somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অখণ্ড অনুশাসন

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অখণ্ড অনুশাসন
সেলিনা ইসলাম

-"শোন মিয়া। এই যে দেশের মাটিতে আজ দাঁড়ায় আছো! গলাবাজি,টাউটগিরি করে গুষ্টির বারোটা বাজাচ্ছো! এই মাটি যে অপবিত্র করতেছো- তা কি একবারও ভাবিছো?" গ্রামের মুদি দোকানে বসে আমি এভাবেই সবাইকে কথা শুনাচ্ছি! কিন্তু প্রচণ্ড কাশি আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। বয়সও হয়ে গেছে। মনে হয় না কেউ আমার কথা শুনছে! আজকাল কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। ভালো কথা তো দূরে থাক-আমি যে দেশ স্বাধীন করেছি তাই কেউ বিশ্বাস করতে চায় না! উল্টো সবাই বলে-
-"এহঃ দেশ স্বাধীন করছে! দেখলে তো ফকির ছাড়া কিছুই মনে হয় না!"
-"তো? জামা কাপড় ছেঁড়া থাকলে কী যুদ্ধ করা যায় না? শোন-যুদ্ধ করতে করতে জামা কাপড়ের কথা কেউ মাথায় আনার সময় পায় নায়। এক নাগাড়ে দুই তিনদিন পেটে কারো একটু দানা পড়ে নায়। হাঁতে বন্ধুক,পিঠে গোলা বারুদের বোঝা! সামনে থেকে ছুটে আসছে 'ধাম ধাম' আগুণের গোলা! সবাই ক্ষুধা ভুলে কীভাবে শত্রুর জাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের বাঁচাবে? কীভাবে শত্রুকে পরাস্ত্র করে যুদ্ধে জয়ী হবে? একমাত্র এইসব চিন্তাই বেশি কাজ করছে!" আমার কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে কেউ কেউ আমাকে দেখছে! দোকানদার রাগ দেখায়-
-“আরে ভাই দোকানের সামনে দিয়া সরেন। কাষ্টমার বিরক্ত হয়! যান যান…!”
-“ঐ মিয়া এমন কর কেন? মানুষের মাঝে কোন মমতা শ্রদ্ধা কিছু থাকব না?”আমার কথা শুনে সে আবার বলে উঠে-“এইসব নীতি কথায় কারো প্যাট ভরব না...সরেন এইখান থাইকা!” আর কথা না বাড়িয়ে সরে যাই। বলতে গেলে নিজেই নিজের সম্মান রেখে সরে যাই। নাহলে আরও জোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতেই ফেলে দেবে! "এই মাটিতে গর্ব করে,মাথা উঁচু করে অধিকারের দাবি নিয়া দাঁড়াইতেই ভালো লাগে। মায়ের বুকে অপমানে গড়াগড়ি খাইতে ভীষণ লজ্জা লাগে...ভীষণ লজ্জা!" দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হেঁটে পাঁশের রাস্তায় বসে যাই।
মাঝে মাঝে তো দুই একজন গায়ের উপর টাকা ছুঁড়ে মারে! তাদের ভাবখানা"নে ব্যাটা নিজের পেটে কিছু দে!" প্রথম প্রথম এসব কষ্ট দিতো। কতদিন টাকার ভীতরে জাতির পিতাকে দেখে চোখের জলে ভিজেছি। চিৎকার করে বলেছি-" কী পেলাম হাজার ত্যাগের বিনিময়ে? একবার বলে যাও পিতা-এই স্বাধীন দেশে কেন এতো অরাজকতা?" না কেউ জবাব দেয়নি। বরং অসুস্থ বৃদ্ধ একজনের অস্পষ্ট বলা কথা শুনে "পাগল"ভেবে দূরে ঠেলে দিয়েছে! কিন্তু একদিনও যদি একবারের জন্য আমি সেইসব ঘটনার কথা কারো সাথে শেয়ার না করতে পারি? বিশ্বাস করেন,আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল ঢেউ উঠে। সেই ঢেউ দুমড়ায় মুচড়ায় আমার বুকটারে ভাইঙ্গা দিতে চায়। আমি ঘুমাতে পারি না। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মনে হয় হাজার আত্মা আমার বুকের উপর উঠে দাপাদাপি করে! মনে হয় ওরা চিৎকার করে বলে-"কী দিলাম! আর কীইবা পেলাম!"
