেও শহরের চিৎকার চেচামেচি কানে আসছে তার। একটু পর খাবার দিবে। জেলখানায় একটা ছোট্ট কক্ষে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয় তাকে। কোন রাতেই তার ঘুম আসে না। খুব ইচ্ছে ছিল মডেল হবে। মায়ের কানের দুল চুরি করে কিছু টাকা পেয়েছিল। সেগুলো দিয়ে এক পরিচালককে ম্যানেজ করে ফেলেছিল। শিবগঞ্জের এক মেসে বন্ধু নাসিরের সাথে থাকতো আর এমসি কলেজে ইকোনমিক্স এ পড়তো কবির। একদিন নাসির মদ খেয়ে এসে কবিরের মাকে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলতে শুরু করলে। রক্ত উঠে গেল মাথায়। যতক্ষণ নাসির না মরে যায় ততক্ষণ প্যান্টের বেল্ট দিয়ে তাকে পিটিয়েছিল কবির। বিভৎস লাশটি গুম করেও ফেলেছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো সে ভিলেনের মতো বাঁচতে চায় না। সে নায়ক, নায়কের মতোই বাঁচবে। সিনেমার শেষে যেমন নায়ক জেল থেকে বেড়িয়ে আসে, সেও একদিন বেড়িয়ে আসবে।
ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন হিরোইন ডেইজি। পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নুর ছবিতে ডেইজির প্রথম অভিনয় সারাদেশে সাড়া পরে গেছে। প্রতিদিন কোননা কোন নতুন অফার পাচ্ছে। নাটক, বিজ্ঞাপন, উপস্থাপনা এমনকি গান গাওয়ারও অনুরোধ পাচ্ছে ডেইজি। তবে ডেইজি চলচ্চিত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে বসেছে আজ। কয়েকটা পাতা পড়ে আর ছাদে চাঁদ দেখে হাটাহাটি করে। হঠাৎ চুন্নু সাহেবের ফোন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধরে- “আরে নায়িকা ঘুমাও নাই? আচ্ছা তুমি মৌসুমীর- কাল তো ছিলাম ভাল, আজ আমার কি হলো; গানটি তো দেখেছো। আমি এটা রিমেইক করবো আমার মতো করে। অভিনয় করবা?” ডেইজি হুমায়ূনে মজে ছিল। চাঁদ থেকে চোখ নামিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো- রাত তিনটা। “চুন্নু ভাই, আমি কি মৌসুমী আপুর মতো এক্সপ্রেশন দিতে পারবো? পারবো না।” বলেই ফোনটা রেখে দেয় ডেইজি।
বালুচর পয়েন্টে দুই যুবক সিগেরেট হাতে নিয়ে হাটছে। আজ রাতের আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ। একটু পরপর মেঘেদের দল ঢেকে দিচ্ছে। রাতজাগা পাখিরা কেউ কেউ সুখ কেউ কেউ এক বুক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের কোন কষ্ট নেই। তারা হাটছে তো হাটছেই, হাটছে তো হাটছেই। নরম হাওয়াটা খারাপ লাগছে না।