"সত্যই তো কী পেলাম?" চুপচাপ বসে এভাবেই নানান কথা ভাবছি। আজকে কেউই আমার জন্য একদণ্ড বসে কথা শুনছে না। অসুস্থ শরীরে ঝিমঝিম একটা ভাব আসছে! কিন্তু সেখানেও "কী দিলাম! কী পেলাম!"দীর্ঘশ্বাস আক্রমণ করছে। চিৎকার করে ধমক দিতে যাব। এমন সময় কেউ একজন বলে উঠে-
-"আইজগো সারাদিনে একটা টেহাও কেউ ভিক্ষা দিলো না ভাই!" ভাই! বিশ্বাস করেন এই শব্দে যে কী যাদু ছিল! মনে হল আমার শরীর অনেক খানি সুস্থ হয়ে গেছে। পিছনে ফিরে দেখি আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট একজন। তার মুখের দিকে তাকায় বিরক্ত নিয়াই জিজ্ঞাসা করলাম-
-"আরে মিয়া তুমি ভিক্ষা কর কেন? কাম কাজ কইরা খাইতে পারো না?"
-"আর ভাই কাম কাজ!" কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। একটু খেয়াল করতেই দেখি তার দুইটা পা-ই নাই। সে একটা কাঠের হুইল লাগানো তক্তায় বসে আছে। কিছুটা মায়া লাগলো। মনে মনে ভাবলাম-"যাক আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু পাইলাম! যুদ্ধে সবকিছু হারিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা সুন্দর সাবলীল,সম্প্রীতি আর উন্নয়নশীল একটা দেশের স্বপ্ন বুনে গেছে। কিন্তু কোন এক অলৌকিক কারণে স্বাধীন দেশেরই মানুষ সেই স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করেছে! নিশ্চয় সে-ও আমার মত আত্মদগ্ধতায় জ্বলছে! কিন্তু আমার সব ভাবনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল ওর বলা কথা-
-" আরে ভাই সাধে কী আর এই অবস্থায় ভিক্ষা করি? আমি মোটামুটি একটা চাকরি করতাম। যা বেতন পেতাম পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাসের কুড়ি তারিখ পর্যন্ত বেশ ভালোই কেটে যেত। অভাব শুরু হত মাসের শেষের দশদিন। কিন্তু আমার স্ত্রী,সে ঠিকই ম্যানেজ করে নিত। অভাব থাকলেও সুখের কমতি ছিল না।"
-"ধ্যাত এই লোক এতো কথা বলে কেন? আমি আমার জীবনের গল্প শোনাতে চাই! উফঃ।" ভীষণ বিরক্ত হলাম। তবুও মুখে কিছু বললাম না। লোকটাকে বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি। ওর নামটা জানি। ও নিজেই বলেছিল-"সিহাব আতিফুল হক!" কিন্তু কোনদিন সে আজকের মত এতো কথা বলেনি। বিরক্ত নিয়েই শুনতে লাগলাম-
-"তারপর ২৫শে নভেম্বর! সেদিন অফিস শেষে রিকশায় করে বাড়ি ফিরছি। মনে কত আনন্দ। সেদিনই আমার একমাত্র ছেলের তিন বছর পূর্ণ হল। আমার স্ত্রী কিছু আত্মীয়-স্বজনকে বাসায় আসতে বলেছে। কিছুটা ধারদেনা করেছে বুঝেছি। তবুও বেশ আনন্দেই একটা কেক নিয়ে বাসায় ফিরছি। সেদিন সকালে ছেলে আবদার করেছে-"বাবা স্ট্রবেরি কেক আনবা ঠিক আছে?" ছেলের খুশি মুখটা বারবার চোখের সামনে ভাসছে। স্ত্রীর সাজগোজ আর ছেলের খুশি-স্পষ্ট দেখতে দেখতে আমি হাওয়ায় ভাসছি! হঠাৎ বিকট একটা শব্দ...চোখের পলকে জোনাক জ্বলে আমার রিকসাটা উল্টে গেলো! আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছি একটা বাস রিকসাটার উপর দিয়েই চলে গেছে। রিকশা চালক স্পট ডেড। ভাগ্য ভালো না খারাপ জানিনা-এই যে,এই আমি বেঁচে আছি! কিন্তু একে কী বেঁচে থাকা বলে?"
লোকটার কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপছে!
-"তোমার স্ত্রী বাচ্চা?"আমার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠলো? লোকটা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
-"ওরা এখন গ্রামে থাকে। ওরা জানে আমি শহরে চাকরি করছি!"

আমার অস্বস্তি লাগতে লাগলো। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মাথা ঘুরছে। ভীষণ তেষ্টা পেলো। কানের ভীতরে "ঠা ঠা গুড়ুম গুড়ুম"শব্দ। চারদিক থেকে ভেসে আসছে মানুষের চিৎকার-"বাঁচাও বাঁচাও! বাবা পুড়ে গেলাম!" আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে ঘর! উঠানে দাঁড়িয়ে মিলিটারি আর রাজাকারেরা অট্টহাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জ্বলে পুড়ে মরে যাওয়া মানুষের চিৎকার ওদেরকে আনন্দোল্লাস এনে দিচ্ছে। বিকৃত আনন্দ! "মারো ওদেরকে! ওদেরকে জেলে নিয়ে ভরে রাখো? ওরা রক্তচোষা পিশাচ! জনগণ তোমাদের মাঝে একতা নাই কেন!" উদ্বিগ্ন একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম-
-"ভাই আপনি এমন করতেছেন কেন? কী হয়ছে আপনার? বিড়বিড় করে কী বলেন?" সিহাব আতিফুল হক কথাগুলো বলতে বলতে আমার ছেঁড়া পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াতে লাগলো! সারাদিনে পাওয়া আমার টাকাগুলো ও তুলে নিলো। আমি চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না! কানে ভেসে এলো "ঘ্যার ঘ্যার"ঠ্যালা চলার শব্দ। বুঝলাম লোকটা ভেগে গেছে! তারপর আর কিছুই মনে নেই।

-"তোমরা সবাই শোন! একদণ্ড বসে শুনে একটু ভেবে নাও! হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি শোন বাবা...এই যে মা তুমি তো একটু শোন,সেই ভয়াবহ সময়ের কথা। একটু শোন...! মাটি না গো মা মাটি না-রক্ত ডোবা সারা পথে হেঁটে হেঁটে যাও! একবার শোন-
যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের মহল্লার ঠ্যালা ওয়ালা জমির হয়েছে রাজাকার! রাস্তায় রাস্তায় ঠ্যালায় করে কেরোসিন বিক্রি করত। কতদিন আমার কাছ থেকে চেয়ে বিড়ি খাওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছে! সে আজ দুই আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে জোরে টান মেরে আয়েশ করে ধোয়া ছাড়ে! পরনের লুঙ্গি উঁচু করে ধরে হেলেদুলে হেঁটে আসে। আর তুড়ি মেরে সিগারেটের ছাই ফেলে! যে জমির আমাকে দেখলে সালাম দিত? সে আজ তুই সম্বোধন করে হুকুম দিচ্ছে!
-"ঐ তোর পরিবার বাচ্চা কাচ্চা টেউটিউ নিয়া সামনে হাজির কর। শুনলাম মালাউনের বাচ্চা আছে তোর বাসায়?"
ওর কথা শুনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো! আমি কী করব বা কী বলব বুঝতে পারলাম না। বারবার মনে পড়ছে অসহায় নিঃস্ব একজন বাবার কথাঃ-"তুমি আমার বাচ্চা দুইটারে দেইখা রাইখো ভাই। তোমার আল্লাহ তোমার ভালো করব!"আমাকে চুপ দেখে মিলিটারির একজন বলে উঠে
-ক্যা হুয়া? জুবান জম গায়া ক্যা? বল মালাউন ক্যা বাচ্চা কিধার হ্যা?
বললাম-আমার চারটা বাচ্চা আর স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ আমার ঘরে নাই!
-"ঝুট! ঝুট মাত বল হারামি"জমির খেঁকিয়ে উঠে।’শালা বেঈমান ভালো করে বাংলা বলতে পারে না! সে আজ মিলিটারির দাপটে উর্দু কপচায়! কানের নীচে থাপড়ায় তোরে কালা বানায় দেব!’ মনে মনে কথাটা বলে উসখুশ করতে থাকি। এমন সময় ওর চ্যালারা ঘর থেকে শরিফা,আমার দুই ছেলেমেয়ে আর নিবারণ বাবুর ছেলেমেয়েকে বের করে আনে। চ্যালাদের একজন বলে-
-“জমির ভাই আর কেউ নেহি।” মিলিটারির একজন প্রতিটা বাচ্চাকে খুব খুঁটে খুঁটে দেখে। তারপর বলে-
-"সুরত তো বাহুত আচ্ছা! হে.হে হে..লেকিন ঠিক...!"কথাটা বলতে বলতে একেবারে বাচ্চাদের মুখের সাথে নিজের মুখ ঘষে নেয়। আগেই শরিফা সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে। আমার ছেলে রাশেদ তিন বছর বয়স। মেয়ের নাম রাশেদা বয়স চার। নিবারণ বাবুর মেয়ে আমার মেয়ের থেকে বড়। আর ছেলেটা আমার ছেলের বড় হলেও রুগ্ন ছোটখাট বলে অনেক ছোট মনে হয়। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। না হলে জমজ ছাড়া একই বাবা মায়ের চার বাচ্চার বয়স কীভাবে একই হয়?
শরিফা নিজের সন্তানের সাথে মিলিয়ে ওদের নাম রেখেছে রাসেল আর জুবেদা! মিলিটারি জিজ্ঞাসা করলে নামগুলো বলে যায় ওরা। নিবারণ বাবুর ছেলেটা ভয়ে "প্রদীপ" নিজের আসল নামটাই প্রায় বলে ফেলছিলো! ওর বোনটা ঝটপট বলে উঠে রাসেল। বাচ্চাটা ভয় পেয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে বলে "দি..."অমনি জমির খেঁকিয়ে উঠে- কী বলা? দি? দিদি বলতা হে?
টেনে বাচ্চাটাকে ঠাস ঠাস করে চড় মারে। আমি বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলি ‘না না দিদি বলবে কেন। বুবু বলছে।’ ছেলেটা এতটাই ভয় পায় যে ওর মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের হয় না। জমির হাঁক ছাড়ে এক চ্যালা কুদ্দুসের নাম ধরে- "ঐ...পোলাডার প্যান্ট খুইলা চেক কর!" এমনিতে এই ছেলে ভয় পেয়েছে। আবার যদি কিছু বলে দেয়। এই ভাবনায় সবার দিকে তাকাই। দেখি সবাই মিলিটারীদের সাথে কীসব ফিসফাস করছে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি একজন চ্যালা এগিয়ে আসে...আমি আস্তে করে আমার নিজের ছেলেকে চ্যালার দিকে এগিয়ে দেই!

আমার ধারনা ছিল তিন বছরের একটা বাচ্চা তার মুসলমানি নিয়ে নিশ্চয় কেউ ভাববে না? কিন্তু জানোয়ারের দল এই শিশুকে নিয়েও ভাবল। আমার ছেলের প্যান্ট খুলে যখন দেখে মুসলমানি হয়নি! খুশিতে চ্যালাটা চিৎকার দিয়ে উঠে "এইটা মালাউনের বাচ্চা!" জমির বিশ্রী হাসি হেসে বলে-"নাউজুবিল্লাহ হে হে" শরিফা চিৎকার দিয়ে বলে-"ও বাচ্চা ছেলে ওর মুসলমানি আর একটু বড় হলে দেব তাই দেয়া হয়নি!" জমির আবার হেসে বলে "ঝুট...আঁতুড় ঘরেই মুসলমানি দেয়া মুসলমানের জন্য ছোঁয়াবের কাজ!" আমার মনে হল ওর লুঙ্গী খুলে আমি ওকে ন্যাংটা করে দেই! ওকে বলি হারামি তোর মুসলমানি তোর বাবা মা আঁতুড় ঘরে দিছে? কিন্তু কিছুই বলতে বা করতে পারলাম না। আমি নিবারণ বাবুর ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা আমার ছেলেটাকে দুইজন দুইদিক থেকে ধরে রেখেছে। একটা ছুরি নিয়ে ছেলেটাকে মুসলমানি দেবার জন্য রেডি হয়ে আছে। শরিফা মেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরে মিনতি করে কেঁদে যাচ্ছে। আমার ব্যবহারে সে আমার উপর ভীষণ রাগ প্রকাশ করে! আমি ভয় পেলাম ভেবে যে,মায়ের মন নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে আবার না জানি নিবারণ বাবুর ছেলেমেয়েকে ধরিয়ে দেয়!
আমার বাচ্চাটা ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। জমির এক হাতে ছুরি আরেক হাতে রাশেদের গোপনাঙ্গের চামড়া জোরে টেনে ঘ্যাচ করে কেটে দেয়। ছেলেটাকে দুইদিক ধরে প্রচন্ড ঝাঁকি দিতে থাকে। জমির হাতে রক্ত নিয়ে হো হো করে হেসে উঠে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাই! আমার ছেলেটা চিৎকার করতে করতে কাঁটা মুরগির মত ছটফট করতে থাকে! রাজাকার জমির আর তার সঙ্গীরা হে হে করে হেসেই মজা লুটতে থাকে। এমন সময় মিলিটারিদের একজন ধমক দিয়ে উঠে- "ছোড় দো উসকো!" আমার দিকে তাকিয়ে বলে- "দেখিয়ে আগার আপকা এ দো লাড়কা আর দো লাড়কি হে তো ঠিক হে। লেকিন ওর ক ই বাচ্চা ইধার হে তো সাচ বলিয়ে!”
-না হুজুর আর কোন বাচ্চা নেই? কার বাচ্চা আমি তো কিছুই বুঝতেছি না।
"ঠিক হাঁয়...সুনো এক কাম করো,আচ্চেছে এ চার বাচ্চা কা সুরত মিলাকার দেখো? আছপাছ পুছো...এ চার বাচ্চা এনকা হে ওর নেহি হে? ফের দেখো এ ঝুট বলা,কি সাস!" কথাটা বলেই মিলিটারিরা বের হয়ে যায়। জমির আর ওর সঙ্গীরা সবাই তাদেরকে অনুসরণ করে। জমির যেতে যেতে বলে "একটু পরে আইতাছি! সেই পর্যন্ত কেউ কোথাও যাবি না। তাইলে কিন্তু ডাইরেক্ট গুলি!"
কথায় আছে মুর্খের দল যতই অভিসন্ধি করুক আর বুদ্ধি খাটাক না কেন? মোক্ষম সময়ে তাদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুর নীচে। জমির ধামকি দিয়ে চলে গেল। একবারও ভাবল না যে ওরা আবার আসার আগেই আমরা পালিয়ে যেতে পারি! ওরা চোখের আড়াল হতেই পিছনের রাস্তা দিয়ে চার বাচ্চা আর শরিফাকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। নদীর পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে এতটাই দূরে এলাম যে, নিজেও জানিনা কোথায় এসেছি। সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ছুটেই চলেছি। সারা পথে শরিফা আমাকে বেশ কয়েকবার বলে"আপনি যা করেছেন,আজ আমার ছেলের কিছু হলে আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করতাম না! আপনি নিষ্ঠুর!" ওর কথায় আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
তারপর যেখানে এসে থামলাম সেখানে কোন মানুষের চিহ্ন দেখছি না। চারিদিকে শুধু পচা আর পোড়া মাটির গন্ধ। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসছে বারুদের গন্ধ! মনে হচ্ছে এখানে খুব বড় ধরণের যুদ্ধ হয়েছে। ভয়ে ভয়ে ওদের সবাইকে নিয়ে একটা জায়গা খুঁজে চুপচাপ বসে রইলাম। বাচ্চারা ভয় আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওরাও বুঝে গেছে আমরা জান বাঁচাতে ছুটছি। কেউ খাবারের জন্য একটুও টু শব্দ করল না! প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে ভোরের অপেক্ষায় ঠায় বসে রইলাম।
পরেরদিন সকালে ওদেরকে ওখানে রেখে বের হলাম খাবারের সন্ধানে! সারা এলাকায় মানুষের কোন সাড়া নেই! কিছুদূর যেতেই হঠাৎ শুনী চিৎকার। আকাশে দেখি শকুনের উড়াউড়ি! ছুটে গেলাম আমার পরিবার যেখানে ছিল সেখানে! কিন্তু সেখানে শুধু দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন! ছুটে যেতে চাইলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কেউ। তাকিয়ে দেখি দুইজন মুক্তিযোদ্ধা! মিলিটারিরা আগুন দিয়ে পুড়ে মেরেছে আমার সব অস্তিত্ব! যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছি। এক একটা শকুনকে মেরেছি আর জয়ের আনন্দ নিয়েছি। ঐ মুক্তিযোদ্ধারাই ছিল আমার একমাত্র সঙ্গী! উফঃ সেকি ভয়ঙ্কর আগুন!"

-"আআহহহহঃ!"আমি চিৎকার করে উঠতেই একটা নারী কণ্ঠ ভেসে এলো-
-"সরি চাচামিয়া,ইনজেকশন দিতে দেন!"চোখ খুলে দেখি নার্স। তারমানে এতক্ষণ বেহুঁশ ছিলাম! মাথাটা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাই। দেখি হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছি। নার্স চলে যাচ্ছে দেখে বললাম-
-"মা একটু শুনো!"
-"চাচামিয়া এই দশদিনে অন্তত একশোবার গল্পটা বলেছেন!"
-"মা এটা গল্প না!"
-"আরে বুড়া চাচা এইসব শোনার টাইম কারো নাই। আপনি ঘুমান!"মেয়েটা বিরক্ত নিয়ে বেশ ধমকালো। সে ভীষণ বিরক্ত। সব বুঝেও বললাম-"আজকে কত তারিখ?" মেয়েটা কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। এমন সময় শুনতে পেলাম কেউ একজন বলল-"২৫শে নভেম্বর স্যার।"
"স্যার! স্যার!" এই প্রথম কেউ এভাবে বলল! এদিক ওদিক তাকিয়ে স্যুট বুট পরা তো কাউকেই দেখছি না! কোন ডাক্তার! নাহ তা ওতো দেখিনা। সামনে এসে দাঁড়ালো একটা যুবক। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে! বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল"স্যার আজ তিনদিন ধরে আপনার বলা মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা শুনেছি! আজ আপনাদের মত যোদ্ধাদের শত ত্যাগেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি!" ছেলেটার কথা শুনতেও আমার ভালো লাগছে না। মনে হল সে আমার কাছ থেকে "বিজয় দিবস"-এ গল্প লেখার মসলা পেয়ে গেছে।
মুখটা ঘুরিয়ে ছাদের দিকে তাকালাম- "সেই একাত্তর থেকে উনিশ-এই আটচল্লিশ বছরে কতজনে কতবার লিখে নিয়েছে,ছবি তুলেছে! ওরা কেউ কেউ পুরষ্কৃতও হয়েছে। ওদের তোলা ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে! ওদেরকে সবাই চিনলেও আমাকে কেউ তেমন চেনে না! আগে কেউ কেউ সমাদর করে ডেকে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে! ভাষণের নামে নিজেরাই বড় বড় বুলি আওড়েছে! অনুষ্ঠান শেষে একশো টাকা বুক পকেটে গুঁজে দিয়ে পিঠেচাপড়ে বলেছে-"আরে যা বেটা এখন। আবার ডাকলে আইসো!" থুঃ থুঃ ছিটাতেও এনার্জি যাবে ভেবে নির্বাক হেঁটে গেছি। আবার আশার প্রদীপটাকে জ্বালিয়েছি-"নাহঃ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে! এটাই আমার লাল সবুজ দেশ! বাঙালি বীরের জাতি!" এভাবেই মেনে নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছি। অবশ্য কখনো কখনো মনে মনে ঘৃণাও করেছি"বাঙালি বীরের জাতি!"এই ভাবনায়।
ঐ ক্যামেরা ঘাড়ে নেয়া ছেলেটা কীসব যেন বলছে আর খাতায় লিখছে! আমি ভাবছি সিহাব আতিফুল হক-এর কথা। আজ ওর ছেলেটার জন্মদিন। এমন কত সন্তানের জন্ম এই স্বাধীন দেশে! "ক্ষত-বিক্ষত নৈতিক আদর্শ...! সন্তানের জন্য পিতারা কী রেখে যাচ্ছে? নাকি আমার মত অক্ষম পিতা হয়ে সারাটা জীবন সন্তানকে পিচাশদের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই হতে দেবে? দেশকে নিয়ে স্বপ্নটা কী খুব বেশি বড় চাওয়া ছিল?" আর ভাবতে পারলাম না! ক্লান্ত চোখ দুটো বুজে আসে-
"এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল!"
মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্রোহী কবির লেখা এই গান শুনে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে! কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি একটা শিকল আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে! উফঃ আ...আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি! আমি তলিয়ে যাচ্ছি ঘুমের অতলে।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×